বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪

প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান প্রশ্নে ঐতিহাসিক দলিলপত্র


বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৪০ বছর পার হয়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন যেমন কম নয়, তেমনি নানান বিষয়ে জাতিসত্তার মধ্যে বিভক্তি জাতিকে সামনের দিকে আগানোর চেয়ে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতার ঘোষণা। এটি ঐতিহাসিকদের বিষয় হলেও বর্তমানে দাঁড়িয়েছে আদালতের কাঠগড়ায়। বর্তমান রাজনীতির অপসংস্কৃতির বদৌলতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনপণ সংগ্রামের স্বীকৃতি আজ আদালতের মাধ্যমে অর্জন করতে হচ্ছে। একটা জাতির জন্যে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে। আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলাদেশের সরকার ও দেশ পরিচালনার অবস্থা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের শাসন থেকে ছিন্ন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করার ২২ দিন পরে ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের আম্রকুঞ্জে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে।
ইতোপূর্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে যারা আগরতলায় হাজির ছিলেন তারা ১৩ই এপ্রিল সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। দেশী-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি ও ১০ সহস্রাধিক জনতার উপস্থিতিতে ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, তার অবর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠে, তাহলে কি স্বাধীনতার প্রারম্ভে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ২২ দিন বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বশূন্য ছিল? এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রেকর্ড পত্রে কি পাওয়া যায় সেটাই আজকের আলোচনা।
প্রথমেই শেখ মুজিব স্বীকৃত ঐতিহাসিক দলিল থেকে উপস্থাপনা। আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত) কর্তৃক এপ্রিল ১৯৭২ সালে প্রকাশিত “বাংলা নামের দেশ” পুস্তক সম্পর্কে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ ১৯৭২ তারিখে স্বাক্ষরিত পত্রে বলেন, “বাংলা নামের দেশ’ গ্রন্থে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের আগের ও পরের ইতিহাস, ধারাবাহিক রচনা, আলোকচিত্রমালায় চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। বইটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।” এ দলিলে ২৫/৩/৭২ দেয়া বানীতে প্রধানমন্ত্রী মুজিব লিখলেন, “১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ আমি ঘোষণা করেছিলাম “এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” বহু নির্যাতন, বহু দুঃখভোগের পর আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। সেই সংগ্রামের কাহিনী ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। পাকিস্তানী সমরনায়কদের নরমৃগয়ার শিকার হয়েছে ৩০ লাখ লোক, এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। জঙ্গিচক্র আঘাতের পর আঘাত হেনেছে, কিন্তু আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনোবল তাতে ভেঙে পড়েনি, আমরা স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছি।”
এ গ্রন্থের ৮১ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের উষালগ্নের অবস্থা সম্পর্কে যে ইতিহাস লেখা রয়েছে তা দেখা যাকÑ
“মুজিব গ্রেফতার। সর্বত্র সংঘশক্তি প্রায় তছনছ। এই শূন্য অবস্থাকে ভরাট করে তোলার জন্য মেজর জিয়া রবিবার ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম রেডিও থেকে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করলেন। তার প্রধান তিনি নিজেই। মনোবল বজায় রাখতে সব জেনেও বললেন, মুজিবের নির্দেশেই এই সরকার, তিনি যেমন বলছেন তেমন কাজ হচ্ছে।”
শেখ মুজিবের বক্তব্য থেকে দলিলটির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে যেমন ধারণা লাভ করা যায়, তেমনি “মেজর জিয়া রবিবার ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম রেডিও থেকে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করলেন। তার প্রধান তিনি নিজেই”Ñ এ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশ পরিচালনার একটি রূপরেখা পাওয়া যায়। ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলেন,
ÒThe brilliant success of our fighting forces and the daily additions to their strength in manpower and captured weapons has enabled the Government of the PeopleÕs Republic of Bangladesh, first announced through major Zia Rahman, to set up a fullfledged operational base from which it is administering the liberated areas.Ó
(Bangladesh Document vol-I, Indian Government, page 284).
অর্থাৎ, এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বশূন্য ছিল না। তার ভাষায় মেজর জিয়া রহমান প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সেখান থেকে মুক্ত এলাকা (Liberated Area) শাসিত (Administering)হচ্ছে। তখন পর্যন্ত (১০ এপ্রিল ১৯৭১) জিয়াউর রহমান ব্যতীত সদ্য স্বাধীন যুদ্ধরত দেশের কোনো শাসক, প্রশাসক, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান দাবিদার ছিলেন না। বিষয়টি জনাব তাজউদ্দিনের বক্তব্য দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত। ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ বিষয়ক ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে “ভারত রক্ষক” শিরোনামীয় সাইটে। সেখানে ৯৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৬ তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এবং তিনি “বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের  (Temporary Head of Republic)” দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে তংকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদের রিপোর্টের অংশ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, “২৫ শে মার্চ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান রচনার জন্য সরকার ও আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বিশ্বাসঘাতকতার এক অতুলনীয় ইতিহাস রচনা করে কাউকে কিছু না জানিয়ে, আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা না করে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাতের বেলায় ঢাকা ত্যাগ করেন। তারপরেই পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী টিক্কা খানের ঘাতক সেনারা মধ্যরাতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যার তা-বে মেতে ওঠে। তারই মধ্যে তারা গ্রেফতার করে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৬ শে মার্চ রাতের ভাষণে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করেন। কুর্মীটোলার সেনানিবাসে, পিলখানার ইপিআর সদর দফতরে ও রাজারবাগে পুলিশ লাইনে সশস্ত্র বাঙালিরা অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে আমৃত্যু যুদ্ধ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বস্তি অঞ্চলে এবং সাধারণ মানুষের ওপরে বর্বর পাকসেনারা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তা প্রতিরোধ করার শক্তি ছিল না নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সংগ্রামরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতে পেরে বাংলার মানুষ এক দুর্জয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলল। বাংলাদেশে সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অপূর্ব দক্ষতা, অপরিসীম সাহসিকতা ও অতুলনীয় ত্যাগের মনোভাব নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অগ্রসর হন। মাত্র তিন দিনে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ করতলগত করার যে পরিকল্পনা সামরিক সরকার করেছিল, প্রাণের বিনিময়ে বাংলার মানুষ তাকে সর্বাংশে ব্যর্থ করে দেয়।” (দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল ১৯৭২)।
অর্থাৎ, চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন বিষয়টি দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭২ সালে। কিন্তু এতকাল পরে কেন অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, সেটাই সকলকে ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত দলিল এবং জনাব তাজউদ্দিনের পরিষ্কার বক্তব্য কি দলীয় রাজনীতির কাছে আজ মূল্যহীন? ওপরে বর্ণিত বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত পত্রে কেবল ৭ মার্চের ভাষণের কথা বলেছেন, ২৫ মার্চ রাতে আটক হবার পূর্বে কোনো স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি তিনি কখনই করেননি।
যদিও আগেই বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্ক আজকের বিষয়বস্তু নয়, তথাপি ওপরের আলোচনায় স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি ইতোমধ্যে চলে এসেছে, তাই এ বিষয়ে ২/১টি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কি ছিল সে স্বাধীনতার ঘোষণা? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র, তৃতীয় খন্ডে বর্ণিত আছে সে ঘোষণাটি :  Dear fellow freedom fighters, I, Major Ziaur Rahman, Provisional Persident and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle, Bangladesh is independent. We have waged war for liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from occupation of Pakistan Army. Inshallah, victory is ours.
এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম, মুক্তি বাহিনীর ৩ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য ১৯৮৯ সালে তার রচিত Bangladesh at war গ্রন্থে লিখেন,
‘Having settled his score with his commanding officer on the night of march 25, Zia decided to take his battalion on the outskirts of the city to re-organise, strengthen and then launch a decisive blow on Chittagong. All troops were collected at a place near patiya.
 ……All the troops then took an oath of allegiance to Bangladesh. The oath was administered by Zia at 1600 hrs on March 26. Thereafter, he distributed 350 soldiers of East Bengal Regiment and about 200 troops of East Pakistan Rifles to various task forces under command of an officer each. These task forces were meant for the city. The whole city of Chittagong was divided into various sectors and each sector was given to a task force. After having made these arrangements, Zia made his first announcement on the radio on March 26. In this announcement apart from saying that they were fighting against Pakistan army he also declared himself as the head of the state. This of course could have been the result of tension and confusion of the moment.  As the battalion began to gather strength in the afternoon of March 27, Zia made another announcement from the Shawadhin Bangla Betar Kendra established at Kalurghat. The announcement reads as follows :
a. ‘I Major Zia, provisional commander– in chief of the Bangladesh liberation army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh.‘
 b. ‘I also declare, we have already formed a sovre, legal government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution.‘
 c. ‘The new democratic government is committed to a policy of non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace.‘
 d. ‘I appeal to all governments to mobilize public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh‘
 e. ‘The government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world‘.
He further said, ‘We shall not die like cats and dogs but shall die as worthy citizens of Bangla Ma. Personnel of the East Bengal Regiment, the East Pakistan Rifles and the entire police force had surrounded West Pakistani troops in Chittagong, Comilla, Sylhet, Jessore, Barisal and Khulna. Heavy fighting was continuing.‘
(Bangladesh at war, Academic Publisher, Dhaka 1989, page 44-45).
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিবকে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে বিচারের প্রহসন করে হত্যার উদ্যোগ নিলে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী মুজিবের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে পৃথিবীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী সফরকালে ৬ নবেম্বর ১৯৭১ তারিখে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেন,
‘The cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asks for independence even now.’ (Bangladesh Documents Vol-II, Page-275, 1972). মিসেস গান্ধী নিশ্চিত করেছেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা করে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ মুজিব করেননি। পাক হানাদার বাহিনীর জেনারেল রাও ফরমান আলী স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লিখেছেন, “প্রতিটি বাঙালি ইউনিটই বিদ্রোহ করেছিল, মেজর জিয়াউর রহমান তার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করেছিলেন এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা চট্টগ্রাম শহর দখল করে নিয়েছিলেন।” (বাংলাদেশের জন্ম, ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. পৃষ্ঠা ৮৭)
শেখ হাসিনা সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রখ্যাত আমলা এএমএ মুহিত বলেন, The next evening Major Zia announced the formatica of a provisional, government under his and solicited the support of the world in the liberation of Bangladesh. Major Zia declared allegiame to Sheikh Mujib and on March 30 he made it clear that the struggle was being led by Mujib who was the supreme commander of the liberation from The movement for autonomy for Bangladesh in the Federation of Pakistan was convested into a struggle for liberation with the revolt of East Pakistan Rifles and Bengali Regents of the Pakistan army in Chittagong. (Bangladesh Emergency of a Nation: AMA Muhit page 227).
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের প্রাইভেট সেক্রেটারি জনাব মঈদুল হাসান তরফদার আরো পরিষ্কার করে লিখেন, “২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও, পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।” (মূলধারা : ৭১, ইউপিএল, ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ৫)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মেজর জিয়া পরবর্তীতে শেখ মুজিবের নির্দেশের কথা বললেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা সংশোধন করেননি।
১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারত সফরে গেলে তার সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জিব রেড্ডি তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন, “Our Position is already assumed in the annals of the history of your country as a brave fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh. Since you took over the reign of government in your country, you have earned wide respect both in Bangladesh and abroad as a leader truly dedicated to the progress of your country and the welbeing of your people.Ó (Bangladesh in International Poltics by M. Shamsul Haq, Page 96, 1993.)
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একান্ত সচিব মঈদুল হাসান তরফদার যুদ্ধ শুরুর অবস্থা, কি প্রেক্ষাপটে সৈনিকরা বিদ্রোহ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এমনকি রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনার কথা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পূর্বেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা করেন, “ফেব্রুয়ারি বা সম্ভবত : তার আগে থেকেই যে সমর প্রস্তুতি শুরু, তার অবশিষ্ট আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধূম্রজাল বিস্তার করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুগপৎ সন্দিহান ও আশাবাদী থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত একই কারণে ২৫/২৬ শে মার্চের মধ্যরাতে টিক্কার সমর অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার সপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও সহকর্মীদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব রয়ে গেলেন নিজ বাসভবনে। সেখান থেকে গ্রেফতার হলেন হত্যাযজ্ঞের প্রহরে।”
“এই সব ঘোষণায় বিদ্যুতের মতো লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালিরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বেতারের এসব ঘোষণার পেছনে এ ধরনের রাজনৈতিক অনুমোদন, না ছিল কোনো কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি। প্রথম উদ্যোগ ছিল আক্রান্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর সেনা ও অফিসারদের সমবায়ে গঠিত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল বাঙালি সৈন্য ও অফিসারই যে এতে যোগ দিয়েছিল তা নয়। অনেকে নিরস্ত্রকৃত হয়েছে, অনেকে বন্দী হয়ে থেকেছে, আবার অনেকে শেষ অবধি পাকিস্তানীদের পক্ষে সক্রিয় থেকেছে। বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআরদের অংশগ্রহণ বরং ছিল অনেক বেশি ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত, যেমন ছিল বাঙালি পুলিশদের। মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর মধ্যে বেতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে এই সব স্থানীয় ও খ- বিদ্রোহ দ্রুত সংহত হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হওয়ার বিষয়টি এদের জন্য মুখ্যত ছিল অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উপস্থিত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এই যুদ্ধের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে অধিকাংশের জ্ঞানও ছিল সীমিত। তবু বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথে পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে এদের তাড়া করে নিয়ে যায় যে, এদের জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়। হয় ‘কোর্ট মার্শাল নতুবা স্বাধীনতা’ এ দুটি ছাড়া অপর সকল পথই তাদের জন্য বন্ধ হয়ে পড়ে। এমনিভাবে পাকিস্তানী আক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয় প্রায় এগারো হাজার ইবিআর এবং ইপিআর এর অভিজ্ঞ সশস্ত্র যোদ্ধা কখনও কোনো রাজনৈতিক আপস মীমাংসা ঘটলেও দেশে ফেরার পথ যাদের জন্য ছিল বন্ধ, যতদিন না বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীরা সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়।”
“২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানী আক্রমণ অত্যাসন্ন তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দিনকে ঢাকারই শহরতলীতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন যাতে ‘শীঘ্রই তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন’। তারপর এক নাগাড়ে প্রায় তেত্রিশ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দিনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ শে মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সাথে আলাপ-পরামর্শের কোনো সুযোগ তাজউদ্দিনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোনো বিলম্ব ঘটেনি (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সবশেষে পাল্টা-আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে সঙ্গী তাজউদ্দিন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০ শে মার্চের সন্ধ্যায়। সারা বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহীদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবাল বৃদ্ধবণিতা। স্বাধীনতার জন্য দেশ একতাবদ্ধ (মূলধারা : ৭১)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি ডিক্লাসিফাইড করা বাংলাদেশ সংক্রান্ত দলিলপত্রে উল্লেখ রয়েছে, “On March 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and a provisional government under the leadership of a Major Zia Khan.”
স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তার জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫ পুস্তকে লিখেছেন, “যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত বাংলা জাতীয় লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এমএম আনোয়ারের উদ্যোগে আগরতলা এসেমব্লি মেম্বার রেস্ট হাউসে আমার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মালেক উকিলের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এক দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেন যে, শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্ত অবধি কোনো নির্দেশ দান করেন নাই। এইদিকে মুজিব-ইয়াহিয়ার মার্চ-এর আলোচনার সূত্র ধরে কনফেডারেশন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমঝোতার আলোচনা চলছিল। জনাব মালেক উকিল আমাকে ইহাও জানান যে, তিনি এই আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী। প্রসঙ্গত ইহাও উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে আমি সর্বজনাব আবদুল মালেক উকিল, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান চৌধুরী, আলী আজম, খালেদ মোহাম্মদ আলী, লুৎফুল হাই সাচ্চু প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সহিত বিভিন্ন সময়ে আলোচনাকালে নেতা শেখ মুজিবর রহমান ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দিয়াছিলেন কিনা, জানিতে চাহিয়াছিলাম। তাহারা সবাই স্পষ্ট ভাষায় ও নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে, ২৫ শে মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোনো নির্দেশ দান কিংবা পরামর্শ দান নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। অথচ স্বাধীনতা উত্তরকালে বানোয়াটভাবে বলা হয় যে, তিনি পূর্বাহ্নেই নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন।” (পৃষ্ঠা ৪২৪-৪২৫)। একই বইয়ের ৪২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “আমি মেজর জিয়া বলছি। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করছি।”
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের প্রভিশনাল সরকার সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেখা যেতে পারে।
On March 28 1971, broadcasts from Swadhin Bangla Betar Kendro monitored in India announced that a provisional government of Bangladesh had been formed and that Major Jia Khan had been declared the temporary head of the provisional government. The Kalurghat broadcasts announced that the provisional government ‘would be guided by Bangabandhu Mujibur Rahman.’
The Statesman published from New Delhi on March 29, 1971 reported a speech by Major Zia declaring himself the provisional head. In a broadcast over the Free Bangla Radio Major Zia Khan, commander-in-chief of the liberation army’ said: ’I hereby assume the powers of the provisional head of the liberation army of Swadhin Bangladesh.
’As provisional head I order the freedom fighters of Bangladesh to continue the struggle till ultimate victory. Jai Bangla.’ He said the enemy was bringing additional troops both by the sea and by the air.’
He appealed to all peace-loving peoples of the world to come to help of Òthe democratic minded fighting people of Bangladesh.’
Major Zia claimed that the ’liberation army’ had killed 300 men of the Punjab Regiment at Comilla. Other men of the regiment fled at the end of the fighting.
This report of the formation of a ’provisional government’ with ’Major Zia Khan’ as its temporary head was picked up and widely reported in the world press on March 29, 1971. For example, The Age from Australia reported on March 29.
The Daily Telegraph, ২৯ শে মার্চ ১৯৭১ রিপোর্ট করে, ‘The clandestine Radio Bangladesh, thought to be in the isolated tea plantation area in the north of province last night announced that a provisional government had been set up, headed by Major Zia Khan, chief of the Bangladesh ’Liberation Army’, since March 25.’ (International Press on Bangladesh Liberation war by Dr. M. D. Husain, 1989).
 করাচীর প্রখ্যাত দৈনিক Dawn ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ ভিন্নতর একটি সংবাদ পরিবেশন করে, “ÒThey mentioned the name of Ziaur Rahman, who had proclaimed the independence of Bangladesh declaring himself as head of independent government. He corrected the following day presumably under pressure by saying that the government was set up under the leadership of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman. The Washington Post further reported that General Osmany, Commander-in-Chief of Bangladesh Muktibahini had sacked sector commander Ziaur Rahman. It was intriguing that in spite of censorship this news item was carried in Pakistan controlled newspapers”.
এ থেকে প্রতীয়মান হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সমরাধিনায়করা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিব্রত ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কার টিক্কা খানের পি.আর.ও. সিদ্দিক সালিক তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “Major Zia took control of the transmitters seperately located on Kaptai Road and used the available equipment to broadcast the ‘declaration of independence’ of Bangladesh’. (Witness to Surrender, Page 79).).
প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তার জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫ পুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলেন, “আমি জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম এবং মাঝে মাঝে তাহার অভয়দাস লেনের বাসায় রাত্রিযাপন করিতাম। তাহার বাসায় যাত্রিযাপন করিতে গিয়া তাহারই রেডিও সেটে ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে “স্বাধীন বাংলা রেডিওর” ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশাহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ। ফলে সর্বত্র উচ্চারিত হয় মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীরের পতনের সংকল্প, আওয়াজ উঠে জালেমের নিকট আত্মসমর্পণ নয়, আহ্বান ধ্বনিত হইতে থাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার, প্রতিরোধ শক্তিকে সুসংহতকরণের। এইভাবেই সেদিন জাতি আত্মসম্বিৎ  ফিরিয়া পায় এবং মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ে।”
অস্থায়ী সরকার গঠন সম্পর্কে তাজউদ্দিনের ভাবনা বর্ণনা করেন মঈদুল হাসান এভাবে, “৩রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শুরু করার পূর্বে কয়েকটি মূল বিষয়ে তাজউদ্দিনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনও তিনি দলের নেতৃস্থানীয় অপরাপর সহকর্মীদের সাক্ষাৎ পাননি। তারা জীবিত কি মৃত, পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী কি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায়রত এমন কোনো তথ্যই তখন অবধি তার কাছে পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় তাকে স্থির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের কোনো আশা আছে কি? বস্তুত তাজউদ্দিনের মনে কোনো সন্দেহই ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোনো বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন তবে সেই সরকারের নেতৃস্থানীয় সদস্য হিসেবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসেবেই গণ্য হবে বলে তার ধারণা জন্মায়। ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার’ প্রধান মূল প্রয়োজন দেখা দেয় নবঠিত সরকারের আইনগত ভিত্তি বৈধকরণের জন্যই। তাজউদ্দিনের ১১ই এপ্রিলের প্রথম বেতার বক্তৃতাকে বৈধ সরকার গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্যই ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার’ তারিখ ১০ই এপ্রিল বলে ঘোষণা করা হয়।” (মূলধারা:৭১)
এ থেকে পরিষ্কার যে, ভারত সরকারের সহানুভূতি আদায়ের লক্ষ্যে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা বা নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দিন স্বীয় বিবেচনায় ভারত সরকারের কাছে পেশ করেন যে, শেখ মুজিব আটক হওয়ার পূর্বেই স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন এবং সরকার গঠনের কথা। কিন্তু শেখ মুজিব আটক হওয়ার পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা থেকে ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি। মঈদুল হাসান পরিষ্কার করে লিখেছেন, “২৫ তারিখ রাত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার সপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। তাছাড়া অলি আহাদের জবানীতে দেখা যায় যে, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, ২৫ শে মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোনো নির্দেশ দান কিংবা পরামর্শ দান নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই।
অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, “২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান নিজ দায়িত্বে নিজেকে বাংলাদেশের কমান্ডার ইন চিফ ও প্রভিশনাল রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন। এটা কেউ তাকে বলেনি। এটা ঠিক, কি ঠিক করেননি- তা আমি বলছি না। তিনি একার দায়িত্বে বলেছেন, এটা জানি। যুদ্ধ শুরুর পর পর দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে, সে জন্য দেশের পক্ষে কোনো একটা লোককে কিছু তো বলতে হবে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন। এর আগে রাজনৈতিক নেতারা কেউ কিছু বলেননি। আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে গেলেন ইন্ডিয়ায়। তারা কেউ কোনো স্টেটমেন্ট দিলেন না। শেখ মুজিব নিজে ধরা দিলেন পাকিস্তানের কাছে। আমরা ছোট রেডিও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম কোথাও কিছু শোনা যায় কি না। তখন হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর শুনলাম, অচেনা-অজানা কণ্ঠস্বর, বললেন, মেজর জিয়া বলছি। ২৬ মার্চ তিনি নিজেকে বাংলাদেশের প্রভিশনাল কমান্ডার ইন চিফ ও রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা বলেন এবং স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা মুছে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিংবা অন্য কোনোভাবে ধ্বংস করা হতে পারে। এটা সঠিকভাব বলতে পারব না। ধ্বংসের কাজটি যারা করেছেন, তারা ঠিক করেননি। মুছে ফেলে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে তথ্য উপস্থাপন করলে তা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিলেও মিথ্যা ইতিহাস হতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমানÑ এ কথা আগেও আমি বলেছি। আমার বহু আগের বইতে আমি লিখেছি। তখন কেউ এর কোনো প্রতিবাদ করেনি। কারণ, এটা ধ্রুব সত্য, এর প্রতিবাদ হবে না। স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবুরের কোনো নির্দেশ ছিল না, আওয়ামী লীগের নেতাদেরও কোনো নির্দেশ ছিল না। তার কারণ, তখন শেখ মুজিব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানে স্বেচ্ছায় যান এবং স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায়। এই সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন সবই জানেন। কারণ, তখন তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। তিনি ঘোষণার জন্য কোনো নির্দেশ দেননি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এর কোনো প্রামাণিক সত্য তথ্যও নেই। এটি পরে আওয়ামী লীগ বলেছে। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক। বিএনপি এতদিন এই ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনে কোনো উদ্যোগ কেন নেয়নি, তা আমার জানা নেই। আমি যেটা সত্য সেটা বারবার বলেছি। আমি ‘যখন সময় এলো’ নামে কলকাতা থেকে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে বইটি লিখেছিলাম, সে বইতে স্পষ্টভাবে লিখেছি, জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এছাড়া এই যা বললাম, তার অনেকটাই সেখানে আছে। কিন্তু কোনোদিন সেই বইয়ের কোনো প্রতিবাদ কেউ করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগও প্রতিবাদ করেনি। ওই বই ছ’মাসেই সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমি বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ কোনো দলের সাথে যুক্ত নই। বলা যেতে পারে, প্রথম যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, তখন শেখ সাহেবের খুব কাছে আমি ছিলাম এবং তার মানসিকতাও আমি জানতাম।”
১৯৭২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের উপস্থিতিতে যখন জিয়াউর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়, “২৫ মার্চ পাক বাহিনীর বর্বর হামলার পর চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী ও তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী কর্নেল জিয়াউর রহমান” তুমুল করতালির মধ্যে বক্তৃতা করতে ওঠেন (দৈনিক বাংলা ২০/২/১৯৭২)।
এটা ঐতিহসিক সত্য যে, ২৬ মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জাতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্দেশে ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নিজেকে বাংলাদেশের কমান্ডার ইন চিফ ও প্রভিশনাল সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। ঐ সময়কালে ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো সরকার ছিল না। জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ২৭ মার্চ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু স্বীকৃত “বাংলা নামের দেশ” বইয়ে লিখিত ইতিহাস, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ ও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে পেশ করা রিপোর্ট, ইন্দিরা গান্ধী, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, অলি আহাদ, সৈয়দ আলী আহসান, এ এম এ মুহিত, মঈদুল হাসান, সিদ্দিক সালিক, ভারত সরকারের বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, স্টেটসম্যান, ড’ন, টেলিগ্রাফসহ দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমের রেকর্ড থেকে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার দিন হতে ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ২২ দিন মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ নেতৃত্বশূন্য ছিল না। এ সময়কালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রভিশনাল সরকারের প্রধান ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।
এম এস আলম 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads