সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৪

পানি সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে


শনিবার প্রগতিশীল প্রকৌশলী ও স্থপতি ফোরামের উদ্যোগে ‘মৃতপ্রায় তিস্তা, মরুকরণের পথে বালাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা তিস্তা ও গঙ্গাসহ অভিন্ন সব নদ-নদীর পানির হিস্যার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার দাবি জানিয়েছেন। বর্তমান সময়ে বেশি আলোচিত তিস্তা নদীর করুণ চিত্র তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা  বলেছেন, তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে ভারত যথেচ্ছভাবে পানি সরিয়ে নেয়ায় নদীটির বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়েছে। এপ্রিল-মে মাসে তিস্তায় যেখানে অন্তত ১০ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা সেখানে এখন চার-পাঁচশ কিউসেক পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে নদীই শুধু শুকিয়ে যায়নি, আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও মরুকরণ প্রক্রিয়া ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে বাংলাদেশের বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলোতে ভারত বাঁধের পর বাঁধ নির্মাণ করায় একদিকে মৎস্য, পশু-পাখি ও গাছপালা মরে যাচ্ছে এবং কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ১৩৫ বিলিয়ন টাকার। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এলাকাই মরুভূমিতে পরিণত হবে। কিন্তু দেশ এত বিপুল ও প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না। দেশটির প্রতারণামূলক কৌশলের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বলেছেন, তিস্তা অভিমুখে বিএনপির লং মার্চের দিনটিতে এক হাজার কিউসেকের মতো পানি ছাড়ার মধ্য দিয়ে ভারত অত্যন্ত নোংরা রাজনীতি করেছে। ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদ-নদীতে নির্মিত বাঁধগুলোর মারাত্মক কুফলের বর্ণনা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়ে গেছে, ভারত তার পানি আগ্রাসন বন্ধ করবে না বরং দিন দিন আগ্রাসনকে আরো ভয়ংকর করতে থাকবে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষয়-ক্ষতি এবং বিপদও কেবল বাড়তেই থাকবে। তাছাড়া এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতায় এসেছে বলে আওয়ামী লীগ সরকার পানি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য কোনো চেষ্টাই চালাবে না। এজন্যই উদ্যোগ নিতে হবে রাজনৈতিক দলসহ দেশপ্রেমিক সকল শক্তিকে। করণীয় সম্পর্কেও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের ওপর সরকার যাতে চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয় সেজন্য দেশের ভেতরে প্রচ- আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্যও বাধ্য করতে হবে।
আমরা শনিবারের সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্য ও দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্মতা প্রকাশ করি এবং মনে করি, বিশেষজ্ঞরা সঠিকভাবেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। তাদের পরামর্শও যথার্থ। কারণ, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উভয় দেশই ন্যায্যতা, ন্যায়পরায়ণতা ও অন্যের কোনো ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে যৌথ নদ-নদীর পানি ভাগাভাগি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের চুক্তি ও নীতি বাস্তবায়নের অবশ্যপালনীয় শর্ত হচ্ছে, কোনো পানি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রকল্প সম্পর্কিত সকল তথ্য অন্য পক্ষকে জানাতে হবে। উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে, অন্য পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ভারত গঙ্গার ক্ষেত্রে তো বটেই, অন্য সব নদ-নদীর পাশাপাশি তিস্তার ক্ষেত্রেও চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন হলো, কোনো বাঁধ নির্মাণ করার আগে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অনুমতিও নিতে হবে। এক্ষেত্রেও ভারত সুস্পষ্টভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী অবস্থানে চলে গেছে। এজন্যই সরকারকে শুধু প্রতিবাদ জানালে চলবে না, অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য। বলা দরকার, এ ধরনের ঘটনায় পৃথিবীর অনেক দেশই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে অধিকার ও ন্যায্য পাওনা আদায় করেছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মামলা করে স্পেন তার হিস্যাই শুধু আদায় করেনি, ফ্রান্সের একটি বাঁধকেও অকার্যকর করিয়ে ছেড়েছে। পাকিস্তানের উদাহরণও উল্লেখ করা দরকার। ভারত তার অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে বাগলিহার বাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তানকে চেনাব নদীর পানির হিস্যা থেকে কোনো এক চক্রে ৫৫ হাজার কিউসেক কম পানি দিয়েছিল। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। ভারত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করায় পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছিল। তখনই টনক নড়েছিল ভারতের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী চেনাব নদী থেকে দুই লাখ একর ফুট পানি দেয়া হবে। এটা মাত্র কিছুদিন আগেরÑ ২০০৮ সালের অক্টোবর-নবেম্বরের ঘটনা। আমরা মনে করি, স্পেন ও পাকিস্তানের মতো কঠোর অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশও সহজেই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে সব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারে। কোনো কোনো বাঁধকে অকার্যকরও করাতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায়ও রয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশকে পানিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা অপরাধ। কিন্তু ভারত শুধু বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্তই করছে না, বাংলাদেশকে পানি-প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রও বানাতে চাচ্ছে। আমরা অবশ্য এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নির্ভর করার পক্ষপাতী নই। কারণ, এই সরকার সকল বিষয়ে জাতীয় স্বার্থকে পরিত্যাগ করে ভারতের সেবাদাসসুলভ ভূমিকা পালন করাকেই নিজের কর্তব্য বানিয়ে ফেলেছে। সে কারণেই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করতে হবে দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোকে। সে আন্দোলনও এমন প্রচ- হতে হবে সরকার যাতে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানাতে এবং দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads