রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৪

নির্বাচন কমিশনকে ইমপিচ করার দাবি প্রসঙ্গে


সংবিধান লংঘন করার অভিযোগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। এ দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দেশের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। গত শনিবার বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের উদ্যোগে ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে নিজের দাবির পক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যাকালে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্নভাবে সংবিধান লংঘন করে চলেছেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ পদটির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সংবিধানে এ ধরনের কোনো পদের অস্তিত্ব নেই। তা সত্ত্বেও আবদুল মোবারক নামের একজন নির্বাচন কমিশনার নিজেকে ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তার এই পরিচয় অবৈধ। তিনি সেই সাথে এমন কিছু বক্তব্য রেখে ও মন্তব্য করে বেড়াচ্ছেন যেগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যারিস্টার রফিক প্রসঙ্গক্রমে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আবদুল মোবারকের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, বেগম জিয়া নাকি ‘নাকে খত দিয়ে’ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন! ব্যারিস্টার রফিক বলেছেন, কোনো নির্বাচন কমিশনার এ ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য করতে পারেন না। কিন্তু আবদুল মোবারক বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি আসলে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী মাত্র, নির্বাচন কমিশনার নন। এজন্যই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাকে ইমপিচ করতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও।
লাভ-লোকসানের হিসাব না করে ভারতকে বিদ্যুতের করিডোর দেয়ার মতো আরো কিছু বিষয়েও সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন ব্যারিস্টার রফিকসহ বিশিষ্টজনরা। কিন্তু সঙ্গত কারণে প্রাধান্যে এসেছে নির্বাচন কমিশন ও কমিশনারদের ভূমিকা সম্পর্কিত কথাগুলো। বস্তুত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় থেকেই ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়ে এসেছে নির্বাচন কমিশন। ১৯ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই কমিশনকে ‘মেরুদ-হীন’ প্রতিষ্ঠান বলেও আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো নিন্দা-সমালোচনাতেই সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। কমিশন বরং ক্ষমতাসীন দলের জন্য আদা জল খেয়ে তৎপরতা চালিয়েছে। এ ব্যাপারে সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের সময়। নির্বাচন কমিশন, কমিশনার এবং সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সমর্থনে প্রকাশ্যেই ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকে শত শত জাল ভোট পর্যন্ত দিয়েছেন। অনেকে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের মতো বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধাইয়ে বেড়িয়েছেন। বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছিল নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই। উপজেলাগুলোর কোনো একটিতেই বিরোধী দলের প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রচারণা ও তৎপরতা চালাতে পারেননি। তাদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করানো হয়েছিল। বেশ কিছু প্রার্থীকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। অন্যরা পালিয়ে থেকেছেন। যৌথবাহিনী তাদের বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সন্ত্রস্ত রেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররাও হামলা চালিয়েছে। ফলে প্রার্থীরা তো বটেই, তাদের সমর্থক নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি। তার ওপর আবার নির্বাচনের দিন ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। ফলে জনগণ অবাধে ভোট দিতে পারেনি, বিরোধী দলের প্রার্থীরা বাধাহীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু সব জেনে বুঝেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বাধাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সামান্য সততারও প্রমাণ দেয়নি। জনগণকে স্তম্ভিত করে নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে ‘অবকাশ’ যাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি জামিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি থাকলেও যে ব্যতিক্রম ঘটতো না তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল সংসদ নির্বাচনের সময়। তা সত্ত্বেও ঠিক এ সময়ে তার বিদেশে চলে যাওয়া ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য সরাসরি একটি ‘ব্ল্যাংক চেক’ পাওয়ার মতো ব্যাপার। এ অবস্থার সুযোগে কমিশনের অন্য কর্তারাও সরকারের পক্ষে নির্লজ্জভাবে কাজ করেছেন। দায়িত্ব যেখানে ছিল সরকারকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা এবং প্রভাব বিস্তার থেকে নিবৃত্ত রাখা, কমিশন সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীন দলের জন্য ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিশেষ করে কথিত ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য ও ভূমিকা ছিল অত্যন্ত আপত্তিজনক। তিনি ১৯ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে ‘নাকে খত দিয়ে’ নির্বাচনে অংশ নেয়ার মতো এমন কিছু কথা বলেছেন যেগুলো কেবল আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষেই বলা সম্ভব। এর মাধ্যমে কথিত এই ভারপ্রাপ্ত সিইসি বুঝিয়ে দিয়েছেন, মেরুদ-হীন তো বটেই, তারা ক্ষমতাসীনদের লোক পুরোপুরিই। একই কারণে জনগণও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে, বর্তমান কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
এই অভিযোগ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের সময় থেকেই উত্থাপন করা হয়েছে। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সেমিনারে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং তার সঙ্গে অন্য বিশিষ্টজনরা সে কথাটারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র। আমরাও মনে করি, দলবাজির ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যারা বিতর্কিত ও নিন্দিত করেছেন এবং যাদের পুতুলসুলভ কার্যক্রমের কারণে নির্বাচন কমিশন অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এজন্য আইন ও সংবিধানসম্মত পথও দেখিয়েছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। রাষ্ট্রপতির উচিত অনতিবিলম্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা এবং নির্বাচন কমিশন ও কমিশনারদের ইমপিচ করার পদক্ষেপ নেয়া। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে কথিত ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারকের বিরুদ্ধে এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যাতে সংবিধান লংঘনসহ নিজের বিভিন্ন বেআইনী কাজের জন্য তাকে ‘নাকে খত দিয়ে’ বিদায় নিতে হয়। এভাবেই নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের যথাযথ অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads