বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪

আসলের কাজ নকলে হয় না


কোনো কোনো ঘটনা আমাদের চমকে দেয়, এমনকি আত্মসমালোচনায়ও উদ্বুদ্ধ করে। গত রোববার প্রথম আলোতে মুদ্রিত এমন একটি ঘটনার শিরোনাম করা হয়েছে ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ এই ক্রেস্ট কোনো সাধারণ ক্রেস্ট নয়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার জন্য বিদেশী বন্ধু ও সংগঠনকে সম্মাননার সঙ্গে এই ক্রেস্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ক্রেস্টে ১ ভরি স্বর্ণের জায়গায় দেয়া হয় সোয়া তিন আনা স্বর্ণ। আর ক্রেস্টে ৩০ ভরি রুপার বদলে দেয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তা মিশ্রিত সংকর ধাতু। বিষয়টি তদন্ত করতে কমিটি গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমানকে প্রধান করে করা তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটিকে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দোষী কর্মকর্তা, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ সবার অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেস্টে সোনা কম দেয়ার ব্যাপারটি তদন্ত করার সুবিধার্থে ‘সংশ্লিষ্ট’ সব কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। তাছাড়া এ মন্ত্রণালয় থেকে কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রী আরো বলেন, “আমি পরিষ্কার বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসততা, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। কেউ যদি মন্ত্রণালয়ে না থেকে থাকেন, অবসরে গিয়ে থাকেন বা চাকরি চলে গিয়ে থাকে, তাদেরকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যেখানে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জড়িত, সে বিষয়ে এ অনিয়ম অবিশ্বাস্য।
মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়ও এমন অসৎ কর্মকর্তারা অবস্থান করছেন, যাদের কাছে দেশের ভাবমর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান বিষয়ও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বর্ণ কিংবা অর্থ। নৈতিক মেরুদ-হীন এমন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের দ্বারা দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষিত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনও তারা লালন করতে সক্ষম নয়। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়নের যে চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে, তারপর প্রশাসনে এমন দুর্বৃত্তায়নের চিত্র জাতির জন্য এক বড় অশনি-সংকেত। জানি না আমাদের সরকার প্রশাসন থেকে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি কিভাবে দূর করবে? তবে আমরা একথা জানি যে, দেশ ও জনগণের কল্যাণে প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে নৈতিকতায় পুষ্ট করা সরকারের দায়িত্ব।
সরকার এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা আগেও বলেছেন, এখনও বলছেন তারা দেশে সুশাসনকে সমুন্নত রাখবেন। কিন্তু দেশে যদি সুশাসন থাকে, আইনের শাসন থাকে তাহলে স্বয়ং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সম্মাননার ক্রেস্ট থেকে স্বর্ণ চুরি করেন কেমন করে? আমরা তো একথা জানি যে, বর্তমান সরকার বেশ শক্তভাবেই দেশ শাসন করছেন। মন্ত্রণালয়ে এবং ক্ষমতার চারপাশেতো সরকার সমর্থক কর্মকর্তা গিজ গিজ করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তথা ক্ষমতার চারপাশে সরকারি ঘরানার লোকজনই দাপটের সাথে অবস্থান করছেন। এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, এই সরকারের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ খুবই তীব্র। পরিতাপের বিষয় হলো, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে সুবিধা লুটে, দলবাজি করে, তারাই একসময় সরকারের ইমেজ ক্ষুণœ করতে কার্পণ্য করে না। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননার ক্রেস্ট থেকে স্বর্ণ চুরি করতে তাদের রুচিতে বাধে না। এদের সমর্থন কিংবা সেøাগানে সরকার, প্রশাসন কিংবা দলের কোনো কল্যাণ হয় কি?
সাম্প্রতিক সময়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে যেসব সচিব ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, তাদের ওএসডি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে অভিযোগ আসছে। তদন্তে প্রমাণিতও হচ্ছে। সম্প্রতি ৩৯ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে ভুল তথ্য দেয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়। এসব উদ্যোগ দুর্নীতি প্রবণতা থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কতটা দূরে রাখতে পারবে কে জানে?
আমরা জানি, ভুয়া ও আসল কখনও এক হতে পারে না। ভুয়া দিয়ে আসলের কাজ হয় না। অথচ সচিব পর্যায় পর্যন্ত আজ ভুয়া প্রবণতায় আক্রান্ত। এ ভুয়াদের উপর ভিত্তি করে প্রশাসন কিভাবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াবে? প্রশাসন শক্ত অবস্থানে না দাঁড়ালে সুশাসন কি করে প্রতিষ্ঠিত হবে? অথচ কে না জানে যে, সুশাসনের উপরেই নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, পত্র-পত্রিকায় যখন সুশাসন ও দুর্নীতি নিয়ে কিছু ছাপা হয়, তখন আমরা সরকারপক্ষ থেকে কিছু নড়াচড়া দেখি, দেখি উত্তম বক্তৃতা-বিবৃতিও। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনে যেসব বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন, সেদিকে তেমন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। ফলে সুশাসন ও নৈতিকতার অভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম যেন চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো।
এমনিতে আমাদের সরকারি ও বিরোধী ঘরানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভাল কথা কম বলেন না। দেশ ও জনগণের উন্নয়নে তারা আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের চারপাশ ঘিরে রাখা যেসব সমথর্কের উল্লাস ধ্বনিতে তারা আহ্লাদিত হন, স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রায় তারা কতটা সক্ষম? আসলে স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন হয় যোগ্যতা, নৈতিকতা এবং ভোগ-বিলাসের বদলে ত্যাগ-তিতিক্ষা। এসব উপাদানের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা কতটা সচেতন ও আন্তরিক? এমন প্রশ্ন হয়তো অনেকেরই ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু আজ প্রশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে এসব প্রশ্ন এসে যায়। জানি না এমন প্রেক্ষাপটে সঠিক ভূমিকা পালনে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা কতটা এগিয়ে আসবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads