শেষ পর্যন্ত বিএনপি চলমান আন্দোলন থেকে তেমন কিছু অর্জন করতে সমর্থ হবে না বলে মনে করছে সরকার। অবরোধ-হরতালে নেতা-কর্মীদের আইন-শৃংখলা বাহিনী দ্বারা মাঠে নামতে না দেয়ায় এ ধরনের মনোভাব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের কাছে। ফলে সংলাপ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগে আপাতত সাড়া দেবে না সরকার।
সরকার মনে করছে, এ অবস্থায় প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি দলীয় কর্মসূচি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ২০ দল বিরোধী জনমত জোরদার করতে হবে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সমর্থিত বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে।
সরকার মনে করে, বিএনপি সামনে থেকে এই কর্মসূচি দিলেও তা পালনের ক্ষেত্রে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাই সম্পৃক্ত হচ্ছেন না। জ্যেষ্ঠ অনেক নেতাও দলের কর্মসূচি সম্পর্কে আগে থেকে জানতে পারেন না। এতে নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন থাকছেন। বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের দাবি জোরালো হলে সরকারও কৌশলী হবে। তারা খালেদা জিয়াকে সংলাপের জন্য কিছু শর্ত দিতে পারে। প্রথমেই থাকবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করা। ইতোমধ্যে ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সরকারের প্রতি সংলাপে বসার আহ্বানের পাশাপাশি বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসও তাদের সম্পাদকীয়তে বিএনপিকে সহিংসতা ও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। আরও কিছু শর্তের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা, নাশকতার দায় স্বীকার করা এবং এর জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামবে কি করে? নষ্ট রাজনীতি নষ্ট উদাহরণের জন্ম দিচ্ছে। প্রকৃতিগতভাবে এই সংসদ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আস্ফালন করছেন আর এর বিপরীতে ‘ফায়ার’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গেছে। গুলীর খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে থাকছে ঘটনাস্থলে। ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দুঃশাসন টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্র এখন ভয়াল ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র যেন আওয়ামী লীগের তহবিলে কেনা হয়েছে। তাই এ অস্ত্র ব্যবহারে কোনো জবাবদিহিতার দরকার নেই। বিবৃতিতে আরও বলেন, আওয়ামী লীগপন্থি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা নির্বিচারে গুলী করে মানুষ হত্যার ছাড়পত্র দিয়েছেন তাদের জওয়ানদের। ‘অস্ত্র, গোলাবারুদ কেন অকেজো করে রাখা হয়েছে’-এ ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছেন র্যাবের ডিজি। দেশে এখন বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে নাকি কিছু নেই বলেও উল্লেখ করেছেন র্যাবের এই মহাপরিচালক। রিজভী বলেন, খিলগাঁও ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে কোন বিচারের আওতায় হত্যা করা হয়েছে? কোন আদালতের রায়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বিধবা করা হয়েছে? সপ্তাহখানেক আগে দলের চারজন কর্মীকে ধরে নিয়ে গিয়ে টার্গেট করে বিচারবহির্ভূত এই হত্যা করা হয়েছে জনগণের টাকায় কেনা বুলেট দিয়ে। সরকার নিজেই বড় ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাতে পারে বলে বিদেশি অনলাইন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার দুই দিনের মাথায়ই রাজধানীর ডেমরায় বাসে আগুন দিয়ে ৩৫ জন বাসযাত্রীকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো। তার পর দিন শোকে কাতর সন্তানহারা মা খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করে মামলা দেয়া হলো। পুরো ঘটনাটিই সরকারের একটা মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। রিজভী আরও বলেন, পেট্রোলবোমা, গানপাউডার, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মানুষ পোড়ানো, লগি-বৈঠার তাণ্ডবে লাশের ওপর নৃত্য ইত্যাদি সর্বনাশা মরণখেলা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭ জানুয়ারি ২০১৫)
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ার একটি ঘটনায় পুলিশের ভাষ্য, তিনজন তরুণকে গণপিটুনি দিয়ে ও গুলী করে হত্যা করেছে স্থানীয়রা। অথচ নিহত তিন তরুণের দেহে ছিল মোট ৫৪টি গুলীর চিহ্ন। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনেই এত গুলীর চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পিটুনির কোনো চিহ্ন নেই। এলাকাবাসীও বলেছেন, গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। অথচ পুলিশের দাবি, তারা গণপিটুনি ও গুলীতে নিহত হয়েছেন।
সাধারণত গণপিটুনির ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে এর শিকারদের কাপড়-চোপড়, স্যান্ডেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। পড়ে থাকে লাঠি বা গণপিটুনিতে ব্যবহৃত উপকরণও। তবে এই ঘটনাস্থলে গুলীর খোসা, দড়ি ছাড়া সে রকম কিছু ছিল না। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন, এখানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। রাত পৌনে ১০টার দিকে অপরিচিত ১০-১২ জন লোক ওই তিন তরুণকে বেঁধে অন্ধকার গলিতে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর গলি থেকে একসঙ্গে প্রচুর গুলীর শব্দ আসে। প্রায় এক ঘণ্টা পর লোকগুলো তিন তরুণের লাশ ফেলে চলে যায়।
পরে তিন তরুণের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় মিরপুর থানার পুলিশ। ময়নাতদন্তে তাদের শরীরে মারধরের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সুরতহাল প্রতিবেদনে মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ পারভেজ উল্লেখ করেন, তিনজনের মধ্যে একজনের দেহে ২২টি, একজনের দেহে ১৭টি এবং অপরজনের দেহে ১৫টি গুলীর ক্ষত (মোট ৫৪টি) রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী বলেও সুরতহালে উল্লেখ করা হয়।
সুরতহাল প্রতিবেদনে ‘প্রাথমিক তদন্তের’ বরাত দিয়ে বলা হয়, নিহত তিনজন কয়েকজন সহযোগীসহ কাজীপাড়ার কৃষিবিদ ভবনের সামনে ককটেল, পেট্রোল, পেট্রোলবোমাসহ নাশকতার জন্য অবস্থান করলে জনতা তাদের ধাওয়া দেয়। বাইশবাড়ী এলাকায় তাদের ধরে ফেলে পিটুনি দেয় ও গুলী করে গুরুতর জখম করে, যার কারণে তাদের মৃত্যু হয়।
তবে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খান বলেন, শেওড়াপাড়া এলাকা (কাফরুল থানার মধ্যে পড়েছে) থেকে ওই তিনজনকে তিনটি ককটেল, চার লিটার পেট্রোলসহ ধরে জনতা। এরপর তাদের মিরপুর থানাধীন বাইশবাড়ী এলাকায় নেয়া হয়। সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের পিটিয়ে ও গুলী করে হত্যা করে। কারা গুলী করল জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকের কাছেই লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। মানুষকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে নিজের ও অন্যের জান-মাল রক্ষার জন্য। এখন সেই অস্ত্র নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আসলে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জনরোষের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ। পুলিশ জানিয়েছে, এই তিনজনের নাম জুয়েল, সুমন ও রবিন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডেফলবাড়িয়া গ্রামের একটি মাঠ থেকে উপজেলার চরখাজুরা গ্রামের নাসিম বিশ্বাসের ছেলে দুলাল হোসেন (২৬) ও সদর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার বিএনপির নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম আজম ওরফে পলাশের (২৮) গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, চার-পাঁচ দিন আগে এই দুজনকে পৃথক স্থান থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। পলাশ কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। তার স্ত্রী ও আড়াই বছরের এক মেয়ে রয়েছে। পলাশের স্ত্রী নাজনীন নাহার অভিযোগ করেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পলাশকে খুঁজতে বাড়িতে পুলিশ আসে। পলাশ বাড়িতে ছিলেন না। পুলিশ ঘরে তল্লাশি চালায়। পরদিন পলাশ দশমাইল বাজারে গেলে সেখান থেকে তাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় বলে জানতে পারেন। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও তার দেখা মেলেনি। তিনি বলেন, ‘পলাশের নামে কোনো মামলা ছিল না। তার পরও পুলিশ তাকে ধরতে আসে। তাকে মেরে ফেলতেই খোঁজাখুঁজি করেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত সেটাই করলো।’
নিহত দুলালের ভাই আলাল হোসেন বলেন, তারা যমজ ভাই। দুলাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়াারি দুলাল মালামাল কিনতে ঝিনাইদহ শহরে যান। এরপর তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। তার মুঠোফোনও ছিল বন্ধ। তারা অনেক খুঁজেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরেও গেছেন। কিন্তু সন্ধান পাননি। পরে লাশ পাওয়া গেল। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়। সরকার মনে করছে, এই উদ্যোগ মূলত বিএনপিকে টেনে তোলার প্রচেষ্টা। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নাগরিক সমাজের চিঠির জবাব দেয়ার সম্ভাবনা কম।
দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু করেছিলেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য দুই জোটের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। এজন্য ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার হলে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকরা ‘জাতীয় সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেমিনারের উদ্যোক্তা ছিলেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। ওই সভা থেকে প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি দেশে চলমান সঙ্কট নিরসনে প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য লিখিত অনুরোধও জানিয়েছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়ে একই রকম চিঠি দিয়েছিলেন ড. হুদা। ওই চিঠির সঙ্গে কিছু প্রস্তাবনাও উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক বিরোধ বা সঙ্কট নিরসনের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রীতি হচ্ছে সংলাপ। এর কোন বিকল্প নেই। সংলাপ হতে হবে দেশের সকল সক্রিয় রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমরা প্রথমেই সরকারকে অনুরোধ করছি এবং এ ব্যাপারে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করছি।
বিএনপি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও আওয়ামী লীগ নেতারা এর বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠক থেকে নাগরিক সমাজের দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর আবারও ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সংলাপে সহায়তা দিতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ড. এ টি এম শামসুল হুদা। ওইদিন ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে ১৩ সদস্যের একটি নাগরিক কমিটির ঘোষণা দেন তিনি। ড. এ টি এম শামসুল হুদা নিজেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, এ এস এম শাহজাহান, ড. আকবর আলি খান, সিএম শফি সামী, রাশেদা কে চৌধুরী, রোকেয়া আফজাল রহমান, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. শাহদীন মালিক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী, ড. আহসান মনসুর, ড. বদিউল আলম মজুমদার। (সূত্র: দৈনিক মানবজমিন ২ মার্চ ২০১৫)
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় নিয়মিতভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যত দায়মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন, তা সাধারণ মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে, তার পরিণতি সাধারণ মানুষকে কীভাবে বইতে হবে, সে বিষয় বিবেচনা করা হয়নি। এ ধরনের কথাবার্তা, আচরণ ও নির্দেশনা আইনের শাসনের অনুপস্থিতির স্মারক ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি জোটের একজন সংসদ সদস্য যখন সংসদে দেয়া বক্তৃতায় বিএনপি নেতাকে গ্যাংগ্রিন বর্ণনা করে ‘কেটে ফেলার’ আহ্বান জানান, তখন তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগের লক্ষণ দেখি না।
১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম ছিল ৩৩ অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা ছিল যে অপরাধের অভিযোগ ব্যতীত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি শুধু অপরাধমূলক কাজ, অর্থাৎ অপরাধের অভিযোগেই কেবল গ্রেফতার বা আটক হতে পারবেন। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর দ্বারা ৩৩ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বলা হলো ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশ’ দেয়া যাবে এবং নিবর্তনমূলক আটকাদেশ-সংক্রান্ত আইন অসাংবিধানিক হবে না। অর্থাৎ আইন করে এমন বিধান করা যাবে, যার অধীনে কোনো ব্যক্তি অপরাধ না করলেও সরকার যদি মনে করে যে ব্যক্তিটি দেশ বা সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারে বা করতে উদ্যত হতে পারে, তাহলে সে ব্যক্তিকে আটক করা যাবে। অর্থাৎ জেলহাজতে পুরে রাখা যাবে। কোনো অপরাধ করার দরকার নেই, সরকারের মনে হলেই হবে যে ব্যক্তিটি অপরাধমূলক কাজ করতে পারে, তাহলেই যথেষ্ট। তাকে গ্রেফতার করে সোজা কারাগারে।
অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলে আটকে রাখা যাবে। কিন্তু ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশে’ গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কোনো বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরও করতে হবে না, সরাসরি কারাগারে পাঠানো যাবে। এই দ্বিতীয় সংশোধনীর পর যে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ হলো, তাতে কারাগারে আটকে রাখার ব্যাপারে এক অর্থে সরকারকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ শুধু অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি হলো। কোনো ব্যক্তি ‘বিপজ্জনক’ বা অপরাধ করতে পারে, সরকার সে রকম মনে করলেই তাকে আটকাতে পারবে এবং জেলে পুরে রাখতে পারবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। তবে ছয় মাস অন্তর একটা উপদেষ্টা বোর্ডের সামনে আটকে থাকা ব্যক্তিটিকে হাজির করতে হবে।
দ্বিতীয় সংশোধনীর আগে বলা ছিল, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইন অসাংবিধানিক বা বাতিল হবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে বলা হলো যে এখন থেকে সংবিধান সংশোধনী আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হলে সে আইন বাতিলযোগ্য হবে না। অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী আইন করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হলো।
দ্বিতীয় সংশোধনীতে বহিঃশক্রর আক্রমণ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এমনকি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ক্ষমতা দেয়া হলো। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ বিকল্প ব্যবস্থা বা ক্ষমতার প্রয়োগ হচ্ছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা। সংবিধানের ১৪১(ক) ধারায় বলা আছে, অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতি অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এ সময় সংবিধানের ছয়টি অনুচ্ছেদের বিধান এবং মৌলিক অধিকার স্থগিত থাকে।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়বে। জরুরি অবস্থা জারি করলে বিরোধীদের জেলে পোরা যায়। নিবর্তনমূলক আটকাদেশ বা বিশেষ ক্ষমতা আইনেও কারণে-অকারণে বিরোধীদের কারাবন্দী করা যায়।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দায়মুক্তি নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আওয়ামী লীগ ও পরে বাকশাল সরকার তৎকালীন তাদের বিরোধীদের কারাগারে পুরতে পেরেছিল বছর দেড়েক ধরে-১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত।
‘রাজনৈতিক মামলা’ বলে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েক হাজার মামলা থেকে সরকারি দলের লোকজনকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। আর এখন চলছে দুদকের দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেয়ার খেলা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে সরকার নিজেদের লোকজনের দায়মুক্তি দেয়ার একটা খুব ‘চালাকি’পূর্ণ কৌশল বের করেছে। অভিযোগ দাখিল, তদন্ত, মামলা দায়ের এবং শেষ পর্যন্ত তদন্তে কোনো কিছু পাওয়া গেল না বলে আদালত দ্বারা মামলা খারিজ।
প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ১৪ দল আয়োজিত হরতাল-অবরোধে নিহত ব্যক্তিদের গায়েবানা জানাযা শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। একই দিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, প্রয়োজনে সরকার সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১ মার্চ ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের রামুতে নবগঠিত দশম পদাতিক ডিভিশনের দরবার হলে সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য বলেছেন, দেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় সশস্ত্র বাহিনীকেও হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর নিন্দাও জানিয়েছেন।
সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মনে করেন, র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও আনসার দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে সংবিধান অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিকল্প নেই। তবে সরকার এখনো বিশ্বাস করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ? আলোচনা করলেই কি তিনি মেনে নেবেন? মেনে তো নেবেন না। তার সঙ্গে আলোচনা মানেই তো জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কার সঙ্গে বসবো? ওদের হাতে তো পোড়া মানুষের গন্ধ। আমার তো মনে হয় খালেদা জিয়ার পাশে বসলে বার্ন ইউনিটের পোড়া মানুষের গন্ধ পাওয়া যাবে। তারা বোমা মেরে পুড়িয়ে মানুষ মারছে। সে জন্য এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে.....।’
এদিকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সঙ্কটের কোনো সমাধান হবে না। দেশের বিবেক বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ জানে, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের একটিই মাত্র পথ আছে-তা হলো সবার অংশগ্রহণমূলক অর্থপূর্ণ নির্বাচন। যত দ্রুত তা আয়োজন করা হবে ততই তা সবার জন্য মঙ্গলজনক। বিলম্ব করা হলে সঙ্কট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
সরকার মনে করছে, এ অবস্থায় প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি দলীয় কর্মসূচি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ২০ দল বিরোধী জনমত জোরদার করতে হবে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সমর্থিত বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে।
সরকার মনে করে, বিএনপি সামনে থেকে এই কর্মসূচি দিলেও তা পালনের ক্ষেত্রে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাই সম্পৃক্ত হচ্ছেন না। জ্যেষ্ঠ অনেক নেতাও দলের কর্মসূচি সম্পর্কে আগে থেকে জানতে পারেন না। এতে নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন থাকছেন। বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের দাবি জোরালো হলে সরকারও কৌশলী হবে। তারা খালেদা জিয়াকে সংলাপের জন্য কিছু শর্ত দিতে পারে। প্রথমেই থাকবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করা। ইতোমধ্যে ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সরকারের প্রতি সংলাপে বসার আহ্বানের পাশাপাশি বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসও তাদের সম্পাদকীয়তে বিএনপিকে সহিংসতা ও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। আরও কিছু শর্তের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা, নাশকতার দায় স্বীকার করা এবং এর জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামবে কি করে? নষ্ট রাজনীতি নষ্ট উদাহরণের জন্ম দিচ্ছে। প্রকৃতিগতভাবে এই সংসদ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আস্ফালন করছেন আর এর বিপরীতে ‘ফায়ার’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গেছে। গুলীর খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে থাকছে ঘটনাস্থলে। ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দুঃশাসন টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্র এখন ভয়াল ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র যেন আওয়ামী লীগের তহবিলে কেনা হয়েছে। তাই এ অস্ত্র ব্যবহারে কোনো জবাবদিহিতার দরকার নেই। বিবৃতিতে আরও বলেন, আওয়ামী লীগপন্থি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা নির্বিচারে গুলী করে মানুষ হত্যার ছাড়পত্র দিয়েছেন তাদের জওয়ানদের। ‘অস্ত্র, গোলাবারুদ কেন অকেজো করে রাখা হয়েছে’-এ ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছেন র্যাবের ডিজি। দেশে এখন বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে নাকি কিছু নেই বলেও উল্লেখ করেছেন র্যাবের এই মহাপরিচালক। রিজভী বলেন, খিলগাঁও ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে কোন বিচারের আওতায় হত্যা করা হয়েছে? কোন আদালতের রায়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বিধবা করা হয়েছে? সপ্তাহখানেক আগে দলের চারজন কর্মীকে ধরে নিয়ে গিয়ে টার্গেট করে বিচারবহির্ভূত এই হত্যা করা হয়েছে জনগণের টাকায় কেনা বুলেট দিয়ে। সরকার নিজেই বড় ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাতে পারে বলে বিদেশি অনলাইন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার দুই দিনের মাথায়ই রাজধানীর ডেমরায় বাসে আগুন দিয়ে ৩৫ জন বাসযাত্রীকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো। তার পর দিন শোকে কাতর সন্তানহারা মা খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করে মামলা দেয়া হলো। পুরো ঘটনাটিই সরকারের একটা মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। রিজভী আরও বলেন, পেট্রোলবোমা, গানপাউডার, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মানুষ পোড়ানো, লগি-বৈঠার তাণ্ডবে লাশের ওপর নৃত্য ইত্যাদি সর্বনাশা মরণখেলা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭ জানুয়ারি ২০১৫)
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ার একটি ঘটনায় পুলিশের ভাষ্য, তিনজন তরুণকে গণপিটুনি দিয়ে ও গুলী করে হত্যা করেছে স্থানীয়রা। অথচ নিহত তিন তরুণের দেহে ছিল মোট ৫৪টি গুলীর চিহ্ন। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনেই এত গুলীর চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পিটুনির কোনো চিহ্ন নেই। এলাকাবাসীও বলেছেন, গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। অথচ পুলিশের দাবি, তারা গণপিটুনি ও গুলীতে নিহত হয়েছেন।
সাধারণত গণপিটুনির ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে এর শিকারদের কাপড়-চোপড়, স্যান্ডেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। পড়ে থাকে লাঠি বা গণপিটুনিতে ব্যবহৃত উপকরণও। তবে এই ঘটনাস্থলে গুলীর খোসা, দড়ি ছাড়া সে রকম কিছু ছিল না। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন, এখানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। রাত পৌনে ১০টার দিকে অপরিচিত ১০-১২ জন লোক ওই তিন তরুণকে বেঁধে অন্ধকার গলিতে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর গলি থেকে একসঙ্গে প্রচুর গুলীর শব্দ আসে। প্রায় এক ঘণ্টা পর লোকগুলো তিন তরুণের লাশ ফেলে চলে যায়।
পরে তিন তরুণের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় মিরপুর থানার পুলিশ। ময়নাতদন্তে তাদের শরীরে মারধরের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সুরতহাল প্রতিবেদনে মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ পারভেজ উল্লেখ করেন, তিনজনের মধ্যে একজনের দেহে ২২টি, একজনের দেহে ১৭টি এবং অপরজনের দেহে ১৫টি গুলীর ক্ষত (মোট ৫৪টি) রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী বলেও সুরতহালে উল্লেখ করা হয়।
সুরতহাল প্রতিবেদনে ‘প্রাথমিক তদন্তের’ বরাত দিয়ে বলা হয়, নিহত তিনজন কয়েকজন সহযোগীসহ কাজীপাড়ার কৃষিবিদ ভবনের সামনে ককটেল, পেট্রোল, পেট্রোলবোমাসহ নাশকতার জন্য অবস্থান করলে জনতা তাদের ধাওয়া দেয়। বাইশবাড়ী এলাকায় তাদের ধরে ফেলে পিটুনি দেয় ও গুলী করে গুরুতর জখম করে, যার কারণে তাদের মৃত্যু হয়।
তবে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খান বলেন, শেওড়াপাড়া এলাকা (কাফরুল থানার মধ্যে পড়েছে) থেকে ওই তিনজনকে তিনটি ককটেল, চার লিটার পেট্রোলসহ ধরে জনতা। এরপর তাদের মিরপুর থানাধীন বাইশবাড়ী এলাকায় নেয়া হয়। সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের পিটিয়ে ও গুলী করে হত্যা করে। কারা গুলী করল জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকের কাছেই লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। মানুষকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে নিজের ও অন্যের জান-মাল রক্ষার জন্য। এখন সেই অস্ত্র নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আসলে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জনরোষের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ। পুলিশ জানিয়েছে, এই তিনজনের নাম জুয়েল, সুমন ও রবিন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডেফলবাড়িয়া গ্রামের একটি মাঠ থেকে উপজেলার চরখাজুরা গ্রামের নাসিম বিশ্বাসের ছেলে দুলাল হোসেন (২৬) ও সদর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার বিএনপির নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম আজম ওরফে পলাশের (২৮) গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, চার-পাঁচ দিন আগে এই দুজনকে পৃথক স্থান থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। পলাশ কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। তার স্ত্রী ও আড়াই বছরের এক মেয়ে রয়েছে। পলাশের স্ত্রী নাজনীন নাহার অভিযোগ করেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পলাশকে খুঁজতে বাড়িতে পুলিশ আসে। পলাশ বাড়িতে ছিলেন না। পুলিশ ঘরে তল্লাশি চালায়। পরদিন পলাশ দশমাইল বাজারে গেলে সেখান থেকে তাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় বলে জানতে পারেন। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও তার দেখা মেলেনি। তিনি বলেন, ‘পলাশের নামে কোনো মামলা ছিল না। তার পরও পুলিশ তাকে ধরতে আসে। তাকে মেরে ফেলতেই খোঁজাখুঁজি করেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত সেটাই করলো।’
নিহত দুলালের ভাই আলাল হোসেন বলেন, তারা যমজ ভাই। দুলাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়াারি দুলাল মালামাল কিনতে ঝিনাইদহ শহরে যান। এরপর তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। তার মুঠোফোনও ছিল বন্ধ। তারা অনেক খুঁজেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরেও গেছেন। কিন্তু সন্ধান পাননি। পরে লাশ পাওয়া গেল। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়। সরকার মনে করছে, এই উদ্যোগ মূলত বিএনপিকে টেনে তোলার প্রচেষ্টা। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নাগরিক সমাজের চিঠির জবাব দেয়ার সম্ভাবনা কম।
দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু করেছিলেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য দুই জোটের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। এজন্য ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার হলে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকরা ‘জাতীয় সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেমিনারের উদ্যোক্তা ছিলেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। ওই সভা থেকে প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি দেশে চলমান সঙ্কট নিরসনে প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য লিখিত অনুরোধও জানিয়েছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়ে একই রকম চিঠি দিয়েছিলেন ড. হুদা। ওই চিঠির সঙ্গে কিছু প্রস্তাবনাও উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক বিরোধ বা সঙ্কট নিরসনের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রীতি হচ্ছে সংলাপ। এর কোন বিকল্প নেই। সংলাপ হতে হবে দেশের সকল সক্রিয় রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমরা প্রথমেই সরকারকে অনুরোধ করছি এবং এ ব্যাপারে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করছি।
বিএনপি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও আওয়ামী লীগ নেতারা এর বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠক থেকে নাগরিক সমাজের দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর আবারও ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সংলাপে সহায়তা দিতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ড. এ টি এম শামসুল হুদা। ওইদিন ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে ১৩ সদস্যের একটি নাগরিক কমিটির ঘোষণা দেন তিনি। ড. এ টি এম শামসুল হুদা নিজেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, এ এস এম শাহজাহান, ড. আকবর আলি খান, সিএম শফি সামী, রাশেদা কে চৌধুরী, রোকেয়া আফজাল রহমান, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. শাহদীন মালিক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী, ড. আহসান মনসুর, ড. বদিউল আলম মজুমদার। (সূত্র: দৈনিক মানবজমিন ২ মার্চ ২০১৫)
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় নিয়মিতভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যত দায়মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন, তা সাধারণ মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে, তার পরিণতি সাধারণ মানুষকে কীভাবে বইতে হবে, সে বিষয় বিবেচনা করা হয়নি। এ ধরনের কথাবার্তা, আচরণ ও নির্দেশনা আইনের শাসনের অনুপস্থিতির স্মারক ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি জোটের একজন সংসদ সদস্য যখন সংসদে দেয়া বক্তৃতায় বিএনপি নেতাকে গ্যাংগ্রিন বর্ণনা করে ‘কেটে ফেলার’ আহ্বান জানান, তখন তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগের লক্ষণ দেখি না।
১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম ছিল ৩৩ অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা ছিল যে অপরাধের অভিযোগ ব্যতীত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি শুধু অপরাধমূলক কাজ, অর্থাৎ অপরাধের অভিযোগেই কেবল গ্রেফতার বা আটক হতে পারবেন। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর দ্বারা ৩৩ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বলা হলো ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশ’ দেয়া যাবে এবং নিবর্তনমূলক আটকাদেশ-সংক্রান্ত আইন অসাংবিধানিক হবে না। অর্থাৎ আইন করে এমন বিধান করা যাবে, যার অধীনে কোনো ব্যক্তি অপরাধ না করলেও সরকার যদি মনে করে যে ব্যক্তিটি দেশ বা সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারে বা করতে উদ্যত হতে পারে, তাহলে সে ব্যক্তিকে আটক করা যাবে। অর্থাৎ জেলহাজতে পুরে রাখা যাবে। কোনো অপরাধ করার দরকার নেই, সরকারের মনে হলেই হবে যে ব্যক্তিটি অপরাধমূলক কাজ করতে পারে, তাহলেই যথেষ্ট। তাকে গ্রেফতার করে সোজা কারাগারে।
অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলে আটকে রাখা যাবে। কিন্তু ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশে’ গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কোনো বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরও করতে হবে না, সরাসরি কারাগারে পাঠানো যাবে। এই দ্বিতীয় সংশোধনীর পর যে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ হলো, তাতে কারাগারে আটকে রাখার ব্যাপারে এক অর্থে সরকারকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ শুধু অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি হলো। কোনো ব্যক্তি ‘বিপজ্জনক’ বা অপরাধ করতে পারে, সরকার সে রকম মনে করলেই তাকে আটকাতে পারবে এবং জেলে পুরে রাখতে পারবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। তবে ছয় মাস অন্তর একটা উপদেষ্টা বোর্ডের সামনে আটকে থাকা ব্যক্তিটিকে হাজির করতে হবে।
দ্বিতীয় সংশোধনীর আগে বলা ছিল, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইন অসাংবিধানিক বা বাতিল হবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে বলা হলো যে এখন থেকে সংবিধান সংশোধনী আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হলে সে আইন বাতিলযোগ্য হবে না। অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী আইন করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হলো।
দ্বিতীয় সংশোধনীতে বহিঃশক্রর আক্রমণ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এমনকি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ক্ষমতা দেয়া হলো। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ বিকল্প ব্যবস্থা বা ক্ষমতার প্রয়োগ হচ্ছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা। সংবিধানের ১৪১(ক) ধারায় বলা আছে, অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতি অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এ সময় সংবিধানের ছয়টি অনুচ্ছেদের বিধান এবং মৌলিক অধিকার স্থগিত থাকে।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়বে। জরুরি অবস্থা জারি করলে বিরোধীদের জেলে পোরা যায়। নিবর্তনমূলক আটকাদেশ বা বিশেষ ক্ষমতা আইনেও কারণে-অকারণে বিরোধীদের কারাবন্দী করা যায়।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দায়মুক্তি নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আওয়ামী লীগ ও পরে বাকশাল সরকার তৎকালীন তাদের বিরোধীদের কারাগারে পুরতে পেরেছিল বছর দেড়েক ধরে-১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত।
‘রাজনৈতিক মামলা’ বলে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েক হাজার মামলা থেকে সরকারি দলের লোকজনকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। আর এখন চলছে দুদকের দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেয়ার খেলা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে সরকার নিজেদের লোকজনের দায়মুক্তি দেয়ার একটা খুব ‘চালাকি’পূর্ণ কৌশল বের করেছে। অভিযোগ দাখিল, তদন্ত, মামলা দায়ের এবং শেষ পর্যন্ত তদন্তে কোনো কিছু পাওয়া গেল না বলে আদালত দ্বারা মামলা খারিজ।
প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ১৪ দল আয়োজিত হরতাল-অবরোধে নিহত ব্যক্তিদের গায়েবানা জানাযা শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। একই দিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, প্রয়োজনে সরকার সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১ মার্চ ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের রামুতে নবগঠিত দশম পদাতিক ডিভিশনের দরবার হলে সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য বলেছেন, দেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় সশস্ত্র বাহিনীকেও হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর নিন্দাও জানিয়েছেন।
সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মনে করেন, র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও আনসার দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে সংবিধান অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিকল্প নেই। তবে সরকার এখনো বিশ্বাস করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ? আলোচনা করলেই কি তিনি মেনে নেবেন? মেনে তো নেবেন না। তার সঙ্গে আলোচনা মানেই তো জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কার সঙ্গে বসবো? ওদের হাতে তো পোড়া মানুষের গন্ধ। আমার তো মনে হয় খালেদা জিয়ার পাশে বসলে বার্ন ইউনিটের পোড়া মানুষের গন্ধ পাওয়া যাবে। তারা বোমা মেরে পুড়িয়ে মানুষ মারছে। সে জন্য এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে.....।’
এদিকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সঙ্কটের কোনো সমাধান হবে না। দেশের বিবেক বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ জানে, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের একটিই মাত্র পথ আছে-তা হলো সবার অংশগ্রহণমূলক অর্থপূর্ণ নির্বাচন। যত দ্রুত তা আয়োজন করা হবে ততই তা সবার জন্য মঙ্গলজনক। বিলম্ব করা হলে সঙ্কট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন