বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০১৪

আবারও গণতন্ত্রের পরাজয়


মুসলমানদের তো নবীর দেখানো পথেই রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার কথা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মুসলমান হলেও তারা এখনও সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মদীনাসনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করার কথা বলেছেন। বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাও একটা দেখার মতো বিষয়। এমন একটা অবস্থায় আমরা গণতন্ত্রের পথকে বেছে নিয়েছি। তবে গণতন্ত্র যে কত রকমের আছে তা আমরা ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে একবার দেখেছি। আবার দেখলাম উপজেলা নির্বাচনে, বিশেষ করে পঞ্চম পর্বে। উপজেলা নির্বাচনের পঞ্চম পর্ব শেষে পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়েছে, ‘ভোটের অঙ্কে আওয়ামী লীগ জিতলেও হেরেছে গণতন্ত্র’। গণতন্ত্রকে পরাভূত করে যখন কোনো দল জিতে যায়, তখন সেই নির্বাচনের চেহারা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। আসলে বর্তমান সরকার ও সরকারি দল নির্বাচন ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়ে গণতন্ত্রকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। মুমূর্ষু এই গণতন্ত্র বেঁচে উঠবে কি না কে জানে! পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে। এবার উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ব্যালটে গণহারে সিল মারা, ব্যাপক সন্ত্রাস এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর দায় গিয়ে পড়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগের ওপর। আস্থার সংকটে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর ৫ পর্বের এবারকার উপজেলা নির্বাচন আস্থার গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের উপজেলা নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও পরের পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সহিংসতা ও কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতির তা-ব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনের পর কমিশন আস্থার সংকটে পড়লো। ভবিষ্যতে সরকারদলীয় ছাড়া সাধারণ মানুষ নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে সে ব্যাপারে জনমনে কোনো দ্বিধা নেই। উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা, জবর দখল ও জালিয়াতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, নির্বাচন এভাবে দখল ও সহিংসতাযুক্ত হলে আমরা গণতন্ত্রহারা হবো। ভোটের প্রতি আগ্রহ হারাবে সাধারণ মানুষও। বল প্রয়োগের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা বাড়ে না বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, উপজেলা নির্বাচনে যে অনিয়ম এবং কারচুপি হয়েছে তা ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে নির্বাচনে যে ব্যবস্থা রয়েছে তা সুষ্ঠু নয় বলেও তিনি মনে করেন। নির্বাচনে কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও সহিংসতা করেও আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেনি বলেও মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৩১টি উপজেলায় জয় লাভ করে। কিন্তু এবার সর্বশক্তি ব্যয় করে মাত্র ২২৫টি উপজেলায় জয় পেয়েছে। এতে বোঝা যায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে। নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা লজ্জাজনক। এ ধরনের নির্বাচন-সংস্কৃতি দেশের জন্য অকল্যাণকর। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উপজেলা নির্বাচনে যা ঘটেছে তা মোটেই গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়, বরং উল্টো। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা সামনে যাওয়ার বদলে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছি। নির্বাচনে সহিংসতার চেয়ে কারচুপি বেশি ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রশাসনের সহায়তায় যে কারচুপি হয়েছে তা আমাদের জন্য তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়।
বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা ছিলেন বেশ সোচ্চার। তারা বলেছেন, ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল। এ নিয়ে কৃতিত্বের দাবিও করতেন তারা। বাংলার মাটিতে ভোট ডাকাতি চিরতরে কবর দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করতেন তারা। কিন্তু এবার উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে ভোট ডাকাতি হয়েছে তাতে তারা মুখরক্ষা করবেন কিভাবে? এখন তারা আর এ কথা বলতে পারবেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অযৌক্তিক। বরং উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে যৌক্তিক বলেই প্রমাণ করলেন।
স্বাধীনতার পর নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণ বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তাদের আশাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য একের পর এক তারা সরকার নির্বাচন করে গেছে। আশাবাদের প্রহর গুণতে গুণতে জনগণের জীবন থেকে খসে পড়েছে ৪৩টি বছর। কিন্তু জনগণের উন্নত জীবনের আশা বাস্তবায়নের জন্য যে সুশাসন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নৈতিকতা প্রয়োজন তা লক্ষ্য করা যায়নি আমাদের সরকার ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে। পরিতাপের বিষয় হলো, একটি স্বাধীন জাতি হওয়ার পরেও ৪৩ বছরের দীর্ঘ সময়ে আমরা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বিতর্কমুক্ত করতে পারলাম না। ফলে নির্বাচন আসলে আনন্দমুখর পরিবেশের বদলে আমরা আতঙ্কের কবলে পড়ে যাই, নির্বাচনের পরেও সেই দুর্ভাবনার শেষ নেই। আমাদের রাজনীতিতে এখন আর মেধা ও কর্মযজ্ঞের প্রতিযোগিতা হয় না। এখন প্রতিযোগিতা হয় পেশীশক্তি ও ছলনার। এমন রাজনীতি দিয়ে জনগণের স্বপ্ন পূরণ হবে কেমন করে? তাই দেশের প্রাগ্রসর মানুষ ও সাধারণ জনগণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এখন কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে। দেশের সচেতন নাগরিক এবং দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদরা যদি তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন, তাহলে সৃজনশীল কর্মসূচি প্রণয়নেও তারা পারঙ্গম হবেন। অচলায়তনের বর্তমান রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হলে বর্তমানে প্রয়োজন গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে এক নবজাগরণ। সময়ের এ বার্তা উপলব্ধিতে যারা ব্যর্থ হবেন, আগামীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। এ বিষয়টি কারা উপলব্ধি করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads