রবিবার, ২৮ জুন, ২০১৫

পলাশীর কথিত যুদ্ধ ও কাশিমবাজার কুঠির ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে রবার্ট ক্লাইভ ও শেঠগণ


কলকাতায় কাশিমবাজার কুঠিস্থ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস আবারো প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে। কারণ  বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতা পাওয়ার কথা যত লেখা আছে; স্বাধীনতা হারানো কথা লেখা আছে ততই। বিশেষত সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হারানোর প্রত্যক্ষ ধারা যদিও এখন আর নেই; তথাপি বিশ্বের দেশে দেশে প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষমতা হারানোর ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাতায়, আমাদের কাছে এবং দূরে এমন উদাহরণেই কমতি নেই। তাই পলাশীর ঘটনা এখনো প্রাসঙ্গিক।    
ইতিহাস জানাচ্ছে যে, উপমহাদেশের আদি ঔপনিবেশিক শক্তি ওলন্দাজরা সযতনে কলকাতাকে এড়িয়ে কুঠি ফেঁদেছিল কিঞ্চিত দূরে, হুগলীর চুঁচুড়ায়। ওলন্দাজদের কেউ কেউ নাকি কলকাতাকে ডাকত ‘গলগথা’ নামে, যার মানে মড়ার খুলি, বা খুলিভর্তি জায়গা। মনে রাখতে হবে, যীশুকে যেখানে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই পাহাড়ের নামও ছিল গলগথা। সেই প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, মহা ষড়যন্ত্র ও দুর্দশার জায়গা বোঝাতে এই কথাটা ব্যবহার হয়। শুধু ওলন্দাজদের দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই।  কারণ, প্রাচীন আমল থেকেই এ অঞ্চল সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায় যে: ‘বঙ্গদেশ মুঘল ও অন্যান্য বৈদেশিকগণের স্বাস্থ্যের প্রতিকূলরূপে বিবেচিত হইত; সেই জন্য যে সকল কর্মচারী রাজার বিরাগভাজন হইত, তাহারাই বঙ্গদেশে প্রেরিত হইত। সুতরাং এই ঊর্বর ভূখ-ে চিরবসন্ত বিরাজমান থাকিলেও, ইহা অন্ধকারময় কারাগার, প্রেতভূমি, ব্যাধিনিকেতন ও যমালয় স্বরূপে পরিগণিত হইত।’ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিক থেকেও এ অঞ্চলের বিবরণ ঐতিহাসিকগণ দিয়েছেন।
এহেন কলকাতায় দুর্ধর্ষ ইংরেজরা এসে ঘাঁটি বানালেন। যদিও তারা জানতেন, ইংরেজদের মধ্যে প্রচলিত ‘টু মনসুন্স’ কথাটা। এর মানে, নতুন সাহেব-মেম জাহাজ থেকে নেমে চন্দ্রপাল (চাঁদপাল) ঘাটে পা রাখার পরে তাঁদের আয়ুর সীমাকাল মাত্র দুটি বর্ষা। এর মধ্যেই কবরের মাটি নিত অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ছেলেছোকরারা আসত চটজলদি টাকা কামানোর ধান্দায়; যুবতী মেয়েরা আসত বড়লোক স্বামীর খোঁজে। তারা অনেকেই গিয়ে মিলত গোরস্থানে।
শুধু সাহেবরা নয়, যে সব পশ্চিমি সেপাই কোম্পানির বাহিনীতে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসত, আক্ষেপ করত তারা এই বলে: ‘দাদ হোয়, খাজ হোয়,/আর হয় হৌহা/ কলকাত্তা নাই যাও/ খাও মৌহা।” তা সত্ত্বেও, তখন এ ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর, কালক্রমে রাজধানী। ফলে, মৌহা না খেয়ে তারা বরং কলকাতাতেই আসত। বিরাম ছিল না লোক আসার। বিরাম ছিল না রোগের, মত্যুরও। আর বিরাম ছিল না তার প্রতি উদাসীন থেকে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার।
এমনই এক শহর প্রতিষ্ঠা করেন জোব চার্ণক্য। আর একে শক্তি ও ভিত্তি দেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভের বয়স তখন মাত্র পঁচিশ। এই যুবক মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য রাইটারশিপ বা কেরানিগিরি চাকরি নিয়ে ভারতের পথে জাহাজে উঠেন। সে সময় তার সামনে ছিল মাত্র দু’টি উপায়: ভারতে গিয়ে ধনবান হওয়া অথবা জ্বরে মরে মারা যাওয়া। তিনি প্রথম উপায়টিই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অনুসরণ করেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ও জাতিগত সাফল্যের স্মারকে পরিণত হয়ে ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে নিজের স্থায়ী  ছাপ অঙ্কন করেন। লর্ড মেকলের ভাষায়- ‘এদেশ (ইংল্যান্ড) অনেক বীর ও রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দিয়ে থাকলেও তার (ক্লাইভ) চেয়ে বড় যোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দেয়নি।’
কিন্তু ক্লাইভ কতটুকু যোদ্ধা আর কতটুকু ষড়যন্ত্রী ছিলেন, ইতিহাস সেটাও জানাচ্ছে। এই জুন মাসে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ কিংবা ষড়যন্ত্রের ঘটনাপ্রবাহে সেসব পুনরায় বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের মতোই স্বাধীনতা হারানোর কথাও ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাই স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস জানা যেমন জরুরি; স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস জানাও তেমনি জরুরি। 
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে পরবর্তী-তাৎপর্য ও গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেছেন। তাঁর এ মতের সঙ্গে কারো দ্বিমত পোষণের অবকাশ খুব কম। তবে বিশ্বখ্যাত এ যুদ্ধটি রণাঙ্গনে দেখি এক ভিন্নরূপ। ২৩ জুন ১৭৫৭। সুবা বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী নামক গ্রামের প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভের সেনাবাহিনী ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে। সকাল নয়টায় যুদ্ধ শুরু, বিকেল চারটার মধ্যেই যুদ্ধ শেষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধ-নাটকে বা ষড়যন্ত্রেই সব শেষ হয়ে গেল। বাংলার স্বাধীনতা গেল। 
এখন ইতিহাসবিদরা বলছেন, পলাশীতে যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার নাম ষড়যন্ত্র। এহেন যুদ্ধ-নাটকের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল প্রবল পরাক্রমশালী ‘ষড়যন্ত্র-কার্যক্রম’ সিরাজের স্থলে ক্লাইভকেই কেবল ক্ষমতায় আনেনি, পলাশীর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা থেকে শুরু করে ক্রমেই সমগ্র ভারতে এবং আরো পরে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থাপন করে রাজনৈতিক-সামরিক শক্তিতে ভরপুর ‘বাণিজ্যিক বলয়’-যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে এবং পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায়। এবং পলাশীর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ‘ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে।’
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলাভাষী অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু সাম্প্রদায়িক ও উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাসকার  ব্যতিত সকল সৎ, যোগ্য এবং প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক একবাক্যে বলেছেন যে, ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল ষড়যন্ত্র আর বিদ্বেষের জাল জগৎশেঠের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল। রবার্ট ক্লাইভ স্বয়ং লিখেছেন, ‘কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি চক্রান্তের পেছনে থাকলেও আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল জগৎশেঠ নিজে।’  মঁশিয়ে জা-ল প্রমুখ সমকালীন-নিরপেক্ষ  ইতিহাসকার লিখেছেন, অনেকদিন ধরে বাংলায় যে সব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিল জগৎশেঠ। ... ইংরেজরা যা করছে (পলাশীর কথিত যুদ্ধবিজয় এবং বাংলা-ভারতে উপনিবেশ স্থাপন) তা জগৎশেঠের সমর্থন ছাড়া কখনো করতে পারত না।’
কে বা কারা এই জগৎশেঠ, সেটা জানা দরকার। শেঠরা বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশের লোক নয়। তারা উত্তর ভারতের যোধপুরের নাগোর  এলাকার মানুষ। জৈন ধর্মের অনুসারী, হীরানন্দ তাদের পূর্ব-পুরুষ। প্রথমে তারা ভাগ্যান্বেষণে বিহারের পাটনায় আসে। হীরানন্দের পুত্র মানিক চাঁদ ঢাকায় তার গদি স্থাপন করে। এ  পর্যায়ে তৎকালীন শাসক মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। মুর্শিদকুলী খানের অনুগমন করে তারা নতুন শহর মুর্শিদাবাদে এসে জেঁকে বসে। বাদশাহ্ ফররুখ শিয়ারের কাছ থেকে তারা শেঠ উপাধি লাভ করে মুর্শিদকুলী খানেরই বদৌলতে। ইতিমধ্যে সারা ভারতের প্রধান প্রধান নগরীতে শেঠদের গদি স্থাপিত হয় এবং চলতে থাকে অর্থলগ্নী ও সুদের ব্যবসা। বলা বাহুল্য, সে যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় জগৎশেঠরা অলিখিত ব্যাংকার হিসাবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চালাতে সচেষ্ট হয়। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হলে ভাগিনা ফতেচাঁদ প্রথম ‘জগৎশেঠ’ উপাধি  প্রাপ্ত হয় এবং তার মৃত্যু হলে তদীয় পৌত্র মাহতাব চাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পায়। অপর শেঠ স্বরূপচাঁদ লাভ করে মহারাজ খেতাব।  শেঠদের গদিতে তৎকালীন সময়ের বাজার মূূল্যে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হত। এহেন জগৎশেঠরা পলাশী বিপর্যয়ের নেপথ্য কারিগর-ষড়যন্ত্রের হোতা।
মূলত নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকেই এরা নানা অপকর্মে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন বটে, কিন্তু শেঠরা ঘাপটি মেরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সংহতির শিকড় কাটতে থাকে। শেঠরা নবাব পরিবারের মধ্যে অর্থ, ঘুষ ও কুমন্ত্রণা দিয়ে নানা উপদল তৈরি করে এবং একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। যে বিভক্তির কারণে তারা ইংরেজদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে তরুণ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে এরা প্রথম থেকেই ছিল খাপ্পা। যে কারণে তারা সিরাজের জন্য দিল্লী থেকে সনদ আনানোর ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও গড়িমসি প্রদর্শন করে। এরা প্রথমে শওকতজঙ্গ, পরে ইয়ার লতিফ ও সর্বশেষ মীর জাফরকে বাংলার নবাব বানানোর প্রজেক্ট গ্রহণ করে। কারণ নবাব সিরাজ ছিলেন লুটেরা-শোষক শেঠদের সীমাহীন নির্যাতন, কায়েমী স্বার্থ ও নীচুতার প্রতিবন্ধক। ফলে তারা নবাব পদে সিরাজকে সহ্য করতে পারেনি এবং নিজেদের বশংবদ একজনকে নবাব বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়। এরাই পুরো ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে এবং ইংরেজ ও প্রাসাদের ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দূতিয়ালী ও সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সম্পাদিত হয় বাংলার স্বাধীনতা-বিনাশী গোপন চুক্তি। আর এভাবেই পদদলিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
বাংলার স্বাধীনতা হারানোর নেপথ্যে কলকাতাস্থ ভয়ঙ্কর-ষড়যন্ত্র এবং ক্লাইভ ও শেঠদের ভূমিকা এতোই উজ্জ্বল যে, কিছুতেই সেটা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তদুপরি প্রায়-তিন শত বছর হয়ে গেলেও ক্লাইভ বা শেঠদের বংশ লোপ পায়নি। তারা এখনো আছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads