রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারা প্রসঙ্গ কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ


গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দল হলো ‘লাইফ লাইন’ বা ‘প্রাণ-প্রবাহ’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিগম্যান্ড নিউম্যান এ একথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, রাজনৈতিক দল ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা অচল। পরিপুষ্ট দল ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো চলতেই পারে না। এজন্যই দলকে ‘প্রাণ-প্রবাহ’ বলা হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা বিশ্বের যেসব দেশে উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল রয়েছে। আর আমাদের দেশে? রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা আর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে কার্যক্রম চালাতে পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীকে কাজ করতেই দেওয়া হচ্ছে না। খোদ আওয়ামী লীগও নিজের দলীয় চরিত্র নষ্ট করে গোষ্ঠী চরিত্রে পরিণত হয়েছে। যারা গণতন্ত্র চায়, তারা তো বিরোধী দল আর নিজের দলকে দুর্বল করে না? নিজের আর অপরের রাজনৈতিক দলকে দুর্বল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি বা প্রত্যাশা করা তো ‘সোনার পাথর বাটি’।
বিরোধী দলের প্রতি আক্রমণের কথা তো সবারই জানা। খোদ আওয়ামী লীগে কি হচ্ছে? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, প্রধান ঘাঁটি গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ঘাঁটি কিশোরগঞ্জে দল ভালো নেই। ভারপ্রাপ্তের ঠেলায় দল ন্যুব্জ। কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন নেই দেড় দশক ধরে। সভাপতির পদে একজন বয়স্ক ভারপ্রাপ্ত আছেন। তাকে ঘিরে অতি বয়স্ক কয়েকজন সহ-সভাপতি আছেন, যাদের অধিকাংশই ভয়ানকভাবে অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম। একজন আবার বাইপাসের রোগী ও সরকারি পদাধিকারী। সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ভারপ্রাপ্তের ভারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ মূল সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুর পর একজন ভারপ্রাপ্ত হন, কিছুদিন বাদে তার মৃত্যুর পর আরেকজন ভারপ্রাপ্ত (২য়) হয়ে এখন বেসামাল। কখনো সাধারণ সম্পাদক হওয়ার চিন্তা করেনি, এমন লোকের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সুযোগে নিজের আর্থিক ও ব্যক্তিগত আখের গোছানোই এখন তার কাছে মুখ্য। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের অন্যান্য পদের কথা বলার মতো নয়। পরিবারতন্ত্রের ঝান্ডা হাতে আবদুল হামিদ পরিবার আর সৈয়দ নজরুল পরিবার মুখোমুখি। কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ এখন পরিবারতন্ত্রের শিকার। অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্য এটা কোনো বিচিত্র বিষয় নয়।
দলের নেতৃত্বের মধ্যে এমনই স্থবিরতার পর গণতান্ত্রিক কাউন্সিলের আশা করা বাতুলতা মাত্র। জেলার ১৩টি উপজেলায় কাউন্সিল করাই সম্ভব হয়নি। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, করিমগঞ্জ উপজেলার কাউন্সিলে দুই গ্রুপের মুখোমুখি সংঘর্ষ থামাতে প্রশাসনকে কমপক্ষে ১০টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। তাছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানের কাউন্সিলে জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতারা অতিথি হিসাবে গিয়ে গ্রুপিং উস্কে দিয়ে এসেছেন। তারা চাচ্ছেন, শীর্ষ নেতৃত্বের পদলেহন করে কাউন্সিল ছাড়াই মনোনয়নে দলের পদ-পদবী হাসিল করতে। এক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে হবেন, সেটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষায়, সততায়, দলের প্রতি নিষ্ঠায়, দক্ষতায়, পরিশ্রমে কে কিশোরগঞ্জে দলের ঝান্ডা যোগ্যতার সাথে ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পারবেন, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। এই পদে এখন তিনভাবে যোগ্য লোক বাছাই করা সম্ভব: ১. কাউন্সিলের মাধ্যমে; ২. প্রেসিডেন্টের পছন্দের কাউকে, বা ৩. সৈয়দ আশরাফের পছন্দের কাউকে বসিয়ে দিয়ে। অবশ্য, শেষ কথা নেত্রী শেখ হাসিনাই বলবেন। এটাই আওয়ামী লীগের দস্তুর। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে গণতন্ত্রের চর্চার ভবিষ্যৎও এখন শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভরশীল।
ঐতিহ্যগতভাবে কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগ সৈয়দ নজরুল বা আবদুল হামিদের আমলেও কাউন্সিল বা গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে যায়নি। এবার যদি তার ব্যতিক্রম ঘটে, তবে সেটা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক উত্তরণ না হয়ে অবক্ষয় হবে। তদুপরি আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব বছরের পর বছর সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। দলে প্রেসিডেন্ট-পুত্র ও সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক, সাবেক-প্রেসিডেন্ট পুত্র নাজমুল হাসান পাপন, এমপি আফজাল ও উপজেলা চেয়ারম্যান সারোয়ার (বাজিতপুর), কুলিয়ারচরের নতুন সভাপতি শিল্পপতি মুসা মিয়ার পুত্র প্রমুখ দলের উদীয়মান নেতা। দলে নবীন-প্রবীণ সমন্বয় করতে না পারলে আওয়ামী ঘাঁটি হিসাবে কিশোরগঞ্জের পতন অনিবার্য।
যে কথার উল্লেখ শুরুতেই করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক দল হলো রাজনীতির প্রাণ-প্রবাহ। সে প্রাণ যদি মুখ থুবড়ে পড়ে তাহলে সে স্থান দখল করে অগণতান্ত্রিক, পেশী শক্তি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, এটা প্রমাণের জন্যেই তৃণমূলে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে। দলের কেন্দ্রের মতোই তৃণমূলেও যদি নানা আকারের পরিবারতন্ত্র ছড়িয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের স্থান কোথায় থাকে? প্রসঙ্গত, কিশোরগঞ্জ হলো আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুলের এলাকা। সৈয়দ আশরাফ এখন সে স্থানে সংসদ সদস্য হিসাবে রয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তার যে ন্যূন্যতম ভূমিকা, কিশোরগঞ্জেও তাই। এলাকায় আসা বা দলের কাজকর্মে খোঁজ-খবর নেওয়া তার পক্ষে খুব কমই সম্ভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে না, সেটা যেমন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বা কর্মীরা জানেন, তেমনি সাধারণ মানুষও অবগত। এই দুর্বলতার সুযোগে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ দলের মধ্যে নিজের অবস্থান মজবুত করেছেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি দল নিরপেক্ষ হওয়ায় তার জেষ্ঠ্যপুত্রকে দলে এনে সংসদ সদস্যও করেছেন। তার আরেক পুত্রও রাজনীতিতে আগ্রহী। এই অবস্থায় দলে তাদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন চলে এসেছে। সেটা করতে হলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ কাউকে রেখেই করতে হবে। আবার সেটা কেবল ভাটি অঞ্চলের একই নির্বাচনী এলাকায় করলে হবে না। পুরো জেলাকে নিয়ে করতে হবে। এজন্য সাংগঠনিকভাবে জেলার ভারপ্রাপ্তরা সামাল দিতে পারছে না। অনেকেই কাউন্সিল হবে না মর্মে বিশ্বাস করে আবদুল হামিদ আর সৈয়দ আশরাফ বলয় তৈরি করে গ্রুপিং শুরু করেছেন। দলও বদলাচ্ছেন অনেকেই। সকালে আবদুল হামিদের লোক হয়ে বিকালে সৈয়দ আশরাফের লোক হচ্ছেন অনেকেই। গোয়েন্দা লাগিয়েও এখন কিশোরগঞ্জের কেন কোন নেতা কোন শীর্ষ নেতার প্রকৃত বা আসল লোক সেটা বের করা সম্ভব হবে না। চারদিকে এখন এমনই সন্দেহ আর ধূম্রজাল। তারপরেও এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করার জন্য দলীয় পর্যায়ে জিল্লুর রহমান, কামরুল আহসান শাহজাহান, এডভোকেট শাহ আজিজুল হকের কথাই সবাই বিবেচনা করছেন। এদের মধ্যে কে কোন শীর্ষ নেতার অনুসারী বা কে কার এলাকার লোক সেটা স্পষ্ট। কাউন্সিলের মাধমে সেটা দেখা হলে আসল জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যেত এবং গণতান্ত্রিকভাবে জেলা আওয়ামী নেতৃত্ব তৈরি করতে পারতো। কিন্তু কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে সেটা সম্ভব হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।
আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক রাখা হবে কিনা, সেটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার মতোই জরুরি বিষয়। বস্ততু বাংলাদেশের সকল দলেই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র থাকা, দেশের গণতন্ত্রের জন্য অতি জরুরি পূর্বশত। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় এটা যে, একমাত্র জামায়াতে ইসলামীতে পরিপূর্ণ দলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান এবং দলটি যথা সময়ে দলের নেতা-কর্মীদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেতৃত্ব কাঠামো নিয়ে কাজ করলেও এমন একটি গণতান্ত্রিক দল সবচেয়ে বেশি সমালোলোচনা ও আক্রমণের শিকার হয়েছে ও হচ্ছে। জামায়াতের মতো দলের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রের চর্চাকারী দল বাংলাদেশে আরেকটি আছে কিনা, সন্দেহ। অথচ এই গণতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে কত কত সাজানো অভিযোগই না করা হচ্ছে। মিথ্যারও যে একটি চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সীমা আছে, জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটা বহু আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আর কেউই ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাইও’ নামক নির্দেশ মান্য করছে না; বরং নিজে যেটা পালন করে না ও বিশ্বাস করে না, সেটাই অন্যকে করতে বাধ্য করছে। প্রহসন, ভ-ামীতে ভরে গেছে চারপাশ। ব্যক্তিগত লাভ, লোভ আর স্বার্থের রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে তার ক্ষেত্র। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়; এ কথাটি সম্ভবত এখন উল্টে গেছে। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দল আর রাজনীতি। বিশেষত শাসক দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের স্থলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী/পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিতি হলে সেই দলের পক্ষে পুরো দেশে গণতন্ত্রের প্রসার, প্রচার, চর্চা দুরূহই বটে।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে কি এখন এমনটিই হচ্ছে না?

শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনীতিতে ব্যঙ্গ-তামাশাই শেষ কথা নয়


এদেশে সাধারণত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীনরাই প্রাধান্যে থাকেন। এক সময় রাজা-বাদশাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা হতো। এখন প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বক্তব্য ও কান্ড-কীর্তি নিয়ে আসর জমে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির মতো বড় দলগুলোর প্রধান নেতা-নেত্রীরাও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে সত্য হলো, রাজনীতিকদের বাইরেও দেশে এমন অনেক বিশিষ্টজন রয়েছেন, সময়ে সময়ে যাদের বক্তব্য ও ভূমিকা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তাদের অনেকে দৃশ্যপটেও এসে হাজির হন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের আক্রমণের শিকার হলে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তেমন একজন। ১৯৬০-এর দশকে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীন মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নির্যাতিত এবং দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে হিসেবে আগে থেকেই পরিচিতি ছিল তার। মানিক মিয়ার ঋণ পরিশোধ করার উদ্দেশ্য থেকেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সবার মতো নেতার বশংবদ হননি ব্যারিস্টার মইনুল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব যখন চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সকল ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তখন প্রতিবাদে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি অবশ্য একা ছিলেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীও সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যার প্রতিবাদে সংসদ এবং আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের পরিস্থিতি তখন শ্বাসরুদ্ধকর ছিল বলেই জেনারেল ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুলের পক্ষে প্রকাশ্যে বাকশাল বা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া সম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও সংসদ থেকে পদত্যাগ করা এবং বাকশালে যোগ না দেয়াটাই ছিল অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত। কারণ, অমন সৎসাহস আর কেউই দেখাননি। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া নেতা শেখ মুজিবও অবশ্য যথেষ্টই দেখিয়েছিলেন। চারটি মাত্র দৈনিক ছাড়া সব পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করার সময় মানিক মিয়ার ইত্তেফাককেও তিনি সরকারের মালিকানায় এনেছিলেন। ফলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং তার ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হারিয়েছিলেন ইত্তেফাকের মালিকানা। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর- সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর। ইত্তেফাকের মালিকানা ফিরে পেয়েছিলেন মানিক মিয়ার ছেলেরা।
ইত্তেফাক এবং দ্য নিউ নেশন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে হোসেন ভ্রাতৃদ্বয় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন। ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জেনারেল এরশাদের এবং শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়েছেন। এই সময়েও তিনি বৈধতার সংকটে হাবুডুবু খাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিত্ব করছেন। ওদিকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দৃশ্যপটে এসেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী উদ্দিন সাহেবদের উপেদেষ্টা হিসেবে। তার এই অবস্থান অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, বছর না ঘুরতেই উপেদেষ্টার পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল তাকে। এটা ২০০৮ সালের কথা। সেই থেকে নিজের এবং অন্য কয়েকটি পত্রিকায় কমেন্ট্রি বা মন্তব্য প্রতিবেদন এবং কলাম লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে চলেছেন ব্যারিস্টার মইনুল। জবাবও তাকে কষেই পেতে হচ্ছে- বিশেষ করে ‘মুজিব কাকুর’ মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। কোনো কোনো উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তো রীতিমতো তুলোধুনোই করছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে। ব্যারিস্টার সাহেবও কম যাচ্ছেন না। সৌজন্যের সীমা অতিক্রম না করেও তিনি এ কথাটাকেই সত্য প্রমাণ করে চলেছেন যে, জ্ঞানী এবং মুর্খ বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে আসলেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে। জবাব তিনি ঠিকই দিচ্ছেন কিন্তু কিছুটা এদিক-সেদিক করে। যেমন সর্বশেষ কয়েকটি কমেন্ট্রি ও টকশোতে ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই’ ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই শেখ হাসিনার নেই। শেখ হাসিনার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকেও টেনে এনেছেন তিনি- দুই নেত্রীকে ‘দ্য টু লেডি লীডার্স’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি...’। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দলীয় নেতৃত্বে ও ক্ষমতায় আসাটা ব্যারিস্টার সাহেবের মতে দেশ ও জনগণের জন্য এক ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা’! এ পর্যন্ত এসেও থেমে যাননি ব্যারিস্টার মইনুল। তার মতে প্রধানমন্ত্রীর দরকার ‘শিক্ষিত সচেতন’ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়া। কিন্তু চাটুৃকার ও দুর্নীতিবাজরা তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এজন্যই ‘বঙ্গবন্ধুর’ কন্যা হিসেবে রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছে যে, ‘আমি এক ইঞ্চিও নড়বো না’ (বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ‘এক চুল’ও নড়বেন না!)। ব্যারিস্টার মইনুলের মতে শেখ হাসিনা এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। কারণ, দেশ কারো নিজের বা পিতার সম্পত্তি নয়। দেশের স্বার্থে এক ইঞ্চি কেন, আরো বেশিও নড়তে হতে পারে!
ব্যারিস্টার মইনুল প্রসঙ্গক্রমে ‘দুর্ভাগ্যের’ কথা জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যারা আছে তারাই সরকার চালাচ্ছে, কমিশন ভাগাভাগি করছে। কোনো এক সাবেক আমলার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, কারো কারো কথা শুনে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী আসলে কে- ওই আমলা, না শেখ হাসিনা? তারাই ‘সব ঠিক আছে’ বলছেন, ঘোষণা দিচ্ছেন ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। ব্যারিস্টার মইনুল জানতে চেয়েছেন, কার বিরুদ্ধে কঠোর হবেন- এটা কি পাকিস্তান? ‘ওনারা বলেন, দেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে’- টিভিতে সঞ্চালকের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, লড়াইটা সেখানেই। বাংলাদেশ কখনো পাকিস্তান যেমন হবে না তেমনি ভারতের কোনো রাজ্যও হবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের একটা চেতনা নিয়ে এসেছে। তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ তো আমরা সবাই মিলে করেছি। যারা ভারতে (কোলকাতায়) গেছে তারাই শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেছিল? মারা গেলাম আমরা আর এখন তারা হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ব্যারিস্টার মইনুলের অভিমত, এটা আসলে সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর একটা ফন্দি। তিনি প্রশ্ন করেছেন, তারা (মুক্তিযুদ্ধের চেতনাওয়ালারা) দেশকে রক্ষা করতে পারবে নাকি? দেশকে তো রক্ষা করবে জনগণ। ‘জয় বাংলা’ স্লোাগান প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, এই স্লোাগানটা তিনি বোঝেন না। তার জিজ্ঞাসা, এটা কোন দেশের স্লোগান? কারণ, আমার দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বলতে চাইলে আপনি ‘জয় বাংলাদেশ’ বলুন। ‘জয় বাংলা’ স্লোাগানটা আমরা বলেছি পাকিস্তানের বিরোধী অবস্থান থেকে। এখন তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে। এভাবে আসলে চালাকি করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার মইনুল বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, কিছুদিন আগে ভারতের কংগ্রেস সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, ‘এটা (বাংলাদেশ) আমাদের অঞ্চল, এ অঞ্চলের ভালোমন্দ আমরাই ভালো বুিঝ’ তখন কোথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? আজ কথায় কথায় পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে দেশকে আসলে সিভিল ওয়ারের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন তারা।
রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সংকট হওয়া উচিত ছিল না। সকলের কাছে গ্রহণীয় নির্বাচনকালীন সরকারের নাম কি হবে- তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন- সেটা নিয়ে তো যুদ্ধ করার কিছু নেই। এজন্য যে দেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, ব্যবসায়ীরা হাহাকার করছেন- এসবই অত্যন্ত দুঃখজনক। সুচিন্তিতভাবে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ নিয়ে ৫ জানুয়ারি যে ন্যক্কারজনকভাবে একতরফা নির্বাচন করা এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতার দখল নেয়া হয়েছে তারও কঠোর সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার মইনুল। তিনি মনেই করেন না যে, বর্তমান সংসদ এবং সরকারের বৈধতা রয়েছে। তার মতে জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে, ভয়ভীতিমুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তারও আগে অবৈধ সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। সংসদকে তো ভেঙে দিতেই হবে। কথাগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল আসলে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠারই তাগিদ দিয়েছেন। তাই বলে জাতীয় পার্টির মতো ‘গৃহপালিত’ কোনো দলের সঙ্গে নয়। বিরোধী দল বলতে তিনি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকেই বুঝিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের ‘ট্রেনিং’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন না বলে পারেননি যে, আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি সেটা পেয়েছি ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে’। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই দুই নেত্রীর নেই। উল্লেখ্য, মূল কথায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য চর্চা ও সহনশীলতার কথা বলেছেন। এই বলে আশাও প্রকাশ করেছেন যে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশে এখনো শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়।
ঠিক বর্তমান সময়ে এসেই ব্যারিস্টার মইনুল কেন কথাগুলো বলেছেন তার কারণ জানার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষও জানে, প্রধানমন্ত্রী কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। ১/১১ ধরনের ক্ষমতা দখলের কল্পিত ষড়যন্ত্রও তেমন একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় সব বক্তৃতায় তিনি তার কল্পিত ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রেখে চলেছেন। বলে বেড়াছেন, ১/১১-এর ‘কুশীলবরা’ নাকি আবারও তৎপর হয়ে উঠেছেন। সরকারকে উৎখাতের জন্য তারা শুধু ষড়যন্ত্রই করছেন না, অনেক কলাকৌশলও খাটাচ্ছেন। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘উদ্দিন সাহেবদের’ আমলের কিছু তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারা ‘কিংস পার্টি’, ‘কুইনস পার্টি’ প্রভৃতি গঠন করে ১/১১ ঘটিয়েছিলেন, কারা ওই সরকারের উপদেষ্টা হয়ে ক্ষমতায় ভাগ বসিয়েছিলেন এবং কাদের কারণে ‘গণতন্ত্রের এত বড় একজন নেত্রী’ হয়েও শেখ হাসিনাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল- ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের নাম-পরিচিতি জানাতে গিয়ে যথেষ্ট ব্যঙ্গাত্মকভাবেই প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, তারা নিজেদের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে দাবি করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফর্মুলা দেন। গণতন্ত্র থাকলে তাদের ‘এক কানাকড়িরও’ মূল্য থাকে না এবং অসাংবিধানিক কিছু ঘটলে তাদের মূল্য বেড়ে যায় বলেই আবারও তারা তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’দের সমন্বয়ে গঠিত কোনো অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। গণতন্ত্রকেও তারা নির্বাসনে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর মতে সেজন্যই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য একটি গুরুতর অভিযোগও হাজির করেছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরও নাকি একই ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে! তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বানচাল করা!
ক্ষমতায় আছেন এবং বিরোধী দল বর্জন করায় একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে গিয়েছিলেন বলে মুখে যা আসছে তাই বলতে পারলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সত্যের ধারেকাছেও যাননি। সহজবোধ্য কারণে তেমন ইচ্ছাও তার থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজন’ এবং ১/১১-এর ‘কুশীলব’দের কথাই ধরা যাক। তিনি ঠিক কোন ‘বিশিষ্টজনদের’ দিকে আঙুল তুলেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার দরকার পড়ে না। এখানে বরং একটি বিশেষ কারণের কথা বলা যাক। ব্যারিস্টার মইনুলসহ প্রধানমন্ত্রী যাদের তুলোধুনো করেছেন তাদের কেউই কিন্তু অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ওকালতি করেননি। তারা বরং সংবিধানের আলোকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করে এবং ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দশম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রধান দলগুলো অংশ না নিলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশ-বিদেশের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না, সরকার এবং সংসদকেও বৈধতার সংকটে পড়তে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকটই কেবল মারাত্মক হয়ে উঠবে না, একই সঙ্গে নতুন নির্বাচনের দাবিও উঠতে থাকবে। পরিস্থিতি এমন হবে যখন স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারকেও নতুন নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে হবে। এর ফলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি রাষ্ট্রের বিপুল অর্থেরও অপচয় ঘটবে। মূলত এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যারিস্টার মইনুলসহ প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজনেরা’ নির্বাচন স্থগিত করার এবং বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রধান দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেড়-দু’মাসের জন্য ছুটিতে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে বিরোধী দল নির্বাচনে না আসার কোনো অজুহাত দেখাতে না পারে। এসব পরামর্শের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। এ টুকুই শুধু নয়, ব্যঙ্গ-তামাশার মধ্য দিয়ে বিশিষ্টজনদের ১/১১-এর ‘কুশীলবও’ বানিয়ে ছেড়েছেন!
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর কথার পিঠে কথাও উঠেছে সঙ্গত কিছু কারণে।  প্রধানমন্ত্রী যাই বোঝাতে চান না কেন, এই সত্য কিন্তু প্রাথমিক দিনগুলোতেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, তিনি যাদের ‘কুশীলব’ বলে ব্যঙ্গ করছেন এবং যাদের ওপর ১/১১ ঘটানোসহ অসাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর দায় চাপাতে চাচ্ছেন, তাদের কারণেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ১/১১-এর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীদের ঠিক কোন নেতা-নেত্রীরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন সে কথাও তো প্রধানমন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়! এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার পরিবর্তে একটি তথ্যের উল্লেখই যথেষ্ট হওয়া উচিত। সে তথ্যটি হলো, যাদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নানা কথা বলছেন সেই ১/১১-এর কোনো একজন নায়ক বা কুশীলবের বিরুদ্ধেই কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নায়ক ও কুশীলবদের সবাই শুধু আরাম-আয়েশে জীবনই যাপন করছেন না, কয়েকজন এখনো দেশে-বিদেশে সরকারি চাকরিতেও বহাল রয়েছেন। সময়ে সময়ে তাদের পদোন্নতিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং এমন বোঝাতে চাওয়াটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, প্রধানমন্ত্রী আসলেও ১/১১-এর কথিত নায়ক ও কুশীলবদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য দিওয়ানা হয়ে উঠেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জরিপ ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে বরং এ অনুমানই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিশেষ করে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত এবং জামায়াতে ইসলামীকে যদি নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা না করা হতো তাহলে নৌকার তথা আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠতো। প্রধানমন্ত্রী আসলে নিশ্চিত সে ভরাডুবি ঠেকানোর এবং আবারও ক্ষমতায় আসার কৌশল হিসেবেই বিএনপি এবং জামায়াতের মতো বড় দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনও আপিলের সুযোগ না দিয়েই জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। এটাই সঠিক বিশ্লেষণ, তথ্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যাও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর উচিত সত্য স্বীকার করে নেয়া এবং মিথ্যাচার বন্ধ করা। বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশের বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সময়ও তার উচিত জিহ্বা সামাল দেয়া। শেখ হাসিনা সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবশ্য কথাটা শুনে মোটেও আশান্বিত হবেন না। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, তিনি কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে যাওয়ায় এবং র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবিকে দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতকে ‘ঠান্ডা’ করতে পারায় তার গলার স্বর তো বরং আরো চড়ছেই শুধু। তা সত্ত্বেও বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই কিন্তু সবাইকে একইভাবে ‘ঠান্ডা’ করতে পারবেন না- যেমনটি পারেননি তিনি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ‘ঠান্ডা’ করতে। কথার পিঠে কথা বরং বাড়তেই থাকবে। একযোগে প্রকাশিত হতে থাকবে এমন অনেক তথ্যও- যেগুলো এক সময় শেখ হাসিনার নিজের এবং তার দল ও পরিবার সদস্যদের জন্য অপ্রীতিকর, এমনকি লজ্জাকর ও বিপদজনকও হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চয়ই ‘ভাবিয়া করিও কাজ...’-যুক্ত প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না! 
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সব আয়োজন পন্ডশ্রমে পরিণত হতে পারে


মানুষের বিরুদ্ধে আজ মানুষের অনেক অভিযোগ। সবার কথা শুনে মনে হয়, পৃথিবী নামক এ ছোট্ট গ্রহ থেকে শান্তি বিদায় নিয়েছে। আমরা তো অশান্তি ও অস্বস্তির কথা বলে যাচ্ছি, কিন্তু এর কারণ কি খতিয়ে দেখছি? আমরা আসলে কারণ খতিয়ে দেখছি না এবং কর্তব্য কর্মও নির্ধারণ করছি না। যে যার মতো চলছি এবং কথা বলে যাচ্ছি। আসলে অশান্তির পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ আছে এবং সে কারণের পেছনে নায়ক বা খল-নায়কও আছেন। আমরা যারা অভিযোগ করছি, তারাও যে কখনও কখনও কোনো কোনো অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছি তা উপলব্ধি করতে পারিনি। আসলে কোনো সমাজে যখন নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, মানবিক সৌন্দর্যবোধের বিকৃতি ঘটে, তখন মানুষের আচরণ আর মানুষের মতো হয় না। সমাজের মানুষ তখন মানুষের আকৃতি নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে কিন্তু কাজ করে নিকৃষ্ট ও কুৎসিত মানের। আসলে মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকে তখন সে সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বের কথা ভুলে যায়। স্বার্থান্ধ এসব মানুষের বিকৃত ভাবনা অব্যাহতভাবে সমাজের ও মানুষের ক্ষতিই করে যায়। অবশ্য এদের সবার পরিচয় আমরা স্পষ্টভাবে জানি না। এখানে সম্পদ, ক্ষমতা, বিদ্যা ও চাতুর্যের কারণে রকমফের লক্ষ্য করা যায়। মাঠ পর্যায়ের অন্যায় ও বিকৃতির ঘটনাগুলো হয়তো আমরা জানতে পারি। কিন্তু প্রাসাদের কিংবা অভিজাত স্তরের ঘটনাগুলো সহজে জানা যায় না। তাদের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা আছে, অর্থের বিনিময়ে খরিদ করা ক্রীতদাসরা আছে। আমাদের হর্তাকর্তারা এখন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলোকিত সমাজের কথা বলছেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চার কথাও বলছেন। বিজ্ঞান প্রযুক্তির চর্চাতো বাড়ছে কিন্তু সমাজ কি আলোকিত হচ্ছে? আমাদের পূর্ব-পুরুষরা বলে গেছেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তথা সভ্যতা হলো বাইরের জিনিস, অন্তরের জিনিস হলো নৈতিকতা বা মূল্যবোধ। এই নৈতিকতা বা মূল্যবোধকে আমরা সাংস্কৃতিক চেতনা হিসেবেও অভিহিত করতে পারি। আসলে অন্তর আলোকিত না হলে সমাজকে আলোকিত করা যায় না। আমরা বাইরের জিনিস তথা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে শোরগোল করছি কিন্তু অন্তর বা প্রাণের বিষয়টি নিয়ে পালন করছি নীরবতা। এ কারণেই বিদগ্ধজনরা বলছেন, আলো ঝলমলে এক নব্য-জাহেলিয়াতে এখন আমাদের বসবাস।
মাঠ পর্যায়ের অন্যায় ও বিকৃতির বিষয়গুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রায়ই রিপোর্ট মুদ্রিত হয়। এর একটি হলো নারী-নির্যাতন। নারী-নির্যাতনের ঘটনা যে শুধু আমাদের দেশেই হয় তা নয়। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশেই নারী-নির্যাতনের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। তবে যে দেশের জনগণ নৈতিক চেতনায় যত সমৃদ্ধ, সে দেশে নারী-নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের ঘটনা তত কম হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, গত ২৫ নবেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এ উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় নারী নির্যাতনের বিষয় নিয়ে রিপোর্ট মুদ্রিত হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, দেশে ধর্ষণ ও বীভৎসতা দু’টোই বেড়েছে। ধর্ষণের চিত্র মুঠো ফোনে ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে বারবার ধর্ষণের শিকারে পরিণত করা হচ্ছে নারীকে। আবার ধর্ষণের শিকার নারী বা কিশোরীকে সেই ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ৫৪৪ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৮ জনকে। আর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৫ বছরে ৩০৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসব তথ্য থেকে উলব্ধি করা যায়, দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা বাড়লেও ধর্ষণ ও হত্যার মতো বিকৃতি ও বীভৎসতার হার কমছে না, বরং বাড়ছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজ দিন দিনই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কিন্তু এমন পরিণতির দিকে আমরা এগুচ্ছি কেন? দেশে তো সমাজ আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, মিডিয়া আছে, রাজনীতি আছে এবং আছে সরকার। এত কিছু থাকার পরেও মানুষ কেন ধর্ষণের শিকার হবে, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হবে? তাহলে কি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারই বা কী করছে?
মানুষ তো ধর্ষণ ও হত্যার শিকারে পরিণত হওয়ার জন্য সমাজবদ্ধ হয়নি। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে উন্নত জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যেই তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজের আজ এ কেমন চেহারা? ধর্ষণের চিত্র মুঠো ফোনে ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে বারবার ধর্ষণের কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ কেমন ব্যবহার? আসলে মানুষ নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ না হলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কাই বাড়ে। মাঠ পর্যায়ের এ চিত্র আন্তর্জাতিক পরিম-লের বড় বড় অঙ্গনেও লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই আমাদের এখন স্পষ্ট করে বলতে হবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আগে প্রয়োজন মানুষের নৈতিক উন্নয়ন। তা না হলে আমাদের এবং বিশ্ব-সমাজের সব আয়োজন প-শ্রমে পরিণত হতে পারে।
মানুষ এখন মহাব্যস্ত। নিজেকে জানার, সন্তানকে জানার তথা নতুন প্রজন্মকে জানার মতো সময় নেই মানুষের হাতে। বস্তি, কলোনি, অভিজাত এলাকা, সব জায়গার চিত্র একই রকমের। কেউ রুটি-রুজির সন্ধানে ব্যস্ত, কেউ বিলাসবহুল জীবন কিংবা আরো সম্পদের মোহে ব্যস্ত। জনপদে উদয়াস্ত এই যে ব্যস্ততা, তার ফসল কেমন ফলছে? আমরা যে, মানবিক পথে হাঁটতে পারছি না তার প্রমাণ সবার হা-হুতাশ। বস্তি, কলোনি ও অভিজাত এলাকায় জীবন-যাপনের পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, কাক্সিক্ষত শান্তি আমরা কেউই পাচ্ছি না। ফলে নানাভাবে আজ অস্থির হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজ।
সমাজের বিশ্লেষণ প্রয়োজন, তবে বিশ্লেষণই সবকিছু নয়। বিশ্লেষণের বার্তা অনুযায়ী কাজও করতে হয়। সে কাজের মূল দায় সরকার ও বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের উপর বর্তালেও, সাধারণ নাগরিকেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে করণীয় আছে। কিন্তু করণীয় তথা কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের জন্য যে জীবন দৃষ্টি ও জবাবদিহিতার চেতনা প্রয়োজন, তা আমাদের সমাজে এখন কতটা বর্তমান আছে? এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা চিন্তা করলে এবং কর্তব্য নির্ধারণে সমর্থ হলে সময়ের দাবি পূরণ হতে পারে। এ ছাড়া সময়ের দাবি পূরণে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবী ও আলেম সমাজকেও। কারণ জাতীয় প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হয় জাতির সবাইকে, কারো পিছিয়ে থাকার অবকাশ নেই।

সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকারের অপশাসন সমাজকে অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে


গত ১৯ নবেম্বর তোপখানা রোডে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের স্বনামধন্য একজন আইনজীবীর চেম্বারে গিয়েছিলাম। সেখানে সৈয়দপুর থেকে আসা সত্তুরোর্ধ একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেলাম। তখন প্রায় মাগরিবের সময়। নামাযের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাকে ডাকলাম, বললাম, আসুন নামায পড়ি। তিনি বললেন, বাবা এখন তো নামায পড়তে পারবো না, ওজর আছে। কাপড়-চোপড় ঠিক নেই। ভোর বেলা রওনা হয়ে এই মাত্র উকিল সাবের চেম্বারে এসে পৌঁছেছি। যাই হোক নামায শেষে তার সাথে কিছু কথা বললাম, জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন, উকিল সাবের কাছে কেন এসেছেন? জবাবে বললেন, ভাল নেই। গ্রাম এখন দোজখ হয়ে গেছে। হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি যা জীবনে কখনো দেখিনি তাই হচ্ছে। কারুর নিরাপত্তা নেই। কেউ কাউকে সম্মান করতে চায় না। সালাম দেয় না। তার ভাষায় গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে শত শত বছর ধরে যে সৌহার্দ্য ছিল তা বিলীন হয়ে গেছে। তিনি ঢাকা এসেছেন একটা মসজিদ রক্ষার জন্য। তার পূর্বপুরুষরা মৌখিকভাবে একটি মসজিদের নামে ৩ একর সম্পত্তি ওয়াকফ্ করে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ওজু-গোসলের জন্য একটি পুকুরসহ মসজিদ ভিটি ও ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসভূমি বাবত ছিল এক একর, বাকীটা কৃষি জমি। তার ভাষ্য মতে দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্বপুরুষদের প্রদত্ত মৌখিক ওয়াকফ্ এর ভিত্তিতে মসজিদের সম্পত্তিটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ করে ওয়ারিশদের মধ্য থেকে ৮ জন এই সম্পত্তি জবর দখল করে নেন। ফলে মসজিদটি বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি জানালেন যে তার পূর্বপুরুষদের যারা জমি ওয়াকফ করেছিলেন তাদের ওয়ারিশের সংখ্যা বর্তমানে ৬২ জন। ৮ জন বাদে অবশিষ্ট ৫৪ জন ওয়াকফ এর পক্ষে এবং পূর্ব পুরুষদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আদালতের সহযোগিতায় বিষয়টি সুরাহা করতে চান। ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আচরণে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ বলে মনে হলো।
ওয়াকফের বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক বলে মনে হয়েছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা-দীক্ষা ও মানুষের সেবায় ইসলামী সমাজে ওয়াকফ্ শত শত বছর ধরে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার ওয়াকফ এস্টেট আছে এবং সেগুলো দেখাশোনার জন্য সরকারের একটি দফতরও আছে। এই দফতরের কার্যকারিতা এবং সততা-নিষ্ঠা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে তেমনি ওয়াক্ফ এস্টেটসমূহের মোতাওয়াল্লী নামে পরিচিত অভিভাবকদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আত্মসাতের বহু নজিরও সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। মৌখিক ওয়াক্ফ সমূহের তো কথাই নেই। মসজিদ, এতিমখানাসহ যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে আমাদের পূর্বপুরুষরা ওয়াক্ফ এ লিল্লাহ করে গেছেন ওয়ারিশদের উচিত তা রক্ষা করা এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করে দেয়া। পূর্বপুরুষদের দান করা সম্পত্তি ফিরিয়ে নিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবেন বলে আশা করে থাকলে সে আশা পূরণ নাও হতে পারে।
(দুই)
গ্রামের মানুষ এখন এক কঠিন অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছেন। ক্ষমতাসীন দল এখন দেশটাকে বিভক্ত করে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, কেউ আর কাউকে আপন ভাবতে পারছেন না। শত শত বছর ধরে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করে এখন তারা শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তে পরস্পর পরস্পরের শত্রুতে পরিগণিত হচ্ছেন। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ সকল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ধ্বংস করে দিচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের খবরাখবর নিয়ে দেখুন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা বেশির ভাগ এখন এলাকায় থাকতে পারছেন না। তাদের জীবন, বাড়িঘর, সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততি কারুরই এখন নিরাপত্তা নেই। মসজিদ থেকে অনেক ইমামকে বের করে দেয়া হয়েছে; যেখানে বের করতে পারেনি সেখানে একই পরিসীমায় নতুন মসজিদ স্থাপন করে মুসল্লীদের বিভক্তি ও বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মাদরাসার শিক্ষকরা কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো দখল করে নেয়া হচ্ছে। নামাযী এবং টুপিধারী ব্যক্তিরা, আলেম হোক কিংবা সাধারণ শিক্ষিত, তাদের মাথার উপর এখন দু’টি খড়গ ঝুলছে, একটি রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর, আরেকটি জেএমবির। কখন কার বিরুদ্ধে তারা কোন অভিযোগ আনেন তারাই শুধু তা জানেন। নতুন বাড়ি করবেন, ব্যবসা শুরু করবেন, মেয়ের বিয়ে দিবেন? ছেলের মুসলমানী করাবেন, চাঁদা তাদের দিতেই হবে। তাদের চাঁদা না দিলে, তাদের কথা না শুনলে ঘরে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি রাখা যায় না, চুরি হয়ে যায়। থানায় জিডি করতে গেলেও আবার তাদের কাছে যেতে হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পরামর্শ না করে থানায় কোনও মামলা না নেয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাকে আসামী করা হবে তাও তাদের সুপারিশ অনুযায়ী করতে হবে। পয়সা দিতে হবে দু’জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্র লীগকে এবং পুলিশকে। না হয় মামলা হবে না। মামলা হলেও যে প্রতিকার হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী হয় তাদের নিজের লোক না হয় অনুগত সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি গ্রামে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে। আবার জ্বেনা-ব্যভিচার তো সর্বকালের সর্ব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যাদের ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে তাদের অনেকেই বেইজ্জতির ভয়ে ঘুমাতে পারেন না। ক্ষমতাসীনরা দেশকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখান থেকে ফিরে আসার জন্য মানুষ রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দলগুলো সক্রিয় না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
চার
২০ নবেম্বর মানব জমিনসহ জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহে একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর প্রকাশিত হয়েছে। মানব জমিনের নাম বললাম এজন্য যে পত্রিকাটি অন্যদের তুলনায় খবরটিকে খুবই গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করেছে। “রিমান্ডে অনিতাকে রোমহর্ষক নির্যাতন” শীর্ষক এই খবরটিতে একজন নারীর ওপর পুলিশী নির্যাতনের যে বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিবেকসম্পন্ন যে কোনও মানুষ শিহরিত না হয়ে পারেন না। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী (যদিও গৃহপালিত) সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সনও নারী। এই অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে একজন সেবিকাকে পুলিশ যে নির্যাতন করেছে সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। একজন পুরুষ নারী নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়েছে। কোতোয়ালী থানার ওসি মনিরুল পাইপ দিয়ে তার মুখে মদ ঢেলে দিয়েছে। বলা হচ্ছে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য এই নির্যাতন করা হয়েছে।
পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের অমানুষিক নির্যাতনের আরো অনেক খবর আমরা এর আগে জেনেছি। একজন সুস্থ মানুষকে তারা সম্পূর্ণ পঙ্গু বানিয়ে চ্যাঙদোলা করে কোর্টে হাজির করে পুনরায় রিমান্ড চেয়েছেন এবং বিচারক এই অবস্থায় আবার রিমান্ড মঞ্জুর করার ন্যায় অমানবিক আদেশ দিয়ে বিচারালয়কে কলঙ্কিত করেছেন ইতোপূর্বে দেশবাসী তা জেনেছেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে অভিযুক্ত নারীর যৌনাঙ্গের ন্যায় সংবেদনশীল শরীরে লাঠি ঢুকিয়ে খোঁচা দেয়ার মতো কাজ কেউ করতে পারে এটা বিশ্বাস করা যায় না। এ ঘটনা ঘটার পর আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ নারী অধিকার নেত্রীরা কিভাবে চুপচাপ বসে আছেন আমি বুঝতে পারি না। কোনও ব্যক্তিকে তার অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করে বিচার করা আইনের পরিপন্থী। আমাদের সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ সত্যটি জানেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। যারা এ কাজে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।
রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন মানবাধিকারের পরিপন্থী। রিমান্ড এবং ৫৪ ধারায় সন্দেহবশত গ্রেফতারে বাংলাদেশ হাইকোর্টের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সরকার এবং পুলিশ বিভাগ ও নিম্ন আদালত এই নির্দেশনাগুলো উপেক্ষা করে চলছে এবং তার জন্য তারা কোনও শাস্তি পাচ্ছে না। এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
১) ডিটেনশান দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২) গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩) গ্রেফতারের কারণ পুলিশকে একটি পৃথক নথিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৪) গ্রেফতারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ উল্লেখ করে পুলিশ তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে এবং ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিবে।
৫) গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে তার কারণ জানাতে হবে।
৬) বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে গ্রেফতার করা হলে এক ঘণ্টার মধ্যে তার আত্মীয়দের টেলিফোনে বা বিশেষ বাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।
৭) গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়দের সাথে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮) গ্রেফতারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও আত্মীয় থাকতে পারবেন।
৯) কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে তাকে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০) জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সংগে সংগে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে যে ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আদালতের এই নির্দেশগুলো ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে এগুলো অমান্য করে চলছে। নিম্ন আদালতও নির্দেশনা মানছে না। সভ্য দেশে আদালতের কাছ থেকে মানুষ ইনসাফ আশা করে নির্যাতন নয়। আমরা আশা করবো আমাদের আদালতগুলো নিরপেক্ষতার প্রতীক হয়ে এই ইনসাফই কায়েম করবেন।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিণতি এমনই হয়


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কোনো দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দাপট ও দৌরাত্ম্যে জনগণ অস্বস্তির মধ্যে জীবনযাপন করে। এটা দেশ ও সরকারের জন্য কোনো ভাল খবর নয়। কোনো সরকার যখন জবাবদিহিতার দায়িত্ব ভুলে যায়, তখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চাতুর্যে মগ্ন থাকে। এমন অবস্থায় তারা বিরোধী দলকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয় না, বরং কোমর ভেঙে দেয়ার আয়োজনে ব্যস্ত থাকে। সরকারের এমন ফ্যাসিবাদী চেহারায় শুধু বিরোধী দলে নয়, জনমনেও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকে। অথচ সরকার কিংবা সরকারী দলের নেতা-কর্মীরা তা উপলব্ধি করতে চায় না। এমন অগণতান্ত্রিক পরিবেশে বিরোধী দলের ম্রিয়মান চেহারা লক্ষ্য করে সরকারী ঘরানার লোকদের মধ্যে অহংকার ও দাম্ভিকতার মাত্রা বেড়ে যায়। তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও লুটেপুটে খাওয়ার জন্য সরকারী দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এমন চিত্রই আমরা এখন লক্ষ্য করছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
শাসকদল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী এখন ব্যস্ত- চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি ও খুনোখুনিতে। স্বার্থের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে তারা এখন নিজেরাই নিজেদের মারছেন। গত বৃহস্পতিবার দিনভর সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পক্ষের গুলী ও ধারালো অস্ত্রের কোপে প্রাণ হারাল অপরপক্ষের কর্মী সুমন চন্দ্র দাস (২২)। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও। আহত হন পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন। তাদের মধ্যে ১৮ জনকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। সংঘর্ষের জের ধরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একই দিন রাতে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম ও বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিনের গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার বড় ভাই আবুল মনসুর ভূঁইয়া নিহত হন, আহত হন আরও ১৫ জন। সংঘর্ষের পর জেলা প্রশাসন নান্দাইল উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করে। আর নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লার তিতাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে রিয়াজুল করিম সেন্টু নামে এক পথচারী প্রাণ হারান। শাসকদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আরও বহু ঘটনা পত্রিকার পাতায় স্থান পেয়েছে। সেই ফিরিস্তি আর বাড়াতে চাই না।
শাসক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও খুনোখুনির ঘটনায় নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষরা কিছুটা খুশি হতে পারেন। কিন্তু জাতীয় দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে এখানে খুশির উপাদানের চাইতে বরং অস্বস্তির উপাদানই বেশি পাওয়া যাবে। হিংসা ও হানাহানির এই রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি এভাবে আমাদের সমাজকে নাগরিকদের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাজি, দখলবাজি, আধিপত্য, মাদক ব্যবসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে একের পর এক খুন হচ্ছেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। তারা এ কথাও বলছেন যে, রাজনীতিসহ অধিকাংশ মহানগর, জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। আসলে এমন পরিস্থিতির পেছনে আইনের শাসন তথা সুশাসনের অভাবকে চিহ্নিত করা যায়। ফ্যাসিবাদী চেতনার কারণে শাসকদল নিজেদের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। এখন নেতা-কর্মীদের ওই দানবীয় চরিত্র নিজেদের জন্যও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র কারো জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে না। বিষয়টি উপলব্ধি করলে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথেই হাঁটতে হবে সরকারকে। সরকার সেই পথে হাঁটে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে শতগুণের বেশি

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত, এর সঠিক হিসাব বা তালিকা মুক্তিযুদ্ধশেষে করা না হলেও যে সংখ্যাটি এখন সামনে আসছে, তা রীতমতো বিস্ময়কর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ওয়াকেবহাল সূত্র থেকে পাওয়া সর্বশেষ উপাত্ত যোগ-বিয়োগ করলে ধারণা করা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হতে চলেছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে প্রকাশিত সব গেজেট মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে দুই লাখ ৯ হাজার ২৮ জন। আর নতুন করে তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী আবেদনকারীর সর্বশেষ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ১৭০ জন। অর্থাৎ মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তিন লাখ ৪২ হাজার ১৯৮ জন। সামনে নতুন যাচাই-বাছাই হবে। তবে পোড়খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা, যাচাইপ্রক্রিয়া অতীতের মতো হলে এ সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এক দুর্লভ সাক্ষাৎকারে ১৯৭৪ সালে বলেছিলেন, তার বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার অনুমিত সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারের মতো। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, রণাঙ্গনে সক্রিয় যোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ এবং প্রশিক্ষণরত প্রায় ৪০ হাজার, যারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণশিবিরে তখন অবস্থান করছিল।  সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, ‘এস ফোর্সঅধিনায়ক মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম বলেছেন, তার জানা মতে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ২৮ হাজার। তিনিও উল্লেখ করেন, ওই সময় বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণরত ছিলেন, যাদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। অপর দিকে, মুক্তিযোদ্ধার চার তালিকায় পর্যায়ক্রমে যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা হলো এক. জাতীয় তালিকা এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন, দুই. মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তালিকা ৬৯ হাজার, তিন. মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকা ৮৬ হাজার এবং চার. মুক্তিবার্তা (লাল বই) এক লাখ ৫৪ হাজার। এ থেকে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা হলো মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনো তালিকাতেই দেড় লাখের ঊর্ধ্বে ওঠেনি। সংখ্যাটি জেনারেল ওসমানী এবং মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহ বর্ণিত সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। মুক্তিযোদ্ধার যে চারটি তালিকার তথ্য এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ২০০০ সালের মধ্যে। এতে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৩০ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তালিকাগুলো করা হলেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কখনো দেড় লাখ অতিক্রম করেনি। কেবল লাল বইতে এসেছে সর্বোচ্চ সংখ্যা, যা অনুমিত সংখ্যার চেয়ে মাত্র চার হাজার জন বেশি। এ থেকে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কম-বেশি দেড় লাখ বলে ধারণা করা যায়। কারণ, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর জেনারেল (অব:) কে এম শফিউল্লাহর দেয়া সংখ্যা-তথ্যের সাথে এ ধারণা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা বাহুল্য, মুক্তিবাহিনীর জনবল নির্ধারণে যে দুজন শীর্ষ অধিনায়কের সংখ্যা-তথ্য এখানে মানদণ্ড ধরা হচ্ছে, তাদের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।  ২০০১ সালের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে মুক্তিযোদ্ধার গেজেট তৈরির সূত্রপাত ঘটে। বিগত ১৪ বছরে তৈরি গেজেট এবং নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ আবেদনসহ মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। আসন্ন যাচাই-বাছাইতে এ সংখ্যায় বড় ধরনের কোনো হেরফের না ঘটলে মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধির হার যে পূর্ববর্ণিত হিসাব অনুযায়ী শতভাগের বেশি হবে, সেটা প্রায় নিশ্চিত। অবসরপ্রাপ্ত একজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যখন করা দরকার ছিল তখন তা করা হয়নি। এটা এক ঐতিহাসিক ভুল। আবার তালিকা চূড়ান্ত না করে নানা ধরনের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এটাই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ। জেনারেল ওসমানীর তথ্য সঠিক হওয়া সম্পর্কে বলেন, মুক্তিবাহিনীর জনবল সম্পর্কে তারচেয়ে কে আর ভালো জানতেন। তিনি বলেন, গত ৪৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। যুদ্ধে মূল বাহিনীর সক্রিয় অংশ, গেরিলা গ্রুপগুলোর সদস্য, বিএলএফ সদস্য, প্রশিক্ষণশিবিরের যোদ্ধারা, অভ্যন্তরীণ বাহিনীগুলোর সদস্য, শব্দসৈনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংগঠকসহ মুক্তিযোদ্ধার মোট সংখ্যা কোনোভাবেই পৌনে দুই লাখের বেশি হবে না।  মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা করতে মুক্তিযোদ্ধা কমিশনগঠনের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার চাইলে এটা করতে পারে। আমরা তো অনেক কিছুতেই কমিশন গঠন করে থাকি। মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ও নির্ভুল তালিকার মতো জাতীয় ইস্যুতে কমিশন হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে বিএনপির চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালের নভেম্বরে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার কাজে মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির গড়া মন্ত্রণালয়ে বসে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী যেভাবে কলকাঠি নাড়ছেন তাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব পদক্ষেপবলা যাবে না। যত দূর খোঁজ নিয়েছি, তাতে তথাকথিত এই যাচাই-বাছাইকে আওয়ামী লীগের বৃদ্ধকর্মী পুনর্বাসন কর্মসূচিবলাই যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সরকারের নিজের করা জাতীয় তালিকা স্থগিত করা হয়েছে যদিও প্রায় ৩০ বছর আগে তৈরি করা এ তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধার নাম নেই। এখন নতুন করে আবার লাখ দেড়েক দরখাস্ত জমা করেছে সরকার। নতুন এই আবেদনকারীরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ কর্মী এবং অমুক্তিযোদ্ধা বলে আমরা জানি। আশঙ্কা হচ্ছে, ছদ্মবেশী অমুক্তিযোদ্ধারা সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন নতুন আবেদন করা অমুক্তিযোদ্ধারা। অনেক জায়গায় এরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা একজোট হচ্ছেন যাচাই-বাছাই কমিটিকে প্রভাবিত করে তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে। এতে কোনো বাধা এলে এরা একজোট হয়ে তা মোকাবেলা করবেন। অপর দিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে চান দলমত নির্বিশেষে ভুয়ামুক্ত তালিকা। আসন্ন যাচাই-বাছাইকে তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিশাপ থেকে মুক্তি অর্জনের শেষ সুযোগ মনে করছেন। এ জন্য তারাও হচ্ছেন ঐক্যবদ্ধ। ছয় মাস আগে অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীরা এখন জেলা-উপজেলা কমান্ডে ক্ষমতাসীন। যাচাই-বাছাই কমিটির যে কাঠামো করা হয়েছে তাতে কমিটিতে এরাই মূলত ছড়ি ঘোরাবেন। অনেক জায়গায় নির্বাচনী প্রতিপক্ষ গ্রুপ ঘায়েল করতে যাচাই-বাছাইকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন জেলা-উপজেলায় ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন নোংরা রাজনীতি অনাকাক্সিত।
বশীর আহমেদ

বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কিছু বক্তব্য নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। কারণ, বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন সম্পর্কে তার কথাগুলো ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গত ১২ নবেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যক্রমের পেছনে ছিল তার নিজের প্রত্যক্ষ ভ’মিকা। প্রতিটি উপজেলায় তিনি কথা বলেছেন, তাদের ‘রিক্রুটেড’ লোকজনকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে তারা নির্বাচন করেছেন। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন যে তাদের অর্থাৎ সরকারের ‘পাশে দাঁড়িয়েছিলেন’ এবং ‘বুক পেতে দিয়েছিলেন’ সে কথাটাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। একই অনুষ্ঠানের ভাষণে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের জন্য চাকরি পাওয়ার সহজ উপায় সম্পর্কেও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, কোনোভাবে লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলেই চলবে। বাকিটা তারা দেখবেন। এইচ টি ইমাম সাধারণ মন্ত্রী বা রাজনীতিক নন বরং অত্যন্ত ক্ষমতাধর উপদেষ্টা। তাছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন বলেও এইচ টি ইমামের কথাগুলো নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রথম থেকে তারা যে অভিযোগ তুলে এসেছেন, গোপন কথা ফাঁস করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা এতদিনে সে অভিযোগের সত্যতাই স্বীকার করেছেন। ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই ছিল এইচ টি ইমামের বক্তব্য বিরোধী। অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও নেতারা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তার নিজের উপদেষ্টাকে তুলোধুনো করেছেন। মিস্টার ইমামও তাই পিছুটান না দিয়ে পারেননি। প্রথম দু-একদিন সুকৌশলে নীরবতা অবলম্বন করলেও শেষ পর্যন্ত ১৭ নবেম্বর তাকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে। সেখানে লিখিত বক্তব্যে দিব্যি বলে বসেছেন, যে মন্তব্যের কারণে তার সমালোচনা করা হচ্ছে সে রকম কিছুই তিনি নাকি বলেননি! এ পর্যন্ত এসেও থেমে যাননি প্রধানমন্ত্রীর এই বিতর্কিত উপদেষ্টা। আওয়ামী কায়দায় সব দোষ চাপিয়েছেন গণমাধ্যমের ওপর। বলেছেন, সাংবাদিকরা নাকি মনগড়া রিপোর্ট করেছেন এবং সেটাই নাকি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে!
বিষয়টি নিয়ে সঙ্গত কারণেই নতুন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে ‘আওয়ামী লীগের ইমাম’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সেই সব সত্য ফাঁস করে দিয়েছেন যেগুলো সম্পর্কে বিরোধী দল এতদিন ধরে বলে আসছিল। নির্বাচনের সময় এইচ টি ইমাম ভোটের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন এবং তাদের ইচ্ছানুসারে তৈরি করিয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের চাপে এখন তিনি বক্তব্য অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জনগণ যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। এ শুধু বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নয়, আমরাও মনে করি, মুখ ফস্কে হলেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম যা কিছু বলে ফেলেছেন সে সবের কোনো কিছুই আর পাল্টে ফেলা যাবে না। কারণ, ‘ডিজিটাল যুগে’ চাইলেই কোনো সত্য অস্বীকার করা যায় না। ছাত্রলীগের আলোচ্য অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা ইমাম যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সংবাদে যেমন প্রচারিত হয়েছে তেমনি রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছে পরদিনের সংবাদপত্রেও। তার ভাষণের অডিও-ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। কোনো কোনো দৈনিক তো এরই মধ্যে ইন্টারনেটের লিংকও প্রকাশ করেছে, যেখানে মিস্টার ইমামের সেদিনের বক্তব্য শোনা ও দেখা যাচ্ছে। সুতরাং নিজের পিঠের চামড়া বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তিনি চাইলেই বা সংবাদ সম্মেলনে পাঠ করা ফরমায়েসী বিবৃতিতে দাবি জানালেই চলবে না। যা কিছু সত্য তার সবই প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে গেছে। জনগণও জেনে ফেলেছে। আমরা তো মনে করি, গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে মিথ্যাবাদী বলার মধ্য দিয়ে উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বরং নতুন করে বড় ধরনের অন্যায় করেছেন। তার উচিত সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের কাছে ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করা। এ সত্যও তাকে স্বীকার করতে হবে যে, গণমাধ্যমে সঠিক বক্তব্যই প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছিল এবং আসলেও তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে কর্তৃত্বসহ নেতৃত্বের ভ’মিকা পালন করেছিলেন।

মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মেজর জলিলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জবানবন্দী


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে বড় সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। সেই মেজর জলিলের আরেকটা পরিচয়ও আছে- তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম গৃহবন্দি এবং খুব সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সেনা কর্মকর্তা, যাকে হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। একজন সেক্টর কমান্ডারকে কেন গৃহবন্দি করা হলো? কেন কেড়ে নেয়া হলো তাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া সম্মান সূচক পদক? কি ছিল মেজর জলিলের অপরাধ?
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে অসুস্থ মাকে দেখতে মেজর জলিল তার কর্মস্থল পাকিস্তানের মূলতান থেকে ছুটি কাটাতে বরিশালে নিজবাড়িতে আসেন। ছুটি শেষ হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তখন তিনি নিজ কর্মস্থলে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। মার্চের শেষদিকে জিয়াউর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর জলিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য ছিন্ন করে মহান মুক্তি-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানের নিপীড়িত মানুষের পরাধিনতা থেকে মুক্তির পণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা-সংগ্রামে।
১৯৭১ সালের গঠিত ১১টি সেক্টরের মধ্যে সাহসী সেনা মেজর জলিলকে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখলী, ফরিদপুর এবং খুলনার কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। দীর্ঘ ৯ মাস তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন, যার মধ্যে ৭ এপ্রিল খুলনা রেডিও সেন্টার মুক্ত করার অপারেশন উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত দক্ষতা, সাহসিকতা এবং বীরত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের শেষদিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত জীবন-পণ যুদ্ধ করেন।
ভৌগোলিক নৈকট্যে আর সব সেক্টর কমান্ডারের চেয়ে জলিলই ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর সবচেয়ে কাছাকাছি। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই তিনি বাড়তি সুবিধাদি পেয়েছেন। এমনকি মে মাসের শুরুতে সুন্দরবনের বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জে পাক বাহিনীর এমবুশে দুটি লঞ্চ বোঝাই অস্ত্র খোয়ানোর পর কলকাতায় ভারতীয় সেনা সদর ফোর্ট উইলিয়ামে মেজর জলিলকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সে দায় থেকে তিনি মুক্তি পান এবং পরবর্তী সময়ে জেনারেল অরোরার আস্থাভাজনদের একজন ছিলেন খুলনা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত। তাহলে জলিল পরবর্তীতে কার রোষের শিকার?
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হালকা অস্ত্র, অল্প প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের মতো একটি সুপ্রশিক্ষিত ও ভারি অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সামনা-সামনি লড়াইয়ে নামা ছিল আত্মহত্যারই নামান্তর। গোটা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভিত্তি ছিল হিট অ্যান্ড রান। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এটি। ৯ নম্বর সেক্টর প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোর একটি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ততদিনে। অল্প দিনের ট্রেনিং নিয়ে গেরিলাদের দেশের ভেতরে অপারেশনের এ পদ্ধতি সামরিক বাহিনীতে ইনডাকশন বলে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর জলিলের অংশগ্রহণের অদ্বিতীয় কারণ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী শোষকদের হাত থেকে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যেমনি ছিলেন আপসহীন, তেমনি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন বজ্রকণ্ঠ। মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতার নেপথ্যের কারণ জানতে পেরে মেজর জলিলের মধ্যে ক্ষোভের তীব্র আগুন জ্বলতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর পরিবর্তে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করানো হয় জেনারেল নিয়াজীকে। অনুরূপভাবে ১৭ ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পাকিস্তানী বাহিনীকে সেক্টর প্রধান হিসেবে মেজর জলিলের কাছে আত্মসমর্পণ না করিয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দানবীর সিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করানো হয়।
মেজর জলিল ৯নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। দক্ষিণাঞ্চল ছিল তার যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধের শুরু থেকেই নানা বিষয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সাথে তার মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশ্য শুধু তার সাথে নয়, প্রায় সব সেক্টর কমান্ডারের সাথেই ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের বিরোধ চলছিল। পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের পর মুক্তবাংলায় ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে অংশ নিল। বাংলার সম্পদ পাচার শুরু করল। এ সময় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রসহ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মেজর জলিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় বাহিনীর নানা ঘটনাসহ স্বাধীনতা-পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বাংলাদেশীদের সম্পদ লুণ্ঠনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ায়ই তখনকার সরকার মেজর জলিলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুণ্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট পত্র লিখেন, যা ১৭ ডিসেম্বর তাদের পৌঁছানো হয়। ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটতরাজের বিরুদ্ধে ক্রমেই ক্রোধে অগ্নিরূপ ধারণ করেন মেজর জলিল। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবীর সিংকে বলতে বাধ্য হন, ‘দেখামাত্র গুলীর হুকুম দিয়েছি আমি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা থেকে বিরত রাখুন।’ মেজর জলিল পরবর্তী কয়েকদিন জাহাজে চড়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং ভোলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে জনসাধারণকে ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ার, গোলাবারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম, কলকারখানার মেশিনপত্র সবকিছুই লুট করে ভারতে পাচার করতে থাকে। এসব লুটপাটের বিরুদ্ধে মেজর জলিলের বিরোধিতা ও তার সাহসিকতা অন্যান্য সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদেরও ‘মিত্র বাহিনীর’ লুটপাটে বাধা প্রদানে উৎসাহিত করে তোলে। কিন্তু মেজর জলিল যদি জানতেন, যে দেশের জন্য তিনি রুখে দাঁড়ালেন, সেই দেশ তার সাথে কি ব্যবহার করতে যাচ্ছে! একসময় জরুরি ভিত্তিতে এক মিটিংয়ে তলব করা হয় সব সেক্টর কমান্ডারকে। সেই মিটিংয়ে যোগ দেবার পথে গ্রেফতার করা হয় মেজর জলিলকে। এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক লুণ্ঠনের প্রতিবাদ করায় ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি হিসেবে মেজর জলিলকে বন্দি করে যশোর সেনা ছাউনির একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়। এ বিষয়ে তিনি এক আত্মকথায় বলেন, ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দি।’
২১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা সাড়ে ১০টায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি। ১৯৭১ সালের সেই ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের কথা আমি কোনো দিনই ভুলতে পারব না। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে বেলা ১১টায় বন্দি করা হয়। বাড়ি না- যেন হানাবাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশপাশে বেশকিছু নরকঙ্কাল পড়ে আছে। ঘরের ভেতর মানুষের রক্তের দাগ। কোনো ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। বাইরে কাক, শকুন, শেয়াল একযোগে ব্যস্ত। ভেতরে মশারা কামান দাগিয়ে আছে। বাথরুমে পানি নেই। ডিসেম্বরের ভিজে শীত। বাইরে সেন্ট্রির বুটের কটমট আওয়াজ। সারাদিন গেল কোনো খাওয়া বা খাবার পানি পর্যন্ত এলো না। ৫ রুমবিশিষ্ট বাড়িটির রুমে রুমে যেন কান্না আর হাহাকার। সন্ধ্যা হতেই প্যাটার গোঙানি শুরু হয়। সহযোগী ভূতুকও পেছনে পড়ে নেই। বাড়িটার একটা রুমেও লাইট নেই। একটা খাটের ওপর একটা আধছেঁড়া কম্বল এবং তখন সেটাই আমার আপন একমাত্র আশ্রয়স্থল। কোনোমতে কম্বলটা জড়িয়ে বসে আছি। রাত ১২টা ১ মিনিটে যশোর সেনাছাউনি নতুন বছরের উজ্জীবনী গীতিতে মুখর হয়ে উঠল। নারী-পুরুষের যৌথ কণ্ঠের মনমাতানো সঙ্গীত নাচ, হাততালি, ঘুঙুরের ঝনঝনানি, উল্লাস, উন্মাদনা সবই ভেসে আসছিল কর্ণকুহুরে। আমার মাটিতে প্রথম নববর্ষেই আমি অনুপস্থিত। এ কথা ভাবতেই আমি কানে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। শুনলাম কেবল একটা ব্যঙ্গাত্মক অট্টহাসি- ‘রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা’ যার অর্থ দাঁড়ায় কতকটা এরকম।
রাতের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারে আমি সেদিন কম্বল জড়িয়েও ঘেমে উঠেছিলাম, শিহরিয়ে উঠেছিলাম পুনঃ পুনঃ। স্বাধীনতার সতের বছর পরেও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অন্ধকারে আজো আমি একইভাবে শিহরে উঠি আর যেন শুনতে পাই- ‘রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা।’ একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন বন্দিদের সঙ্গে পাওয়া জিনিসপত্রের সিজার লিস্ট করতে। সবার ব্যাগেই কাপড় ও গুলী ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর আসে জলিলের ব্যাগ খোলার পালা। তার অনুপস্থিতিতে এই ব্যাগ খোলার ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদের পরও সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে তালা ভাঙা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাগের ওজন সন্দেহজনক বলে রায় দেন তার আগে। খোলার পর এতে পাওয়া যায় বিখ্যাত সমর নায়কদের লেখা গেরিলা যুদ্ধের মোটা মোটা সব বই, যা কলকাতা থেকে ফেরার পথে বিভিন্ন বুকস্টল থেকে কিনে আনতেন জলিল। মূলত স্বাধীন একটা দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ করে অফিসারদের আধুনিক রণকৌশল এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানা উচিত বলেই মনে করতেন মেজর জলিল। সে কারণেই ভারত থেকে এ বইগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তিনি । যাই হোক, হতভম্ব ম্যাজিস্ট্রেট এরপর স্টাফ অফিসার মোস্তফাকে জানান, তাকে বলা হয়েছিল মেজর জলিল ও তাদের সঙ্গীরা খুলনা থেকে লুট করা ব্যাগ ভর্তি সোনাদানা, অলঙ্কার ও টাকা-পয়সা নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে!
ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সমগ্র জাতি সরকারের ঐ ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১১ মার্চ ১৯৭২ বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের এক বিশাল সমাবেশে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার জোর দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করে, ‘সেনাবিধি অনুসারে হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য, বিদ্রোহ এবং খুলনা পতনের পর লুটতরাজ পরিচালনার পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন বিরোধিতামূলক বক্তব্য ও পদক্ষেপের অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ কোর্ট মার্শালে বিচার করা হবে।’ সরকারের ঐ ঘোষণার পর বিক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। আর্মি, মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণ ক্ষেপে ওঠে। এভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম রাজবন্দি। তার নিজের কথায়, ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দি।’ এসব বিষয় স্বাধীনতা অর্জনের পরে তুলেছিল তুমুল ঝড়।
জিবলু রহমান 

সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশে জুলুম নির্যাতন ও স্বর্গপ্রাপ্তির যোগ্যতা


গত কয়েক মাস ধরে দেশব্যাপী খুন, রাহাজানি, যত্রতত্র বেওয়ারিশ লাশের মিছিল যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়। ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই জীবন, সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চলাফেরা করতে পারছেন না। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন কি রাতের আঁধারেও চোর ডাকাত, খুনি সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও ভালো মানুষদের ভয় করতো, দেখলে পালিয়ে যেতো। কিন্তু এখন জামানা পাল্টে গেছে বলে মনে হয়। চোর ডাকাতরাই এখন ভালো মানুষদের তাড়াচ্ছে। দাগী অপরাধীরা সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে সজ্জনদের মাথার উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে এবং তাদের অত্যাচার নির্যাতন এবং গুমের শিকার বানাচ্ছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন হচ্ছে সরকারের কাজ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তারা এখন দুষ্টকে লালন এবং শিষ্টকে দমনের কাজে ব্যস্ত। তাদের এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, চুরি ডাকাতির মামলায় এজাহার নিতে গেলেও পুলিশকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুমোদন নিতে হয়। আবার র‌্যাব এবং পুলিশ সদস্যরাও দলীয় নির্দেশে মানুষ খুন করে। খুনের জন্য ভাড়া খাটে। কিছু দিন হৈ চৈ হয় আবার পরিস্থিতি সাবেক অবস্থায় ফিরে যায়।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশসহ র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সম্পৃক্তি, কাস্টডিতেও ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধের স্বীকারোক্তির পরও বিচারে বিলম্ব এবং ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সরকারি কৌশল জাতি হিসেবে সারা দুনিয়ার সামনে আমাদের ভাবমর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। গত সাত বছরে এ ধরনের শত শত ঘটনা ঘটেছে এবং অপরাধীরা বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা জীবনের নিরাপত্তা। শত শত কোটি টাকা খরচ করে সরকার মন্ত্রীদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই; না জীবনের, না সম্পত্তির, না ইজ্জতের। দেশব্যাপী লুটপাট চলছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, শিল্পকারখানা এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া করে দেয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মন্ত্রী এমপিরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার সদস্যদের নিয়ে লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ দেশকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। দেশে সামরিক শাসন নেই। কিন্তু তবুও বিরোধী দলের জন্য মিটিং করা হারাম। সরকারি দল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মিটিংয়ের আয়োজন করে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, রাহাজানি, অস্ত্রবাজি ও নৈতিক স্খলনের প্রধান অনুঘটক যুবলীগকে সদম্ভে দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে আখ্যায়িত করছে। প্রহসন আর কাকে বলে। রাজনৈতিক নির্যাতন, খুন-খারাবি এবং হামলা মামলায় মানুষ এতই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে যে, দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতের কথা তারা প্রায় ভুলেই গেছেন। চারদলীয় জোট ক্ষমতা ছাড়ার প্রাক্কালে যে চাল ১৬ টাকা ছিল তা এখন ৪৬ টাকা। ১২ টাকার লবণ ৩২ টাকা। ৫৮ টাকা লিটারের সয়াবিন ১৪০ টাকা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্র, গণপরিবহনের ভাড়া, মাছ-গোশত এমন কোনো পণ্য নেই যার মূল্য ৪/৫ গুণ বৃদ্ধি পায়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির দুরবস্থা ও বেকারত্ব পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সরকারি চাকরি দলীয় লোক ছাড়া বাইরে যায়নি। যে দেশের অর্থমন্ত্রী ঘুষ-দুর্নীতিকে গ্রিজিং মানির নামে বৈধ বলে ঘোষণা দেন, সে দেশের নৈতিক মান কোথায় গিয়ে নামতে পারে সহজেই তা অনুমেয়।
সরকারের কোথাও চেইন অব কমান্ড নেই। পাগলা রাজার রাজত্বে সবাই রাজা। সরকার অনির্বাচিত হওয়ায় সবাই নিজেকে সরকার মনে করেন। সিভিল প্রশাসন দলীয়করণ করে জুনিয়রকে সিনিয়র, সিনিয়রকে জুনিয়র এবং অথর্ব ও দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য লোকদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষে বসিয়ে দেয়ার ফলে সচিবালয় এখন তামাসার পাত্রে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির সাথে শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েছেন। তারা শাস্তি পাননি। জুনিয়র বশংবদরা কতজন এর সাথে জড়িত আছেন তার হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। আর্মি অফিসারদের পুলিশের অধীনে কাজ করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে এবং অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের সিভিল প্রশাসনে রাখা হচ্ছে। এতে সৈনিক হিসেবে তাদের দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে। গণতন্ত্র ধ্বংসের পাশাপাশি সিভিল সোসাইটিকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা হয়নি; দুভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ। বেকার টেকনোক্যাটরা এখন সরকারের বুদ্ধিদাতা। অপকর্ম করতে করতে সরকার দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র ভাঙতে ভাঙতে তারা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে তারা মনে করছেন নির্বাচনের আর দরকার নেই।
এদেশের মানুষের চাহিদা খুব বেশি ছিল না। তারা পাকিস্তান ভেঙে এমন একটি শান্তির পরিবেশে বসবাস করতে চেয়েছিলেন, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ইনসাফ ও ভয়ভীতিশূন্য স্বাধীন পরিবেশ বজায় থাকবে। তারা তাদের আদর্শ, মূল্যবোধ, জীবন, সম্পত্তি ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারবেন। এখানে স্বৈরাচার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছায়াও থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ তাদের সমস্ত স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। বিরোধী জোট বিশেষ করে এই জোটের বৃহত্তম শরিক দল বার বার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েও তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে পারছে না। তাদের আন্দোলনের হুমকি স্বৈরসরকারের জুলুম-নির্যাতনকে আরও বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে বলে মনে হয়। পথে-প্রান্তরে মানুষের এখন একটিই প্রশ্ন, বিরোধী জোটের নিষ্ফল অকার্যকর আন্দোলনের ঘোষণা আর কতদিন চলবে? জুলুম-নির্যাতন শেষ হবে কবে? এই পর্যায়ে একটি গল্প বলতে চাই। এক সময় অর্থনীতি দিয়ে আমি আমার সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেছিলাম। অর্থনীতির তত্ত্ব এবং তার ফলপ্রসূতা নিয়ে বিতর্ক আমার বেশ ভালোই লাগতো। দার্শনিক আর অর্থনীতিবিদদের ঝগড়াও ছিল মজার। দার্শনিকরা প্রতিপাদনবাদের দুর্বলতাসমূহ স্বীকার করেন। কিন্তু অসারতা প্রতিপাদনবাদ পূর্ববর্তী দর্শনের চেয়ে উন্নত, এ বক্তব্য তারা মোটেও মানেন না। তাদের ধারণা তত্ত্ব প্রতিপাদনের জন্য যে আদর্শ অবস্থা অনুমান করা হয় সে অবস্থা বাস্তবে নাও থাকতে পারে। আবার উপাত্ত শূন্য থেকে আসে না, তা সংগ্রহ করার আগে একটি পূর্ব ধারণা বা Hypothesis দিয়ে শুরু করতে হয়। তদুপরি পূর্ব ধারণা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রচলিত তত্ত্ব দ্বারা। এ প্রেক্ষিতে বস্তু নিরপেক্ষ উপাত্ত বলতে কিছু নেই। এই অবস্থায় সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্ক ব্লাগ (Mark Blaug) এর ধারণাই সঠিক। তিনি বলেছেন, সকল উপাত্তই হলো তত্ত্বভারাক্রান্ত, আবার সকল তত্ত্বই হলো মূল্যবোধে ভারাক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল যথার্থই বলেছেন, ‘The most reckless and dangerous theorist is the man who claims to let the part speak for Themselves.’ অর্থাৎ সেই তত্ত্ববিদই হচ্ছেন সবচেয়ে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক যিনি দাবি করেন যে, উপাত্ত নিজে নিজেই তার সত্যতা প্রমাণ করবে। বিষয়টি একটু জটিল। কাজেই আমি এখানে টমাস কুনের (Kuhn)-এর Paradigm Theory বা আদল তত্ত্ব এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত Predictive instrumentalism বা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক নিমিত্তবাদ নিয়ে আলোচনা করবো না। তবে এ তত্ত্বের মূল প্রবক্তা মিল্টন ফ্রিডম্যানের লেখা এক পাদ্রীর গল্প পাঠকদের সাথে উপভোগ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তার গল্পের ‘পাদ্রী সারা জীবন সৎপথে থেকে ধর্ম সাধনা ও ধর্মপ্রচার করেছেন। মারা যাবার কিছুদিন আগে সেই পাদ্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একজন বেপরোয়া ট্যাক্সিচালকের শেষকৃত্য সম্পাদন করেন। এর দিন কয়েক পর পাদ্রী নিজেই মারা যান। স্বর্গে যাবার পর তিনি দেখতে পান যে, ট্যাক্সিচালকেরও স্বর্গে ঠাঁই হয়েছে এবং তার মর্যাদা পাদ্রী সাহেবের অনেক ঊর্ধ্বে। পাদ্রী মনক্ষুণ্ন হয়ে সেন্ট পিটারকে বললেন, ট্যাক্সিচালকটি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালাতো এবং নানা কুকর্মে লিপ্ত থাকতো। তিনি সারা জীবন ধর্ম-কর্ম করেছেন অথচ স্বর্গে তার স্থান ট্যাক্সিচালকের নীচে। স্বর্গে এ ধরনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা ন্যায় বিচার নয়’ সেন্ট পিটার জবাবে বললেন, ‘দেখো, স্বর্গের শ্রেণী ও আসন বিন্যাস নির্ভর করে সাধনার কার্যকারিতার ওপর। তুমি অবশ্যই নিজে ধর্ম-কর্ম করেছো; কিন্তু বেশি লোককে দিয়ে প্রার্থনা করাতে পারনি। গীর্জায় তোমার বক্তৃতা ও প্রার্থনা সঙ্গীত শুনে বেশিরভাগ লোক ঘুমিয়ে পড়তো, কিন্তু বেপরোয়া ট্যাক্সিচালক যখনি গাড়ি চালাত আরোহীরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতো। ভগবানের কাছে তোমার চাইতে ট্যাক্সিচালক বেশি কার্যকর। স্বর্গে তাই তার স্থান উপরে।’
এখন পাঠকরাই বিবেচনা করে দেখুন, আন্দোলন আর জুলুমের কার্যকারিতার দিক থেকে কে বেশি যোগ্য, বিরোধী দল না স্বৈরাচারী জালেম সরকার? এদের মধ্যে স্বর্গ কার বেশি প্রাপ্য তার বিচারও আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আওয়ামী ও আনন্দ বাজারী আষাঢ়ে গল্প


ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে সেই প্রবাদ প্রবচনটিও বিশ্বাস করার মত অবস্থা হয়েছে। সেটি হল, ‘গাঁজার নৌকা পাহাড় বইয়া যায়’। তথাকথিত প্রগতিবাদী বন্ধুরা জামায়াত এবং শিবিরকে ইলাস্টিকের মত টেনে লম্বা করেছে এবং গোলায়াথ বা হারকিউলেক্সের মত বলশালী করেছে। তা না হলে যারা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতায় যায়নি তারা একেবারে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম পর্যন্ত দখল করতে যাচ্ছে কিভাবে? এই ধরনের ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। এই ধরনের ঘটনা ঘটে কল্পনায়, ঘটে স্বপ্নে এবং গাঁজার কল্কিতে। তাই যদি না হবে তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনার কথা এল কোত্থেকে? বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মুখ চেনা খবরের কাগজ বিষয়টি নিয়ে খুব তোলপাড় করে। কিন্তু তাদের সমস্ত উন্মাদনার মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে খোদ ভারতীয় সংস্থা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশী কয়েকজনের জড়িত থাকার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কোনো তথ্য দেয়নি ভারত। গত রোববার প্রথম আলোয় এ খবর দেয়া হয়েছে।
এদিকে গত রবিবার বর্ধমানের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) এক সূত্রের উল্লেখ করে বিবিসি জানায়, ওই ঘটনায় যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যা চেষ্টার কথা আদৌ উল্লেখ করা হয়নি। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে তারা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন।
বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত ১২ পলাতক জঙ্গিকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য এনআইএ পুরস্কার ঘোষণা করে। ১২জন পলাতক জঙ্গির মধ্যে চারজন বাংলাদেশি আছে বলে দাবি করছে ভারতের তদন্ত সংস্থা। এই ১২ জঙ্গির মধ্যে পাঁচজনের জন্য ১০ লাখ রুপি, তিনজনের জন্য পাঁচ লাখ এবং বাকি চারজনের জন্য তিন লাখ রুপি করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ২ অক্টোবর বোমা বানাতে গিয়ে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে নিহত হন শাকিল আহমেদ ও সুবহান মন্ডল নামের দুই জঙ্গি। ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে সে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে দাবি করা হয়, তাঁরা বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য।
তবে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বর্ধমানের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশিদের জড়িত থাকার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারের কোনো তথ্য র‌্যাবের কাছে নেই। তবে নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে র‌্যাব সম্প্রতি কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্ধমানের ঘটনায় সরকারিভাবে কোনো তথ্য তাঁদের কাছেও নেই। তিনি মনে করেন, ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশি হিসেবে যে জঙ্গিদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলো তাঁদের আসল পরিচয় নয়। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা এমনিতেই অনেকগুলো নাম ব্যবহার করে। যদি তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তাঁদের একটি স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে। সেই জঙ্গিদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পেলে সেগুলো যাচাই করে তাদের আসল পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
দুই
এদিকে বিবিসির খবরে আরো বলা হয়, বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তের সূত্র ধরে পুলিশ ও তদন্তকারীরা যে জঙ্গি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছেন, বাংলাদেশের মাটিতে তাঁদের সত্যিই কত বড় হামলা ঘটানোর ক্ষমতা ছিল তা নিয়ে সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে। ওই জঙ্গি নেটওয়ার্কের যে লোকবল, অর্থবল বা অস্ত্র সম্ভারের হদিস পাওয়া গেছে সেগুলো দেখেও ধারণা হয় যে একটা বড় মাপের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল না। এনআইএ অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয় তদন্ত সংস্থা তেমন ধারণাই করেন।
কী ছিল জঙ্গিদের উদ্দেশ্য? এক মাসের ওপর হলো এনআইএ এই ঘটনার তদন্ত করছে। যারা ধরা পড়েছেন তাদের কেউ কেউ বলেছেন যে বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তম ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ও সেখানে শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে প্রকৃত ইসলামী শাসনের পথ সুগম করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
কিন্তু প্রায় এক মাস ধরে এই তদন্ত চালানোর পর গোয়েন্দারা ক্রমেই বুঝতে পারছেন যে এগুলো অনেকটাই শেখানো বুলি কিংবা নিছকই কথার কথা। কতটা শক্তিশালী ছিল এই নেটওয়ার্ক? বর্ধমানে ছিল এই জঙ্গি মডিউলটির অস্ত্র কারখানা, যেখানে বিস্ফোরক মজুত করা হতো ও আইডি তৈরি করা হতো। তবে আরডিএক্স বা আরও শক্তিশালী বোমা তৈরির উপাদান কিন্তু সেখানে মেলেনি। এই মডিউলের সঙ্গে যুক্ত দুটো মাদরাসারও সন্ধান মিলেছে। এনআইএ বলছে, এই মাদরাসাগুলোতে জেএমবির সদস্য মোট ১৪ জন মহিলা ক্যাডার জেহাদী প্রশিক্ষণ দিতেন।
এই নেটওয়ার্কের অনেকটা অর্থায়ন হতো আসামের বরপেটা জেলায় এক হাতুড়ে ডাক্তার শাহনূর আলমের মাধ্যমে। ব্যাপক তদন্তের পর চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে সেগুলোতে লেনদেন বন্ধ ছিল মাস তিনেক আগে থেকেই। সীমান্তে গরু পাচার, জাল নোটের কারবারই ছিল এই জঙ্গিদের টাকার উৎস এবং হাওয়ালার মাধ্যমেও তাদের কাছে টাকা পাঠানো হতো বলে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন।
এখানে সংগত ভাবেই একটি প্রশ্ন এসে যায়। সেটি হল, যারা গরু পাচার বা হাওয়ালার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে এবং সেই কাজেও নেতৃত্ব দেয় একজন হাতুড়ে ডাক্তার তাদের পক্ষে কি বস্তা বস্তা টাকা বা শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব? শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নাকি সারদা বাবু। সেটিও চিট ফান্ডের টাকা। চিট ফান্ডের টাকা জেএমবির ক্যাডাররা পেয়েছে এমন কথা ভারতের কোন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়নি।
তিন
তদন্তে রাজনীতির ছায়া পড়েছে বলে ভারতীয় পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী সরকারের তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, এই তদন্তে তারা শুরু থেকেই বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু এখন এই নেটওয়ার্কের মূল হোতা হিসেবে যাকে  চিহ্নিত করা হচ্ছে সেই শেখ সাজিদ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতেই ধরা পড়ার পর সেই অভিযোগ যে কতটা মিথ্যে ছিল তা এখন প্রমাণিত হয়েছে বলে তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের তরফ থেকে দাবী করা হচ্ছে।
তৃণমূলের একজন এমপি বলেছেন, তাদের সন্দেহ, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু- মুসলিম মেরুকরণের রাজনীতি উস্কে দিতেই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির উস্কানিতে বর্ধমান ঘটনা নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জিত করে  নানা কথা বলা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হল, সুসংগঠিত ও মতলবি প্রচারণার ফলে তদন্ত টিমের তদন্তকে প্রভাবিত করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের কথিত পরিকল্পনার কোনো উল্লেখ নেই ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) প্রতিবেদনে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি এনআইএ। ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ধমান বিস্ফোরণ ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে এনআইএ। সেখানে হাসিনা এবং খালেদাকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা নিয়ে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনা ছিল জেএমবির। জেলা তিনটি হলো মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও নদীয়া।
চার
বিজিপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এমন একটি দাবী তুলেছেন যেটি শুধুমাত্র আজগুবিই নয়, বরং যেটি পড়লে চোখ কপালে উঠে যায়। তার এই দাবী প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার ‘আনন্দ বাজার পত্রিকায়’। খবরটির শিরোনাম,‘জামায়াতের হাত ধরেই ক্ষমতায় মমতা, অভিযোগ বিজেপির’। রিপোর্টটিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির গোপন সমঝোতা হয়েছিল বলে অভিযোগ তুলল বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের দাবি, জামায়াতের সাহায্য নিয়েই রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ৭৫টি বিধানসভা আসনের অধিকাংশ আসনে জিতেছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। এই সমঝোতার কারণেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে ঢাকা সফর বাতিল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি রূখে দিয়েছিলেন কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব প্রাপ্ত বিজেপির এই কেন্দ্রীয় নেতা।
মঙ্গলবার কলকাতায় সিদ্ধার্থনাথ বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর সাহায্য নিয়েই সীমান্ত এলাকার ৭৫টি আসনের অধিকাংশে জিতেছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। তৃণমূল জিতেছিল ৩২টি এবং কংগ্রেস ১৩টিতে।” সিদ্ধার্থনাথের দাবি, নির্বাচনে সাহায্য পাওয়ার বিনিময়ে তৃণমূল জামায়াত নেতৃত্বকে আশ্বাস দিয়েছিল, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
আনন্দবাজার লিখেছে, সিদ্ধার্থনাথের প্রশ্ন, এই সমঝোতার ফলেই কি মনমোহন সিংহের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছিলেন মমতা? ২০১১-র ওই সফরে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে তা হতে পারেনি। সিদ্ধার্থনাথ বলেন, “বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট দু’পক্ষের এই সমঝোতার কথাই বলছে। ও দেশের সংবাদপত্রেই এই খবর প্রকাশিত হয়েছে।” তার তোলা এই অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করবেন বলেও জানিয়েছেন ওই বিজেপি নেতা।
তবে সিদ্ধার্থনাথের অভিযোগকে ‘কাল্পনিক’ আখ্যা দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার মন্তব্য, “কলকাতায় বসে সিদ্ধার্থ নাথ বাবু হালে পানি পাননি। এখন চলে গিয়েছেন সীমান্তে। পাগলে কী না বলে। এর পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “যা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বলার এবং তৎপর হওয়ার কথা, যে তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে থাকার কথা, তা একজন প্রাদেশিক নেতার কাছে থাকে কীভাবে? সন্দেহ হয়, রাজনাথ সিংহ কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেই?” তার আরও অভিযোগ, “যে সময়ের কথা উনি বলছেন, তখন তৃণমূল ক্ষমতায় ছিল না”
কংগ্রেসও সিদ্ধার্থনাথের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “বিজেপি যা খুশি তাই বলছে। বিধানসভা নির্বাচনে ভোটটা কি বাংলাদেশের মানুষ এসে দিয়ে গিয়েছিল?”
দেখা যাচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার জন্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগই আদা পানি খেয়ে নামেনি, ওই ধারে ভারতের একটি মহল জামায়াতকে ক্রাশ করতে চায়। জামায়াত নাকি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচনে তৃণমূলকে ৩২টি আসনে জিতিয়ে দিয়েছে। এসব উন্মাদের কথা নিয়ে আলোচনা করারও প্রবৃত্তি হয় না। কিন্তু যথাযথ উত্তর না দিলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। তাই আজ এই বিষয়টি নিয়ে লিখলাম। কারণ ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী ক্যাম্পের মিডিয়া শক্তি প্রবল। ওরা দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারে শুধু মাত্র মিডিয়া শক্তির জোরে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অবশ্যই বুঝবেন যে জামায়াত যদি এতোই শক্তিশালী হতো তাহলে বাংলাদেশে তারা পড়ে পড়ে মার খেত না। 
আসিফ আরসালান 

শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এক কীর্তিমানের কথা


দেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ মাঝে-মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় এসে থাকেন। সম্প্রতি আবারও এসেছেন। তাকে নিয়ে আলোচনা জমে ওঠার কারণ, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ‘সঠিক’ ইতিহাস শেখানোর নামে একজন মাত্র নেতাকে প্রাধান্যে রাখার এবং সকল কৃতিত্ব কেবল তাকেই দেয়ার যে উদ্ভট কর্মকা- বহুদিন ধরে চলে আসছে অবসরপ্রাপ্ত এই জেনারেলও সে কর্মকা-ে নেমে পড়েছেন। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, গত সপ্তাহের নিবন্ধে অতি সংক্ষেপে কে এম সফিউল্লাহ সম্পর্কে বলার পাশাপাশি জানিয়ে রেখেছিলাম, কেউ উল্লেখিত নেতার ব্যাপারে ব্যতিক্রম ঘটালে কিংবা তার সামান্য সমালোচনা করলেই তার পেছনে আওয়ামী ঘরানার লোকজন এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন ওই ব্যক্তি কোনো মহা অপরাধ করে ফেলেছেন! দেশ ও জাতির জন্য যতো অবদানই রেখে থাকুন না কেন নেতার সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে তার আর রেহাই নেই! এমন অবস্থারই শিকার হয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার ‘বীর উত্তম’- যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন। তার অন্য দু-একটি পরিচিতিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন তিনি। তারও আগে, উদ্দিন সাহেবদের আমলে মূলত তারই নেতৃত্বে জাতিকে বিভক্ত করার সুনির্দিষ্ট ভারতীয় এজেন্ডা নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। দীর্ঘদিন এই ফোরামের সভাপতিও ছিলেন এ কে খন্দকার। ভারতপন্থী হিসেবেও বিশেষ পরিচিতি রয়েছে তার। অর্থাৎ সব দিক থেকেই আওয়ামী ঘরানার একজন ‘খাস লোক’ তিনি। কিন্তু এতো কিছুতেও কোনো লাভ হয়নি। অমন একজন কৃতী পুরুষকেই ক’দিন আগে রীতিমতো তুলোধুনো করেছেন কে এম সফিউল্লাহ। তিনি এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকেই এ কে খন্দকারের নাম বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে বসেছেন। দাবিটির কারণ সম্পর্কে পাঠকরাও সম্ভবত এরই মধ্যে জেনে গেছেন। ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ নামে লেখা গ্রন্থে এ কে খন্দকার নাকি অনেক ভুল ও মিথ্যে তথ্য দিয়ে সেই মহান নেতাকে ‘খাটো’ করার গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছেন!
এ পর্যন্ত এসেই গত সপ্তাহে বলতে হয়েছিল, কে এম সফিউল্লাহ নিজে কত বড় ‘কীর্তিমান’ পুরুষ সেটাও অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। এবারের নিবন্ধে একটি মাত্র ঐতিহাসিক ঘটনার- আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এবং বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে সফিউল্লাহর ভূমিকার আলোকে তেমন পর্যালোচনারই চেষ্টা করা হবে। বিস্তারিত উল্লেখের আগে শুরুতে জানিয়ে রাখি, কে এম সফিউল্লাহকে নিয়ে প্রথম দফায় নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল ২০০৯ সালে। সেবার তাকে সর্বোচ্চ অদালতের তিরষ্কার শুনতে হয়েছিল। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, সে বছরের অক্টোবরে শেখ মুজিব হত্যা মামলার শুনানিতে আসামী পক্ষের আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বলেছিলেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, ওইদিন সকাল ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে তিনি নাকি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। অথচ অন্য সাক্ষীরা জানিয়েছেন, সেদিন ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তাছাড়া সফিউল্লাহর সাক্ষ্যতেই জানা গেছে, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাকে টেলিফোনে ফোর্স পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হলেও রাষ্ট্রপতির প্রাণ বাঁচানোর জন্য সফিউল্লাহ সেনা পাঠাননি। এ পর্যায়ে এসেই মাননীয় বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, সফিউল্লাহ একজন কাপুরুষ, ভীতু এবং মিথ্যাবাদী সেনাপতি।
সেবার কথার পিঠে কথাও উঠেছিল। কারণ, সর্বোচ্চ আদালতই প্রথম নয়, তারও আগে খোদ আওয়ামী লীগ থেকেও সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। সকল সরকারের আমলে সুবিধাভোগকারী এই জেনারেলের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম বলেছিলেন, সেদিন আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে ‘পালিয়ে যাওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন! উল্লেখ্য, দুটি অনুষ্ঠানের একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও ছিলেন সামনের সারিতে। শেখ সেলিম বলেছিলেন, সেনা প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকান্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেতো। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার পর পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন সফিউল্লাহ। পরদিন, ২০০৯ সালের ২৩ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে শেখ সেলিমের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি নাকি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও নাকি তার কাছ থেকে ‘ছিনিয়ে’ অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং হত্যাকান্ডে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছিল না! রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন- এই প্রচারণাকে ‘অসত্য’ দাবি করে তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধ হয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে (মুজিবপুত্র শেখ কামাল) মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ পেয়েছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর (‘দ্রুত’ কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে) ‘বেশ কয়েক মিনিট’ তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু গুলীর শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার ‘মনে হয়েছিল’, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই। সফিউল্লাহ দাবি করেছিলেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি হামলার প্রথম খবর পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই তিনি ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ধানমন্ডি যাওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিলের সেনারা নাকি ‘মুভ’ করেনি! এর মধ্যেই সফিউল্লাহ নাকি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে যান। এখানে লক্ষ্য করা দরকার, সফিউল্লাহ নিজেই আবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও নাকি ‘অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে’ ন্যস্ত করা হয়েছিল! এটা সত্য হলে তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন অধিকারে?
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ব্যাপারে সফিউল্লাহ ‘নিশ্চিত খবর’ পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। তিনি তখন তার অফিসে উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এই দু’জনও নাকি তার টেলিফোনে দেয়া নির্দেশ পালন করেননি! ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সফিউল্লাহ নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল! সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল! সেখানে আগে থেকে উপস্থিত নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নিতে’ বলেছিলেন! প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার ব্যাপার এসেছিল কিভাবে? কে এম সফিউল্লাহ তখন নাকি ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজর ডালিম তার ‘পথরোধ’ করে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! মেজর ডালিমকে কেন গ্রেফতার করেননি- এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, পরিস্থিতি ‘কখনোই’ সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলেছে! মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর অফিসের দরোজায় লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন! এরপর ২৪ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং ‘বাধ্য হয়ে’ তিনি রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান!
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ কিন্তু নিজেকে ‘বাঁচাতে’ পারেননি। জনগণ বরং তার কাছ থেকেই জেনেছে, তিনি এমন ‘যোগ্য’ সেনাপ্রধানই ছিলেন যে, ‘খুনি’ মেজররা তার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলার সাহস পেয়েছেন, তাকে ‘ধরে’ নিয়ে গেছেন রেডিও অফিসে এবং তাকে দিয়ে আনুগত্যের শপথ ‘পাঠ’ করিয়ে ছেড়েছেন! সফিউল্লাহ লক্ষ্য করেননি যে, এসবের প্রতিটিই ভারি লজ্জার কথা। তাছাড়া রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। এজন্যই চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও সাবেক এই সেনাপ্রধান দায়দায়িত্ব এড়ানোর মতো যুৎসই বক্তব্য হাজির করতে পারেননি। তার বক্তব্যে বরং প্রমাণিত হয়েছিল, হয় তিনি হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন; না হলে নিজের অধীনস্থদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এই সময়ের আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব হত্যার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে সাবেক এই জেনারেল নিজে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে দিব্যি বহাল তবিয়তে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য পর্যন্ত বানিয়েছেন। কিন্তু শেখ সেলিমের মতো শীর্ষ একজন নেতা হঠাৎ হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়ায় এবং সর্বোচ্চ আদালত তার সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করায় প্রমাদ গুণতে হয়েছিল তাকে। তাকে এমনকি মুজিব হত্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায়ও দাঁড় করানোর দাবি উঠেছিল সে সময়। পাঠকরা ভেবে দেখতে পারেন, মাননীয় আদালত যাকে একজন ‘কাপুরুষ, ভীতু এবং মিথ্যাবাদী সেনাপতি’ বলেছেন তেমন কেউ এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারের মতো একজন ‘বীর উত্তম’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানোর যোগ্যতা রাখেন কি না? একই কথা অন্যদের সম্পর্কেও সমান সত্য, যারা সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের প্রধান নায়ক এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন, যারা একজন মাত্র নেতাকে প্রাধান্যে রাখার জন্য কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে পর্যন্ত ‘রাজাকার’ বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন, পেছনে র‌্যাব-পুলিশসহ সরকারের সমর্থন থাকায় অমন ধৃষ্টতা তারা দেখাতেই পারেন, পারেন যথেচ্ছভাবে মিথ্যাচার করতেও। কিন্তু করা ও বলাটাই সব নয়। ‘সঠিক’ ইতিহাস তো রয়েছেই, জনগণও সবকিছু ভুলে যায়নি! সুতরাং কাউকে কিছু বলার কিংবা জিয়াউর রহমান থেকে এ কে খন্দকার ও কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত দেশের কৃতীপুরুষদের সম্পর্কে কিছু বলার আগে দশবার অন্তত ভেবে দেখা এবং জিহবা সামাল দেয়া দরকার। চামচামোর পরিণতি কতটা লজ্জাকর হয় তার সর্বশেষ প্রমাণ তো এ কে খন্দকারই!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের শেষ নেই


বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সেখানে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। তাদের লক্ষ্য থাকে, যথাসময়ে শিক্ষা সমাপন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করা। এটাই প্রত্যাশিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ থাকবে, কার্যকর নিরাপত্তা থাকবে, নির্বাধ পাঠদান ও পাঠাভ্যাসের সুযোগ থাকবে এবং নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ও ফলাফল প্রকাশিত হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অবস্থা বিরাজ করছে না। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে একশ্রেণীর শিক্ষার্থী খুন, সন্ত্রাস, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যের মতো গুরুতর অপরাধ ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে বহুবারই বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হত্যা, সন্ত্রাস, সহিংসতাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হয় না। ঘটনা ঘটার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় বটে, তবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা হয় না। পুলিশের তদন্তও সেভাবে এগোয় না। এক সময় সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মামলা পরিত্যক্ত হয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক খুন, সন্ত্রাস, সহিংসতা ইত্যাদি অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর সশস্ত্র কর্মীরা অবলীলায় খুনোখুনি, মারামারি ও গোলাগুলী করছে। তাদের রুখা যাচ্ছে না। যারা মারা যাচ্ছে কিংবা পঙ্গু হচ্ছে তাদের খোঁজ কেউ রাখছে না। অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগের জন্মলগ্ন থেকেই এই সংগঠনটির চেতনার মূল অংশ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র। তখন ছাত্রলীগ ছাড়া সাংগঠনিক অবকাঠামোয় অন্য কোনো সংগঠনের জন্ম হয়নি। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে একত্রিত করার গৌরবদীপ্ত দায়িত্বটিও পালন করেছিল ছাত্রসমাজ। এর অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের নামে যে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনটি তৈরি হয়েছিল, সেটিতেও ছাত্রসমাজের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়।
১৯৬৯ সালের অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফার মধ্যে ৬ দফাকে সন্নিবেশিত করার গৌরবও ছাত্রলীগের।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। একের পর এক অস্ত্রবাজি আর অপকর্ম করেই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজারো সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অগণিত শিক্ষার্থী খুন হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। আহতদের মধ্যে অন্তত অর্ধশতাধিক পঙ্গু হয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। এসব হত্যাকা-ে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর কোনো রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা।
সারাদেশেই ছাত্রলীগ নামক দানব ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার প্রক্রিয়ায় প্রায় অর্ধশত নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তির সুপারিশসহ রিপোর্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেয়া হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন হয়নি।
ছাত্রলীগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আওয়ামী লীগের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিএম মোজাম্মেল হক ও আহমেদ হোসেনকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। তারপর থেকে ছাত্রলীগকে নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল কমিটির নেতার সঙ্গেও বসেন কমিটির সদস্যরা। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রাপ্ত তথ্যে সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন।
 ছাত্রলীগের দেখভাল ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্তরা আকার-ইঙ্গিতে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে বক্তব্য পেশ করলেও অবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছেই। এ ছাড়াও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে শিবিরের অনুপ্রবেশের উৎস উল্লেখ করে তা ঠেকানোর পরিকল্পনার নামে বিভিন্ন হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ‘ছাত্রলীগে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে’ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি) শহীদ বরকত হলের ৩০৩ নম্বার রুমের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র একেএম রেজাউল হক তুহিন ২০০২ সালের মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ফরম পূরণ করেছিলেন। তার রোল নং-৯৯০৭৫৬। জালিয়াতির মাধ্যমে অসুস্থতা দেখিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নার্সদের ড্রেস বদলানোর রুমে তালাবদ্ধ করে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২ তিনি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী অধ্যাপক তার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়েল ব্লকের আবাসিক সার্জন ডা. মো. শফিকুর রহমান হাসপাতালের মেট্রোন ও সহকারী মেট্রোনদের নিয়ে কি কি ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনে বের হলে হঠাৎ নার্সদের ড্রেস বদলানোর রুমে পাখা ঘুরছে অথচ বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখে ডা. শফিক তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর দেখেন তিনজন লোক ভেতরে বসে আছেন। ডা. শফিকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেন, তুহিন বিশ্ববিদ্যালয়েল ছাত্র। অন্য দু’জন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ আহসান ও আহমেদ সানি। তারা এই রুমে কিভাবে আসলেন এ প্রশ্নের জবাবে তুহিন বলেন, জরুরি বিভাগের সহকারী নার্স আলতাফ ফারুক ও কর্মচারী শাহজাহানের মাধ্যমে তিনি এখানে অসুস্থতা দেখিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরে তাদের তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পুলিশ ফাঁড়িতে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ ফাঁড়িতে তুহিন বলেন, ‘সে আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটি টিকিট ক্রয় করেন। এই টিকিটটি নিয়ে (মেডিসিন আউটডোর) সাধারণ মেডিকেল অফিসারের কাছে যায়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় আবাসিক সার্জন ডা. হায়দার আলীর কাছে। তিনি তার জন্ডিস রোগের কথা বললে, ডা. হায়দার তাকে দুই নাম্বার ওয়ার্ডে রেফার্ড করেন। তখন তিনি আবার সাড়ে পাঁচ টাকা দিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য একটি ফাইল তৈরি করেন। কিন্তু সেই ফাইল হাসপাতালের ওয়ার্ডে জমা না করে তুহিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান, সে অসুস্থ। যে কোনো হাসপাতালে পরীক্ষা দিতে চান। এর সাথে তুহিন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে তুহিন জানান তার এখানে পরীক্ষা দিতে অসুস্থতার পাশাপাশি আরো সমস্যা রয়েছে। এখানে পরীক্ষা দিলে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। তুহিনের অভিযোগ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসার কাগজপত্র দেখে কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরীক্ষার অনুমতি দেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো চিঠিপত্র পাননি। এভাবেই পরিকল্পনা করে জরুরি বিভাগের আলতাফ ফারুক ও কর্মচারী শাহজাহানকে হাত করে উক্ত রুমে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে মোট ৩টি পরীক্ষাই তালাবদ্ধ অবস্থায় দিয়ে আসছিল।
২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের যুগ্ম-সম্পাদক রোকনুজ্জামান ইডেন কলেজের জনৈক ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে নীলছবি তৈরি করে বাজারে ছেড়েছিলেন ‘রোকন ডটকম।’ ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি শিলু পরকীয়ায় জড়িয়েছিল সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এনামুল হক শামীমের। শিলুকে এনামুল বিয়ে করতে অস্বীকার করলে পরকীয়ার ভিডিও দৃশ্য সাংগঠনিকভাবে শেখ হাসিনার কাছে জমা দিয়েছিল শিলু।
ছাত্রলীগের নেতারা উন্মাদ তা আরেকবার প্রমাণ করে ২০০৫ সালে নীলক্ষেত ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার ও শামসুন্নাহার হলে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মমতাজকে নিয়ে। পরে মমতাজ দেলোয়ারকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ছাড়া কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন দৈনিক আজকের কাগজের বিজ্ঞাপন ম্যানেজারের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে প্রেম করেছিল। পরে টাকার পরিমাণ বেশি না হওয়াতে ম্যানেজারকে শ্রীঘরে যেতে হয়। ছাত্রলীগ সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন তার এলিফেন্ট রোডের বাসায় বহু মেয়েকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আবিষ্কার হয় হেমায়েত হিমু ও আফিফার রোমাঞ্চ প্রেমের কাহিনী। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ খোকন চারুকলা ইনস্টিটিউটে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ধরা পড়েছিল। ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মইনুল মোস্তাক ও বৈশাখী টিভির পরিচালক এমএন এইচ বুলুর স্ত্রীর পরকীয়ার পর লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের নারী কেলেঙ্কারির রাজনীতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করল। 
জিবলু রহমান 

Ads