আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, যৌক্তিক পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সাম্প্রতিক আন্দোলনরত অবস্থায় এটি তার দ্বিতীয় সাংবাদিক সম্মেলন। এদিন তিনি সাফ ভাষায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার তাগিদই দিয়েছেন। গণতন্ত্রের নেত্রী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য তার সংগ্রাম ও সঙ্কল্প পুনঃব্যক্ত করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বক্তব্য আশাব্যঞ্জক নয়। তাদের কথা শুনে মনে হয় ‘কিছুই হয়নি।’ ড্যামকেয়ার ভাব। মাসের পর মাস আন্দোলন-হরতাল-সংগ্রাম চলছে; দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে; অকাতরে মানুষ মরছে; জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিত্যদিন সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছে, এগুলো কিছুই না? ‘কিছু’ তাহলে কি? সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক হলে আশা ও ইতিবাচকতার আলো দেখা তো সম্ভব হবে না? বরং সবাই বলবে, নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। কারণ, মানুষ আশা করে ইতিবাচকতা বা পজিটিভিজম বা পজিটিভতত্ত্ব। কেননা, পজিটিভতত্ত্ব বলে, মানুষের সভ্যতা কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় এবং বিজ্ঞান যেমন প্রাকৃতিক নিয়মকে মান্য করে; সামাজিক নিয়মকে মান্য করাও তাই একটি বিজ্ঞান। সমাজের আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্কতা হলো ইতিবাচতার ধারণা। অতএব, নেতিবাচকতার ঠাঁই কোথায়?
পজিটিভতত্ত্বের বড় পন্ডিত অগাস্ট কোঁৎ বলেছিলেন, পজিটিভ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন মানুষ তার জীবন ও কাজকর্মকে ইতিবাচকভাবে দেখবে। অর্থাৎ পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে ইতিবাচকভাবে দেখতে, ভাবতে শেখাতে। এ কারণেই সমাজে ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তির একটি লড়াই চলতেই থাকে। সরকারের লাগাতার নেতিবাচকতা মূলত ইতিবাচকতাকেই ব্যাহত করছে। সঙ্কট দীর্ঘায়িত ও জটিল করার পেছনেও রয়েছে নেতিবাচকতার ভূমিকা।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সমাজে নানা পক্ষ নানা রকম মত ও পন্থার কথা বলবে। সমাজে গণতন্ত্র থাকলে বহুমত থাকবেই। কর্তব্য হলো, সকল মত ও পথকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য পন্থা বের করা। বেগম জিয়া কিভাবে সেটা করা যায়, সে প্রস্তাব দিয়েছেন। সুশীল নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে পথ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। এসব ইতিবাচকতার বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে করবো না বা মানবো না বললে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা নেতিবাচকতার গর্ভেই লুক্কায়িত থাকবে।
গণতন্ত্রে তাই নেতিবাচক হওয়া যায় না। ইতিবাচক হতে হয়। নেতিবাচকতা একদলীয় ও স্বৈরতন্ত্রের লক্ষণ। কারো কথা শুনবো না বা কাউকেই সুযোগ দেবো না; এসবই স্বৈরাচারের প্রবণতা। এহেন প্রবণতা গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
নেতিবাচকতা সম্মানজনক সমাধানের সুযোগ হাত ছাড়া করে। নেতিবাচকতার সঙ্গে যখন গুয়ার্তুমি বা মৌলবাদী কট্টর মনোভাব যুক্ত হয়, তখন ভয়াবহ বিপদ নেমে আসে। কোনো ধরনের জায়গা না রেখে কেবলই নাকচ করার মনোভাব তাদেরকে একঘরে এবং একাকী করে ফেলে। তখন সকল পজিটিভ শক্তি নে গেটিভ বা নেতিবাচক শক্তিকে পরাজিত করে। কারণ, শেষ বিবেচনায় সমাজে ও মানুষের মধ্যে ইতিবাচক বা পজিটিভ শক্তিরই প্রাধান্য রয়েছে। এই প্রাধান্যই জয়ী হয়। নেতিবাচকতা ক্রমে ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মাসের পর মাস অবরোধ-হরতাল-আন্দোলন দেশ ও বিশ্বের নজর কাড়লেও নেতিবাচকতার ভ্রম থাকায় সংশ্লিষ্টদের চোখে পড়ছে না। বরং সমস্যার সঠিক অনুধাবনের অভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ও বলপ্রয়োগ সমস্যাকে জটিলতর করছে। বিশ্ববাসী পর্যন্ত এজন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নেতিবাচকতার জন্য শুধু দেশে নয়; বিদেশেও ইমেজ হানি ঘটছে।
রাজনীতি বা সমাজ নেতিবাচকতাকে সহ্য করে না। গুয়ার্তুমিকে তো নয়ই। বরং ইতিবাচকতাই বিজয়ী হয়। ইতিহাসেও এমন ভাষ্যই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই যে মার্চ মাস চলছে স্বাধীনতার স্মৃতি নিয়ে, সেখানেও কিন্তু ইতিবাচকতার জয়ই দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনের নেতা সারা জীবন লড়াই করেছেন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি মানবো না, মানি না ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। আলাপ-আলোচনায় ইতিবাচকভাবে এগিয়ে গেছেন। চরম প্রতিপক্ষের সঙ্গেও ইতিবাচক আচরণ করেছেন। ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। তার দূরদৃষ্টি ও তৎপরতা বিজয়ী হয়েছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারী জান্তা পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় অসাধু রাজনীতিবিদের সঙ্গে আঁতাত করে আলাপ-আলোচনার মধ্যেই অতর্কিতে আক্রমণ করে বসলো। ডান-বাম-ইসলামপন্থী সকল রাজনীতিবিদই ইতিবাচকভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক সঙ্কটকে বিবেচনা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নেতিবাচক মনোভাবের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ ইতিবাচক সুযোগকে হারালো এবং জনপ্রতিরোধে চরমভাবে পরাজিত হলো। অতএব সর্বাবস্থায় ইতিবাচক ও জনমুখী থাকাই রাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো যে, নেতিবাচক বা বলের শক্তি দ্বারা রাজনীতি থেকে প্রতিপক্ষকে মুছে ফেলা কখনোই সম্ভব নয়। একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনেও সেটা করা যায় নি। স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট বা নাৎসি শাসনেও ভিন্নমত ছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে একদলীয় ব্যবস্থা চালু করে বা বিভিন্ন শাসনামলে শক্তি প্রয়োগ করেও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূল করা যায় নি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হলো এই যে, এখানে বহুমানুষ বহুমত ও পথ গ্রহণ করে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও ক্রিয়াশীল থাকেন। বরং নেতিবাচক ক্ষুদ্র-স্বার্থচিন্তায় হত্যা, নির্যাতন, হামলা, মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিধনের উদ্যোগ সম্পূর্ণ ভুল পথ। এ পথে চললে পদে পদে বিপদ বাড়বে; সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হবে। বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক বিন্যাসের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, এখানে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জনমানুষের মধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের বিপুল-বিশাল কর্মী-সমর্থক রয়েছে। এটাই বিদ্যমান বাস্তবতা। এই বাস্তবতার বাইরে গিয়ে শক্তি দিয়ে বা জোর করে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বিন্যাস বদলানো যায় না। বরং বাস্তবতা মেনে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ‘পিসফুল কো-অ্যাকজিসটেন্স’ বা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ই সঙ্কট মুক্তির একমাত্র পথ।’ ইতিবাচকতা এমনভাবেই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলে। ভিন্নমতকেও সম্মান জানিয়ে শান্তি ও সম্মানের সঙ্গে একই ব্যবস্থায় কাজ করার পরিবেশ ইতিবাচকতা তৈরি করতে চায়। নেতিবাচকতা যেটা পারে না।
বাংলাদেশের চলমান তীব্র ও সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্ভাব্য সমাধান প্রসঙ্গে তাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই ভাবতে হবে। বিএনপি-জামায়াত তথা বিরোধী-আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং নিরপেক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে নানা প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাবের মোদ্দা কথাই হলো, সর্বজনগ্রহণীয় নির্বাচন হলো বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় উত্তরণের বৈধ ও পরীক্ষিত পন্থা। ভোটার বিহীন, নিয়মরক্ষার নির্বাচন সেটা করতে পারে না। সকলের অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনই সঙ্কট-সমস্যার অবসান ঘটাতে পেরেছে এবং ভবিষ্যতেও পারবে। এখানে ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছা বা একগুঁয়েমি নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া-আসার নীতিকে মান্য করাই প্রধান কথা। এই কথাটি রাজনীতিবিদরা মেনে নিলে সঙ্কট থাকার কথা নয়।
প্রসঙ্গত বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের একটি উক্তিও স্মরণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রায়-অর্ধেক এসেছেন ভোট ছাড়াই। বাকী অর্ধেক শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছেন বলে দেশে বা বিদেশে কেউই স্বীকার করছেন না। যে নির্বাচনে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ ভোটই দিতে পারলো না এবং সকল দল অংশও নিলো না, সে নির্বাচন শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রে পৌঁছার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করতে পারবে না। বরং একটি সত্যিকারের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনমতের ভিত্তিতে নির্বাচিত নেতৃত্বই সমস্যা ও সঙ্কট দূরীকরণে সফল হতে পারবেন।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রধান কাজ হলো জনমনে স্বস্তি আনা, আইনের নৈর্ব্যক্তিক শাসক প্রতিষ্ঠা করা, দলীয় বা আঞ্চলিক স্বজনপ্রীতির বা বলপ্রয়োগের নীতি পরিহার করা, মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অগ্রজ নেতৃবৃন্দ এবং সংগ্রামী জনতা এমন আদর্শের জন্যই ব্রিটিশ-পাকিস্তানী আমলে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন; প্রয়োজনে জীবন দান করেছেন। বাংলাদেশের সমগ্র জনতাই এমন গণতান্ত্রিক সুশাসনের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা তাদের বুকে ও চেতনায় ধারণ করেন। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই গণতান্ত্রিক সুশাসনের বাইরে ভিন্ন বিকল্প বা বিকৃত পদ্ধতি বা শক্তির দাম্ভিকতা বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে কারো পক্ষেই মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, “সঙ্কট যেমন থাকে; তেমনি থাকে সমাধানও। কখনো সমাধান ধীরে আসে; কখনো দ্রুত। এর মানে হলো, সমস্যা কখনোই চিরস্থায়ী হয় না। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত, সঙ্কট ও সমস্যাসমূহ অবশ্যই সমাধানের আওতায় আসবে এবং সেটা সুনিশ্চিতভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক-সুশাসনমুখী চিরায়ত-প্রত্যাশার আলোকেই সম্পন্ন হবে।”
সঙ্কট সমাধানে নানা পক্ষ ও মত থেকে যেসব ইতিবাচক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে ‘কিছুই মানবো না’ ধরনের নেতিবাচক মনোভাব সঙ্কট মোচন করতে পারবে না। এমন করলে সঙ্কটের দায় নেতিবাচকতার পক্ষাবলম্বীদের উপরই বর্তাবে। আন্দোলনরত দলসমূহের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়া গত শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেটাকে গ্রহণ না করে অতীতের মতো নেতিবাচকতার চক্করে আবর্তিত হলে নেতিবাচকতার গর্ত থেকে উঠা কি করে সম্ভব হবে? মানুষ নেতিবাচকতার খানা-খন্দে নিমজ্জিত হয়েই থাকবে, এমনটি ভাবার তো কোনো কারণ নেই। ইতিহাস, সভ্যতা ও বিজ্ঞান তো তেমন কথা বলে না। সবাই সমস্বরে বলছে, ইতিবাচকতারই নিরঙ্কুশ বিজয় হবে। নেতিবাচকতা যখন সঙ্কট প্রলম্বিত করছে তখন ইতিবাচক সম্মিলিত শক্তি চুপ করে থাকবে না। ইতিবাচকভাবে সঙ্কটের অচল চাকাকে সচল করবে। তখন নেতিবাচকতার শক্তির অবসান ঘটাবে।
প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বক্তব্য আশাব্যঞ্জক নয়। তাদের কথা শুনে মনে হয় ‘কিছুই হয়নি।’ ড্যামকেয়ার ভাব। মাসের পর মাস আন্দোলন-হরতাল-সংগ্রাম চলছে; দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে; অকাতরে মানুষ মরছে; জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিত্যদিন সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছে, এগুলো কিছুই না? ‘কিছু’ তাহলে কি? সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক হলে আশা ও ইতিবাচকতার আলো দেখা তো সম্ভব হবে না? বরং সবাই বলবে, নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। কারণ, মানুষ আশা করে ইতিবাচকতা বা পজিটিভিজম বা পজিটিভতত্ত্ব। কেননা, পজিটিভতত্ত্ব বলে, মানুষের সভ্যতা কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় এবং বিজ্ঞান যেমন প্রাকৃতিক নিয়মকে মান্য করে; সামাজিক নিয়মকে মান্য করাও তাই একটি বিজ্ঞান। সমাজের আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্কতা হলো ইতিবাচতার ধারণা। অতএব, নেতিবাচকতার ঠাঁই কোথায়?
পজিটিভতত্ত্বের বড় পন্ডিত অগাস্ট কোঁৎ বলেছিলেন, পজিটিভ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন মানুষ তার জীবন ও কাজকর্মকে ইতিবাচকভাবে দেখবে। অর্থাৎ পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে ইতিবাচকভাবে দেখতে, ভাবতে শেখাতে। এ কারণেই সমাজে ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তির একটি লড়াই চলতেই থাকে। সরকারের লাগাতার নেতিবাচকতা মূলত ইতিবাচকতাকেই ব্যাহত করছে। সঙ্কট দীর্ঘায়িত ও জটিল করার পেছনেও রয়েছে নেতিবাচকতার ভূমিকা।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সমাজে নানা পক্ষ নানা রকম মত ও পন্থার কথা বলবে। সমাজে গণতন্ত্র থাকলে বহুমত থাকবেই। কর্তব্য হলো, সকল মত ও পথকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য পন্থা বের করা। বেগম জিয়া কিভাবে সেটা করা যায়, সে প্রস্তাব দিয়েছেন। সুশীল নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে পথ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। এসব ইতিবাচকতার বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে করবো না বা মানবো না বললে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা নেতিবাচকতার গর্ভেই লুক্কায়িত থাকবে।
গণতন্ত্রে তাই নেতিবাচক হওয়া যায় না। ইতিবাচক হতে হয়। নেতিবাচকতা একদলীয় ও স্বৈরতন্ত্রের লক্ষণ। কারো কথা শুনবো না বা কাউকেই সুযোগ দেবো না; এসবই স্বৈরাচারের প্রবণতা। এহেন প্রবণতা গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
নেতিবাচকতা সম্মানজনক সমাধানের সুযোগ হাত ছাড়া করে। নেতিবাচকতার সঙ্গে যখন গুয়ার্তুমি বা মৌলবাদী কট্টর মনোভাব যুক্ত হয়, তখন ভয়াবহ বিপদ নেমে আসে। কোনো ধরনের জায়গা না রেখে কেবলই নাকচ করার মনোভাব তাদেরকে একঘরে এবং একাকী করে ফেলে। তখন সকল পজিটিভ শক্তি নে গেটিভ বা নেতিবাচক শক্তিকে পরাজিত করে। কারণ, শেষ বিবেচনায় সমাজে ও মানুষের মধ্যে ইতিবাচক বা পজিটিভ শক্তিরই প্রাধান্য রয়েছে। এই প্রাধান্যই জয়ী হয়। নেতিবাচকতা ক্রমে ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মাসের পর মাস অবরোধ-হরতাল-আন্দোলন দেশ ও বিশ্বের নজর কাড়লেও নেতিবাচকতার ভ্রম থাকায় সংশ্লিষ্টদের চোখে পড়ছে না। বরং সমস্যার সঠিক অনুধাবনের অভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ও বলপ্রয়োগ সমস্যাকে জটিলতর করছে। বিশ্ববাসী পর্যন্ত এজন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নেতিবাচকতার জন্য শুধু দেশে নয়; বিদেশেও ইমেজ হানি ঘটছে।
রাজনীতি বা সমাজ নেতিবাচকতাকে সহ্য করে না। গুয়ার্তুমিকে তো নয়ই। বরং ইতিবাচকতাই বিজয়ী হয়। ইতিহাসেও এমন ভাষ্যই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই যে মার্চ মাস চলছে স্বাধীনতার স্মৃতি নিয়ে, সেখানেও কিন্তু ইতিবাচকতার জয়ই দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনের নেতা সারা জীবন লড়াই করেছেন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি মানবো না, মানি না ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। আলাপ-আলোচনায় ইতিবাচকভাবে এগিয়ে গেছেন। চরম প্রতিপক্ষের সঙ্গেও ইতিবাচক আচরণ করেছেন। ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। তার দূরদৃষ্টি ও তৎপরতা বিজয়ী হয়েছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারী জান্তা পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় অসাধু রাজনীতিবিদের সঙ্গে আঁতাত করে আলাপ-আলোচনার মধ্যেই অতর্কিতে আক্রমণ করে বসলো। ডান-বাম-ইসলামপন্থী সকল রাজনীতিবিদই ইতিবাচকভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক সঙ্কটকে বিবেচনা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নেতিবাচক মনোভাবের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ ইতিবাচক সুযোগকে হারালো এবং জনপ্রতিরোধে চরমভাবে পরাজিত হলো। অতএব সর্বাবস্থায় ইতিবাচক ও জনমুখী থাকাই রাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো যে, নেতিবাচক বা বলের শক্তি দ্বারা রাজনীতি থেকে প্রতিপক্ষকে মুছে ফেলা কখনোই সম্ভব নয়। একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনেও সেটা করা যায় নি। স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট বা নাৎসি শাসনেও ভিন্নমত ছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে একদলীয় ব্যবস্থা চালু করে বা বিভিন্ন শাসনামলে শক্তি প্রয়োগ করেও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূল করা যায় নি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হলো এই যে, এখানে বহুমানুষ বহুমত ও পথ গ্রহণ করে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও ক্রিয়াশীল থাকেন। বরং নেতিবাচক ক্ষুদ্র-স্বার্থচিন্তায় হত্যা, নির্যাতন, হামলা, মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিধনের উদ্যোগ সম্পূর্ণ ভুল পথ। এ পথে চললে পদে পদে বিপদ বাড়বে; সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হবে। বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক বিন্যাসের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, এখানে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জনমানুষের মধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের বিপুল-বিশাল কর্মী-সমর্থক রয়েছে। এটাই বিদ্যমান বাস্তবতা। এই বাস্তবতার বাইরে গিয়ে শক্তি দিয়ে বা জোর করে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বিন্যাস বদলানো যায় না। বরং বাস্তবতা মেনে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ‘পিসফুল কো-অ্যাকজিসটেন্স’ বা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ই সঙ্কট মুক্তির একমাত্র পথ।’ ইতিবাচকতা এমনভাবেই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলে। ভিন্নমতকেও সম্মান জানিয়ে শান্তি ও সম্মানের সঙ্গে একই ব্যবস্থায় কাজ করার পরিবেশ ইতিবাচকতা তৈরি করতে চায়। নেতিবাচকতা যেটা পারে না।
বাংলাদেশের চলমান তীব্র ও সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্ভাব্য সমাধান প্রসঙ্গে তাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই ভাবতে হবে। বিএনপি-জামায়াত তথা বিরোধী-আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং নিরপেক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে নানা প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাবের মোদ্দা কথাই হলো, সর্বজনগ্রহণীয় নির্বাচন হলো বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় উত্তরণের বৈধ ও পরীক্ষিত পন্থা। ভোটার বিহীন, নিয়মরক্ষার নির্বাচন সেটা করতে পারে না। সকলের অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনই সঙ্কট-সমস্যার অবসান ঘটাতে পেরেছে এবং ভবিষ্যতেও পারবে। এখানে ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছা বা একগুঁয়েমি নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া-আসার নীতিকে মান্য করাই প্রধান কথা। এই কথাটি রাজনীতিবিদরা মেনে নিলে সঙ্কট থাকার কথা নয়।
প্রসঙ্গত বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের একটি উক্তিও স্মরণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রায়-অর্ধেক এসেছেন ভোট ছাড়াই। বাকী অর্ধেক শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছেন বলে দেশে বা বিদেশে কেউই স্বীকার করছেন না। যে নির্বাচনে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ ভোটই দিতে পারলো না এবং সকল দল অংশও নিলো না, সে নির্বাচন শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রে পৌঁছার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করতে পারবে না। বরং একটি সত্যিকারের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনমতের ভিত্তিতে নির্বাচিত নেতৃত্বই সমস্যা ও সঙ্কট দূরীকরণে সফল হতে পারবেন।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রধান কাজ হলো জনমনে স্বস্তি আনা, আইনের নৈর্ব্যক্তিক শাসক প্রতিষ্ঠা করা, দলীয় বা আঞ্চলিক স্বজনপ্রীতির বা বলপ্রয়োগের নীতি পরিহার করা, মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অগ্রজ নেতৃবৃন্দ এবং সংগ্রামী জনতা এমন আদর্শের জন্যই ব্রিটিশ-পাকিস্তানী আমলে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন; প্রয়োজনে জীবন দান করেছেন। বাংলাদেশের সমগ্র জনতাই এমন গণতান্ত্রিক সুশাসনের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা তাদের বুকে ও চেতনায় ধারণ করেন। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই গণতান্ত্রিক সুশাসনের বাইরে ভিন্ন বিকল্প বা বিকৃত পদ্ধতি বা শক্তির দাম্ভিকতা বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে কারো পক্ষেই মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, “সঙ্কট যেমন থাকে; তেমনি থাকে সমাধানও। কখনো সমাধান ধীরে আসে; কখনো দ্রুত। এর মানে হলো, সমস্যা কখনোই চিরস্থায়ী হয় না। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত, সঙ্কট ও সমস্যাসমূহ অবশ্যই সমাধানের আওতায় আসবে এবং সেটা সুনিশ্চিতভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক-সুশাসনমুখী চিরায়ত-প্রত্যাশার আলোকেই সম্পন্ন হবে।”
সঙ্কট সমাধানে নানা পক্ষ ও মত থেকে যেসব ইতিবাচক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে ‘কিছুই মানবো না’ ধরনের নেতিবাচক মনোভাব সঙ্কট মোচন করতে পারবে না। এমন করলে সঙ্কটের দায় নেতিবাচকতার পক্ষাবলম্বীদের উপরই বর্তাবে। আন্দোলনরত দলসমূহের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়া গত শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেটাকে গ্রহণ না করে অতীতের মতো নেতিবাচকতার চক্করে আবর্তিত হলে নেতিবাচকতার গর্ত থেকে উঠা কি করে সম্ভব হবে? মানুষ নেতিবাচকতার খানা-খন্দে নিমজ্জিত হয়েই থাকবে, এমনটি ভাবার তো কোনো কারণ নেই। ইতিহাস, সভ্যতা ও বিজ্ঞান তো তেমন কথা বলে না। সবাই সমস্বরে বলছে, ইতিবাচকতারই নিরঙ্কুশ বিজয় হবে। নেতিবাচকতা যখন সঙ্কট প্রলম্বিত করছে তখন ইতিবাচক সম্মিলিত শক্তি চুপ করে থাকবে না। ইতিবাচকভাবে সঙ্কটের অচল চাকাকে সচল করবে। তখন নেতিবাচকতার শক্তির অবসান ঘটাবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন