মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৪

গণতন্ত্র নির্বাচন প্রহসন ও সরকারের গন্তব্য


একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন হচ্ছে শাসক নির্ধারণের প্রকৃষ্ট এবং শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতি। আর সভ্যতার সুপ্রভাত থেকে মানব জাতি ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে উৎকৃষ্ট শাসনপদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। নির্বাচন নির্ধারণ করে, কোন দল বা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে। মানবজাতির পার্লামেন্ট (United Nations) গণতন্ত্রকে একটি জাতির অবাধ মত প্রকাশের বাহন মনে করে। গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন সম্মতির নির্ধারক মনে করে (জাতিসঙ্ঘ:২০০৫:১)।
বাংলাদেশের মানুষ তাদের শাসনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রকে ধারণ করে এবং বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রকে লালন করে; কিন্তু শাসনপদ্ধতি হিসেবে দৃশ্যত গণতন্ত্র অনুসৃত হলেও জীবনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র আজো বাংলাদেশের মাটিতে সুপ্রোথিত নয়। যেহেতু রাজনীতিই গণতন্ত্রের উপজীব্য অথবা গণতন্ত্রই রাজনীতির বৈধ বাহন, তাই রাজনীতি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যবিধাতা। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর। প্রতিষ্ঠিত সরকার ওই ব্যবস্থাপনার জন্য নির্বাচিত; কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের এসব সরকার গণতন্ত্রের অনুশীলন তো দূরের কথা সরকার পরিবর্তনের বাহন হিসেবে গণতন্ত্রকে অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুর করে ফেলেছে। এই অবস্থাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নির্বাচনী গণতন্ত্র, এক দিনের গণতন্ত্র অথবা অসহিষ্ণু গণতন্ত্র বলে অভিহিত করছেন। এ জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা এ সময় এক ন্যক্কারজনক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রের অধীনে দিনাতিপাত করছি। ব্যক্তিতন্ত্র নির্বাচনী গণতন্ত্রকেও নস্যাৎ করেছে।
 
উপজেলা নির্বাচন-২০১৪
৫ জানুয়ারির অবৈধ নির্বাচনের পর জনগণের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, এই আশঙ্কায় মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই বশংবদ ইলেকশন কমিশনকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো দীর্ঘ সময় নিয়ে দফায় দফায় উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি এক দিনে নির্বাচন করা যায় তাহলে উপজেলা নির্বাচন কেন বিভক্ত হবে? উত্তর : আওয়ামী লীগকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার সুবিধে দেয়ার জন্য। জাতীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী মহলে উপজেলা নির্বাচনের ফল নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। অপর দিকে বিএনপি ছিল আশাবাদী। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে এই দলের প্রতি জনগণের আস্থা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ তাদের মতামত প্রদর্শনের জন্য উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়ে ওঠে। প্রথম দফার ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জোট ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াত সফলতা লাভ করেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফা নির্বাচন মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও সরকারি দল কর্তৃক কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তৃতীয় দফা থেকে আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক সন্ত্রাসের শুরু। চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় বিধি-ব্যবস্থা। এতে করে এরশাদোত্তর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বিগত ২৩ বছরে অর্জিত নির্বাচনব্যবস্থা কার্যত তছনছ হয়ে গেছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালটে গণহারে সিল মারা, অপকর্মে নির্বাচনী কর্মকর্তার অংশগ্রহণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সরকারি দলের সহায়তা ছিল ন্যক্কারজনক। শীর্ষ নেতৃত্ব বড়াই করে বলতেন, তার সময়ে শত হাজার নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না। এবার উপজেলা নির্বাচনে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। নির্বাচন কমিশন নিষ্ক্রিয় থাকে। বিদেশে ছুটিতে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাদের অযোগ্যতার প্রমাণ রেখে স্বীকারোক্তি করলেন যে, তিনি থাকলেও যেমন নির্বাচন হয়েছে তেমনটিই হতো। এতে বোঝা যায় তারা কতটা তল্পিবহনে পারঙ্গম।
সাধারণ মানুষ জাতীয় নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে উপজেলা নির্বাচনকে গ্রহণ করে। রাজনৈতিক পরিচয়ের বৈধতা না থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের অংশগ্রহণে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। আওয়ামী রোষানলে তাদের উৎসাহ ধুলায় মিশে যায়। প্রথম দিকে বিরোধী জোটের আসন বৃদ্ধি যতটা দ্রুততার সাথে হয়েছে তার চেয়েও বেশি দ্রুততার সাথে আওয়ামী সন্ত্রাস বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ত্রাসের বৃদ্ধি আওয়ামী আসন বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। পাঁচ ধাপের এই নির্বাচনী সহিংসতায় ১০ জন নিহত এবং কয়েক শআহত। পত্রিকাগুলো প্রথম দিকে মন্ত্রীদের নির্বাচনী এলাকার পরাজয়কে তাদের জনপ্রিয়তার ধস হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে পরে ওইসব লোকের জিতে আসাটা ইজ্জতের সওয়াল হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ করা যায়, বিএনপি প্রভাবিত এলাকায় বেশি করে জবরদস্তির ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী প্রভাবিত এলাকায় সন্ত্রাসী ঘটনা কম।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
উপজেলা নির্বাচনের প্রথমিক পর্বে বিএনপি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট করে বলেছেন সরকার ভোট ডাকাতি করেছে। জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অভিযোগ করেছেন, সরকার জোর করে বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকে তিনি আন্দোলন বেগবান করার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন। রিজভী বলেন, উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হয়েছে এ সরকার একটি দানব সরকার। বিএনপি এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা আজ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের আধিপত্যের নগ্নতা ফুটে উঠেছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের নোংরা ও কলঙ্কজনক চিত্র গিনেজ বুকে রেকর্ড হয়ে থাকবে। একজন নির্বাচন কমিশনার বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে যে কটাক্ষ করেছেন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার এই মর্মে মন্তব্য করেন যে, বেগম খালেদা জিয়া নাকে খত দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গয়েশ্বর রায় বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতারা যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একই সুরে কথা বলেছেন। একটি সাংবিধানিক পদে থেকে এভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া ধৃষ্টতা বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অতীতের যেকোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে এবার উপজেলা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যবহার নেই বললেই চলে। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয় আর কিভাবে কারচুপি হলে বলবেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। জবাবে মন্ত্রী বলেন, সরকার কেন নির্বাচন খারাপ করবে? তাতে সরকারেরই ক্ষতি। তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের শুরুটা ভালো হয়েছে। শেষটাও ভালো হয়েছে। শেষটায় তেমন কোনো সহিংসতা হয়নি। উপজেলা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কুৎসিত ও ভিত্তিহীন মিথ্যাচারে বিএনপি নেতারা লিপ্ত হয়েছেন।সরকারি দলের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পর অবশ্যই প্রত্যক্ষদর্শীদের লজ্জা পেতে হবে। সেই সাথে সংবাদমাধ্যমকে হয়তো ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে সত্য বলার দায়ে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা
দেশের জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব থাকলেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে সর্বমহলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে আগামী দিনে নির্বাচনে জনগণ হয়তো আর ভোট দিতে আগ্রহী হবে না। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন প্রথম দফা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও পরবর্তী সময়ে ক্রমেই সহিংসতা, অনিয়ম, সরকারি দলের কেন্দ্র দখল ও জোরজবরদস্তির ঘটনায় নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি নীরব থাকে আইনে বিপুল ক্ষমতা থাকলেও। দ্বিতীয় দফায় ৯৮টি কেন্দ্র দখল ও সহিংসতায় একজন নিহত হলে প্রার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীকে ইসি কিছু নির্দেশনা দেয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তৃতীয় দফায় ১৭৫টি কেন্দ্র দখল করা ছাড়াও সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়। ভারপ্রাপ্ত ইসি আবদুল মোবারক নির্বাচন শেষে বলেন আলহামদুলিল্লাহ। নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু হয়েছে। চতুর্থ দফায় আরো বেশি সঙ্ঘাতের আশঙ্কা নির্বাচন কমিশনকে সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করলেও কমিশন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ২৫০টি কেন্দ্র দখল ও সহিংসতায় সাতজনের মৃত্যু হয়। সেখানেও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করেছে কমিশন। পঞ্চম তথা শেষ দফায় ভোটের আগেই ব্যাপক সহিংসতা শুরু হলে বিরোধী দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত ইসি আবদুল মোবারক নিজেই সরকারি দলের ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শেষ দফায় ৫৩টি উপজেলায় সব কটি কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেছে। অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন অনিয়মকেই সহযোগিতা দেয়ায় শেষ তিন পর্বে নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অনেক উপজেলায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই সিল মারা ব্যালট বাক্সে ভরে রাখা হয় প্রশাসনের সহায়তায়। প্রতিপক্ষ এমনকি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কোণঠাসা, এলাকা ছাড়া করার অনেক ঘটনা ঘটেছে। বাকি ১৪টি উপজেলা নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ ১৯ মে। অব্যাহত সমালোচনার মুখে নির্বাচন কমিশন এই শেষ দফা নির্বাচনে কী ভূমিকা রাখে, গোটা জাতি তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, ’৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর গত ২৩ বছরের গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে দেশে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কেন্দ্র দখল করে ও সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরার সংস্কৃতি মানুষ ভুলতে শুরু করেছিল; কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে চলতি বছরের সব নির্বাচনে দেশের ২৩ বছরের নির্বাচনী গৌরবময় অধ্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
সিভিল সোসাইটি ও পর্যবেক্ষণ গ্রুপের মন্তব্য
সুজন-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কেন্দ্র দখল, সিল মারা, জনগণকে ভোটদানে বাধা দান, সহিংসতার ঘটনায় জনগণ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারাবে। পাঁচ দফা নির্বাচনে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের ভোটকেন্দ্র দখলের যে লীলা আমরা দেখেছি এতে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। এতে প্রমাণ হয়, আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর জোট ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’(ইডব্লিউজি) বলেছে, পঞ্চম দফা উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা হয়েছে, ৭৬ শতাংশ ভোটারকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে এবং ২০ শতাংশ ভোটারকে ভোটদানে বাধা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫৯ শতাংশ পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির হার ৫৩ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে জানিপপ চেয়্যারমান ড. নাজমুল হাসান কলিমউল্লাহ বলেন, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় তিনটি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্সের মধ্যে আগে থেকে বিপুলসংখ্যক ব্যালট ভরা ছিল। ওই বাক্সগুলো ভোট গ্রহণে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, লক্ষ্মীপুর সদর, সাতক্ষীরা সদর ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আঙুলে কালি লাগিয়ে চলে যেতে বলা হয়। কারণ জানতে চাইলে ভোটারদের বলা হয়, ভোট দেয়া হয়ে গেছে। অন্য দিকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই প্রার্থীর সমর্থকেরা কেন্দ্রে প্রবেশ করে নিজেরাই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেন।
আওয়ামী গন্তব্য
বিগত পাঁচ বছরে দুঃশাসন থেকে মুক্তির আশায় সাধারণ মানুষ যখন উন্মুখ হয়ে সাধারণ নির্বাচনের অপেক্ষা করছিল, তখন ক্ষমতাসীনেরা তাদের অনিবার্য পরিণতি অনুধাবন করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করে। শীর্ষ নেতৃত্ব ছলেবলে কলাকৌশলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও তাদের পায়ের তলায় যে মাটি নেই, তারা তা বোঝে। ওই নৈতিক পরাজয় থেকে তাদের উক্তি : সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, আপাতত নির্বাচন, ভবিষ্যতে সত্যিকার নির্বাচন ইত্যাদি। জনগণের আপাত নীরবতায় তুষ্ট আওয়ামী লীগ ঝড়ের পূর্বাহ্ণের গুমোট ক্ষণে অবস্থান করছে। আসন্ন ঝড়ে তারা যে শুধু ক্ষমতাই হারাবে তা নয় বরং তাদের সংগঠন অস্তিত্বের সঙ্কট আশঙ্কায় থাকবে। দেশী বিদেশী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের এমনটিই ধারণা।
অবৈধ অকার্যকর জাতীয় নির্বাচনের পর কোনো কোনো রাজনৈতিক ভাষ্যকার আশা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ প্রহসনের পর প্রশান্তির উন্মেষ ঘটাবে। তা না করে তারা ২০১৯ সাল পর্যন্ত অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করছে। নির্বাচনের আগে যেমন বিরোধীদলীয় শীর্ষ নেতাদের পাইকারি গ্রেফতার করা হচ্ছিল এখনো তা-ই চলছে। সরকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা করছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা অবিলম্বে আসছে বলে তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। সরকারবিরোধী কোনোরকম সভা সমাবেশ এখনো এক রকম নিষিদ্ধই আছে। প্রায় সব বিরোধী প্রচারমাধ্যম ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন সব চ্যানেলে সরকারের প্রশস্তি। খুন গুম রাহাজানি আগের মতোই চলছে। দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে রাজপথে দায়িত্বশীল নাগরিকেরা অপহৃত হচ্ছেন। এসবের পরও আওয়ামী নেতৃত্বে অনুতাপ অনুশোচনা অনুপস্থিত। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম লি মাইলাম মনে করেন, ‘সরকারের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা ও ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী কার্যক্রম চরমপন্থীদের উসকে দেবে। মাইলাম সব ধরনের উগ্রপন্থীকে বুঝিয়েছেন। তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ না করে মন্তব্য করেন যে, ‘পরিহাস হচ্ছে যে দলকে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করতে চায়, সেই দলই হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামী পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে। বড় দুই দলের দুর্নীতি ও দলবাজিতে মানুষ জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে।তার মতে জামায়াতে ইসলামী প্রধান বিরোধী দলেও পরিণত হতে পারে। তিনি আশঙ্কা করেন এই পুনর্গঠিত দল যদি সৎ নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে গণেশ উল্টে যেতে পারে। দেশের একজন মেধাবী রাজনৈতিক ভাষ্যকার মন্তব্য করেন, নিশিতে পেলে মানুষ যেমন ঘুমের মধ্যে হাঁটে, দলটি সে রকম ঘুমের ঘোরে খাদের দিকে চলছে।থামানোর কেউ নেই।
 
গোটা জাতির এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিভিল সোসাইটি তথা দেশের সচেতন মানুষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না।  সরকার নিজ খননকৃত খাদে পড়ার আগে তাদের উচিত একটি প্রকৃত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা। একই সাথে বিরোধী দলগুলোর উচিত চূড়ান্ত সরকার পতন আন্দোলনের আগে সরকারকে সমঝোতার সুযোগ দেয়া। এর পরও যদি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে দেশের স্বাধীনতা, সংহতি, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
উপসংহার
নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এর দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ জন্য দেশের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাও তাকে দেয়া হয়েছে। এমনকি আইন ও বিধিবিধানের সাথে সংযোজনের ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে; কিন্তু কী দেখতে পাচ্ছি? মন্ত্রী-এমপিরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন। আর নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। আইন, নৈতিকতা ও বিধিব্যবস্থা কোনো ব্যাকরণই অন্যায় কার্যক্রমকে অনুমোদন করে না। সুতরাং তাদের অবৈধ কার্যক্রম চলতে দেয়া যায় না। বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল তাদের পদত্যাগ দাবি করেছে। স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ তদন্ত করে অনিয়মের নির্বাচন বাতিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর ধারাবাহিকতায় আন্দোলন ও সহিংসতা হয়েছে, অনুষ্ঠিত হয়েছে একতরফা নির্বাচন। এর মাধ্যমে আইনগত ও সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এ সরকার অবৈধ।তোফায়েল আহমেদের মন্তব্যের আলোকে সাধারণ মানুষ আশা করে, যদি ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ন্যূনতম নীতি ও মূল্যবোধ বিরাজ করে তাহলে সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। জনগণের ঈপ্সিত ইচ্ছাই যদি হয় গণতন্ত্র তবে গণতন্ত্রের জয় অনিবার্য। ÒDemocracy may lose many battles but it wins the last.Ó

ড. আবদুল লতিফ মাসুম


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads