জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর
মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত, এর
সঠিক হিসাব বা তালিকা মুক্তিযুদ্ধশেষে করা না হলেও যে সংখ্যাটি এখন সামনে আসছে, তা রীতমতো বিস্ময়কর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ওয়াকেবহাল সূত্র
থেকে পাওয়া সর্বশেষ উপাত্ত যোগ-বিয়োগ করলে ধারণা করা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হতে চলেছে। সর্বশেষ
পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে প্রকাশিত সব
গেজেট মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে দুই লাখ ৯ হাজার ২৮ জন। আর
নতুন করে তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী আবেদনকারীর সর্বশেষ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৩
হাজার ১৭০ জন। অর্থাৎ মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তিন লাখ ৪২ হাজার ১৯৮ জন। সামনে নতুন
যাচাই-বাছাই হবে। তবে পোড়খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা, যাচাইপ্রক্রিয়া অতীতের মতো হলে এ সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা
খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এক দুর্লভ সাক্ষাৎকারে
১৯৭৪ সালে বলেছিলেন, তার বাহিনীতে
মুক্তিযোদ্ধার অনুমিত সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারের মতো। তিনি উল্লেখ
করেছিলেন,
রণাঙ্গনে সক্রিয় যোদ্ধার সংখ্যা ছিল
প্রায় এক লাখ এবং প্রশিক্ষণরত প্রায় ৪০ হাজার, যারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণশিবিরে তখন অবস্থান করছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম
সেক্টর কমান্ডার, ‘এস ফোর্স’ অধিনায়ক মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম বলেছেন, তার জানা মতে, মুক্তিযোদ্ধার
সংখ্যা এক লাখ ২৮ হাজার। তিনিও উল্লেখ করেন, ওই
সময় বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণরত ছিলেন, যাদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। অপর দিকে, মুক্তিযোদ্ধার চার তালিকায় পর্যায়ক্রমে যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা হলো এক. জাতীয় তালিকা এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন, দুই. মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তালিকা ৬৯ হাজার, তিন. মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকা ৮৬ হাজার এবং চার. মুক্তিবার্তা
(লাল বই) এক লাখ ৫৪ হাজার। এ থেকে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা হলো মুক্তিযোদ্ধার
সংখ্যা কোনো তালিকাতেই দেড় লাখের ঊর্ধ্বে ওঠেনি। সংখ্যাটি জেনারেল ওসমানী এবং মেজর
জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহ বর্ণিত সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। মুক্তিযোদ্ধার যে
চারটি তালিকার তথ্য এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো
তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ২০০০ সালের মধ্যে। এতে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৩০ বছর।
দীর্ঘ এ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তালিকাগুলো করা হলেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা
কখনো দেড় লাখ অতিক্রম করেনি। কেবল লাল বইতে এসেছে সর্বোচ্চ সংখ্যা, যা অনুমিত সংখ্যার চেয়ে মাত্র চার হাজার জন বেশি। এ থেকে
মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কম-বেশি দেড় লাখ বলে ধারণা করা যায়। কারণ, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহর দেয়া
সংখ্যা-তথ্যের সাথে এ ধারণা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা বাহুল্য, মুক্তিবাহিনীর জনবল নির্ধারণে যে দু’জন শীর্ষ অধিনায়কের সংখ্যা-তথ্য এখানে মানদণ্ড ধরা হচ্ছে, তাদের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ২০০১ সালের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে
মুক্তিযোদ্ধার গেজেট তৈরির সূত্রপাত ঘটে। বিগত ১৪ বছরে তৈরি গেজেট এবং নতুন করে
তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ আবেদনসহ মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ।
আসন্ন যাচাই-বাছাইতে এ সংখ্যায় বড় ধরনের কোনো হেরফের না ঘটলে মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধির
হার যে পূর্ববর্ণিত হিসাব অনুযায়ী শতভাগের বেশি হবে, সেটা প্রায় নিশ্চিত। অবসরপ্রাপ্ত একজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা
মন্তব্য করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যখন
করা দরকার ছিল তখন তা করা হয়নি। এটা এক ঐতিহাসিক ভুল। আবার তালিকা চূড়ান্ত না করে
নানা ধরনের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এটাই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ।
জেনারেল ওসমানীর তথ্য সঠিক হওয়া সম্পর্কে বলেন, মুক্তিবাহিনীর জনবল সম্পর্কে তারচেয়ে কে আর ভালো জানতেন। তিনি
বলেন,
গত ৪৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা
তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। যুদ্ধে মূল বাহিনীর সক্রিয় অংশ, গেরিলা গ্রুপগুলোর সদস্য, বিএলএফ
সদস্য,
প্রশিক্ষণশিবিরের যোদ্ধারা, অভ্যন্তরীণ বাহিনীগুলোর সদস্য, শব্দসৈনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংগঠকসহ মুক্তিযোদ্ধার মোট সংখ্যা কোনোভাবেই পৌনে দুই লাখের
বেশি হবে না। মুক্তিযোদ্ধার
নির্ভুল তালিকা করতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার চাইলে এটা করতে পারে। আমরা তো অনেক কিছুতেই কমিশন গঠন
করে থাকি। মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ও নির্ভুল তালিকার মতো জাতীয় ইস্যুতে কমিশন হতে
পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে বিএনপি’র চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালের নভেম্বরে। মুক্তিযোদ্ধার
তালিকা করার কাজে মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া
জানতে চাইলে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল
কবির রিজভী আহমেদ বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির
পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি’র গড়া মন্ত্রণালয়ে বসে
একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী যেভাবে কলকাঠি নাড়ছেন তাকে ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব পদক্ষেপ’ বলা যাবে না। যত দূর খোঁজ নিয়েছি, তাতে তথাকথিত এই যাচাই-বাছাইকে ‘আওয়ামী লীগের বৃদ্ধকর্মী পুনর্বাসন কর্মসূচি’ বলাই যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সরকারের
নিজের করা জাতীয় তালিকা স্থগিত করা হয়েছে যদিও প্রায় ৩০ বছর আগে তৈরি করা এ
তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধার নাম নেই। এখন নতুন করে আবার লাখ দেড়েক দরখাস্ত জমা করেছে
সরকার। নতুন এই আবেদনকারীরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ কর্মী এবং অমুক্তিযোদ্ধা বলে
আমরা জানি। আশঙ্কা হচ্ছে, ছদ্মবেশী অমুক্তিযোদ্ধারা
সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন নতুন আবেদন করা অমুক্তিযোদ্ধারা। অনেক
জায়গায় এরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা একজোট হচ্ছেন যাচাই-বাছাই কমিটিকে প্রভাবিত করে
তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে। এতে কোনো বাধা এলে এরা একজোট হয়ে
তা মোকাবেলা করবেন। অপর দিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে চান দলমত নির্বিশেষে
ভুয়ামুক্ত তালিকা। আসন্ন যাচাই-বাছাইকে তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিশাপ থেকে
মুক্তি অর্জনের শেষ সুযোগ মনে করছেন। এ জন্য তারাও হচ্ছেন ঐক্যবদ্ধ। ছয় মাস আগে
অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীরা এখন জেলা-উপজেলা কমান্ডে ক্ষমতাসীন।
যাচাই-বাছাই কমিটির যে কাঠামো করা হয়েছে তাতে কমিটিতে এরাই মূলত ছড়ি ঘোরাবেন। অনেক
জায়গায় নির্বাচনী প্রতিপক্ষ গ্রুপ ঘায়েল করতে যাচাই-বাছাইকে অস্ত্র হিসেবে কাজে
লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন জেলা-উপজেলায় ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের
নিয়ে এমন নোংরা রাজনীতি অনাকাক্সিত।
বশীর আহমেদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন