গত ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার একটি চুক্তিও বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল নয়। আর এই চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, ‘আমাদের যে পার্শ্ববর্তী দেশ, আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো, তাদের সঙ্গে গত ৪০ বছরে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে একটা সীমানা রেখা ছিল, আমি মনে করি ধীরে ধীরে সেটাও আজকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আমরা এখন সবাই এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছি’ (এনটিভি, অনলাইন/মানবজমিন অনলাইন, ০৭.০৬.১৫)। তার অর্থ, ভারত ও বাংলাদেশ ক্রমেই এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে যারা রাস্তাঘাটে বাংলাদেশবিরোধীদের খুঁজে খুঁজে পেরেশান হচ্ছেন, তারা, আশা করি, উপলব্ধি করতে পারছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বা বাংলাদেশবিরোধী কাদের বলে।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মন্ত্রী কিভাবে এখনো মন্ত্রিপরিষদে থাকতে পারে, সেটা দেশবাসীর একটা বড় প্রশ্ন। কই স্বাধীনতাবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী বলে যারা অবিরাম মুখে ফেনা তুলছেন, তারা এখন কোথায়? আমাদের এখনই চিহ্নিত করে রাখার দরকার আছে, কারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ভারতের সাথে এক রাষ্ট্র করতে চাইছে।
আমাদের মধ্যে একটা গৎবাঁধা বুলি আছে : তা হলো একশ্রেণীর নাগরিকের উদ্দেশে আমরা বলতে পছন্দ করি যে, ওরা দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়। এর মানে বোঝা দুঃসাধ্য। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর দুটো মাত্র পথ খোলা আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা একেবারে মাটির গভীর থেকে খুঁড়ে লাখ লাখ আলাদিনের দৈত্যের মাথায় তুলে নিয়ে যেতে হবে পাকিস্তান সীমান্তে। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হবে সিন্ধু প্রদেশের সীমান্তবর্তী করাচির পাশে সমুদ্রের ভেতরে। এলাকাটা এই কারণে বেছে নিতে হবে যে, পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকার সীমান্ত বরাবর রয়েছে আর কোনো দেশ। স্বাভাবিকভাবেই তারা সেখানে বাংলাদেশকে বসিয়ে দেয়ার জন্য ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা ছেড়ে দেবে না। এতএব বাংলাদেশের অবস্থান হবে সমুদ্র থেকে গভীরতম সমুদ্রে।
আরো একটা পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আর তা হলো, আদর্শিকভাবে। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এই প্রক্রিয়াটা বেশ কঠিন ও জটিল। কারণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেই বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সংবিধানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটা লিখে দিলেই বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের জীবনধারা বদলে যাবে না। আর পাকিস্তান হয়ে যাওয়াটা তো বহুদূর। কারণ ইরানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র, পাকিস্তানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র। তাই বলে এই দুই রাষ্ট্র কোনো দিন এক রাষ্ট্র হয়ে যাবে, বর্তমানকালে কোনো পাগলেও বোধকরি এ চিন্তা করতে পারবে না। বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার এই দু’টি পথ ছাড়া ভিন্ন কোনো পদ্ধতি জানা নেই।
তা হলে উপায়? সে উপায় বাতলাতে পারেন এই প্রচারবাজরাই। কোনো উন্মাদও, ধারণা করি বলবে না যে, বাংলাদেশকে মাটি খুঁড়ে গাছের চারার মতো তুলে নিয়ে অন্য কোথায়ও বসিয়ে দেয়া সম্ভব। আর নাম পরিবর্তন করলেই একটি দেশ আরেকটি দেশে পরিণত হয়ে যায় না। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। এ সব কথা বাতকে বাত বা স্লোগান মাত্র। বাস্তবে এসব কথার দুই পয়সাও দাম নেই। আমাদের মধ্যে একশ্রেণীর ইতিহাসজ্ঞানহীন লোক আছেন, যারা এসব কথা গালি হিসেবে ব্যবহার করেন।
কিন্তু দেশে এখনো এমন গালি কেন প্রচলিত হয়নি যে, ওরা বাংলাদেশকে ভারত বানাতে চায়? অথচ বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যে মাত্রায় কঠিন, তার চেয়ে অনেক সহজ ভারত বানানো। কারণ বাংলাদেশকে ভারত বানানোর জন্য দেশটাকে মাটি খুঁড়ে অন্য কোথায়ও তুলে নিয়ে যেতে হবে না। বাংলাদেশ আছে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর। শুধু তাই নয়, এ দেশের তিন দিকই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। উপরন্তু বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রও ঘোষণা করতে হবে না। ভারত হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি শাসিত রাষ্ট্র হলেও তারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ। আর বাংলাদেশ যত বড় স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিতই হোক না কেন, তারাও ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে এই মাসতুতো ভাইদের একত্রে মিলে যাওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। আর সে কারণেই এ দেশের কোনো মন্ত্রী বলতে পারেন যে, ভারত- বাংলাদেশ ক্রমেই একরাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় দালালদের কারসাজিতে এর আগে অন্তত দু’টি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। সে দু’টি রাষ্ট্র হলো মনিপুর ও সিকিম। মাত্র ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মনিপুর ভারতের মিজোরাম সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। লোকসংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ মণিপুরে ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন মিতেই গোষ্ঠীর রাজা নন্দা লাইরেন পাখাম্বা। তিনি ছয়টি গোষ্ঠীকে একীভূত করে তার রাজকাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুবাদ, যা হিন্দুত্ববাদেরই অংশ। মিতেইদের সঙ্গে ওই উপত্যকায় শান্তিতে বসবাস করে মিজোরাও। ১৭২০ সাল থেকে মনিপুরে স্থায়ী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশরা এই রাজ্য অধিগ্রহণ করে। মনিপুর ছিল ব্রিটেনের ভারতভুক্তির শেষ রাজ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ও তার মিত্ররা মনিপুর আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তারা রাজধানী ইমফল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী ওই এলাকায় আসার আগেই মণিপুরীরাই জাপানি বাহিনীকে যুদ্ধ করে হটিয়ে দেয়। এখান থেকেই উপমহাদেশে যুদ্ধে নতুন ধারার সূচনা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালেই মনিপুর ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই বছরই মনিপুর তার সংবিধান রচনা করে। তাতে মহারাজা হন রাষ্ট্রের সম্মানসূচক প্রধান নির্বাহী। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। একটি সংবিধান প্রণীত হয়। তাদের জাতীয় পতাকাও ছিল। সে সংসদে সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও মণিপুরের কংগ্রেস নেতা রাজার ভাই প্রিয়ব্রত সিং ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রিয়ব্রত রাজা হতে চেয়েছিলেন। ভারত তাকে সে আশাও দিয়েছিল। কিন্তু মণিপুরের ভারতভুক্তির পর ভারত সরকার তাকে আর বিশ্বাস করেনি। আর তিনিই ছিলেন মূল বিশ্বাসঘাতক। মনিপুরীরা ঘৃণাভরে তার নাম উচ্চারণ করে। আর লাখো মানুষের ঘৃণা নিয়েই গৃহবন্দী অবস্থায় বহু বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী থাকার পর ২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে তিনি রাজাদের একটি প্রাসাদে বন্দী অবস্থায় মারা যান।
কিন্তু ভারত মনিপুর রাজ্যটি দখল করে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে ১৯৪৭ সাল থেকেই। ১৯৪৯ সালে ভারত মনিপুরের মহারাজা বুদ্ধচন্দ্রকে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে ডেকে পাঠায় এবং অস্ত্রের মুখে ২১ সেপ্টেম্বর তাকে দিয়ে মনিপুরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। যদিও ওই চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সাংবিধানিক অধিকার রাজার ছিল না এবং ওই চুক্তি স্বাক্ষরের তিনি শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করতে থাকেন। তখন তাকে বলা হয় যে, তিনি যদি ভারতভুক্তির স্বাক্ষর না করেন, তবে ভারত রাজপরিবারের অন্য কাউকে রাজা করবেন, যিনি এই চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি আছেন। এটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। রাজপরিবারে বিশ্বাসঘাতক ছিল, কিন্তু নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মতো কেউ ছিল না। শেষে বিপুল সেনা দিয়ে প্রাসাদ ঘিরে ফেলে রাজা বোধচন্দ্রকে দিয়ে ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই নেয়া হয়। এরপর মনিপুরের জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ১৯৪৯ সালেরই অক্টোবরে সামরিক অভিযান চালিয়ে মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ভারত। ১৯৭২ সালে মনিপুর পুরোপুরিভাবে একটি ভারতীয় রাজ্যে পরিণত হয়। আর রাজা শিলংয়ের প্রাসাদে বন্দী থেকে ১৯৫৫ সালে মারা যান।
কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এ উদ্যোগ আসার পর গোটা মনিপুরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছেও প্রতিবাদলিপি পাঠায়। স্পিকারসহ জাতীয় সংসদের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য এর তীব্র বিরোধিতা করে। তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রিয়ব্রত (মণিপুরের ভাষায় তার নামের উচ্চারণ প্রিয়ব্রাত্তা) মনিপুরে সব বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। কিন্তু তাকেও বিশ্বাস করেনি ভারত। ফলে তাকেও একটি প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়।
আর ভারতভুক্তির পর থেকেই মনিপুরিরা তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে। সে যুদ্ধ চলছেই। এমনকি মনিপুরের স্বাধীনতাকামীরা মোদির বাংলাদেশ সফরের পাক্কালে গেরিলা হামলা চালিয়ে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে।
আর সিকিমের বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। মণিপুর, নেপাল, সিকিম আর ভুটান দখলের স্বপ্ন ছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর। শ্রীলঙ্কার দিকেও তার চোখ ছিল। তবে তিনি শুধু মণিপুর দখল করে যেতে পেরেছিলেন। সিকিম দখল করেছেন তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। ভুটান জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়ে যাওয়ায় দখলে অসুবিধা হয়ে যায়। তবে দেশটি সম্পূর্ণরূপে ভারতের কব্জায়ই আছে।
লেন্দুপ দর্জি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। ছিলেন সিকিমে। তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে তার লক্ষ্য ছিল, সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা। সে লক্ষ্যেই তিনি রাজা চোগিয়ালের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে চোগিয়াল দক্ষতার সঙ্গেই তা মোকাবিলা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় র-এর প্ররোচনা ও ধারাবাহিক আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৭৩ সালে দর্জি যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা আর মোকাবিলা করতে পারেননি চোগিয়াল। চোগিয়াল ধরে নিয়েছিলেন, তিনি গান্ধীর অনুসারী ও ভারত-অনুরক্ত। ফলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মতো কোনো কাজ ভারত করবে না। কিন্তু তবু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের পতন ঘটে এবং সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ভারতের চাপে রাজা চোগিয়াল সরকার, সিকিম কংগ্রেস ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি বলে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতেই জয়লাভ করে সিকিম কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হন দেশদ্রোহী দর্জি আর তিনি নেপালের খ্যাতিমান পত্রিকা কান্তিপুরের সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, ওই নির্বাচনে বা আন্দোলনে যত না সিকিমিজ অংশ নিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় অংশ নিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। সংসদে দর্জি ভারতের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব তেলেন এবং তা বিনা বাধায় পাস হয়ে যায়। আর সে পথ ধরেই ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ সিকিম ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। তার চার দিন পরে তথাকথিত এক গণভোটে সিকিমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তাতেও বেশির ভাগ ভোট দিয়েছিল সাদা পোশাকে ভারতীয় সৈন্যরা। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাই রাষ্ট্রদোহী ব্যক্তির নাম আর মীরজাফর নেই, লেন্দুপ দর্জি হয়ে গেছে।
১৯৭৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ক্ষমতায় ছিলেন পাঁচ বছর। সিকিমে ১৯৭৯ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে দর্জির কংগ্রেস একটি আসনও লাভ করতে পারে না। ফলে এই রাষ্ট্রদ্রোহী দর্জিকে ক্ষমতা শুধু নয়, সিকিম ছেড়েই চলে যেতে হয়। ভারত সরকার তাকে পশ্চিমবঙ্গের কালিমপংয়ে কার্যত বন্দী করে রাখে এবং তাকে বাকি জীবন তার জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে নিঃসঙ্গ কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময় ভারতীয় আইবির লোকেরা সপ্তাহে দুদিন এসে তাকে গাট্টি গাট্টি টাকা দিয়ে যেত। ওই সাংবাদিক সুধীর শর্মার সঙ্গে দু’দফা সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দুঃখ ও আফসোস করেছেন। বলেছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শুধু কি তিনি একাই দায়ী?
সুধীর শর্মাকে তিনি জানান, ‘র’সহ যে ভারতীয় গোয়েন্দারা তার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছে, তাদের সঙ্গে দিনাতিপাতের টাকা পয়সার জন্য কথা বলতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখনো কখনো মাসের পর মাস। নিজের সার্বভৌম দেশকে অন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার ঘৃণা তার প্রতি এতটাই তীব্র ছিল যে, তার আত্মীয়স্বজনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন না। সিকিমবাসীর এই পর্বতপ্রমাণ ঘৃণা নিয়ে ১০৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই কাজী লেন্দুপ দর্জি মারা যান। ইতিহাস সাক্ষী, এ পর্যন্ত কোনো দেশদ্রোহীরই বেদনাবিহীন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মন্ত্রী কিভাবে এখনো মন্ত্রিপরিষদে থাকতে পারে, সেটা দেশবাসীর একটা বড় প্রশ্ন। কই স্বাধীনতাবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী বলে যারা অবিরাম মুখে ফেনা তুলছেন, তারা এখন কোথায়? আমাদের এখনই চিহ্নিত করে রাখার দরকার আছে, কারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ভারতের সাথে এক রাষ্ট্র করতে চাইছে।
আমাদের মধ্যে একটা গৎবাঁধা বুলি আছে : তা হলো একশ্রেণীর নাগরিকের উদ্দেশে আমরা বলতে পছন্দ করি যে, ওরা দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়। এর মানে বোঝা দুঃসাধ্য। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর দুটো মাত্র পথ খোলা আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা একেবারে মাটির গভীর থেকে খুঁড়ে লাখ লাখ আলাদিনের দৈত্যের মাথায় তুলে নিয়ে যেতে হবে পাকিস্তান সীমান্তে। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হবে সিন্ধু প্রদেশের সীমান্তবর্তী করাচির পাশে সমুদ্রের ভেতরে। এলাকাটা এই কারণে বেছে নিতে হবে যে, পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকার সীমান্ত বরাবর রয়েছে আর কোনো দেশ। স্বাভাবিকভাবেই তারা সেখানে বাংলাদেশকে বসিয়ে দেয়ার জন্য ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা ছেড়ে দেবে না। এতএব বাংলাদেশের অবস্থান হবে সমুদ্র থেকে গভীরতম সমুদ্রে।
আরো একটা পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আর তা হলো, আদর্শিকভাবে। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এই প্রক্রিয়াটা বেশ কঠিন ও জটিল। কারণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেই বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সংবিধানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটা লিখে দিলেই বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের জীবনধারা বদলে যাবে না। আর পাকিস্তান হয়ে যাওয়াটা তো বহুদূর। কারণ ইরানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র, পাকিস্তানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র। তাই বলে এই দুই রাষ্ট্র কোনো দিন এক রাষ্ট্র হয়ে যাবে, বর্তমানকালে কোনো পাগলেও বোধকরি এ চিন্তা করতে পারবে না। বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার এই দু’টি পথ ছাড়া ভিন্ন কোনো পদ্ধতি জানা নেই।
তা হলে উপায়? সে উপায় বাতলাতে পারেন এই প্রচারবাজরাই। কোনো উন্মাদও, ধারণা করি বলবে না যে, বাংলাদেশকে মাটি খুঁড়ে গাছের চারার মতো তুলে নিয়ে অন্য কোথায়ও বসিয়ে দেয়া সম্ভব। আর নাম পরিবর্তন করলেই একটি দেশ আরেকটি দেশে পরিণত হয়ে যায় না। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। এ সব কথা বাতকে বাত বা স্লোগান মাত্র। বাস্তবে এসব কথার দুই পয়সাও দাম নেই। আমাদের মধ্যে একশ্রেণীর ইতিহাসজ্ঞানহীন লোক আছেন, যারা এসব কথা গালি হিসেবে ব্যবহার করেন।
কিন্তু দেশে এখনো এমন গালি কেন প্রচলিত হয়নি যে, ওরা বাংলাদেশকে ভারত বানাতে চায়? অথচ বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যে মাত্রায় কঠিন, তার চেয়ে অনেক সহজ ভারত বানানো। কারণ বাংলাদেশকে ভারত বানানোর জন্য দেশটাকে মাটি খুঁড়ে অন্য কোথায়ও তুলে নিয়ে যেতে হবে না। বাংলাদেশ আছে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর। শুধু তাই নয়, এ দেশের তিন দিকই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। উপরন্তু বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রও ঘোষণা করতে হবে না। ভারত হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি শাসিত রাষ্ট্র হলেও তারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ। আর বাংলাদেশ যত বড় স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিতই হোক না কেন, তারাও ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে এই মাসতুতো ভাইদের একত্রে মিলে যাওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। আর সে কারণেই এ দেশের কোনো মন্ত্রী বলতে পারেন যে, ভারত- বাংলাদেশ ক্রমেই একরাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় দালালদের কারসাজিতে এর আগে অন্তত দু’টি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। সে দু’টি রাষ্ট্র হলো মনিপুর ও সিকিম। মাত্র ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মনিপুর ভারতের মিজোরাম সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। লোকসংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ মণিপুরে ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন মিতেই গোষ্ঠীর রাজা নন্দা লাইরেন পাখাম্বা। তিনি ছয়টি গোষ্ঠীকে একীভূত করে তার রাজকাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুবাদ, যা হিন্দুত্ববাদেরই অংশ। মিতেইদের সঙ্গে ওই উপত্যকায় শান্তিতে বসবাস করে মিজোরাও। ১৭২০ সাল থেকে মনিপুরে স্থায়ী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশরা এই রাজ্য অধিগ্রহণ করে। মনিপুর ছিল ব্রিটেনের ভারতভুক্তির শেষ রাজ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ও তার মিত্ররা মনিপুর আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তারা রাজধানী ইমফল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী ওই এলাকায় আসার আগেই মণিপুরীরাই জাপানি বাহিনীকে যুদ্ধ করে হটিয়ে দেয়। এখান থেকেই উপমহাদেশে যুদ্ধে নতুন ধারার সূচনা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালেই মনিপুর ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই বছরই মনিপুর তার সংবিধান রচনা করে। তাতে মহারাজা হন রাষ্ট্রের সম্মানসূচক প্রধান নির্বাহী। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। একটি সংবিধান প্রণীত হয়। তাদের জাতীয় পতাকাও ছিল। সে সংসদে সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও মণিপুরের কংগ্রেস নেতা রাজার ভাই প্রিয়ব্রত সিং ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রিয়ব্রত রাজা হতে চেয়েছিলেন। ভারত তাকে সে আশাও দিয়েছিল। কিন্তু মণিপুরের ভারতভুক্তির পর ভারত সরকার তাকে আর বিশ্বাস করেনি। আর তিনিই ছিলেন মূল বিশ্বাসঘাতক। মনিপুরীরা ঘৃণাভরে তার নাম উচ্চারণ করে। আর লাখো মানুষের ঘৃণা নিয়েই গৃহবন্দী অবস্থায় বহু বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী থাকার পর ২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে তিনি রাজাদের একটি প্রাসাদে বন্দী অবস্থায় মারা যান।
কিন্তু ভারত মনিপুর রাজ্যটি দখল করে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে ১৯৪৭ সাল থেকেই। ১৯৪৯ সালে ভারত মনিপুরের মহারাজা বুদ্ধচন্দ্রকে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে ডেকে পাঠায় এবং অস্ত্রের মুখে ২১ সেপ্টেম্বর তাকে দিয়ে মনিপুরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। যদিও ওই চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সাংবিধানিক অধিকার রাজার ছিল না এবং ওই চুক্তি স্বাক্ষরের তিনি শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করতে থাকেন। তখন তাকে বলা হয় যে, তিনি যদি ভারতভুক্তির স্বাক্ষর না করেন, তবে ভারত রাজপরিবারের অন্য কাউকে রাজা করবেন, যিনি এই চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি আছেন। এটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। রাজপরিবারে বিশ্বাসঘাতক ছিল, কিন্তু নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মতো কেউ ছিল না। শেষে বিপুল সেনা দিয়ে প্রাসাদ ঘিরে ফেলে রাজা বোধচন্দ্রকে দিয়ে ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই নেয়া হয়। এরপর মনিপুরের জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ১৯৪৯ সালেরই অক্টোবরে সামরিক অভিযান চালিয়ে মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ভারত। ১৯৭২ সালে মনিপুর পুরোপুরিভাবে একটি ভারতীয় রাজ্যে পরিণত হয়। আর রাজা শিলংয়ের প্রাসাদে বন্দী থেকে ১৯৫৫ সালে মারা যান।
কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এ উদ্যোগ আসার পর গোটা মনিপুরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছেও প্রতিবাদলিপি পাঠায়। স্পিকারসহ জাতীয় সংসদের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য এর তীব্র বিরোধিতা করে। তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রিয়ব্রত (মণিপুরের ভাষায় তার নামের উচ্চারণ প্রিয়ব্রাত্তা) মনিপুরে সব বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। কিন্তু তাকেও বিশ্বাস করেনি ভারত। ফলে তাকেও একটি প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়।
আর ভারতভুক্তির পর থেকেই মনিপুরিরা তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে। সে যুদ্ধ চলছেই। এমনকি মনিপুরের স্বাধীনতাকামীরা মোদির বাংলাদেশ সফরের পাক্কালে গেরিলা হামলা চালিয়ে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে।
আর সিকিমের বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। মণিপুর, নেপাল, সিকিম আর ভুটান দখলের স্বপ্ন ছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর। শ্রীলঙ্কার দিকেও তার চোখ ছিল। তবে তিনি শুধু মণিপুর দখল করে যেতে পেরেছিলেন। সিকিম দখল করেছেন তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। ভুটান জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়ে যাওয়ায় দখলে অসুবিধা হয়ে যায়। তবে দেশটি সম্পূর্ণরূপে ভারতের কব্জায়ই আছে।
লেন্দুপ দর্জি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। ছিলেন সিকিমে। তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে তার লক্ষ্য ছিল, সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা। সে লক্ষ্যেই তিনি রাজা চোগিয়ালের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে চোগিয়াল দক্ষতার সঙ্গেই তা মোকাবিলা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় র-এর প্ররোচনা ও ধারাবাহিক আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৭৩ সালে দর্জি যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা আর মোকাবিলা করতে পারেননি চোগিয়াল। চোগিয়াল ধরে নিয়েছিলেন, তিনি গান্ধীর অনুসারী ও ভারত-অনুরক্ত। ফলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মতো কোনো কাজ ভারত করবে না। কিন্তু তবু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের পতন ঘটে এবং সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ভারতের চাপে রাজা চোগিয়াল সরকার, সিকিম কংগ্রেস ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি বলে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতেই জয়লাভ করে সিকিম কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হন দেশদ্রোহী দর্জি আর তিনি নেপালের খ্যাতিমান পত্রিকা কান্তিপুরের সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, ওই নির্বাচনে বা আন্দোলনে যত না সিকিমিজ অংশ নিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় অংশ নিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। সংসদে দর্জি ভারতের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব তেলেন এবং তা বিনা বাধায় পাস হয়ে যায়। আর সে পথ ধরেই ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ সিকিম ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। তার চার দিন পরে তথাকথিত এক গণভোটে সিকিমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তাতেও বেশির ভাগ ভোট দিয়েছিল সাদা পোশাকে ভারতীয় সৈন্যরা। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাই রাষ্ট্রদোহী ব্যক্তির নাম আর মীরজাফর নেই, লেন্দুপ দর্জি হয়ে গেছে।
১৯৭৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ক্ষমতায় ছিলেন পাঁচ বছর। সিকিমে ১৯৭৯ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে দর্জির কংগ্রেস একটি আসনও লাভ করতে পারে না। ফলে এই রাষ্ট্রদ্রোহী দর্জিকে ক্ষমতা শুধু নয়, সিকিম ছেড়েই চলে যেতে হয়। ভারত সরকার তাকে পশ্চিমবঙ্গের কালিমপংয়ে কার্যত বন্দী করে রাখে এবং তাকে বাকি জীবন তার জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে নিঃসঙ্গ কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময় ভারতীয় আইবির লোকেরা সপ্তাহে দুদিন এসে তাকে গাট্টি গাট্টি টাকা দিয়ে যেত। ওই সাংবাদিক সুধীর শর্মার সঙ্গে দু’দফা সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দুঃখ ও আফসোস করেছেন। বলেছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শুধু কি তিনি একাই দায়ী?
সুধীর শর্মাকে তিনি জানান, ‘র’সহ যে ভারতীয় গোয়েন্দারা তার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছে, তাদের সঙ্গে দিনাতিপাতের টাকা পয়সার জন্য কথা বলতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখনো কখনো মাসের পর মাস। নিজের সার্বভৌম দেশকে অন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার ঘৃণা তার প্রতি এতটাই তীব্র ছিল যে, তার আত্মীয়স্বজনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন না। সিকিমবাসীর এই পর্বতপ্রমাণ ঘৃণা নিয়ে ১০৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই কাজী লেন্দুপ দর্জি মারা যান। ইতিহাস সাক্ষী, এ পর্যন্ত কোনো দেশদ্রোহীরই বেদনাবিহীন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন