গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দল হলো ‘লাইফ লাইন’ বা ‘প্রাণ-প্রবাহ’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিগম্যান্ড নিউম্যান এ একথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, রাজনৈতিক দল ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা অচল। পরিপুষ্ট দল ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো চলতেই পারে না। এজন্যই দলকে ‘প্রাণ-প্রবাহ’ বলা হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা বিশ্বের যেসব দেশে উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল রয়েছে। আর আমাদের দেশে? রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা আর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে কার্যক্রম চালাতে পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীকে কাজ করতেই দেওয়া হচ্ছে না। খোদ আওয়ামী লীগও নিজের দলীয় চরিত্র নষ্ট করে গোষ্ঠী চরিত্রে পরিণত হয়েছে। যারা গণতন্ত্র চায়, তারা তো বিরোধী দল আর নিজের দলকে দুর্বল করে না? নিজের আর অপরের রাজনৈতিক দলকে দুর্বল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি বা প্রত্যাশা করা তো ‘সোনার পাথর বাটি’।
বিরোধী দলের প্রতি আক্রমণের কথা তো সবারই জানা। খোদ আওয়ামী লীগে কি হচ্ছে? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, প্রধান ঘাঁটি গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ঘাঁটি কিশোরগঞ্জে দল ভালো নেই। ভারপ্রাপ্তের ঠেলায় দল ন্যুব্জ। কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন নেই দেড় দশক ধরে। সভাপতির পদে একজন বয়স্ক ভারপ্রাপ্ত আছেন। তাকে ঘিরে অতি বয়স্ক কয়েকজন সহ-সভাপতি আছেন, যাদের অধিকাংশই ভয়ানকভাবে অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম। একজন আবার বাইপাসের রোগী ও সরকারি পদাধিকারী। সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ভারপ্রাপ্তের ভারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ মূল সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুর পর একজন ভারপ্রাপ্ত হন, কিছুদিন বাদে তার মৃত্যুর পর আরেকজন ভারপ্রাপ্ত (২য়) হয়ে এখন বেসামাল। কখনো সাধারণ সম্পাদক হওয়ার চিন্তা করেনি, এমন লোকের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সুযোগে নিজের আর্থিক ও ব্যক্তিগত আখের গোছানোই এখন তার কাছে মুখ্য। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের অন্যান্য পদের কথা বলার মতো নয়। পরিবারতন্ত্রের ঝান্ডা হাতে আবদুল হামিদ পরিবার আর সৈয়দ নজরুল পরিবার মুখোমুখি। কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ এখন পরিবারতন্ত্রের শিকার। অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্য এটা কোনো বিচিত্র বিষয় নয়।
দলের নেতৃত্বের মধ্যে এমনই স্থবিরতার পর গণতান্ত্রিক কাউন্সিলের আশা করা বাতুলতা মাত্র। জেলার ১৩টি উপজেলায় কাউন্সিল করাই সম্ভব হয়নি। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, করিমগঞ্জ উপজেলার কাউন্সিলে দুই গ্রুপের মুখোমুখি সংঘর্ষ থামাতে প্রশাসনকে কমপক্ষে ১০টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। তাছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানের কাউন্সিলে জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতারা অতিথি হিসাবে গিয়ে গ্রুপিং উস্কে দিয়ে এসেছেন। তারা চাচ্ছেন, শীর্ষ নেতৃত্বের পদলেহন করে কাউন্সিল ছাড়াই মনোনয়নে দলের পদ-পদবী হাসিল করতে। এক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে হবেন, সেটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষায়, সততায়, দলের প্রতি নিষ্ঠায়, দক্ষতায়, পরিশ্রমে কে কিশোরগঞ্জে দলের ঝান্ডা যোগ্যতার সাথে ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পারবেন, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। এই পদে এখন তিনভাবে যোগ্য লোক বাছাই করা সম্ভব: ১. কাউন্সিলের মাধ্যমে; ২. প্রেসিডেন্টের পছন্দের কাউকে, বা ৩. সৈয়দ আশরাফের পছন্দের কাউকে বসিয়ে দিয়ে। অবশ্য, শেষ কথা নেত্রী শেখ হাসিনাই বলবেন। এটাই আওয়ামী লীগের দস্তুর। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে গণতন্ত্রের চর্চার ভবিষ্যৎও এখন শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভরশীল।
ঐতিহ্যগতভাবে কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগ সৈয়দ নজরুল বা আবদুল হামিদের আমলেও কাউন্সিল বা গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে যায়নি। এবার যদি তার ব্যতিক্রম ঘটে, তবে সেটা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক উত্তরণ না হয়ে অবক্ষয় হবে। তদুপরি আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব বছরের পর বছর সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। দলে প্রেসিডেন্ট-পুত্র ও সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক, সাবেক-প্রেসিডেন্ট পুত্র নাজমুল হাসান পাপন, এমপি আফজাল ও উপজেলা চেয়ারম্যান সারোয়ার (বাজিতপুর), কুলিয়ারচরের নতুন সভাপতি শিল্পপতি মুসা মিয়ার পুত্র প্রমুখ দলের উদীয়মান নেতা। দলে নবীন-প্রবীণ সমন্বয় করতে না পারলে আওয়ামী ঘাঁটি হিসাবে কিশোরগঞ্জের পতন অনিবার্য।
যে কথার উল্লেখ শুরুতেই করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক দল হলো রাজনীতির প্রাণ-প্রবাহ। সে প্রাণ যদি মুখ থুবড়ে পড়ে তাহলে সে স্থান দখল করে অগণতান্ত্রিক, পেশী শক্তি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, এটা প্রমাণের জন্যেই তৃণমূলে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে। দলের কেন্দ্রের মতোই তৃণমূলেও যদি নানা আকারের পরিবারতন্ত্র ছড়িয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের স্থান কোথায় থাকে? প্রসঙ্গত, কিশোরগঞ্জ হলো আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুলের এলাকা। সৈয়দ আশরাফ এখন সে স্থানে সংসদ সদস্য হিসাবে রয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তার যে ন্যূন্যতম ভূমিকা, কিশোরগঞ্জেও তাই। এলাকায় আসা বা দলের কাজকর্মে খোঁজ-খবর নেওয়া তার পক্ষে খুব কমই সম্ভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে না, সেটা যেমন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বা কর্মীরা জানেন, তেমনি সাধারণ মানুষও অবগত। এই দুর্বলতার সুযোগে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ দলের মধ্যে নিজের অবস্থান মজবুত করেছেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি দল নিরপেক্ষ হওয়ায় তার জেষ্ঠ্যপুত্রকে দলে এনে সংসদ সদস্যও করেছেন। তার আরেক পুত্রও রাজনীতিতে আগ্রহী। এই অবস্থায় দলে তাদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন চলে এসেছে। সেটা করতে হলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ কাউকে রেখেই করতে হবে। আবার সেটা কেবল ভাটি অঞ্চলের একই নির্বাচনী এলাকায় করলে হবে না। পুরো জেলাকে নিয়ে করতে হবে। এজন্য সাংগঠনিকভাবে জেলার ভারপ্রাপ্তরা সামাল দিতে পারছে না। অনেকেই কাউন্সিল হবে না মর্মে বিশ্বাস করে আবদুল হামিদ আর সৈয়দ আশরাফ বলয় তৈরি করে গ্রুপিং শুরু করেছেন। দলও বদলাচ্ছেন অনেকেই। সকালে আবদুল হামিদের লোক হয়ে বিকালে সৈয়দ আশরাফের লোক হচ্ছেন অনেকেই। গোয়েন্দা লাগিয়েও এখন কিশোরগঞ্জের কেন কোন নেতা কোন শীর্ষ নেতার প্রকৃত বা আসল লোক সেটা বের করা সম্ভব হবে না। চারদিকে এখন এমনই সন্দেহ আর ধূম্রজাল। তারপরেও এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করার জন্য দলীয় পর্যায়ে জিল্লুর রহমান, কামরুল আহসান শাহজাহান, এডভোকেট শাহ আজিজুল হকের কথাই সবাই বিবেচনা করছেন। এদের মধ্যে কে কোন শীর্ষ নেতার অনুসারী বা কে কার এলাকার লোক সেটা স্পষ্ট। কাউন্সিলের মাধমে সেটা দেখা হলে আসল জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যেত এবং গণতান্ত্রিকভাবে জেলা আওয়ামী নেতৃত্ব তৈরি করতে পারতো। কিন্তু কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে সেটা সম্ভব হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।
আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক রাখা হবে কিনা, সেটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার মতোই জরুরি বিষয়। বস্ততু বাংলাদেশের সকল দলেই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র থাকা, দেশের গণতন্ত্রের জন্য অতি জরুরি পূর্বশত। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় এটা যে, একমাত্র জামায়াতে ইসলামীতে পরিপূর্ণ দলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান এবং দলটি যথা সময়ে দলের নেতা-কর্মীদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেতৃত্ব কাঠামো নিয়ে কাজ করলেও এমন একটি গণতান্ত্রিক দল সবচেয়ে বেশি সমালোলোচনা ও আক্রমণের শিকার হয়েছে ও হচ্ছে। জামায়াতের মতো দলের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রের চর্চাকারী দল বাংলাদেশে আরেকটি আছে কিনা, সন্দেহ। অথচ এই গণতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে কত কত সাজানো অভিযোগই না করা হচ্ছে। মিথ্যারও যে একটি চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সীমা আছে, জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটা বহু আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আর কেউই ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাইও’ নামক নির্দেশ মান্য করছে না; বরং নিজে যেটা পালন করে না ও বিশ্বাস করে না, সেটাই অন্যকে করতে বাধ্য করছে। প্রহসন, ভ-ামীতে ভরে গেছে চারপাশ। ব্যক্তিগত লাভ, লোভ আর স্বার্থের রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে তার ক্ষেত্র। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়; এ কথাটি সম্ভবত এখন উল্টে গেছে। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দল আর রাজনীতি। বিশেষত শাসক দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের স্থলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী/পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিতি হলে সেই দলের পক্ষে পুরো দেশে গণতন্ত্রের প্রসার, প্রচার, চর্চা দুরূহই বটে।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে কি এখন এমনটিই হচ্ছে না?
বিরোধী দলের প্রতি আক্রমণের কথা তো সবারই জানা। খোদ আওয়ামী লীগে কি হচ্ছে? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, প্রধান ঘাঁটি গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ঘাঁটি কিশোরগঞ্জে দল ভালো নেই। ভারপ্রাপ্তের ঠেলায় দল ন্যুব্জ। কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন নেই দেড় দশক ধরে। সভাপতির পদে একজন বয়স্ক ভারপ্রাপ্ত আছেন। তাকে ঘিরে অতি বয়স্ক কয়েকজন সহ-সভাপতি আছেন, যাদের অধিকাংশই ভয়ানকভাবে অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম। একজন আবার বাইপাসের রোগী ও সরকারি পদাধিকারী। সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ভারপ্রাপ্তের ভারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ মূল সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুর পর একজন ভারপ্রাপ্ত হন, কিছুদিন বাদে তার মৃত্যুর পর আরেকজন ভারপ্রাপ্ত (২য়) হয়ে এখন বেসামাল। কখনো সাধারণ সম্পাদক হওয়ার চিন্তা করেনি, এমন লোকের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সুযোগে নিজের আর্থিক ও ব্যক্তিগত আখের গোছানোই এখন তার কাছে মুখ্য। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের অন্যান্য পদের কথা বলার মতো নয়। পরিবারতন্ত্রের ঝান্ডা হাতে আবদুল হামিদ পরিবার আর সৈয়দ নজরুল পরিবার মুখোমুখি। কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ এখন পরিবারতন্ত্রের শিকার। অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্য এটা কোনো বিচিত্র বিষয় নয়।
দলের নেতৃত্বের মধ্যে এমনই স্থবিরতার পর গণতান্ত্রিক কাউন্সিলের আশা করা বাতুলতা মাত্র। জেলার ১৩টি উপজেলায় কাউন্সিল করাই সম্ভব হয়নি। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, করিমগঞ্জ উপজেলার কাউন্সিলে দুই গ্রুপের মুখোমুখি সংঘর্ষ থামাতে প্রশাসনকে কমপক্ষে ১০টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। তাছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানের কাউন্সিলে জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতারা অতিথি হিসাবে গিয়ে গ্রুপিং উস্কে দিয়ে এসেছেন। তারা চাচ্ছেন, শীর্ষ নেতৃত্বের পদলেহন করে কাউন্সিল ছাড়াই মনোনয়নে দলের পদ-পদবী হাসিল করতে। এক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে হবেন, সেটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষায়, সততায়, দলের প্রতি নিষ্ঠায়, দক্ষতায়, পরিশ্রমে কে কিশোরগঞ্জে দলের ঝান্ডা যোগ্যতার সাথে ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পারবেন, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। এই পদে এখন তিনভাবে যোগ্য লোক বাছাই করা সম্ভব: ১. কাউন্সিলের মাধ্যমে; ২. প্রেসিডেন্টের পছন্দের কাউকে, বা ৩. সৈয়দ আশরাফের পছন্দের কাউকে বসিয়ে দিয়ে। অবশ্য, শেষ কথা নেত্রী শেখ হাসিনাই বলবেন। এটাই আওয়ামী লীগের দস্তুর। কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে গণতন্ত্রের চর্চার ভবিষ্যৎও এখন শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভরশীল।
ঐতিহ্যগতভাবে কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগ সৈয়দ নজরুল বা আবদুল হামিদের আমলেও কাউন্সিল বা গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে যায়নি। এবার যদি তার ব্যতিক্রম ঘটে, তবে সেটা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক উত্তরণ না হয়ে অবক্ষয় হবে। তদুপরি আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব বছরের পর বছর সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। দলে প্রেসিডেন্ট-পুত্র ও সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক, সাবেক-প্রেসিডেন্ট পুত্র নাজমুল হাসান পাপন, এমপি আফজাল ও উপজেলা চেয়ারম্যান সারোয়ার (বাজিতপুর), কুলিয়ারচরের নতুন সভাপতি শিল্পপতি মুসা মিয়ার পুত্র প্রমুখ দলের উদীয়মান নেতা। দলে নবীন-প্রবীণ সমন্বয় করতে না পারলে আওয়ামী ঘাঁটি হিসাবে কিশোরগঞ্জের পতন অনিবার্য।
যে কথার উল্লেখ শুরুতেই করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক দল হলো রাজনীতির প্রাণ-প্রবাহ। সে প্রাণ যদি মুখ থুবড়ে পড়ে তাহলে সে স্থান দখল করে অগণতান্ত্রিক, পেশী শক্তি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, এটা প্রমাণের জন্যেই তৃণমূলে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে। দলের কেন্দ্রের মতোই তৃণমূলেও যদি নানা আকারের পরিবারতন্ত্র ছড়িয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের স্থান কোথায় থাকে? প্রসঙ্গত, কিশোরগঞ্জ হলো আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুলের এলাকা। সৈয়দ আশরাফ এখন সে স্থানে সংসদ সদস্য হিসাবে রয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তার যে ন্যূন্যতম ভূমিকা, কিশোরগঞ্জেও তাই। এলাকায় আসা বা দলের কাজকর্মে খোঁজ-খবর নেওয়া তার পক্ষে খুব কমই সম্ভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে না, সেটা যেমন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বা কর্মীরা জানেন, তেমনি সাধারণ মানুষও অবগত। এই দুর্বলতার সুযোগে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ দলের মধ্যে নিজের অবস্থান মজবুত করেছেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি দল নিরপেক্ষ হওয়ায় তার জেষ্ঠ্যপুত্রকে দলে এনে সংসদ সদস্যও করেছেন। তার আরেক পুত্রও রাজনীতিতে আগ্রহী। এই অবস্থায় দলে তাদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন চলে এসেছে। সেটা করতে হলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ কাউকে রেখেই করতে হবে। আবার সেটা কেবল ভাটি অঞ্চলের একই নির্বাচনী এলাকায় করলে হবে না। পুরো জেলাকে নিয়ে করতে হবে। এজন্য সাংগঠনিকভাবে জেলার ভারপ্রাপ্তরা সামাল দিতে পারছে না। অনেকেই কাউন্সিল হবে না মর্মে বিশ্বাস করে আবদুল হামিদ আর সৈয়দ আশরাফ বলয় তৈরি করে গ্রুপিং শুরু করেছেন। দলও বদলাচ্ছেন অনেকেই। সকালে আবদুল হামিদের লোক হয়ে বিকালে সৈয়দ আশরাফের লোক হচ্ছেন অনেকেই। গোয়েন্দা লাগিয়েও এখন কিশোরগঞ্জের কেন কোন নেতা কোন শীর্ষ নেতার প্রকৃত বা আসল লোক সেটা বের করা সম্ভব হবে না। চারদিকে এখন এমনই সন্দেহ আর ধূম্রজাল। তারপরেও এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করার জন্য দলীয় পর্যায়ে জিল্লুর রহমান, কামরুল আহসান শাহজাহান, এডভোকেট শাহ আজিজুল হকের কথাই সবাই বিবেচনা করছেন। এদের মধ্যে কে কোন শীর্ষ নেতার অনুসারী বা কে কার এলাকার লোক সেটা স্পষ্ট। কাউন্সিলের মাধমে সেটা দেখা হলে আসল জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যেত এবং গণতান্ত্রিকভাবে জেলা আওয়ামী নেতৃত্ব তৈরি করতে পারতো। কিন্তু কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগে সেটা সম্ভব হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।
আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক রাখা হবে কিনা, সেটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার মতোই জরুরি বিষয়। বস্ততু বাংলাদেশের সকল দলেই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র থাকা, দেশের গণতন্ত্রের জন্য অতি জরুরি পূর্বশত। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় এটা যে, একমাত্র জামায়াতে ইসলামীতে পরিপূর্ণ দলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান এবং দলটি যথা সময়ে দলের নেতা-কর্মীদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেতৃত্ব কাঠামো নিয়ে কাজ করলেও এমন একটি গণতান্ত্রিক দল সবচেয়ে বেশি সমালোলোচনা ও আক্রমণের শিকার হয়েছে ও হচ্ছে। জামায়াতের মতো দলের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রের চর্চাকারী দল বাংলাদেশে আরেকটি আছে কিনা, সন্দেহ। অথচ এই গণতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে কত কত সাজানো অভিযোগই না করা হচ্ছে। মিথ্যারও যে একটি চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সীমা আছে, জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটা বহু আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আর কেউই ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাইও’ নামক নির্দেশ মান্য করছে না; বরং নিজে যেটা পালন করে না ও বিশ্বাস করে না, সেটাই অন্যকে করতে বাধ্য করছে। প্রহসন, ভ-ামীতে ভরে গেছে চারপাশ। ব্যক্তিগত লাভ, লোভ আর স্বার্থের রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে তার ক্ষেত্র। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়; এ কথাটি সম্ভবত এখন উল্টে গেছে। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দল আর রাজনীতি। বিশেষত শাসক দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের স্থলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী/পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিতি হলে সেই দলের পক্ষে পুরো দেশে গণতন্ত্রের প্রসার, প্রচার, চর্চা দুরূহই বটে।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে কি এখন এমনটিই হচ্ছে না?