মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ, ২০১৫

খুনিরা আছে ‘জামাই’ আদরে


জামাই আদর বিষয়টা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষ করে পল্লী সমাজে জামাই আদর খুবই চেনা এক অনুসঙ্গ। মেয়ে জামাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে আসা, সে এক বিরাট আয়োজন। জামাই আনেন মিষ্টি। শ্বশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-শ্যালিকার জন্য আনেন উপহার। স্ত্রীর জন্য ডুরে শাড়ী, আলতা কিংবা গহনা। আবার জামাই আসছে শুনলে দেখেছি বাড়ি জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। খোপের বড় মোরগ ধরার জন্য বাড়িময় ছুটাছুটি চলে। রান্না হয় পোলাও, সেমাই, শীতকাল হলে পিঠাপুলি। শৈশবে, কৈশোরে এরকমই দেখেছি। এখন হয়তো এর আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু জামাই আদর ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এখনও জামাই আদর ব্যাপারটা আছে।
তেমনি জামাই আদরে আছেন র‌্যাবের খুনিরা। তারা আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র নজরুলসহ অন্য সাতজনকে কীভাবে খুন করেছেন। তিন মাঝি যারা র‌্যাবের নৌকা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের কোনো হদীস মেলেনি। এই নয়-দশটি পরিবারে যে বেদনা আর হাহাকার উঠেছে, যে দীর্ঘশ্বাস তা কোনোদিন মোচন হবার নয়। নিশ্চয়ই সে হাহাকার ধ্বনি পরিবারের সদস্যরা আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে এবং অভিসম্পাত দিতে থাকবে। সরকার যদি ভেবে থাকে এসব অভিসম্পাত তাদের মোটেও স্পর্শ করবে না, তাহলে তারা ঐতিহাসিক ভুল করবে। এর খেসারতও একদিন তাদের দিতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত স্বৈরশাসক এরকম নিষ্ঠুরতার খেসারত দিয়েছেন।
আলোচনা শুরু করেছিলাম র‌্যাবের খুনিদের নিয়ে। এর প্রধান খুনি সরকারের ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই তারেক সাঈদ। মায়ার পুত্র সম্পর্কেও এন্তার সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। মায়ার মেয়ের জামাই যখন এই খুনের দায়ে ধরা পড়লেন এবং স্বীকারোক্তি দিলেন কীভাবে তিনি এই খুন করেছেন তখন গা শিউরে উঠলেও প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিল, অর্থের বিনিময়ে তারা যে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এর বিচার কোনোদিনই হবে না। এখন ক্রমেই ঘটনাটি বিচার না হওয়ার দিকে চলে যাচ্ছে।
খুনের দায় সবাই স্বীকার করেছেন। কীভাবে খুনগুলো করা হয়েছে তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এগারো মাস পার হয়ে গেছে। এখনও কোনো চার্জশীট আদালতে দাখিল হয়নি। ধারণা করা যায় চার্জশীটের সে দিল্লী এখনও অনেক দূর। এমনকি আদালতের বিচারে যদি এই খুনীদের মৃত্যুদন্ডও হয় তারপরেও কেন জানি মনে হয় ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমা’য় তারা বেকসুর খালাস পাবেন এবং কোনো এক সার্কিট হাউজে নিয়ে মন্ত্রীরা তাদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে সাত খুনের অনন্য কৃতিত্বের জন্য সংবর্ধনা জানাবেন। এর আগেও আমরা দেখেছি মৃত্যুদন্ডের জন্য অপেক্ষমাণ খুিনদের ‘রাষ্ট্রপতি ক্ষমা’য় মুক্তি দিয়ে মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে তাদের সংবর্ধনা দিয়েছেন।
এই প্রশ্ন হয়তো আসতো না। কিন্তু এলো মায়ার জামাইসহ র‌্যাবের খুনিদের আদালতে হাজির করা নিয়ে। গত ১১ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আদালতে র‌্যাবের আত্মস্বীকৃত তিন খুনিকে আদালতে হাজির করা হয় এবং দেখা গেলো, সত্যি সত্যি তারা তিন ‘জামাই’ একেবারে ঝলমলে পোশাক পরে হাসি হাসি মুখে পুলিশের হাত ধরে আদালতে হাজির হলেন। এমন একটি নৃশংস খুনের এই আসামী তিনজন ছিলেন একেবারে ভিআইপি আসামী। হাতে হাতকড়া নেই। কোমরে দড়ি নেই। ডান্ডাবেড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ঐ খুনের ঘটনায় আটক অপর সন্দেহভাজন আসামীদের ঠিক ঠিকই হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছিল। ঐ তিনজন ছাড়াও আসামী ছিলো আরো ২৭ জন। হাতকড়ার পাশাপাশি তাদের কোমরে দড়িও লাগানো ছিল।
এ নিয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম শফিকুল ইসলামের আদালতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী, অন্যান্য আসামী ও তাদের স্বজনরা। তারা অভিযোগ করেন র‌্যাবের ঐ তিন কর্মকর্তাকে (সাঈদ, আরিফ ও রানা) আদালতে আনতে কখনওই হাতকড়া পরানো হয় না। তাদের হাতে হাত রেখে পুলিশ সদস্যরা এমনভাবে আদালতে নিয়ে আসেন যেন তারা সরকারের কোনো মন্ত্রী বা এমপি। অথচ তারা ঐ নৃশংস হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আইনজীবী ও বাদীর স্বজনরা প্রশ্ন করেন আইনের দৃষ্টিতে যদি সবাই সমান হয় তবে অন্য আসামীদের হাতে ও কোমরে হ্যা-কাফ বাঁধা হয় কেন? র‌্যাবের কর্মকর্তা ছিলেন বলেই কি তারা আইনের ঊর্ধ্বে? নাকি তাদের একজন মন্ত্রীর জামাতা বলে?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশীদ ম-ল জানান, এর উত্তর আমার কাছে নেই। এটা কোর্ট পরিদর্শক ভাল বলতে পারবেন। নারায়ণগঞ্জের কোর্ট পরিদর্শক হাবিবুর রহমান মিঞা জানান, ঐ তিন কর্মকর্তাকে ঢাকা ও গাজীপুর কারাগার থেকে সরাসরি কোর্টে আনা হয়। যারা সেখান থেকে এদের এসকট করে নিয়ে আসেন বা যে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের নারায়ণগঞ্জে ফেরত পাঠান কেন হাতকড়া ছাড়া আসামী দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে এজলাসের মধ্যেই অন্য আসামীরা প্রতিবাদ শুরু করেন। তারা ঐ তিন কর্মকর্তাকে খাতির করার অভিযোগ এনে বলেন, ওদের কারণেই আমরা আজ আসামী। ওরাই নাটের গুরু। কিন্তু ওদের হাতকড়াও নেই। কোমরে দড়িও নেই। আমাদের হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি পরিয়ে আদালতে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সে সময় আদালতে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
র‌্যাবের আত্মস্বীকৃত খুনী ‘জামাই’দের এমন আদরের বিপরীতে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক নেতাদের দুর্দশা। কোনো কোনো বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ রাজনৈতিক নেতাকে ককটেল ফাটানোর মামলায় আমরা দেখেছি হাতে হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করতে। ঐসব পরিশীলিত রাজনৈতিক নেতার উপর এমন বর্বরোচিত আচরণে অনেক মানুষই চোখের পানি ফেলেছেন। সরকারকে ধিক্কার দিয়েছেন। তাদের উপর এই হীন নির্যাতন করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত। এর পেছনে আর কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। যদিও এই ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কখনও যুক্তি, ভব্যতা, সভ্যতার ধার ধারেনি। যেন তারা আমাদের ঠেলে দিতে চাইছে এক প্রগৈতিহাসিক বর্বরতার যুগে। কিন্তু নিষ্ঠুর সত্য হলো এই যে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না।
এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির মোড়ে দু’জন হত্যাকারী পেছন দিক থেকে এসে মাত্র পাঁচ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সামনে শত শত মানুষের মধ্যেই অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বাধা দিতে গিয়ে তিনিও আহত হন। কয়েকদিন স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য মার্কিন সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। পত্রিকার গ্র্যাফিক্স ছবিতে দেখানো হয় যে, হত্যাকান্ডের পর একজন হত্যাকারী পুলিশের সামনে দিয়েই ঘটনাস্থল থেকে বাংলা একাডেমির দিকে হেঁটে চলে যায়। আর একজন চলে যায় ঘটনাস্থল থেকে নীলক্ষেতের দিকে। তাদের কেউই দৌড়ায়নি। অর্থাৎ তারা নিশ্চিত ছিল যে, কেউ তাদের বাধা দিবে না কিংবা ধরে ফেলার চেষ্টা করবে না। আর ঐ পুরো সময়টা ঐ এলাকা জুড়ে আড্ডা দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাফিদা বলেন, এত মানুষের মধ্যে এরকম একটি হামলা হতে পারে তা তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। আহত রক্তাক্ত রাফিদা যখন রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে মানুষের সাহায্য চাইছিলেন তখন এগিয়ে আসেনি কেউ। পুলিশও কোনোরকম সহযোগিতা করেনি। পুলিশ নাকি ভেবেছিল ওখানে মারামারি হচ্ছে। তাই এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। যেন মারামারি হলে পুলিশের কোনো দায় নেই। এমনকি তা যদি খুনের পর্যায়েও যায় তাহলেও নয়। তাছাড়া ঐ এলাকায় যারা মারামারি, খুনোখুনি করতে পারে পুলিশ হয়তো ভেবেছে তারা ছাত্রলীগ কর্মী হবে। ফলে সে ভ্যাজালে তাদের না যাওয়াই ভাল।
এদিকে আবার সাধারণ মানুষের বিপদ অনেক বেশি। কেউ যদি এগিয়ে যায় এবং রক্তাক্ত ব্যক্তিকে ধরে নিজের গায়ে রক্ত লাগিয়ে ফেলে, তাহলে পুলিশ খুনী বলে তাকে ধরে ফেলতে পারে। এতে পুলিশের কাজ সহজ হবে। কিন্তু যাকে ধরবে নির্ঘাত তার কারাগার, পড়াশোনার বিরতি, হাঁটুতে গুলী, মুক্তিপণ, চাই কি ক্রসফায়ারেও পড়তে হতে পারে তাকে। বাংলাদেশে এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে। অথচ আমরা জাতি হিসেবে এমন নই। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা পরস্পরের বিপদে এগিয়ে গেছি। এখনও গ্রাম এলাকায় চোর-ডাকাতের উৎপাত এবং যৌথ বাহিনীর তথাকথিত অভিযান রোধে গ্রামবাসীরা পালা করে রাতে পাহারা দেয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খামখেয়ালি এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে মানুষের এত বড় বিপদেও লোকে তামাশা দেখে, এগিয়ে আসে না। কিন্তু তারপরেও প্রকৃত মানুষ থাকে। আর তিনি ছিলেন বাংলার চোখ-এর ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। শত ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি এই দম্পতিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস পথে খুনী হিসেবে আটক করে কেউ তাকে গণপিটুনি দেয়নি। যদিও ঐটুকু পথে সবসময়ই জীবন তেমন আশঙ্কাই করছিলেন।
সে ক্ষেত্রেও এক নতুন বিপদের খবর দিলেন ঢাকা মহানগর  পুলিশ  গত ১৬ মার্চ সাংবাদিকদের বলা হয়েছে, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক টাকার বিনিময়ে ও মতাদর্শগত কারণে নাশকতার চিত্র ও তথ্য সরবরাহ করেন। এরা বেশিরভাগ অনলাইন সংবাদপত্রে কাজ করেন। অপেশাদার। এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন মনিরুল।
তাহলে জীবন আহমেদের কী হবে? তিনি ছবি তুলেছিলেন রক্তাক্ত অভিজিৎ ও রাফিদার। সে ছবি এখনকার প্রযুক্তি অনুযায়ী মুহূর্তেই পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব নিজের পোর্টালে। সে পোর্টাল তা সঙ্গে সঙ্গে আপলিংক করতে পারে এবং পৌঁছে যায় তার গ্রাহকদের কাছে। তবে কি জীবন আহমেদকে এখন আটক করা হবে, নাকি  পুরস্কৃত করা হবে?
র‌্যাবের ‘জামাই’দের মতো আর এক জামাইয়ের সন্ধান মিলল সিলেটে। সে ‘জামাই’ সিলেট মহানগর পুলিশের বিমান বন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুর রহমান। অর্থের লোভে এবাদুর রহমান তার সহযোগী র‌্যাবের সোর্স গেদা মিঞা ও জেলা আওয়ামী ওলামালীগের সাধারণ সম্পাদক এন ইসলাম তালুকদার ওরফে রাকিব মিলে গত ১৪ মার্চ নয় বছরের স্কুল ছাত্র আবু সাঈদকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ হিসেবে তারা শিশু সাঈদের পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। শেষে দুই লাখ টাকায় রফা হয়। কিন্তু ঐ তিনজনই শিশু সাঈদের পরিচিত ছিল। সাঈদ সকলকেই চিনে ফেলে। ফলে মুক্তিপণ না নিয়ে ‘জামাই’ এবাদুর রহমানসহ তিনজন মিলে সাঈদকে গলা টিপে হত্যা করে। এরপর তাকে সাতটি বস্তায় পেঁচিয়ে চিলেকোঠায় রেখে দেয়। আর সাঈদ অপহৃত হয়েছে শুনে এবাদুর তাদের বাসায় গিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকে এবং মুক্তিপণ দিয়ে সাঈদকে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। সেভাবে দুই লাখ দেয়াও হয়। ‘জামাই’ এবাদুর গ্রেফতার হয়েছেন। আশা করি তিনিও ‘জামাই’ সাঈদের মতোই ‘জামাই আদর’ পাবেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads