বিশ্বের অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও রাতারাতি স্বাধীনতা অর্জন করেনি। এর পেছনে রয়েছে শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। সুদূর অতীতের সে ইতিহাস নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের আশু কারণ সম্পর্কে জানানো দরকার। এই কারণ তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর। ওই নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জিতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপ্লস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছিল ৮৮টি আসন। এই ভুট্টো ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নির্বাচনের পর দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার উদ্ভট দাবির পাশাপাশি ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সঙ্কটের সৃষ্টি করেছিলেন ভুট্টো। তার এ সিদ্ধান্ত ও অস্বীকৃতিকে অজুহাত বানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন ১ মার্চ। প্রতিবাদে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু হয়, দাবি ওঠে স্বাধীনতার। শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলেও জানিয়েছিলেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীও উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। জনসভার ঠিক আগের দিন ‘খুনী জেনারেল’ নামে কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গভর্নর পদে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। ৬ মার্চই ‘জাতির উদ্দেশে’ প্রচারিত ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। গভর্নর পদে টিক্কা খানের নিযুক্তি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতামুখী আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠেছিল। প্রধান নেতা শেখ মুজিবের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার আকাক্সক্ষা নিয়ে ৭ মার্চের জনসভায় লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিল। শেখ মুজিব তার ভাষণে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, ভুট্টোর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং সবশেষে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অসাধারণ বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তার অনেক ভাষণই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। ৭ মার্চের অত্যন্ত জ্বালাময়ী ও আবেগপূর্ণ ভাষণটি স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত ছাত্র-জনতাকে প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছিল। ভাষণটি আজও পর্যন্ত শোনার দিক থেকে শেখ মুজিবের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মাত্র ৯১ বাক্যের ভাষণটির অধিকাংশ ব্যয়িত হয়েছিল ইতিহাসের পর্যালোচনায় এবং ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সমালোচনায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করার সময় শেখ মুজিব অবশ্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন- ‘হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলো’, ‘দোষ দেয়া হলো’ ধরনের পরোক্ষ অভিযোগ জানানোর বাইরে তেমন কিছু বলেননি তিনি। ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান’, ‘আপনি আসুন, আপনি দেখুন’ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব বরং ইয়াহিয়ার প্রতি ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন ১৫ মার্চ, মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক শুরু হয়েছিল ১৬ মার্চ থেকে। এটা সম্ভব হওয়ার কারণ, ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদকে বাতিল ঘোষণা করেননি বরং বলেছিলেন, অধিবেশনে তিনি বসবেন যদি প্রেসিডেন্ট চারটি দাবি মেনে নেনÑ (১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে; (২) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; (৩) সংঘটিত সব হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার করতে হবে এবং (৪) জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
ভাষণের মাঝামাঝি উপস্থাপিত এই চারটি দাবির ভিত্তিতেই পরবর্তী দিনগুলোতে শেখ মুজিব পা বাড়িয়েছিলেন। এখানে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ইয়াহিয়ার মন্ত্রী ড. জিডব্লিউ চৌধুরী ছিলেন শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান ব্যক্তি। ৭ মার্চ সকালের একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. জিডব্লিউ চৌধুরী লিখেছেন, সঙ্কটের ওই পর্যায়েও শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে নিয়মিত টেলিফোনে কথাবার্তা চলছিল। জনসভায় যাওয়ার প্রাক্কালে দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয় এবং ইয়াহিয়ার নির্দেশে এ সময় ড. চৌধুরী তার সামনে উপস্থিত থাকেন। তিনি লিখেছেন, ‘দু’জনের মনোভাবই তখনও পর্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল, দু’জনই তখন পর্যন্ত সমঝোতায় আসার জন্য আগ্রহী ছিলেন। মুজিব ঢাকায় আসার এবং নিজ চোখে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি দেখার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান। অন্যদিকে মুজিবকে এমন কোনো বক্তব্য দেয়া থেকে ইয়াহিয়া বিরত থাকতে বলেন, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ থাকবে না।’ (জিডব্লিউ চৌধুরী, ‘দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’, ১৯৭৪, পৃÑ১৫৮) ইয়াহিয়ার এই পরামর্শকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন বলেই শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে একপাক্ষিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরিবর্তে চার দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন।
অন্য একটি কম আলোচিত ঘটনাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ড. কামাল হোসেনের বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনার এবং একজন ব্রিগেডিয়ারের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার বার্তা পাওয়ার পর ৬ মার্চ রাতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ছয়জন নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, আন্দোলনের গতিবেগ ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বক্তব্য দিলেও ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাবেন। বৈঠকের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনকে এমন একটি বিবৃতি তৈরি বলেছিলেন, যাতে আইনগতভাবে নিরাপদ অবস্থান বজায় রাখা যায়। ঠিক হয়েছিল, বিবৃতিটি তাজউদ্দিন আহমদের দায়িত্বে থাকবে। জনসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রয়োজনে কিছু কথা যোগ-বিয়োগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ ৭ মার্চ রাতে সেটা দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছে দেবেন। পৌঁছে দিয়েছিলেনও তাজউদ্দিন। শেখ মুজিবের এই বিবৃতিটি ৮ মার্চের সংবাদপত্রগুলোতে কম গুরুত্বের সঙ্গে ভেতরের পৃষ্ঠায় প্রকশিত হয়েছিল। অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল ভাষণের কথাগুলো- বিশেষ করে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’সহ শেষ বাক্য দুটি। (পূর্ণ বিবৃতির জন্য দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭১)
এভাবে গোপনীয়তার সঙ্গে বিবৃতি প্রকাশ করার পেছনে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে আইনগত দিক থেকে নিজের নিরাপত্তা ও অবস্থান বিপদমুক্ত রাখা এবং অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার পথ খুলে দেয়া। বিবৃতিটির ভাষা ছিল অত্যন্ত মার্জিত ও সংযত। রেসকোর্সের ভাষণের মতো বিবৃতিতেও নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব কয়েকটি দাবি ও পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বিবৃতির সর্বশেষ অংশটুকু। ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ধরনের কোনো শব্দের উল্লেখ না করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো অবিলম্বে সামরিক আইন বিলোপ ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ১৬ মার্চ থেকে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট হাউজে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত কোনো বৈঠকেও শেখ মুজিব তার চার দফা দাবিরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বিশেষ করে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, এ দুটির কম কোনো কিছুই পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট হবে না। জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং জটিলতা দেখা দেবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিব দু’পক্ষের আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। সে বৈঠকেও আইনগত শূন্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছিল। পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠক শেষে শেখ মুজিব নতুন এক প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে দুই অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের বৈঠকে তথ্যটি জানিয়ে জেনারেল পীরজাদা আরো বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছেন- যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবকে গতকাল প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসার পর খুবই হর্ষোৎফুল দেখায়।’ শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় নিচের তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে- (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিচের দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলÑ (১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে সেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউজে অপ্রত্যাশিতভাবে ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যস্থতায় শেখ মুজিবের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার জন্য আগের দিন তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেদিনের বৈঠকে ইয়াহিয়ার পক্ষে অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা এমএম আহমদ একের পর এক সংশোধনী এনে আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। উপদেষ্টাদের সান্ধ্য বৈঠকও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছিল।
২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। বিচারপতি কর্নেলিয়াস বলেছিলেন, ‘কনফেডারেশন’-এর পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন অব পাকিস্তান’ রাখা যেতে পারে। জেনারেল পীরজাদা এ প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ কোনো এক সময় ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি কবে প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়ার এবং দু’জনের উপদেষ্টাদের মধ্যকার অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা যেমন টেলিফোন করেননি, তেমনি প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও- যার জন্য এত সময় নষ্ট করা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কিনা। আমি তাকে জানিয়েছি যে, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, তারা যখন গিয়েছিলেন শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন- যা দেখে তার ‘লাস্ট সাপার’-এর কথা মনে হয়েছিল। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে শেখ মুজিব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারা অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে বা অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। সেখান থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। কয়েকটি পর্যায়ে রীতিমতো ‘ইন্টারভিউ’ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেপুরের বৈদ্যনাথ তলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। (দেখুন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খন্ড)
ওপরের বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার ভিত্তিতে বলা যায়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্তও নিয়মতান্ত্রিক পথে সঙ্কটের সমাধান করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। একপাক্ষিক স্বাধীনতা ঘোষণার দায়দায়িত্ব এড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি আলোচনার পথকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতামুখী প্রবল জনমত এবং ‘পশ্চিম পাকিস্তানী’ সেনা নায়কদের অসহযোগিতা ও শত্রুতার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব প্রথমে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে দুই অঞ্চলের সদস্যদের যৌথ অধিবেশনে সংবিধান পাস করার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ জন্য স্বায়ত্তশাসনের বিধান সংযোজন করা সম্ভব হয়। শেখ মুজিবের এই অবস্থানের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে- (১) এভাবে সমঝোতার পথে স্বাধীনতামুখী আন্দোলনকে প্রশমিত করে তিনি পাকিস্তানভিত্তিক সমাধান অর্জন করতে চেয়েছিলেন; অথবা (২) আলোচনার নামে সঙ্কটকে আরো জটিল করার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বলা দরকার, পরিস্থিতি ততদিনে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যখন এমনকি শেখ মুজিব নিজেও যদি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতেন তাহলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করা সম্ভব হতো না।
ভাষণের মাঝামাঝি উপস্থাপিত এই চারটি দাবির ভিত্তিতেই পরবর্তী দিনগুলোতে শেখ মুজিব পা বাড়িয়েছিলেন। এখানে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ইয়াহিয়ার মন্ত্রী ড. জিডব্লিউ চৌধুরী ছিলেন শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান ব্যক্তি। ৭ মার্চ সকালের একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. জিডব্লিউ চৌধুরী লিখেছেন, সঙ্কটের ওই পর্যায়েও শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে নিয়মিত টেলিফোনে কথাবার্তা চলছিল। জনসভায় যাওয়ার প্রাক্কালে দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয় এবং ইয়াহিয়ার নির্দেশে এ সময় ড. চৌধুরী তার সামনে উপস্থিত থাকেন। তিনি লিখেছেন, ‘দু’জনের মনোভাবই তখনও পর্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল, দু’জনই তখন পর্যন্ত সমঝোতায় আসার জন্য আগ্রহী ছিলেন। মুজিব ঢাকায় আসার এবং নিজ চোখে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি দেখার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান। অন্যদিকে মুজিবকে এমন কোনো বক্তব্য দেয়া থেকে ইয়াহিয়া বিরত থাকতে বলেন, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ থাকবে না।’ (জিডব্লিউ চৌধুরী, ‘দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’, ১৯৭৪, পৃÑ১৫৮) ইয়াহিয়ার এই পরামর্শকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন বলেই শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে একপাক্ষিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরিবর্তে চার দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন।
অন্য একটি কম আলোচিত ঘটনাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ড. কামাল হোসেনের বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনার এবং একজন ব্রিগেডিয়ারের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার বার্তা পাওয়ার পর ৬ মার্চ রাতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ছয়জন নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, আন্দোলনের গতিবেগ ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বক্তব্য দিলেও ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাবেন। বৈঠকের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনকে এমন একটি বিবৃতি তৈরি বলেছিলেন, যাতে আইনগতভাবে নিরাপদ অবস্থান বজায় রাখা যায়। ঠিক হয়েছিল, বিবৃতিটি তাজউদ্দিন আহমদের দায়িত্বে থাকবে। জনসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রয়োজনে কিছু কথা যোগ-বিয়োগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ ৭ মার্চ রাতে সেটা দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছে দেবেন। পৌঁছে দিয়েছিলেনও তাজউদ্দিন। শেখ মুজিবের এই বিবৃতিটি ৮ মার্চের সংবাদপত্রগুলোতে কম গুরুত্বের সঙ্গে ভেতরের পৃষ্ঠায় প্রকশিত হয়েছিল। অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল ভাষণের কথাগুলো- বিশেষ করে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’সহ শেষ বাক্য দুটি। (পূর্ণ বিবৃতির জন্য দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭১)
এভাবে গোপনীয়তার সঙ্গে বিবৃতি প্রকাশ করার পেছনে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে আইনগত দিক থেকে নিজের নিরাপত্তা ও অবস্থান বিপদমুক্ত রাখা এবং অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার পথ খুলে দেয়া। বিবৃতিটির ভাষা ছিল অত্যন্ত মার্জিত ও সংযত। রেসকোর্সের ভাষণের মতো বিবৃতিতেও নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব কয়েকটি দাবি ও পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বিবৃতির সর্বশেষ অংশটুকু। ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ধরনের কোনো শব্দের উল্লেখ না করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো অবিলম্বে সামরিক আইন বিলোপ ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ১৬ মার্চ থেকে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট হাউজে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত কোনো বৈঠকেও শেখ মুজিব তার চার দফা দাবিরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বিশেষ করে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, এ দুটির কম কোনো কিছুই পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট হবে না। জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং জটিলতা দেখা দেবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিব দু’পক্ষের আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। সে বৈঠকেও আইনগত শূন্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছিল। পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠক শেষে শেখ মুজিব নতুন এক প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে দুই অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের বৈঠকে তথ্যটি জানিয়ে জেনারেল পীরজাদা আরো বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছেন- যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবকে গতকাল প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসার পর খুবই হর্ষোৎফুল দেখায়।’ শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় নিচের তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে- (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিচের দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলÑ (১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে সেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউজে অপ্রত্যাশিতভাবে ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যস্থতায় শেখ মুজিবের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার জন্য আগের দিন তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেদিনের বৈঠকে ইয়াহিয়ার পক্ষে অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা এমএম আহমদ একের পর এক সংশোধনী এনে আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। উপদেষ্টাদের সান্ধ্য বৈঠকও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছিল।
২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। বিচারপতি কর্নেলিয়াস বলেছিলেন, ‘কনফেডারেশন’-এর পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন অব পাকিস্তান’ রাখা যেতে পারে। জেনারেল পীরজাদা এ প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ কোনো এক সময় ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি কবে প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়ার এবং দু’জনের উপদেষ্টাদের মধ্যকার অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা যেমন টেলিফোন করেননি, তেমনি প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও- যার জন্য এত সময় নষ্ট করা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কিনা। আমি তাকে জানিয়েছি যে, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, তারা যখন গিয়েছিলেন শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন- যা দেখে তার ‘লাস্ট সাপার’-এর কথা মনে হয়েছিল। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে শেখ মুজিব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারা অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে বা অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। সেখান থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। কয়েকটি পর্যায়ে রীতিমতো ‘ইন্টারভিউ’ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেপুরের বৈদ্যনাথ তলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। (দেখুন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খন্ড)
ওপরের বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার ভিত্তিতে বলা যায়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্তও নিয়মতান্ত্রিক পথে সঙ্কটের সমাধান করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। একপাক্ষিক স্বাধীনতা ঘোষণার দায়দায়িত্ব এড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি আলোচনার পথকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতামুখী প্রবল জনমত এবং ‘পশ্চিম পাকিস্তানী’ সেনা নায়কদের অসহযোগিতা ও শত্রুতার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব প্রথমে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে দুই অঞ্চলের সদস্যদের যৌথ অধিবেশনে সংবিধান পাস করার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ জন্য স্বায়ত্তশাসনের বিধান সংযোজন করা সম্ভব হয়। শেখ মুজিবের এই অবস্থানের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে- (১) এভাবে সমঝোতার পথে স্বাধীনতামুখী আন্দোলনকে প্রশমিত করে তিনি পাকিস্তানভিত্তিক সমাধান অর্জন করতে চেয়েছিলেন; অথবা (২) আলোচনার নামে সঙ্কটকে আরো জটিল করার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বলা দরকার, পরিস্থিতি ততদিনে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যখন এমনকি শেখ মুজিব নিজেও যদি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতেন তাহলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করা সম্ভব হতো না।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন