মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫

আমদানি খাদ্য নিয়ে বিতর্ক


সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবির পাশাপাশি চাল রফতানির খবর প্রচার করা হলেও বাস্তবে পরিস্থিতির উল্টো অবনতি ঘটে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষাসহ বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই দেশে ২৮ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে, যার মধ্যে চালের পরিমাণ পাঁচ লাখ টন। এ সময় বেসরকারি পর্যায়ে আট দশমিক ৬৯ লাখ টন চাল এবং ১৯ দশমিক শূন্য দুই টন গম আমদানি করা হয়েছে। অর্থবছরের বাকি চার মাসে আরো ১৪ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হতে পারে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিগত অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩১ দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিক টন, চলতি অর্থবছরে সেখানে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হতে পারে ৪২ লাখ মেট্রিক টন। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো, এমন অবস্থার মধ্যেও সরকার নিজের সাফল্য ও কৃতিত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে ২৫ হাজার টন চাল রফতানি করেছে। ফলে সঙ্গত কারণেই খাদ্য উৎপাদনের প্রকৃত হালচাল নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সত্যিই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়ে থাকলে এত বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করার প্রয়োজন পড়তে পারে না। পর্যালোচনায় প্রাধান্যে এসেছে কৃষকদের বঞ্চনা সম্পর্কিত তথ্য। কৃষক বোরো ধানের যথেষ্ট উৎপাদনই করেছিল। কিন্তু সরকার কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। প্রতি মণ ধানের জন্য কৃষককে যেখানে অন্তত ৮০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে সরকার সেখানে মাত্র ৮০ টাকা বেশি অর্থাৎ ৮৮০ টাকা দাম নির্ধারণ করেছিল। সেই দামও পায়নি কৃষক। সরকার নানা অজুহাতে সময় নষ্ট করায় কৃষককে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। আর সে পর্যায়েই মাঠে নেমেছিল ফড়িয়া থেকে মহাজন পর্যন্ত বিশেষ গোষ্ঠী, যাদের পেছনে সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন ও প্রশ্রয় রয়েছে। তারা রাজনীতি তো করেই, অনেকে আবার আওয়ামী লীগেরও নেতা-কর্মী। এই গোষ্ঠীর লোকজন সরকার-নির্ধারিত ৮৮০ টাকার স্থলে প্রতি মণের দাম দিয়েছে বড়জোর ৫০০ টাকা। কোনো কোনো এলাকায় ৪০০ টাকাও পায়নি কৃষক, অথচ ধান কাটার জন্য দিনমজুরকেই দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। ফলে সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়ে তারা চোরাচালানীদের কাছে ধান বিক্রি করেছে। ধানও রাতারাতি চলে গেছে ভারতে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বাস্তবে এটাই ছিল গোপন পরিকল্পনা। একই গোষ্ঠী একদিকে ধান-চাল পাচার করেছে অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে আমদানি করার অনুমতিও আদায় করেছে। মূলত সে কারণেই খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ টন বেড়ে গেছে। তুলনামূলক পরিসংখ্যান হলো, উৎপাদিত ধান-চালের মাত্র ৩৬ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়েছে। বাকি ৬৪ শতাংশই হয় চোরাচালানের পথে ভারতে পাচার হয়েছে নয়তো রয়েছে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর দখলে। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে, ইতিমধ্যে করতে শুরুও করে দিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকিছুর পেছনে খাদ্যশস্য নিয়ে সরকারের অশুভ রাজনীতিই প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। নিজের কৃতিত্ব ও সাফল্য সম্পর্কে জাহির করার জন্য যা আদৌ সত্য নয় তাকেই সরকার জোর করে সত্য বানাতে চেয়েছে। এতেও আপত্তি উঠতো না, সরকারের পক্ষ থেকে যদি কৃষকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হতো। অন্যদিকে মুখে লম্বা অনেক আশ্বাস দিলেও সরকার এ বছরও বোরো মওসুমে কোনো সাহায্য করেনি তাদের। শুধু ধান কেনার সময় ঠকেনি কৃষক, তারও আগে তাকে খোলা বাজার থেকে অনেক বেশি দামে ভারতীয় সার ও বীজ কিনতে হয়েছিল। সেই সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকায় পানির মেশিন চালানোর জন্য কৃষককে ডিজেল কিনতে হয়েছে। সেখানেও সরকারের প্রশ্রয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বিক্রেতারা। এসবের পাশাপাশি প্রয়োজনের সময়ে ব্যাংক ঋণও পায়নি কৃষকরা। তাদের তাই আবারও গ্রামীণ সুদখোর মহাজন এবং এনজিওদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সবশেষে ছিল ধান বিক্রির সময় বঞ্চনা ও বিপদের পালা। অথচ তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এবং আমরাও মনে করি, ধান-চাল নিয়ে অশুভ রাজনীতি করার পরিবর্তে সরকার যদি কৃষকদের জন্য কিছুটা লাভজনক মূল্য পাওয়ারও ব্যবস্থা করতো তাহলে একদিকে চোরাচালান প্রতিহত করা সম্ভব হত, অন্যদিকে খাদ্যশস্যও আমদানি করার প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু দলীয় লোকজনের পকেট ফুলিয়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল বলেই সরকার বাঁকা পথে পা বাড়িয়েছে। আমরা এই নীতি-কৌশল ও উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাই। সরকারের উচিত সস্তা রাজনীতির পথ ছেড়ে কৃষকদের কল্যাণে ভূমিকা রাখা এবং জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads