সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪

সরকারের অপশাসন সমাজকে অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে


গত ১৯ নবেম্বর তোপখানা রোডে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের স্বনামধন্য একজন আইনজীবীর চেম্বারে গিয়েছিলাম। সেখানে সৈয়দপুর থেকে আসা সত্তুরোর্ধ একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেলাম। তখন প্রায় মাগরিবের সময়। নামাযের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাকে ডাকলাম, বললাম, আসুন নামায পড়ি। তিনি বললেন, বাবা এখন তো নামায পড়তে পারবো না, ওজর আছে। কাপড়-চোপড় ঠিক নেই। ভোর বেলা রওনা হয়ে এই মাত্র উকিল সাবের চেম্বারে এসে পৌঁছেছি। যাই হোক নামায শেষে তার সাথে কিছু কথা বললাম, জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন, উকিল সাবের কাছে কেন এসেছেন? জবাবে বললেন, ভাল নেই। গ্রাম এখন দোজখ হয়ে গেছে। হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি যা জীবনে কখনো দেখিনি তাই হচ্ছে। কারুর নিরাপত্তা নেই। কেউ কাউকে সম্মান করতে চায় না। সালাম দেয় না। তার ভাষায় গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে শত শত বছর ধরে যে সৌহার্দ্য ছিল তা বিলীন হয়ে গেছে। তিনি ঢাকা এসেছেন একটা মসজিদ রক্ষার জন্য। তার পূর্বপুরুষরা মৌখিকভাবে একটি মসজিদের নামে ৩ একর সম্পত্তি ওয়াকফ্ করে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ওজু-গোসলের জন্য একটি পুকুরসহ মসজিদ ভিটি ও ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসভূমি বাবত ছিল এক একর, বাকীটা কৃষি জমি। তার ভাষ্য মতে দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্বপুরুষদের প্রদত্ত মৌখিক ওয়াকফ্ এর ভিত্তিতে মসজিদের সম্পত্তিটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ করে ওয়ারিশদের মধ্য থেকে ৮ জন এই সম্পত্তি জবর দখল করে নেন। ফলে মসজিদটি বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি জানালেন যে তার পূর্বপুরুষদের যারা জমি ওয়াকফ করেছিলেন তাদের ওয়ারিশের সংখ্যা বর্তমানে ৬২ জন। ৮ জন বাদে অবশিষ্ট ৫৪ জন ওয়াকফ এর পক্ষে এবং পূর্ব পুরুষদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আদালতের সহযোগিতায় বিষয়টি সুরাহা করতে চান। ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আচরণে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ বলে মনে হলো।
ওয়াকফের বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক বলে মনে হয়েছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা-দীক্ষা ও মানুষের সেবায় ইসলামী সমাজে ওয়াকফ্ শত শত বছর ধরে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার ওয়াকফ এস্টেট আছে এবং সেগুলো দেখাশোনার জন্য সরকারের একটি দফতরও আছে। এই দফতরের কার্যকারিতা এবং সততা-নিষ্ঠা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে তেমনি ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহের মোতাওয়াল্লী নামে পরিচিত অভিভাবকদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আত্মসাতের বহু নজিরও সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। মৌখিক ওয়াক্ফ সমূহের তো কথাই নেই। মসজিদ, এতিমখানাসহ যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে আমাদের পূর্বপুরুষরা ওয়াক্ফ এ লিল্লাহ করে গেছেন ওয়ারিশদের উচিত তা রক্ষা করা এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করে দেয়া। পূর্বপুরুষদের দান করা সম্পত্তি ফিরিয়ে নিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবেন বলে আশা করে থাকলে সে আশা পূরণ নাও হতে পারে।
(দুই)
গ্রামের মানুষ এখন এক কঠিন অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছেন। ক্ষমতাসীন দল এখন দেশটাকে বিভক্ত করে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, কেউ আর কাউকে আপন ভাবতে পারছেন না। শত শত বছর ধরে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করে এখন তারা শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তে পরস্পর পরস্পরের শত্রুতে পরিগণিত হচ্ছেন। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ সকল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ধ্বংস করে দিচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের খবরাখবর নিয়ে দেখুন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা বেশির ভাগ এখন এলাকায় থাকতে পারছেন না। তাদের জীবন, বাড়িঘর, সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততি কারুরই এখন নিরাপত্তা নেই। মসজিদ থেকে অনেক ইমামকে বের করে দেয়া হয়েছে; যেখানে বের করতে পারেনি সেখানে একই পরিসীমায় নতুন মসজিদ স্থাপন করে মুসল্লীদের বিভক্তি ও বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মাদরাসার শিক্ষকরা কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো দখল করে নেয়া হচ্ছে। নামাযী এবং টুপিধারী ব্যক্তিরা, আলেম হোক কিংবা সাধারণ শিক্ষিত, তাদের মাথার উপর এখন দু’টি খড়গ ঝুলছে, একটি রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর, আরেকটি জেএমবির। কখন কার বিরুদ্ধে তারা কোন অভিযোগ আনেন তারাই শুধু তা জানেন। নতুন বাড়ি করবেন, ব্যবসা শুরু করবেন, মেয়ের বিয়ে দিবেন? ছেলের মুসলমানী করাবেন, চাঁদা তাদের দিতেই হবে। তাদের চাঁদা না দিলে, তাদের কথা না শুনলে ঘরে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি রাখা যায় না, চুরি হয়ে যায়। থানায় জিডি করতে গেলেও আবার তাদের কাছে যেতে হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পরামর্শ না করে থানায় কোনও মামলা না নেয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাকে আসামী করা হবে তাও তাদের সুপারিশ অনুযায়ী করতে হবে। পয়সা দিতে হবে দু’জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্র লীগকে এবং পুলিশকে। না হয় মামলা হবে না। মামলা হলেও যে প্রতিকার হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী হয় তাদের নিজের লোক না হয় অনুগত সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি গ্রামে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে। আবার জ্বেনা-ব্যভিচার তো সর্বকালের সর্ব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যাদের ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে তাদের অনেকেই বেইজ্জতির ভয়ে ঘুমাতে পারেন না। ক্ষমতাসীনরা দেশকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখান থেকে ফিরে আসার জন্য মানুষ রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দলগুলো সক্রিয় না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
চার
২০ নবেম্বর মানব জমিনসহ জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহে একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর প্রকাশিত হয়েছে। মানব জমিনের নাম বললাম এজন্য যে পত্রিকাটি অন্যদের তুলনায় খবরটিকে খুবই গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করেছে। “রিমান্ডে অনিতাকে রোমহর্ষক নির্যাতন” শীর্ষক এই খবরটিতে একজন নারীর ওপর পুলিশী নির্যাতনের যে বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিবেকসম্পন্ন যে কোনও মানুষ শিহরিত না হয়ে পারেন না। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী (যদিও গৃহপালিত) সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সনও নারী। এই অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে একজন সেবিকাকে পুলিশ যে নির্যাতন করেছে সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। একজন পুরুষ নারী নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়েছে। কোতোয়ালী থানার ওসি মনিরুল পাইপ দিয়ে তার মুখে মদ ঢেলে দিয়েছে। বলা হচ্ছে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য এই নির্যাতন করা হয়েছে।
পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের অমানুষিক নির্যাতনের আরো অনেক খবর আমরা এর আগে জেনেছি। একজন সুস্থ মানুষকে তারা সম্পূর্ণ পঙ্গু বানিয়ে চ্যাঙদোলা করে কোর্টে হাজির করে পুনরায় রিমান্ড চেয়েছেন এবং বিচারক এই অবস্থায় আবার রিমান্ড মঞ্জুর করার ন্যায় অমানবিক আদেশ দিয়ে বিচারালয়কে কলঙ্কিত করেছেন ইতোপূর্বে দেশবাসী তা জেনেছেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে অভিযুক্ত নারীর যৌনাঙ্গের ন্যায় সংবেদনশীল শরীরে লাঠি ঢুকিয়ে খোঁচা দেয়ার মতো কাজ কেউ করতে পারে এটা বিশ্বাস করা যায় না। এ ঘটনা ঘটার পর আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ নারী অধিকার নেত্রীরা কিভাবে চুপচাপ বসে আছেন আমি বুঝতে পারি না। কোনও ব্যক্তিকে তার অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করে বিচার করা আইনের পরিপন্থী। আমাদের সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ সত্যটি জানেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। যারা এ কাজে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।
রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন মানবাধিকারের পরিপন্থী। রিমান্ড এবং ৫৪ ধারায় সন্দেহবশত গ্রেফতারে বাংলাদেশ হাইকোর্টের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সরকার এবং পুলিশ বিভাগ ও নিম্ন আদালত এই নির্দেশনাগুলো উপেক্ষা করে চলছে এবং তার জন্য তারা কোনও শাস্তি পাচ্ছে না। এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
১) ডিটেনশান দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২) গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩) গ্রেফতারের কারণ পুলিশকে একটি পৃথক নথিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৪) গ্রেফতারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ উল্লেখ করে পুলিশ তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে এবং ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিবে।
৫) গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে তার কারণ জানাতে হবে।
৬) বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে গ্রেফতার করা হলে এক ঘণ্টার মধ্যে তার আত্মীয়দের টেলিফোনে বা বিশেষ বাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।
৭) গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়দের সাথে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮) গ্রেফতারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও আত্মীয় থাকতে পারবেন।
৯) কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে তাকে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০) জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সংগে সংগে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে যে ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আদালতের এই নির্দেশগুলো ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে এগুলো অমান্য করে চলছে। নিম্ন আদালতও নির্দেশনা মানছে না। সভ্য দেশে আদালতের কাছ থেকে মানুষ ইনসাফ আশা করে নির্যাতন নয়। আমরা আশা করবো আমাদের আদালতগুলো নিরপেক্ষতার প্রতীক হয়ে এই ইনসাফই কায়েম করবেন।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads