সোমবার, ১ জুন, ২০১৫

নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর ও দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়াবলী


এই মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে অর্থাৎ আগামী ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তার এই সফরকে ঘিরে সারা দেশে নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সরকার প্রধান হিসেবে তার এই সফর দেশব্যাপী নানা প্রত্যাশারও জন্ম দিয়েছে। অবশ্য তার এই সফরকালে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি সম্পাদিত হবে বলে যারা বিশাল আশা পোষণ করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন হতাশ। তার এই সফর দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে গভীর করবে, আমরা এই আশা পোষণ করে তার বাংলাদেশ সফরকে স্বাগত জানাচ্ছি।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। এই দেশটির মানুষের অভ্যাস আচরণ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে আমাদের শতাব্দীকালের সম্পর্ক। প্রায় আটশ বছর মুসলমানরা এই দেশটি শাসন করেছে। বৃটিশ আমলে স্বাধীনতার জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এই উপমহাদেশের মানুষ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এই অঞ্চলের মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংখ্যালঘুদের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সর্বদা পদানত রাখার প্রচেষ্টা আমাদের এক থাকতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। ভারত পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন সত্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশে আমাদের সহযোগিতা করেছে। তারা শুধু নৈতিক নয় আর্থিক ও সামরিক দিক থেকেও আমাদের সাহায্য করেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনে ও ভয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় ১ কোটি লোককে তারা তাদের ভূখণ্ডে আশ্রয়ও দিয়েছে। তাদের এই বদান্যতা আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। শুধু এই প্রেক্ষিতে নয়, নিকটতম প্রতিবেশী এবং বড় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারতের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
॥ দুই ॥
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন; তিনি আমাদের সম্মানিত মেহমান। রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসাবে তাকে যথাযথ সম্মান দেয়া হোক এটাই আমরা কামনা করবো। তিনি এবং তার সহযাত্রীরা বাংলাদেশে শুধু বেড়াতে আসছেন তা নয়। তাদের দীর্ঘ একটি এজেন্ডা রয়েছে। সম্প্রসারিত ট্রানজিট-করিডোর প্রাপ্তি ও তার অনুকূলে চুক্তি সম্পাদন তাদের এই এজেন্ডার প্রধান লক্ষ্য। এই চুক্তিটি সম্পাদিত হলে তারা বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করতে পারবে, সাথে সমুদ্র ও নৌবন্দরও। এর ফলে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ সহজতর হওয়া ছাড়াও তারা হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন। আগেই বলেছি, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সাথে জনাব মোদির এই সফরকালে একটি চুক্তি হবার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে সে চুক্তিটি হচ্ছে না। তার প্রথম সফরেও একই কারণে তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এই খবরটি নিতান্তই হতাশার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই সফরকে উপলক্ষ করে কিছু কথা বলা এবং তার গোচরীভূত করা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
এর প্রথম কথাটি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক চাই। যদি বন্ধুত্বের কথাই বলি তাহলে এই বন্ধুত্ব নিছক দুই দেশের সরকার নয়, দুই দেশের জনগণের মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভারতকে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে যে বাংলাদেশে দল বিশেষ যখন ক্ষমতায় আসে ও সরকার পরিচালনা করে তখন জনগণ ভারতবিদ্বেষী হয় কেন? জনগণের স্বভাব বৈশিষ্ট্য বিদ্বেষের অনুকূল নয়, কিন্তু তথাপিও বিগত বছরগুলোতে এটি বাস্তব সত্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বন্ধুত্বের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।
দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত  বিষয়সমূহের নিষ্পত্তি। বলা বাহুল্য এই বিষয়গুলো দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে আছে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে নিরপরাধ  বাংলাদেশীদের হত্যা। এই হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতের কর্তৃপক্ষীয় মহলের তরফ থেকে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা রক্ষা করা হয়নি। সীমান্ত এলাকার ৬.৫ কিলোমিটারের সীমানা নির্ধারণ ও উভয় দেশের enclave বাসিন্দাদের সামগ্রিক সমস্যাবলীর সমাধান এবং বাণিজ্য বৈষম্য দূরীকরণ, কারণে অকারণে সীমান্তে গোলাগুলী, সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশী নাগরিকদের গবাদি পশু ও ফসল লুট প্রভৃতি বিষয়কে খাটো করে দেখা যায় না। ভারত সীমান্ত বরাবর কাঁটা তারের বেড়া দিয়েছে। এই বেড়া বন্ধুত্ব উন্নয়নের কাঁটা হিসাবেও কাজ করছে। বেড়া বরাবর অনেক স্থানে সারারাত তারা হাই-ভল্টেজের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখেন। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার ফসলের আলো ও তাপ সংবেদনশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং ফলন কম হয়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা নদীসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে ভারত বিপুলসংখ্যক বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করার ফলে বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়েছে এবং মানুষের জীবনযাত্রাও ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়গুলোর সুরাহা যেমন দরকার তেমনি আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতিও আমরা ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সদাচরণ আশা করি। কয়েকটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করার মতো।
॥ তিন ॥
South Asia Analysis Group কর্তৃক ২০০৭ সালের ৫ জুন প্রকাশিত এক রিপোর্টে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার জনাব পিনাক চক্রবর্তী প্রদত্ত ভাষণের একটি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছিল। এতে তিনি বলেছিলেন, Democracy world be Stronger in Bangladesh of it could establish a real Secular Country like India অর্থাৎ বাংলাদেশে যদি ভারতের ন্যায় প্রকৃত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করা হয় তা হলেই মাত্র এই দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, Bangladesh is a Secular country but here is no real practice of Secularism, as there is a religious Ministry here.” The High commissioner said that democracy is very strong in india as there is no division or discrepancy among the people of different faithy and values and real secularism is practised there. He suggested that Bangladesh follow his country for pactising real secularism which would help it establish a strong democratic country removing all discrepancies among people of different beliefs and values.” তিনি বলেছেন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ কিন্তু এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা নেই ---- যেহেতু এখানে একটি ধর্ম মন্ত্রণালয় রয়েছে।
হাই কমিশনারের মতে ভারতে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার ফলে বিভিন্ন মূল্যবোধ ও ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারীদের মধ্যে কোন বিভেদ বৈষম্য নেই এবং গণতন্ত্রও সেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য তার দেশকে অনুসরণ করার আহ্বান জানান। একজন কূটনীতিকের চমৎকার নোশখা! আফগান বা ইরানী স্টাইলের বিপ্লব রফতানির কথা আমরা শুনেছি তবে তা ঐ দেশগুলোর কূটনীতিকরা প্রকাশ্যে কোথাও করেছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু ভারতীয় স্টাইলের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাজারজাতকরণের যে দৃষ্টান্ত জনাব পিনাক অথবা এর আগে ঐ দেশের তৎকালীন একজন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জয়রাম রমেশ দেখিয়েছিলেন তা অনন্য। ভারতীয় কূটনীতিক জনাব পিনাক চক্রবর্তী তার দেশ ভারতবর্ষ সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখতেন তা আমি জানি না, তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলবো যে ভারতীয়  সেক্যুলারিজম এবং গণতন্ত্র সে দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সাথে বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বৈষম্য ও বঞ্চনাকে কমাতে পারেনি বরং বৃদ্ধি করেছে। সেখানে বিভেদ বৈষম্য নেই বলে তিনি যে দাবি করেছিলেন তা সত্য নয়। তার দেশে এমন দিন নেই যে দিন কোন না কোন রাজ্যে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে না। তাদের প্রতি সুবিচারের কথা বললেন, তার তো অস্তিত্বই নেই।
॥ চার ॥
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ২০০৫ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেছিলেন। ভারতীয় সমাজে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা ও অবস্থান সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য এই কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এই কমিটি বিভিন্ন সরকারি দফতর অধিদফতর এজেন্সিতে মুসলমানদের অবস্থান, চাকরি, বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের অংশগ্রহণ, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার অবস্থা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমানদের জনসংখ্যা, তার অনুপাতে প্রাপ্ত সুবিধা, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সরকারি বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের হার, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, স্কুল-কলেজে ড্রপ আউটের হার অন্যান্য সংখ্যালঘুদের তুলনায় তাদের অবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জরিপ চালিয়ে কমিটি একটি রিপোর্ট দিয়েছে।
সাচার কমিটি সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানদের বঞ্চনার যে তথ্য তার রিপোর্টে তুলে ধরেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা এই নিবন্ধের সীমিত কলেবরে দেয়া সম্ভবপর নয়। আমি শুধু পাঠকদের সুবিধার্থে এর প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ তুলে ধরছি।
 বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রশ্নে কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ÒIn the field of literacy the committee found that the rate among Muslims was far below the national average which is greater in urban areas and women. 25% of Muslim children in the 6-14 years age group have dropped out. Expansion of educational opportunities since independence has not led to a convergence of attainment levels between Muslim and all others. Drop out rates among Muslims are higher at the level of primary, middle and higher secondary. The disparity in graduation attainment rates is widening since 1970 between Muslims and all other categories in both urban and rural areas. In premier colleges only one out of 25 under Graduate students and one out of 50 Postgraduate students is a Muslim. Unemployment rate among Muslim graduates is the highest among all socio-religious communities.
তাদের বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়। ব্যাংক থেকে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা যা ঋণ পায় তার দুই-তৃতীয়াংশ পায় মুসলমানরা। মুসলিম অধ্যুষিত বেশ কিছু এলাকা আছে যেগুলোকে ব্যাংকসমূহ ঋণের জন্য Negative Geographical zone হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। রিপোর্টে আরেকটি তথ্য দেয়া হয়েছে যা ভয়াবহ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যার হার ১৫ থেকে ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আইএএসএতে মুসলমানদের সংখ্যা ৩%, আইএফএসএতে ১.৮% আইপিএসএতে ৪% এবং রেলওয়ে সার্ভিসে আছে ৪.৫% যার ৯৮.৭% হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণী পর্যায়ে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতীয় রাজ্যগুলোর কোথাও চাকরি-বাকরিতে জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নেই। পুলিশ কনস্টেবলের ৬%, স্বাস্থ্য কর্মীদের ৪.৪%, পরিবহন শ্রমিকদের ৬.৫% মুসলমান, আর শিক্ষকতায়? এটা উল্লেখ করার মতো নয়।
আর বাংলাদেশে প্রাইমারি শিক্ষকদের ৪০%, হাইস্কুল শিক্ষকদের ৩২%, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এক চতুর্থাংশের বেশি অমুসলমান। আমাদের সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ১৯% অমুসলমান। এখানে  চাকরি প্রার্থীরা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হন না। অমুসলমান হবার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা অযোগ্য বিবেচিত হন না। কাজেই ভারত অনুসৃত বঞ্চনা ও বৈষম্যের রাষ্ট্র ব্যবস্থা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না।
॥ পাঁচ ॥
এখন বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। ভারত একটি বড় দেশ। বাংলাদেশ তার কোন কোন অঙ্গরাজ্য থেকেও ছোট। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কাবে অথবা সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশ ভূখ- ব্যবহার করতে গিয়ে ভারতের শত্রুতা উপার্জন করবে একথা বোকাও বিশ্বাস করবে না। কেননা এতে বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ নেই। বাংলাদেশ এটা অস্বীকার করেও এসেছে এবং এমনকি বিগত জোট সরকারের আমলে এ ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তরফ থেকে যৌথ তদন্তের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় অভিযোগ অনুযায়ী যেখানে  যেখানে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলোর যথার্থতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে যৌথ টিমের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ হেলিকপ্টার দিতে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু ভারত উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। বরং বার বার একই অভিযোগ করে যাচ্ছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের সমস্যা আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের সৃষ্ট কোনও সমস্যা নয়। এই সমস্যা মানবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ভারতেরই সৃষ্টি। ভারতই এর সমাধান করতে পারে, অবশ্য সামরিক শক্তি দিয়ে নয়। এ ব্যাপারে গত বছর আগস্ট মাসে প্রকাশিত United States Institute of Peace এর Special Report 171 এর বিশ্লষণ প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে “One of  the leitmotifs that have characterized New Delhi’s relations with the Northeast is the tension between demands for regional autonomy and fears of secession. A number of north eastern ethnic and tribal groups have felt that most central governments in New Delhi were not specially sensitive to their needs. They also feared that the dominant culture of Hindi speaking heartland would, overtime, efface their distinctive cultural and ethnic heritage, These misgivings contributed to demands for autonomy and specially in the case of the Nagas, for outright secession from India  এখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের যে আশংকার কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত ঐতিহ্যের বিলুপ্তি। তারা মনে করেছেন এবং দেখে আসছেন যে হিন্দী ভাষাভাষীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে তারা স্বায়ত্তশাসনকেই তাদের রক্ষাকবচ বলে মনে করছে। ভারত তাদের এই দাবিকে দেখছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতি হুমকি তথা বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে। বিশ্লেষকদের ভাষায়, ’Regardless of the regime in New Delhi to Indian states tended to see all these demands through the prism of potential threats to national unity and territorial integrity. This led it to adopt a rather Unyielding stands towards most demands for autonomy. As a result it has repeatedly deployed troops in Assam and northeastern states to abrogate the civil and political rights of much of the population, using considerable force to suppress insurgent movements.”
এখানে বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার। মিজো হোক, নাগা হোক কিংবা অসমীয় অথবা অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠী। ভারত যদি তাদেরকে এই গ্যারান্টি দিতে পারে যে তাদের হাতে তাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব এবং মূল্যবোধ নিরাপদ তা হলে এই ইনসার্জেন্সি অব্যাহত থাকতে পারে না। কিন্তু তারা কি তা করতে পেরেছেন? বাংলাদেশের মানুষকে উপরোক্ত বিষয়গুলো অহরহ নাড়া দেয় তাই আমি এগুলো উল্লেখ করলাম।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads