শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৪

আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি : গুম এবং খুন


অনেক দিন আগে আমাকে একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছিলেন  যে, আওয়ামী লীগের যখন জন্ম হয় তখন আকাশে রক্তাক্ত সূর্য জ্বলছিলো। এর অর্থ এই যে, আওয়ামী লীগ যত দিন রাজনীতিতে থাকবে ততদিন প্রচুর রক্তপাত হবে। তার কথাটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। বিগত সুদীর্ঘ ৬৪ বছরে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই দলটি যখন বিরোধী দলে থেকেছে তখন রক্তপাত ঘটিয়েছে, আবার যখন সরকারে থেকেছে তখনও রক্তপাত ঘটিয়েছে।
আওয়ামী লীগের জন্ম তারিখটি বিশ্লেষণ করুন, দেখবেন সেখানেও এক কলঙ্কময় দিনে এই দলটির জন্ম। এই দলটির জন্ম হয়েছে ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান পলাশীর রণক্ষেত্রে নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে নবাবের বাহিনী বৃটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে পরাস্ত হয়। সেদিন শুধু নবাব সিরাজই পরাজিত হননি, তার পরাজয়ের সাথে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও ডুবে যায়। পরবর্তী ঘটনাবলী সকলেই জানেন। পরবর্তী ১৯০ বছর ধরে বাংলা (ভারতীয় বাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশ) ইংরেজ শোষকদের শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হয় এবং ভারতের মুসলমানরা স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করে। পক্ষান্তরে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ ছাড়া অবশিষ্ট ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়।
এইসব কথা কম বেশি সকলেরই জানা। কিন্তু যেটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকে সেটি হলো, আওয়ামী লীগ তার জন্মের সময়টিকে ২৩শে জুন বেছে নেয় কেন? ২৩শে জুনের সাথে যে নামটি কলঙ্কিত হয়ে আছে, যে নামটি এখন ‘বেঈমান’ শব্দের সমার্থক, সেই মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার দিনটিকে আওয়ামী লীগ তার জন্মলগ্ন হিসাবে বেছে নিলো কেন? ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এটি বিবেচনা করেছেন এবং এখনো বিবেচনা করে যাচ্ছেন। পাকিস্তান আমলেও আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে এবং আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিকে মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি। কি সরকারে, কি বিরোধী দলে, যে অবস্থানে তারা থেকেছে সেই অবস্থানেই তারা বিরোধী দলের জনসভায় হামলা করেছে, মারপিট করেছে এবং তাদের গুন্ডামীকে ‘জনতার রুদ্ররোষ’ বলে চালিয়ে দিয়েছে। তাদের হামলায় বিরোধী দলের অনেক কর্মী সেদিনও শহীদ হয়েছেন। শহীদ আব্দুল মালেক সেই সব শহীদের একটি জলন্ত নজির।
দুই
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ শুধু গুন্ডামীতেই তাদের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপহরণ এবং গুপ্তহত্যাও চালু করেছে। এই অপহরণ এবং গুপ্ত হত্যার প্রথম শিকার ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির’ সভাপতি কমরেড সিরাজ শিকদার। তাকেও পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ক্রসফায়ারে হত্যা করে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রসফায়ারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করার উদ্বোধন করা হয় সিরাজ শিকদারের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ সেই গুম এবং খুনের মহাজনী পথ মাড়িয়েই চলেছে।
কিন্তু গুম এবং খুনের ঘটনাবলি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদে এবং বর্তমানের অনির্বাচিত এবং অবৈধ মেয়াদে। মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রের’ (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চার বছরে সারাদেশে ২৬৮ জন অপহৃত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে ১৪ জনকে। আর ১৮৭ জনের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ নেই। আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ৬৮ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার এবং ছয়জন ছাড়া পেলেও বাকি ৫৫ জনের এখনও খোঁজ নেই। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিশ কেন্দ্র আসকের হিসাবে দেখা যায়, বিএনপির আমলে ২০০৪ সালে ২১০ জন, ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন, ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ সংখ্যা কমে আসে। ২০০৭ সালে ১৮০, ২০০৮ সালে ১৭৫ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয় ২২৯। অন্যদিকে পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অপহরণের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৩৯১টি। এর মধ্যে ২০১০ সালে ৮৭০টি, ২০১১ সালে ৭৯২টি, ২০১২ সালে ৮৫০টি ও ২০১৩ সালে ৮৭৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অপহরণের ঘটনা ঘটে ১৯৬টি। জানুয়ারি মাসে ৬২টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৫টি ও মার্চ মাসে ৭৯টি। (নয়াদিগন্ত : ২০ এপ্রিল, ২০১৪)। একইভাবেই আরো বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা অপহৃত হওয়ার পর দীর্ঘদিন পার হলেও তারা এখনও উদ্ধার হননি। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানা বিএনপির সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচার অপহরণের পর খোঁজ মেলেনি। অপহৃতের পরিবারের দাবি, র‌্যাব সদস্যরা তাকে ঢাকার গাজীপুর থেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নেলাইন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আলম ঢাকার পল্টন থেকে নিখোঁজ হন ২০১১ সালের ৬ মার্চ। ওই ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয় পল্টনসহ কয়েকটি থানায়। মাসের পর মাস চলে তদন্ত। কিন্তু ফিরে আসেননি শহীদুল। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মেরে ফেলা হয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় তার পরিবার। পুলিশও উদ্ঘাটন করতে পারছে না নিখোঁজ রহস্য। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর লক্ষীপুর চকবাজার জামে মসজিদের সামনে থেকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে কিছু লোক ওষুধ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বিএনপি নেতা ইকবাল মাহমুদ জুয়েলকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় থানায় জিডি হলেও সন্ধান মেলেনি জুয়েলের। খুলনার কেএম শামীম আকতারকে ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয় ঢাকা থেকে। ওই দিনই পল্টন থানায় জিডি করেন শামীমের স্ত্রী ঝর্ণা খানম। কিন্তু শামীমের কোনো হদিস মেলেনি। স্ত্রী ঝর্ণা খানম বলেন, ‘সন্তান বাবার কথা জানতে চাইলে কিছুই বলতে পারি না। তিনি (স্বামী) বেঁচে আছেন, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানি না।’ নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া পারভেজকে গুলশান থেকে অপহরণ করা হয় গত বছরের ৬ জুলাই। এ ঘটনায় গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার স্ত্রী সোহানা আক্তার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পারভেজকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত ৪ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হত্যা ও গুম নিয়ে উদ্বিগ্ন খালেদা জিয়া হোটেল ওয়েস্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বাপর ঘটনায় তাদের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি কার্যালয়ে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী ২৪২ জনকে হত্যা এবং ৬০ জনকে গুম করা হয়েছে। তবে দলীয় তথ্য সংগ্রাহকদের সংশোধিত বর্তমান তালিকায় দেখা যায়, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৬১-তে দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে দায়িত্বশীল নেতারা দাবি করেছেন। নিহত ২৬১ জনের মধ্যে জামায়াতের অন্তত ৮১ জন। গুম হয়েছেন সাতজন জামায়াত নেতাকর্মী। বাকিরা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বলে দাবি করছেন তথ্য সংগ্রহকারীরা।
তিন
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ হন তৎকালীন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক। গাজীপুরে পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় অপহরণের শিকার হন।  ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম। ২০১৩ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখ গুম-হত্যার শিকার হন ঢাকার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদার। ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার আনন্দনগর গ্রাম থেকে সাদা পোশাকধারী একদল লোক র‌্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করে। পরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাগুলা ইউনিয়নের আদাবাড়িয়া গ্রামের মাঠ থেকে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার হাতকড়ায় ‘পুলিশ’ শব্দটি খোদাই করে লেখা ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
গত বছরের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকি। দু’দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার হয় তার লাশ। ত্বকি শহরের চাষাড়ার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলো। ত্বকি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরি ওসমানসহ ১২ জন অভিযুক্ত করা হলেও তারা রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাবা রফিউর রাব্বীর ওপর প্রতিশোধ নিতেই ছেলেকে হত্যা করা হয় বলে তদন্তে বের হয়ে এসেছে।
চার
বলছিলাম আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির কথা। তারেক রহমান লন্ডন থেকে শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে সুধী সমাবেশ ডেকে দুটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তার ওই বক্তব্য ছিলো তথ্য উপাত্ত এবং যুক্তি ও ডকুমেন্টে সমর্থিত। তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করার অধিকার সকলেরই আছে। আওয়ামী লীগেরও আছে। কারণ বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আওয়ামী লীগ যুক্তি তর্ক দিয়ে তারেক রহমানের বক্তব্য খন্ডন করতে পারে। তারেকের বক্তব্য তারা যুক্তিতর্ক দিয়ে খন্ডন না করে, গালাগালির পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি তারেক বা তার মাতা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করারও হুমকি দিয়েছে। এগুলো করে কি রাজনীতি, মতবাদ বা আদর্শকে হত্যা করা যায়? ইতোমধ্যে  শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানকে নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য তথ্য সমৃদ্ধ বক্তব্য ইন্টারনেটে তথা ফেসবুকে আসছে। টুইটার এবং ইমেলেও সেগুলো আসছে। তাজ উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সহচর মইদুল হোসেন এবং তাজ উদ্দিনের কন্যা আমেরিকা থেকে বই প্রকাশ করে শেখ মুজিব সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছে। শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে ১৯৭১ সালের ৬ই নভেম্বর আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দিরা গান্ধী একটি বক্তব্য দিয়েছেন। এইগুলো এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকে জেনে যাচ্ছেন। এখন ওইসব বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই সরকার তার পুরনো অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়। সমালোচকদের বলে রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানের দালাল ইত্যাদি। কিন্তু এইগুলোতো আদর্শিক বিরোধ সমাধানের কোন পথ নয়। এটা অপরাজনীতি। আওয়ামী  লীগকে অবিলম্বে এই অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে যে, কাঁচের ঘরে বসে অন্যের ঘরে ঢিল ছোঁড়া যায় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads