শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

ভারত ও প্রণব মুখার্জি প্রসঙ্গে আরো একবার


গত সপ্তাহের নিবন্ধে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে অংশ না নেয়ার কারণ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য উল্লেখ করেছিলাম। এবারের নিবন্ধে খালেদা জিয়ার সে বক্তব্যের ভিত্তিতে কিছু বিশেষ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। মিস্টার মোদি ঘুরে যাওয়ার পরপর ভারতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, নিজের প্রাণনাশের আশংকা ছিল বলেই ২০১৩ সালের মার্চে তিনি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসেননি। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, সেদিন জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ছিল। হরতালের মধ্যে গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে আসার বা যাওয়ার পথে তার ওপর হামলা চালানো হতো এবং হামলা ও হত্যার দায় চাপানো হতো জামায়াতের ওপর। এটাই ছিল সরকারের পরিকল্পনা- ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলেন বলেই খালেদা জিয়া বৈঠক বাতিল করেছিলেন। এটাই ছিল প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার ‘প্রকৃত’ কারণ।
খালেদা জিয়ার কথার মধ্যে সত্যতা আছে কি না তা নিয়ে সরকারের উচিত ব্যাখ্যা দেয়া। আমরা শুধু অন্য কিছু কথা স্মরণ করতে পারি। কথাগুলো সে সময় ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত। তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছিলেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছিলেন! সে প্রচারণা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। এখনো তারা বিএনপির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম তো মাত্র ক’দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়েও মিথ্যাচার করেছেন। অন্যদিকে সত্য কিন্তু তেমন ছিল না- ক্ষমতাসীনরা যেমনটি বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং এখনো বোঝাতে চাচ্ছেন। কারণ, এই সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত তারিখ ছিল ২০১৩ সালের ৪ মার্চ। সেদিন এবং তার আগেরদিন আগেই হরতাল ডেকেছিল ১৮ দলীয় জোটের দ্বিতীয় প্রধান দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে হরতাল ভঙ্গ করা এবং গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া গণহত্যাসহ সরকারের ফ্যাসিস্ট কর্মকা-ের কারণে তার জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল, যে কথাটা এতদিন পর তিনি প্রকাশ করেছেন। এজন্যই খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই নাকি সরকারের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল! ওদিকে ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরো জানিয়েছিল, খালেদা জিয়া আসবেন না- এ খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
ক্ষমতাসীনরা ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করার বিষয়টিকে নিয়ে এভাবে রাজনীতি করলেও দেশপ্রেমিকরা কিন্তু তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট নেত্রীর সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারা বলেছিলেন, সরকার আসলে প্রণব মুখার্জিকেও নিজেদের দাবার ঘুঁটিই বানিয়ে ছেড়েছেন। না হলে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সম্মান দেখানোর সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের গণতন্ত্রসম্মত প্রতিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এতটা ভয়ংকরভাবে মারমুখী হয়ে উঠতো না। তার সফরের ডাশ প্রাক্কালে ডজনে-ডজনে লাশও ফেলতো না। ক্ষমতাসীনরা ঠিকই জানতেন, আন্দোলনকারীদের লাশের ওপর দিয়ে খালেদা জিয়া অন্তত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না। তেমন অবস্থায় তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে এবং নতুন পর্যায়ে ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারবেন। মূলত অমন এক কূটিল কৌশল নিয়েই এগিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। অন্য একটি কথাও ব্যাপকভাবেই আলোচিত হয়েছিল। সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি প্রণব মুখার্জির সমর্থন সংক্রান্ত। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যখন সেনা অফিসারদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন এই প্রণব মুখার্জি নাকি ঢাকা থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘অনুরোধ’ তথা ‘এসওএস’ বার্তা পেয়েছিলেন। এই বার্তার ভিত্তিতেই তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। কলকাতা ও আসামের গৌহাটি বিমান বন্দরে যুদ্ধ বিমানগুলোকেও রেখেছিলেন ‘প্রস্তুত’ অবস্থায়। পিলখানায় হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য পাল্টা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটা ছিল পরিষ্কার হুমকি, যার ওপর ভর করে বিপদ পাড়ি দিয়েছিল সরকার। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন উপলক্ষে প্রণব মুখার্জি আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন। তার কিছু কার্যক্রম নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধু নয়, ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে। সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পর এবং পিলখানা হত্যাকান্ডের ঠিক প্রাক্কালে একই প্রণব মুখার্জি ১০ ঘণ্টার এক রহস্যময় ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন (৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)। তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সফর সম্পর্কে তখন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, সেবার ঢাকায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলের নেত্রী এবং তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। হতে পারে, খালেদা জিয়া তার ‘বন্ধু’ ছিলেন না, কিন্তু গণতন্ত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করাটা প্রণব মুখার্জির কর্তব্য ছিল। তা না করায় মইন উ’র সঙ্গে একান্ত বৈঠক নিয়ে সে সময় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। কারণ, ততদিনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল এবং মইন উ রাষ্ট্রীয় কোনো বিশেষ অবস্থানে ছিলেন না। বলা হয়েছে, এর পর পর সংঘটিত পিলখানা হত্যাকান্ডকে বিবেচনায় নেয়া হলে এবং তারও আগে লগি- বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে তথাকথিত ১/১১ ও রোডম্যাপ এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার কথা স্মরণ করা হলে প্রণব মুখার্জির উদ্দেশ্য সম্পর্কে নাকি ধারণা পাওয়া যেতে পারে! বড়কথা, দু’ দেশের সরকার চেষ্টা চালালেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার বিষয়ে কিন্তু মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছিল, সেটা যদি ‘অশোভন’ ও ‘কূটনৈতিক সৌজন্যের লংঘন’ না হয়ে থাকে তাহলে হরতালের যুক্তিসঙ্গত কারণে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন এত পাড়া মাতানো হয়েছিল?
প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে অন্য একটি কারণের মধ্যে। ক্ষমতাসীনরা আসলে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন খালেদা জিয়ার দুটি বিবৃতির জন্য। প্রথম বিবৃতিটি তিনি দিয়েছিলেন ২ মাচ (২০১৩)। এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, নিরস্ত্র জনগণের ওপর সরকার শুধু গুলী চালাচ্ছে না, গণহত্যার ভয়ংকর অভিযানও চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভিনদেশী কোনো হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশের ওই সময়ের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ সংকট হিসেবে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকার গোটা জাতিকে বিভক্ত করে এক ভয়ংকর সংঘাত ও সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সরকারের মদতে একটি কুচক্রী মহল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে পবিত্র ইসলাম এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে নোংরা কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে। তারা সরকারবিরোধী সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধরে ধরে ‘জবাই’ করতে চাচ্ছে। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম ও গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি ইঙ্গিত করে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকার একটি গোষ্ঠীকে উস্কানিমূলক ও বেআইনী কর্মকা- সংঘটনে প্রতিনিয়ত আস্কারা ও সমর্থন দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে এই গোষ্ঠীর লোকজন জাতীয় জীবনে বিভেদ-বিভাজনকে উস্কে দিচ্ছে। হত্যাকান্ডে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। শাহবাগীরা অভিযুক্ত প্রত্যেককে ফাঁসি দেয়ার যে অন্যায় দাবি জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী তার পক্ষ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি দাবিটি বিবেচনায় রেখে রায় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন ঘটনা নজীরবিহীন। এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের পক্ষেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা কিংবা রায় দেয়া সম্ভব নয়। তাই এ ট্রাইব্যুনালের যে কোনো রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গক্রমে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার আমরাও চাই। তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ এবং দেশী ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে। আমরা বিচারের নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের পক্ষপাতী নই। অন্যদিকে চলমান বিচার প্রক্রিয়া, ট্রাইব্যুনাল ও আইন নিয়ে শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ব্যাপক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। সে কারণে আমরা বার বার সরকারকে সতর্ক করেছি। এ বিচারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য গঠন খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সরকার আমাদের কথায় কান দেয়নি।
৪ মার্চের দ্বিতীয় বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার হীনউদ্দেশ্যে সরকার পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়ে দেশে বিরাজিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি এই আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র থেকে বিরত হওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সজাগ থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিচার প্রক্রিয়ার ওপর বিক্ষোভের চাপ প্রয়োগকে সমর্থন জানিয়ে, জাতিকে বিভক্ত করে ও সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়ে এবং নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়ে সরকার ক্ষমতায় থাকার সব নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ আরো ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। সে কারণে অনতিবিলম্বে ‘রক্তপিপাসু খুনি’ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হলে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। সরকারের জন্য এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। সবশেষে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আসুন সবাই মিলে দেশ বাঁচাই, মানুষ বাঁচাই। আসুন মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ ফসল গণতন্ত্রকে রক্ষা করি। জনগণের জানমালের হেফাজত করি এবং জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করি।
এসব লক্ষ্য অর্জন করার উদ্দেশ্যেই বেগম খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের ৫ মার্চ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিলেন। তার ডাকে সাড়াও পড়েছিল জনগণের মধ্যে। হরতাল পালিত হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। এর কারণ, কোনো একটি প্রশ্নেই তিনি সামান্য বাড়িয়ে বলেননি বরং বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেছিলেন কঠিন সত্য। বস্তুত ইসলাম বিরোধী প্রচন্ড উস্কানি থেকে নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র পর্যন্ত প্রসঙ্গগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সরকারের মদতে শাহবাগের কথিত তরুণ প্রজন্ম শুধু বিচার প্রক্রিয়াকেই চ্যালেঞ্জ করেনি, ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগানের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতার ওপরও হস্তক্ষেপ করেছিল। বন্দী সব নেতাকে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে তারা গায়ের জোরে রায় আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়াও তাই না বলে পারেননি যে, ন্যায়বিচারের সর্বশেষ আশাটুকুও তিরোহিত হয়ে গেছে। একই কারণে এ ট্রাইব্যুনালের যে কোনো রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। ইসলামবিরোধী ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রচারণা ও কর্মকান্ড সম্পর্কেও যথার্থই বলেছিলেন তিনি। ইসলাম ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ না থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার শুধু উস্কানি দিয়ে বেড়ায়নি, ইসলাম এবং স্বাধীনতাকেও মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে নোংরা কুৎসা রটিয়ে বেড়ানোর সাহস পেয়েছে। হীন ও ভয়ংকর এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কিন্তু দেশের ৯০ ভাগ অধিবাসী মুসলমানদের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান দেখানোর পরিবর্তে সরকার পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছিল। প্রণব মুখার্জির সফরের প্রাক্কালে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘটনাপ্রবাহের প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ১১ দিনে পুলিশ ১৭ জনের লাশ ফেলেছিল। এরপর এসেছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা-উত্তর পরিস্থিতি। ২৮ ফেব্রুয়ারির একদিনেই সরকার পুলিশকে দিয়ে ৬০ জনের বেশি মানুষের লাশ ফেলেছিল। সব মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। পৈশাচিক এ হত্যাকা-কেই বেগম খালেদা জিয়া ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তার এ মন্তব্য যথার্থ হলেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বলে বেড়িয়েছিলেন, জামায়াতের ডাকা ৩ ও ৪ মার্চের হরতালের পরদিন হরতালের ডাক দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি নাকি জামায়াতের ‘লেজুড়বৃত্তি’ শুরু করেছে! এ ব্যাপারে এককালের ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্য উল্লেখ করতেই হবে। তিনি বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি জামায়াতের ‘ভারপ্রাপ্ত আমীর’ হয়েছেন! বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা, সম্ভব হলে দল দুটির ঐক্যে ভাঙন ধরানো। এই চেষ্টা তারা বহুদিন ধরেই চালাচ্ছিলেন। বিএনপির জন্য মায়াকান্নাও তারা কম কাঁদেননি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
এ ধরনের কোনো চেষ্টাতেই যে কাজের কাজ কিছু হবে না সে কথা স্বয়ং খালেদা জিয়াই পরিষ্কার করেছিলেন। ২০১৩ সালের ২ মার্চই প্রথম নয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে শুরু থেকেই তিনি একই অবস্থান বজায় রেখেছেন। যেমন জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের পরপর, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিল মুজিব সরকার। চার দশক পর আরেক আওয়ামী লীগ সরকার বিচারের নামে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে সরকারের এই নীতিকে খালেদা জিয়া ‘দু-মুখো নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, বিচারের নামে সরকারের পদক্ষেপটি জাতিকে শুধু বিভক্তই করবে না, দেশে রাজনৈতিক সংঘাতেরও উস্কানি দেবে। প্রায় আড়াই বছর পরও খালেদা জিয়া সে একই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বাস্তবেও দেখা গেছে, সরকার দেশকে বিভক্ত করে ফেলেছে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে এবং দেশের নিরাপত্তা যাতে বিপন্ন না হয় সে জন্যই খালেদা জিয়া দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জনগণ যে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসবে তার লক্ষণ ও সূচনা দেখা গিয়েছিল ৫ মার্চের হরতালে। এজন্যই প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের চাল ও কৌশল তখন কোনো কাজে আসেনি। এখনো আসবে বলে মনে হয় না। কারণ, এতদিন পর খালেদা জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক বাতিল করার প্রকৃত কারণ ফাঁস করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ তো বটেই, ভারতীয়রাও তার কথাই বিশ্বাস করবে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জির তো আরো নির্দিষ্টভাবেই জানার কথা!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads