গত ৭ নবেম্বর দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। ‘এবার নরসিংদীতে ছাত্রলীগ! অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত এই নিবন্ধে পত্রিকাটি লিখেছে, “ছাত্রলীগ এবার হামলা চালিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সাংবাদিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য এবং তিতাস কর্তৃপক্ষের লোকজনের উপর। গত বুধবার নরসিংদীর ভাটপাড়া এলাকায় তিতাস কর্তৃপক্ষ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে পলাশ থানা ছাত্রলীগের নেতারা এই হামলা চালায়। বোঝা যাচ্ছে এই অবৈধ সংযোগের সাথে ওই ছাত্রলীগ নেতাদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তা না হলে তারা সরকারি কার্যক্রমে এভাবে বাধা দিবে কেন? সরকারি দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হিসেবে তাদের তো বরং এতে সহযোগিতা করারই কথা। জানা গেছে ভাটপাড়া ও আসমানীর চর গ্রামে প্রায় এক হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি অবৈধ সংযোগের বিপরীতে ছাত্রলীগ নেতারা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেয়। কাজেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে তাদের এই লাভের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযানে আসা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই বেধড়ক পিটিয়েছে।”
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘সরকারি কার্যক্রমে এভাবে বাধা প্রদানের বিষয়টি কার্যত রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর হামলারই সামিল। এর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এ ব্যাপারে মানুষ সন্দিহান। আমার মনে হয় মানুষের সন্দিহান হবার বিষয়ে যুগান্তরের সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনও কারণ নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও তাদের গায়ে হাত তোলার বিষয়টি নতুন কোনও ঘটনা নয়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতঃপূর্বেও এ ধরনের বহু ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। তাদের হাত থেকে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যও রেহাই পায়নি। এজন্য তাদের শাস্তিও হয়নি। বরং সরকার ও সরকারি দল এর দায় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের উপর চাপিয়েছেন। তারা বলেছেন, ছাত্রদল ও শিবিরের ছেলেরা ছাত্রলীগে ঢুকে নানা অপরাধে ছাত্রলীগকে জড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল তাদের চিহ্নিত করার জন্য একাধিক কমিটিও গঠন করেছে। কিন্তু অদ্যাবধি দেশবাসীকে তার ফলাফল জানাতে পারেনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগের অপকর্ম অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারি দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সাহস পায়নি। অবশ্য রক্ত, পায়খানা, পেশাব পরীক্ষা করে পাবনার নেতৃত্ব নির্বাচনের একটা নাটক সরকার মঞ্চায়ন করে ২০১০ সালের দিকে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিলেন। অধুনা যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে সহজেই মহাভারতের ন্যায় একটি সাহিত্য রচনা করা যায়। আসলে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একটি মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হতে দেখা গেছে। তাদের বেপরোয়া আচরণ দেশের শুধু শিক্ষা নয় রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকেও ধ্বংসের শেষপ্রান্তে নিয়ে পৌঁছিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজসমূহে তাদের বেপরোয়া তৎপরতা ছাত্র, অভিভাবক এবং শিক্ষানুরাগীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা চর দখলের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখলে শুধু তৎপর হয়ে ওঠেনি পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতায় চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, হল থেকে প্রতিপক্ষ ও নিরপেক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছেদ করে পয়সার বিনিময়ে সীট বিতরণ বাণিজ্যেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি সরকার প্রধানের নজরে আসে এবং প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকার প্রধান প্রথমত এতে অত্যন্ত নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এবং এই মর্মে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যে, দীর্ঘকাল তাদের দলীয় কর্মীরা কিছু উপার্জন করতে পারেনি। এখন প্রথম সুযোগে যদি কিছু উপার্জন করে নেয় তাতে দোষের কিছু আছে বলে মনে করা উচিত নয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের শীর্ষমহল ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী যুবলীগকে ৬ মাসের সময় বেঁধে দিয়ে কামাই-রোজগারের পর্ব শেষ করার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবং বলে দিয়েছিলেন যে, এরপর তাদের আর এই সুযোগ দেয়া হবে না। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তা মানেনি। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা আরো লোভী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের লালসার লেলিহান শিখা রাজনৈতিক আধিপত্যের অঙ্গন থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতির সকল মূল্যবোধকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসবাদী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, ভর্তি বাণিজ্য প্রভৃতি দেশের দেশপ্রেমিক মহল এমন কি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদেরও উৎকণ্ঠিত করে তোলে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা ছাত্রলীগের অপকর্মকে ভিত্তি করে এক বছরের মাথায় একটি Suppliment প্রকাশ করে। এতে সরকার প্রধানের কিছু টনক নড়ে। তিনি ছাত্রলীগের অপকর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে দেশবাসীর একটি উপকার হয়েছে এবং সেটা হচ্ছে এতদিন পর্যন্ত তারা জানতেন না যে, শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বের পদ অলংকৃত করে আছেন। এখন তারা জানলেন এবং তারা এটাও জানলেন যে, তার সাংগঠনিক নেতৃত্বাধীন এই সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পূর্ববর্তী মেয়াদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালনসহ এ যাবত যতো কলঙ্কজনক কাজে তাদের ‘কৃতিত্ব’ দেখিয়েছে তার সব দায়ভার তার ওপরও বর্তায়। এটা বাংলাদেশের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের জন্য সুখকর ছিলো না। ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, দুর্বৃত্তপনা এবং অনৈতিক কর্মকান্ডে স্বয়ং আওয়ামী লীগের একটি অংশ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ঘরানার শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরাও তাদের ঠেকানোর জন্যে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। মরহুম বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার এক বক্তৃতায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগসহ সরকারি দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনসমূহের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, অস্ত্রবাজি প্রভৃতির কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে ‘বাজিকর সরকার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং কট্টরপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু দল ও সরকারের যে আচরণের প্রতি রুষ্ট হয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্ব এই কঠোর মন্তব্যটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই আচরণ থেকে সরকার সরে আসেননি। বরং তাদের প্রশ্রয়ে দলটির ছাত্র ও যুব সংগঠনদ্বয় বাজিকরী কাজকে আরো শাণিত ও সম্প্রসারিত করেছে। সরকারি দল বিরোধী দল দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং ভর্তি বাণিজ্যে অবাধ লাইসেন্স পেয়ে সংগঠনটি অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আন্তঃদলীয় কোন্দলেও লিপ্ত হয়েছে এবং এর পরিণতি হিসেবে তাদের নিজেদের হাতেই নিজেদের ৮০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ভিনদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও নিজ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করার জন্য ভাড়াটে হিসেবে এদের ব্যবহারের সংস্কৃতিও চালু করেছে। ফলে ছাত্রলীগ নামটি এখন দেশবাসীর কাছে একটি ত্রাসের নাম। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসমূহের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দুইশত বছরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ অন্তত ১১০০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এই সংঘর্ষসমূহের স্থিতিকালকে যদি বিবেচনায় আনা হয় তাহলে দেখা যায় যে, ছাত্রলীগের হামলার কারণে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ ৭৩০ দিন অর্থাৎ দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ ছিলো। এটা হচ্ছে একটি সাধারণ হিসাব। এই হিসাবের বাইরের যে বাস্তবতা তা হচ্ছে, ছাত্রলীগের হামলার কারণে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক নাগাড়ে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত বন্ধ ছিলো। এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে সরকারপন্থী শিক্ষকদের যোগসাজশও কম ছিলো না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার অবস্থা কি ছিলো বা আদৌ সেখানে লেখাপড়ার পরিবেশ এখন আছে কিনা? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করা যাদের দায়িত্ব তারা তা করছেন না। সবকটি সাধারণ, কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং পেশাজীবী ইনস্টিটিউটসমূহে ছাত্রলীগের দাপটে শিক্ষকরা কাজ করতে পারেন না। বিনা প্ররোচনায় ছাত্রলীগের নেতকর্মীরা শিক্ষাঙ্গনে শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে সাধারণ ছাত্রদের অহরহ শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে। তাদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে। তাদের মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাদের আবাসিক হল বা মেসে হামলা করে সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। ক্লাস করতে দিচ্ছে না। পরীক্ষা দিতে আসলে শিক্ষকদের সামনে এমন কি প্রশাসনের নাকের ডগায় তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এর কোনো প্রতিকার নেই। সরকার এখানে নীরব। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তারা যখন নিজেরা নিজেদের হাতে মরছে, প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ছে, ভিসিসহ শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন তখন বড় জোর যেটা করা হচ্ছে সেটা হলো দল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার। এই বহিষ্কার হওয়ার পর দেখা গেছে যে, বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা আরো প্রতাপশালী হয়ে উঠছে এবং এই বহিষ্কারের সাথে যারা জড়িত সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তারাই তাদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করছে। তাদের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচার ছাড়াও ছাত্রলীগ দেশের গার্লস কলেজসমূহে বিশেষ করে ইডেন, বদরুন্নেসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্মীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে দেশব্যাপী ইভটিজিংয়ের নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির কাজে ছাত্রলীগ, যুবলীগের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার যে দৃষ্টান্ত অদ্যাবধি প্রমাণিত হয়েছে আমাদের মাননীয় নারী প্রধানমন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এর বিরুদ্ধে যেমন টু শব্দটি করেননি তেমনি তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ করলেই সাত খুন মাফ। এই ধারণাটিই তারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন মাত্র। বহিষ্কার ও তিরস্কার মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধের শাস্তি হতে পারে না। এর সাথে সাথে যদি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হতো এবং বিনা জামিনে তাদের আটক রাখা যেতো, তাহলে হয়তো তাদের আচরণ কিছুটা সংযত হতো। কিন্তু তা করা হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ সরাসরিভাবে বহু খুনের সাথে জড়িত ছিল। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা মেডিকেলে তাদের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগেরই সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ নিহত হয়। একই বছরের মার্চ মাসে তাদেরই হামলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী শহীদ হন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিভাবান নির্দলীয় ছাত্র আবু বকর নিহত হন। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট কুপন বিতরণকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের দোতলা থেকে তাদেরই এক কর্মী নাসিমকে নীচে ফেলে দিয়ে তারা হত্যা করে। একই বছর ছাত্রলীগ রাজশাহী পলিটেকনিকের ছাত্রমৈত্রীর নেতা রেদোয়ান চৌধুরীকে হত্যা করে এবং ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের ২ জন নেতা মুজাহিদ ও মাসুদকে নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছে। প্রত্যক্ষ এই খুনগুলো ছাড়াও তারা আগে অসংখ্য পরোক্ষ খুনের সাথে জড়িত। এক্ষেত্রে পুলিশ এবং সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সরকার বরাবরই বলে বেড়াচ্ছেন যে, তারা আইনের শাসন কায়েম করতে চান এবং এজন্য অতীতের সব খুনের বিচার হওয়া ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে যে, তারা এবং তাদের দলের লোকেরা যেসব হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন তাকে তারা আদৌ হত্যাকা- হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।
নিজেরা মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থেকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বানোয়াট মানবতাবিরোধী অপরাধ অনুসন্ধান এবং তার বিচারে তারা লিপ্ত রয়েছেন। এখানে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের দুজন নেতাকে হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে তাতে দলমত নির্বিশেষে সকল পত্র-পত্রিকাই ছাত্রলীগকে এর জন্য দায়ী বলে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন এ হত্যাযজ্ঞের জন্য যে মামলা করেছেন তাতে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়নি। বরং আসামী করা হয়েছে ছাত্রশিবিরের নিরপরাধ ১২ জন নেতাকর্মীকে, যারা মজলুম এবং ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের নির্মমতার শিকার। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ ব্যাপারে আমাদের বেশিরভাগ অন্ধ ও বিবেক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা কোনো কথা বলেন না। অবশ্য তাদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে কিছু বলার চেষ্টা যে করেন না তা নয় তবে রিজার্ভেশন রেখেই বলেন। মুনতাসির মামুন একবার ‘দুর্বৃত্তহীন ছাত্রলীগ সবার কাম্য’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তার মতে, স্বাধীনতার পর ছাত্ররা ক্ষমতার স্বাদ পায় এবং এই প্রথম তারা মারণাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি আরো বলেছেন যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দাপট ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কথা দেশবাসী ভোলেনি। তিনি স্বীকার করেছেন যে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। আবার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মুনতাসির মামুনের মূল্যায়ন হচ্ছে, যেহেতু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় (আশরাফ ও হানিফের প্রেস কনফারেন্স ছাড়া) সেহেতু ছাত্রলীগের কার্যকলাপ আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যকলাপ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। আবার উপাচার্য যেহেতু নিযুক্ত হন দলীয় বিবেচনায় সে জন্য তিনি সম্পৃক্ত থাকেন সরকারি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে। এক্ষেত্রে অবশ্য অভিজ্ঞজন ও বিশ্লেষকরা স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পান না। তাদের দলীয় অসহিষ্ণুতা এবং এক নায়কত্ববাদী চিন্তা-চেতনা, প্রতিপক্ষ নির্মূলপ্রবণতা এবং দেশকে উত্তরাধিকার সম্পত্তি গণ্য করার স্পৃহা তখনো ছিল এখনো রয়েছে এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোকে তারা সর্বদা এ কাজেই ব্যবহার করেছেন। স্বয়ং রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানও এই রোগ থেকে মুক্ত ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ভাই?) তার রচিত নিস্তব্ধতার সংস্কৃতি (ডানা প্রকাশনীর কাজী মুকুল কর্তৃক ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত) শীর্ষক পুস্তকের ৩৭ পৃষ্ঠায় এর একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘শেখ মুজিবর রহমানের পুত্র শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন আমার কক্ষে প্রবেশ করে আমার বুকে পিস্তল চেপে ধরে। আমার অপরাধ সরকার বিরোধী খবরের কাগজগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকের সঙ্গে আমি যৌথ বিবৃতি দিয়েছি। শেখ কামাল যে বিভাগের ছাত্র সেই বিভাগে তখন আমি একজন শিক্ষক। সেই বিবৃতি কর্তৃপক্ষের ক্রোধ উদ্রেকের যথেষ্ট কারণ শেখ কামালের বিভাগীয় একজন শিক্ষকের স্পর্ধা (মালিকানার বোধ কি প্রচন্ড)। সেই ক্রোধ বারুদে বদলে দিয়েছিল।’’ এই উদ্ধৃতিটি আমি এজন্য দিলাম যে আসলে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের জন্য নতুন কিছু নয়, এটা তাদের উত্তরাধিকার। আজকে ছাত্রলীগের পুরাতন নেতারা তাদের অতীত নিয়ে গর্ব করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিজেদের ফেরেশতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন এটা তাদের একটা প্রতারণা মাত্র। তাদের তৎপরতায় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ছাত্র আন্দোলন থেকে দেশের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। ছাত্রনেতারা শিক্ষাপর্ব শেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব হাতে নেন। ছাত্রলীগ উচ্ছন্নে গেছে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, সন্ত্রাস ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে দেশের পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। অন্যান্য দলের মেধাবী ও চরিত্রবান ছাত্র নেতাদের হত্যা করে তারা দেশকে ধ্বংস করার যে আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে তা অবিলম্বে রোধ করা দরকার বলে আমি মনে করি।
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘সরকারি কার্যক্রমে এভাবে বাধা প্রদানের বিষয়টি কার্যত রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর হামলারই সামিল। এর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এ ব্যাপারে মানুষ সন্দিহান। আমার মনে হয় মানুষের সন্দিহান হবার বিষয়ে যুগান্তরের সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনও কারণ নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও তাদের গায়ে হাত তোলার বিষয়টি নতুন কোনও ঘটনা নয়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতঃপূর্বেও এ ধরনের বহু ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। তাদের হাত থেকে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যও রেহাই পায়নি। এজন্য তাদের শাস্তিও হয়নি। বরং সরকার ও সরকারি দল এর দায় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের উপর চাপিয়েছেন। তারা বলেছেন, ছাত্রদল ও শিবিরের ছেলেরা ছাত্রলীগে ঢুকে নানা অপরাধে ছাত্রলীগকে জড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল তাদের চিহ্নিত করার জন্য একাধিক কমিটিও গঠন করেছে। কিন্তু অদ্যাবধি দেশবাসীকে তার ফলাফল জানাতে পারেনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগের অপকর্ম অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারি দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সাহস পায়নি। অবশ্য রক্ত, পায়খানা, পেশাব পরীক্ষা করে পাবনার নেতৃত্ব নির্বাচনের একটা নাটক সরকার মঞ্চায়ন করে ২০১০ সালের দিকে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিলেন। অধুনা যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে সহজেই মহাভারতের ন্যায় একটি সাহিত্য রচনা করা যায়। আসলে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একটি মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হতে দেখা গেছে। তাদের বেপরোয়া আচরণ দেশের শুধু শিক্ষা নয় রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকেও ধ্বংসের শেষপ্রান্তে নিয়ে পৌঁছিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজসমূহে তাদের বেপরোয়া তৎপরতা ছাত্র, অভিভাবক এবং শিক্ষানুরাগীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা চর দখলের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখলে শুধু তৎপর হয়ে ওঠেনি পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতায় চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, হল থেকে প্রতিপক্ষ ও নিরপেক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছেদ করে পয়সার বিনিময়ে সীট বিতরণ বাণিজ্যেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি সরকার প্রধানের নজরে আসে এবং প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকার প্রধান প্রথমত এতে অত্যন্ত নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এবং এই মর্মে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যে, দীর্ঘকাল তাদের দলীয় কর্মীরা কিছু উপার্জন করতে পারেনি। এখন প্রথম সুযোগে যদি কিছু উপার্জন করে নেয় তাতে দোষের কিছু আছে বলে মনে করা উচিত নয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের শীর্ষমহল ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী যুবলীগকে ৬ মাসের সময় বেঁধে দিয়ে কামাই-রোজগারের পর্ব শেষ করার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবং বলে দিয়েছিলেন যে, এরপর তাদের আর এই সুযোগ দেয়া হবে না। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তা মানেনি। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা আরো লোভী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের লালসার লেলিহান শিখা রাজনৈতিক আধিপত্যের অঙ্গন থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতির সকল মূল্যবোধকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসবাদী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, ভর্তি বাণিজ্য প্রভৃতি দেশের দেশপ্রেমিক মহল এমন কি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদেরও উৎকণ্ঠিত করে তোলে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা ছাত্রলীগের অপকর্মকে ভিত্তি করে এক বছরের মাথায় একটি Suppliment প্রকাশ করে। এতে সরকার প্রধানের কিছু টনক নড়ে। তিনি ছাত্রলীগের অপকর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে দেশবাসীর একটি উপকার হয়েছে এবং সেটা হচ্ছে এতদিন পর্যন্ত তারা জানতেন না যে, শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বের পদ অলংকৃত করে আছেন। এখন তারা জানলেন এবং তারা এটাও জানলেন যে, তার সাংগঠনিক নেতৃত্বাধীন এই সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পূর্ববর্তী মেয়াদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালনসহ এ যাবত যতো কলঙ্কজনক কাজে তাদের ‘কৃতিত্ব’ দেখিয়েছে তার সব দায়ভার তার ওপরও বর্তায়। এটা বাংলাদেশের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের জন্য সুখকর ছিলো না। ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, দুর্বৃত্তপনা এবং অনৈতিক কর্মকান্ডে স্বয়ং আওয়ামী লীগের একটি অংশ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ঘরানার শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরাও তাদের ঠেকানোর জন্যে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। মরহুম বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার এক বক্তৃতায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগসহ সরকারি দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনসমূহের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, অস্ত্রবাজি প্রভৃতির কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে ‘বাজিকর সরকার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং কট্টরপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু দল ও সরকারের যে আচরণের প্রতি রুষ্ট হয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্ব এই কঠোর মন্তব্যটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই আচরণ থেকে সরকার সরে আসেননি। বরং তাদের প্রশ্রয়ে দলটির ছাত্র ও যুব সংগঠনদ্বয় বাজিকরী কাজকে আরো শাণিত ও সম্প্রসারিত করেছে। সরকারি দল বিরোধী দল দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং ভর্তি বাণিজ্যে অবাধ লাইসেন্স পেয়ে সংগঠনটি অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আন্তঃদলীয় কোন্দলেও লিপ্ত হয়েছে এবং এর পরিণতি হিসেবে তাদের নিজেদের হাতেই নিজেদের ৮০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ভিনদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও নিজ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করার জন্য ভাড়াটে হিসেবে এদের ব্যবহারের সংস্কৃতিও চালু করেছে। ফলে ছাত্রলীগ নামটি এখন দেশবাসীর কাছে একটি ত্রাসের নাম। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসমূহের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দুইশত বছরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ অন্তত ১১০০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এই সংঘর্ষসমূহের স্থিতিকালকে যদি বিবেচনায় আনা হয় তাহলে দেখা যায় যে, ছাত্রলীগের হামলার কারণে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ ৭৩০ দিন অর্থাৎ দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ ছিলো। এটা হচ্ছে একটি সাধারণ হিসাব। এই হিসাবের বাইরের যে বাস্তবতা তা হচ্ছে, ছাত্রলীগের হামলার কারণে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক নাগাড়ে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত বন্ধ ছিলো। এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে সরকারপন্থী শিক্ষকদের যোগসাজশও কম ছিলো না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার অবস্থা কি ছিলো বা আদৌ সেখানে লেখাপড়ার পরিবেশ এখন আছে কিনা? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করা যাদের দায়িত্ব তারা তা করছেন না। সবকটি সাধারণ, কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং পেশাজীবী ইনস্টিটিউটসমূহে ছাত্রলীগের দাপটে শিক্ষকরা কাজ করতে পারেন না। বিনা প্ররোচনায় ছাত্রলীগের নেতকর্মীরা শিক্ষাঙ্গনে শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে সাধারণ ছাত্রদের অহরহ শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে। তাদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে। তাদের মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাদের আবাসিক হল বা মেসে হামলা করে সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। ক্লাস করতে দিচ্ছে না। পরীক্ষা দিতে আসলে শিক্ষকদের সামনে এমন কি প্রশাসনের নাকের ডগায় তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এর কোনো প্রতিকার নেই। সরকার এখানে নীরব। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তারা যখন নিজেরা নিজেদের হাতে মরছে, প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ছে, ভিসিসহ শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন তখন বড় জোর যেটা করা হচ্ছে সেটা হলো দল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার। এই বহিষ্কার হওয়ার পর দেখা গেছে যে, বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা আরো প্রতাপশালী হয়ে উঠছে এবং এই বহিষ্কারের সাথে যারা জড়িত সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তারাই তাদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করছে। তাদের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচার ছাড়াও ছাত্রলীগ দেশের গার্লস কলেজসমূহে বিশেষ করে ইডেন, বদরুন্নেসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্মীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে দেশব্যাপী ইভটিজিংয়ের নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির কাজে ছাত্রলীগ, যুবলীগের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার যে দৃষ্টান্ত অদ্যাবধি প্রমাণিত হয়েছে আমাদের মাননীয় নারী প্রধানমন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এর বিরুদ্ধে যেমন টু শব্দটি করেননি তেমনি তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ করলেই সাত খুন মাফ। এই ধারণাটিই তারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন মাত্র। বহিষ্কার ও তিরস্কার মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধের শাস্তি হতে পারে না। এর সাথে সাথে যদি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হতো এবং বিনা জামিনে তাদের আটক রাখা যেতো, তাহলে হয়তো তাদের আচরণ কিছুটা সংযত হতো। কিন্তু তা করা হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ সরাসরিভাবে বহু খুনের সাথে জড়িত ছিল। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা মেডিকেলে তাদের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগেরই সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ নিহত হয়। একই বছরের মার্চ মাসে তাদেরই হামলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী শহীদ হন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিভাবান নির্দলীয় ছাত্র আবু বকর নিহত হন। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট কুপন বিতরণকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের দোতলা থেকে তাদেরই এক কর্মী নাসিমকে নীচে ফেলে দিয়ে তারা হত্যা করে। একই বছর ছাত্রলীগ রাজশাহী পলিটেকনিকের ছাত্রমৈত্রীর নেতা রেদোয়ান চৌধুরীকে হত্যা করে এবং ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের ২ জন নেতা মুজাহিদ ও মাসুদকে নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছে। প্রত্যক্ষ এই খুনগুলো ছাড়াও তারা আগে অসংখ্য পরোক্ষ খুনের সাথে জড়িত। এক্ষেত্রে পুলিশ এবং সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সরকার বরাবরই বলে বেড়াচ্ছেন যে, তারা আইনের শাসন কায়েম করতে চান এবং এজন্য অতীতের সব খুনের বিচার হওয়া ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে যে, তারা এবং তাদের দলের লোকেরা যেসব হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন তাকে তারা আদৌ হত্যাকা- হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।
নিজেরা মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থেকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বানোয়াট মানবতাবিরোধী অপরাধ অনুসন্ধান এবং তার বিচারে তারা লিপ্ত রয়েছেন। এখানে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের দুজন নেতাকে হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে তাতে দলমত নির্বিশেষে সকল পত্র-পত্রিকাই ছাত্রলীগকে এর জন্য দায়ী বলে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন এ হত্যাযজ্ঞের জন্য যে মামলা করেছেন তাতে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়নি। বরং আসামী করা হয়েছে ছাত্রশিবিরের নিরপরাধ ১২ জন নেতাকর্মীকে, যারা মজলুম এবং ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের নির্মমতার শিকার। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ ব্যাপারে আমাদের বেশিরভাগ অন্ধ ও বিবেক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা কোনো কথা বলেন না। অবশ্য তাদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে কিছু বলার চেষ্টা যে করেন না তা নয় তবে রিজার্ভেশন রেখেই বলেন। মুনতাসির মামুন একবার ‘দুর্বৃত্তহীন ছাত্রলীগ সবার কাম্য’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তার মতে, স্বাধীনতার পর ছাত্ররা ক্ষমতার স্বাদ পায় এবং এই প্রথম তারা মারণাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি আরো বলেছেন যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দাপট ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কথা দেশবাসী ভোলেনি। তিনি স্বীকার করেছেন যে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। আবার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মুনতাসির মামুনের মূল্যায়ন হচ্ছে, যেহেতু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় (আশরাফ ও হানিফের প্রেস কনফারেন্স ছাড়া) সেহেতু ছাত্রলীগের কার্যকলাপ আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যকলাপ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। আবার উপাচার্য যেহেতু নিযুক্ত হন দলীয় বিবেচনায় সে জন্য তিনি সম্পৃক্ত থাকেন সরকারি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে। এক্ষেত্রে অবশ্য অভিজ্ঞজন ও বিশ্লেষকরা স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পান না। তাদের দলীয় অসহিষ্ণুতা এবং এক নায়কত্ববাদী চিন্তা-চেতনা, প্রতিপক্ষ নির্মূলপ্রবণতা এবং দেশকে উত্তরাধিকার সম্পত্তি গণ্য করার স্পৃহা তখনো ছিল এখনো রয়েছে এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোকে তারা সর্বদা এ কাজেই ব্যবহার করেছেন। স্বয়ং রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানও এই রোগ থেকে মুক্ত ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ভাই?) তার রচিত নিস্তব্ধতার সংস্কৃতি (ডানা প্রকাশনীর কাজী মুকুল কর্তৃক ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত) শীর্ষক পুস্তকের ৩৭ পৃষ্ঠায় এর একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘শেখ মুজিবর রহমানের পুত্র শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন আমার কক্ষে প্রবেশ করে আমার বুকে পিস্তল চেপে ধরে। আমার অপরাধ সরকার বিরোধী খবরের কাগজগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকের সঙ্গে আমি যৌথ বিবৃতি দিয়েছি। শেখ কামাল যে বিভাগের ছাত্র সেই বিভাগে তখন আমি একজন শিক্ষক। সেই বিবৃতি কর্তৃপক্ষের ক্রোধ উদ্রেকের যথেষ্ট কারণ শেখ কামালের বিভাগীয় একজন শিক্ষকের স্পর্ধা (মালিকানার বোধ কি প্রচন্ড)। সেই ক্রোধ বারুদে বদলে দিয়েছিল।’’ এই উদ্ধৃতিটি আমি এজন্য দিলাম যে আসলে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের জন্য নতুন কিছু নয়, এটা তাদের উত্তরাধিকার। আজকে ছাত্রলীগের পুরাতন নেতারা তাদের অতীত নিয়ে গর্ব করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিজেদের ফেরেশতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন এটা তাদের একটা প্রতারণা মাত্র। তাদের তৎপরতায় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ছাত্র আন্দোলন থেকে দেশের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। ছাত্রনেতারা শিক্ষাপর্ব শেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব হাতে নেন। ছাত্রলীগ উচ্ছন্নে গেছে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, সন্ত্রাস ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে দেশের পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। অন্যান্য দলের মেধাবী ও চরিত্রবান ছাত্র নেতাদের হত্যা করে তারা দেশকে ধ্বংস করার যে আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে তা অবিলম্বে রোধ করা দরকার বলে আমি মনে করি।
ড. মোঃ নূরুল আমিন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন