সোমবার, ২৯ জুন, ২০১৫

স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট ও মানবাধিকারের টুকিটাকি


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস্ এন্ড লেবার সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত রিপোর্টে ২০১৪ সালে এই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটি নিটোল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম, নারী নির্যাতন, বাক-স্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের একাংশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়া, সরকারি খাতের ব্যাপক দুর্নীতি, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতিকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এই বিভাগের সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং বিচারের আগে দীর্ঘমেয়াদী ডিটেনশানের সমালোচনা করে বলা হয় যে, এর ফলে বিচার প্রার্থীরা অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং সরকার বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন। এতে বলা হয় যে, আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা সরকারি কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বুদ্ধ করছে এবং অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার ও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা সংক্রান্ত কোনও পরিসংখ্যান প্রকাশ অথবা এ ব্যাপারে কোনও তদন্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় রিপোর্টে সরকারের সমালোচনা করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাষায় “The Government took limited measures to investigate and Prosecute cases of security force abuse and killing.” রিপোর্টে মানবধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থাকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন রাজনীতি নেই। স্বৈরাচারী পন্থায় আওয়ামী লীগ এখন তার অনুগত এবং জনধিকৃত কিছু দল ও রাজনৈতিক এতিমদের সাথে নিয়ে দেশ শাসন করছেন। বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত এমপি’ ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে অস্ত্রবলে এখন তারা দেশ চালাচ্ছেন এবং কেউ কেউ মনে করেন যে, দেশটি এখন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যভিচারের আঁস্তাকুড়ে পরিণত হয়েছে। আইনের শাসন এখন আর নেই। ফলে ক্ষমতাসীনরা যে যেখানে পারছেন সেখানেই আখের গুছাচ্ছেন।
এদিকে নিরাপত্তা বাহিনী পর্যায়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অংশে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার প্রবণতাও মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হয়। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গত তিন মাসে বিভিন্ন স্থানে ২৮ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এদের কেউ ছিনতাইকালে, কেউ চুরি আবার কেউ বিনা কারণে এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়।
॥ দুই ॥
আমাদের দেশের সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। নিখুঁত ন্যায়বিচার পাওয়া আমার আপনার সকলের অন্যতম মানবিক অধিকার। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান এবং আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যম ছাড়া কারুর নাগরিক অধিকার হরণ করা যায় না। এটা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনে রয়েছে। কিন্তু দেশের সব মানুষ তো আর সংবিধান পড়েননি, গণপিটুনি বা গুলী করে মানুষ হত্যা অথবা তাকে পঙ্গু করে দেয়ার পরিণাম ও তাৎপর্য তাদের সকলেরই জানা থাকার কথা নয়। আইনগত দিক থেকে সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যা করা হলে এ ব্যাপারে মানুষের মটিভেশনের কাজ সম্পন্ন হতো এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কম হতো বলেই মনে হয়। অবশ্য সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এখানে কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে অভিজ্ঞজনদের ধারণা। তাদের মতে আজকে যে বা যে সব দল ক্ষমতাসীন রয়েছেন তারাই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুরানা পল্টনে প্রকাশ্য দিবালোকে সাপের মত পিটিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলেন। আবার এরাই ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহকে একই কায়দায় হত্যা করেছিলেন। এ দু’টি হত্যাকা-ের বিচার এখনো পর্যন্ত হয়নি। এই অবস্থায় গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যার যে সব ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে তার প্রতিকার ও বিচারের ব্যাপারে মানুষ অনেকটা হতাশ।
দেশের প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নেও বিচারালয় রয়েছে। থানায় পুলিশ আছে, ইউনিয়নে চৌকিদার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মী আছে, আদালতে বিচারক আছেন, সরকারি-বেসরকারি উকিল আছেন। আইনকে সমুন্নত রাখা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ও মানুষের মানবিক অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চত করা এদের কাজ। সাংবিধানিক পদ্ধতির বাইরে এবং তার মূল স্পিরিটের সাথে সংগতিহীন বিচারের যে কোন ব্যবস্থাই বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুম করে হত্যা, মাতাল হয়ে পিস্তল দিয়ে গুলী করে পাখির মতো মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে অথবা লুটপাটের উদ্দেশ্যে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মারধোর- এর প্রত্যেকটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে দেশে এই অপরাধের বিচার হয় না সে দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন হত্যা, গুম ও গণপিটুনীর অংশ হয়ে যায় তখন তো কথাই নেই।
প্রতিবাদী হওয়া মানুষের একটি সামাজিক প্রবণতা। এই প্রবণতার পেছনে  কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। এক, পুলিশ ও আইন-আদালতের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে সে সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষের অনীহা ও অনাস্থার মনোভাব। সুবিচার বা ন্যায়বিচার পাবার ক্ষেত্রে মানুষের যখন সংশয় দেখা দেয় তখনি তারা আইনকে হাতে তুলে নেয়। চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে এবং হাতেনাতে অপরাধীদের পাকড়াও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার পরও যখন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় কিংবা নির্দিষ্ট মেয়াদে শাস্তি ভোগ করে পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হয়, তখনি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা থেকে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নিজেদের মর্জিমত বিচার-আচারে লিপ্ত হয়। এই কথা কে না জানে যে, আমাদের দেশের জেলখানাগুলো অপরাধ বিদ্যার এক একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে। অপরাধীদের সংশোধন, অপরাধের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পেশাগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ জেলাখানায় অপরাধীরা খুব একটা পায় না। এখানে তারা পরস্পর পরস্পরের সংস্পর্শে এসে অপরাধের কলাকৌশল সম্পর্কে পারস্পরিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। চুরির অপরাধে যে জেলে যায় সে বড় ডাকাতের জ্ঞান ও ডিগ্রি নিয়ে জেল থেকে বের হয়। এর ফল স্বাভাবিক। মানুষ পাপের পরিবর্তে পাপীকে ঘৃণা করতে শেখে এবং অপরাধের মাত্রা নির্বিশেষে পকেটমার, চোর, ডাকাত, হাইজাকার যাকেই যেখানে ধরতে পারে তাকেই পিটিয়ে হত্যা করে।
দ্বিতীয়ত পিটিয়ে মানুষ মারার আরেকটি কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুস্পষ্ট। এটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ। কিছুসংখ্যক কায়েমী স্বার্থবাদী মাতব্বর, রাজনৈতিক নেতা ও দল এই কাজের উদ্যোক্তা। তারা নিজেদের লোক লেলিয়ে দিয়ে কাল্পনিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিদের মারধোর ও হত্যা করে এবং বিরোধী শিবিরের লোকজনদের আসামী করে থানায় মামলাও করে। বহু নিরপরাধ লোক এই চক্রের হাতে নির্যাতিত হয়। বিভিন্ন জেলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার এর অন্তর্ভুক্ত। এই অত্যাচার এখন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; ইসলামী ছাত্রীসংস্থা ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত পুরুষ ও নারী কর্মীদের বেলায়ও সাংঘাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। বিচারলয়ে গিয়ে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক মামলায় নিরীহ রাজনৈতিক কর্মীদের বিচারের কাজেই বিচারকদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে হয়। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ও অন্যান্য ফৌজদারী অপরাধের জন্য চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার করার তারা সময়ই পান না। ফলে দেশে অপরাধপ্রবণতা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমাদের দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। কিন্তু আমরা আমাদের সমাজে এখন তা দেখতে পাই না। ক্ষমতাসীন দল বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা যত বড় অপরাধই করুক তাদের জন্য সাত খুন মাফ। সামাজিক জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামাজিক সংহতির সমস্ত গ্রন্থিগুলো খুলে পড়ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়ছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো আগেই মেরুদ- হারিয়েছে। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এখন ব্যভিচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সমাজের নৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিচ্ছে। তাদের অপরাধের কোনও বিচার হয় না। সমাজে যারা সুকৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, চরিত্রবান মানুষ তৈরিতে বদ্ধপরিকর তারা এখন সরকারের শত্রু। এ প্রবণতার অবসান হওয়া প্রয়োজন এবং এ জন্য প্রত্যেকটি মানুষের সচেতন ও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তা না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা কেউই তা থেকে রেহাই পাবো না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads