মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৪

উপজেলা নির্বাচন যে সত্য তুলে ধরেছে


নানা ঘটনা ও অঘটনের মধ্য দিয়ে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন শেষ হয়েছে। এক দুই করে ইতোমধ্যে পঞ্চম দফার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার দাবিতে দেশের প্রধান দুটি দলের একটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে নজিরবিহীন একতরফাভাবে ওই নির্বাচন সম্পন্ন করে। সেটি বিএনপি জোটের জন্য ব্যর্থতা বলা যায় না। কারণ, সরকার এবং বিরোধী দলের অসম শক্তি-বল প্রতিযোগিতায় সরকারি দলই বীরদর্পে জয় লাভ করে। তবে ওই নির্বাচনের যে চালচিত্র, সেটাই ছিল বিএনপির অর্জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির একটা সাময়িক বিরতি আমরা লক্ষ করি। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। বিএনপি জোটের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দেশ-বিদেশের কোনো কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছিল। আমরা মনে করি, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া না  নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পেরেছে। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা কিছুটা শান্তিপূর্ণ হলেও তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দফার উপজেলা নির্বাচন আমাদের আশির দশকের এরশাদ সরকারের নির্বাচনী স্টাইলের কথা পুনরায় মনে করিয়ে দিয়েছে। পঞ্চম দফার উপজেলা নির্বাচন তো আশির দশককেও হার মানিয়েছে। এ অভিযোগ হয়তো বিরোধী দলের পক্ষে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা তো অস্বীকার করা যায় না। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তুলে ধরে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করেছে। এ অভিযোগ আমলে নিয়ে যাদের দায়িত্ব তা খতিয়ে দেখা, নিরসন করা এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, আমাদের দুর্ভাগ্য, তারা তা স্বীকার করতে অপারগ। ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছে না।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা অপরিসীম। কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে এর দায়ভার প্রথমে ইসির ওপরই বর্তায়। উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও জাল ভোট দেয়া প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায় ইসিকেই নিতে হবে। ইতোপূর্বে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সিইসির একটি বক্তব্য ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পঞ্চম দফা নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোটারদের তাড়িয়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সিল মেরে ভোটের বাক্স পূর্ণ করেছে। স্থানীয়পর্যায়ের নির্বাচনে সাধারণত যেখানে যে দল সমর্থিত প্রার্থীর শক্তি বেশি, ফলাফল অনুকূলে নিতে সেখানে সে দলই প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট থাকে। এবারো এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কিন্তু অনেক স্থানে দেখা গেছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, উল্টো আইনবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল। এ ব্যাপারে ইসি ও প্রশাসনকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মতো বিরোধীদলীয় নেতাদের উদ্দেশ্যে নাক খত দিয়েছেনবলে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন। আমরা বিস্মিত হই এ জন্য যে, এই নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের সার্চ কমিটির মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয়েছে। সার্চ কমিটির উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা, তবে সেই উদ্দেশ্য যে পুরোপুরি বিফলে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দৃশত নির্বাচন কমিশনের কার্যাবলিতে মনে হচ্ছে সরকার আওয়ামী লীগারদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করেছে। দেশ জাতির আস্থা অর্জনে এ নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের অনেক দায়িত্বশীল মন্ত্রী নেতা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপি করার অভিযোগ বিষয়ে নির্বাচিত বিরোধী দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যানদের পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এটি খুবই অশালীন এবং দৃষ্টিকটু। নিন্দনীয়ও বটে। এর মাধ্যমে কী তারা এটা বুঝাতে চান যে, সরকারি দল আশা করেছিল, বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না; এবং এ সুযোগে দশম জাতীয় সংসদের মতো সরকারি দল নিজেদের মতো করে উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদগুলোও ভাগবাটোয়ারা করে নেবে? সেটি সম্ভব না হওয়ার তারা বেজায় চটেছেন?
সাধারণ জনগণের কাছে স্পষ্ট, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় দফায় বিএনপি প্রার্থীদের জয়জয়কার অবস্থা সরকারি দলের কাছে ভালো লাগেনি। বিরোধীদের এ জয়ে সরকার ভীত হয়েছে। ফলে পরের ধাপগুলোতে তারা আর পরাজয় মানতে নারাজ। এ জন্য ভোট চুরি এবং অনিয়ম সব কিছু করেছে।  এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সবই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।
নির্বাচন পরিস্থিতির যেখানে ধাপে ধাপে উন্নতির কথা ছিল, সেখানে ঘটেছে ঠিক এর উল্টোটি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফা মোটামুটি ভালোভাবেই সম্পন্ন হওয়ার পর দ্বিতীয় দফাও মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু তৃতীয় থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম দফায় এসে যাকে বলে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি- সেটাই যেন ঘটল নির্বাচনের কপালে। পঞ্চম দফায় সহিংসতা ও জবরদখলের ঘটনায় মারা গেছে দুজন। ৭৩টি উপজেলার নির্বাচন বর্জন করেছেন অনেক প্রার্থী। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ডাকা হয়েছে হরতাল। এবারের উপজেলা নির্বাচনে, বিশেষ করে শেষ কয়েকটি দফার নির্বাচনে যেভাবে সিল মেরে বাক্সভর্তি করার ঘটনা ঘটেছে, সন্দেহ নেই তা আবারো আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা যখন এ ধরনের নির্বাচনী অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন উপজেলা নির্বাচনের এই চিত্র সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। দেশের রাজনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রবল। বস্তুত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিষ্কলুষ করার কোনো বিকল্প নেই। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে না। সন্দেহ নেই, এ উপজেলা নির্বাচনের পর একটি স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলার দাবি আরো জোরদার হবে।
একটি নিষ্কলুষ নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সবার আগে দায়িত্ব নিতে হবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে। তারা নিজেরা যত দিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণে এগিয়ে না আসবে, তত দিন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে না। আর তাই সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দল উভয়কেই চর্চা করতে হবে পরমত সহিষ্ণুতার। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি বহুল প্রচলিত উক্তি আছেÑ আমি তোমার মতের সাথে একমত নই, কিন্তু আমার জীবন দিয়ে হলেও তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। এটাই গণতন্ত্রের মর্মবাণী। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই সত্যের চর্চা করতে পারে, তাহলেই সম্ভব হবে নিষ্কলুষ নির্বাচনব্যবস্থা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলা।
পঞ্চম দফা উপজেলা নির্বাচনের পরও আরো কিছু উপজেলায় নির্বাচন এখনো বাকি। ওই নির্বাচন নিয়ে এখন আর কারো আগ্রহ নেই। আগ্রহ রয়েছে যারা বিজয়ী ঘোষিত হবেন তারা। জনসাধারণ এ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সুতরাং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলে সমর্থিত প্রার্থীদের এখন ষোলকথা পূর্ণ হওয়া বাকি মাত্র। উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় দফা থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে বিতাড়িত করা, জয় ছিনিয়ে নেয়ায় বিএনপি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। দেশ-বিদেশে এ নির্বাচনও কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না, এটা উপজেলা নির্বাচনে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের এ দায় থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।


 অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads