গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেগম জিয়ার ভাষণ নিয়ে বোধগম্য কারণেই বিভিন্ন মহল থেকে নানামুখী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। এটিই স্বাভাবিক। কারণ দেশে আজ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে যে আন্দোলন চলছে তার একচ্ছত্র সেনাপতি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই অবিসংবাদিত নেত্রী গত দুই মাসেরও বেশি সময় হলো অঘোষিতভাবে অবরুদ্ধ। তাই সুদীর্ঘ সময় পর তিনি যখন সাংবাদিকদের সামনে বেরিয়ে এলেন তখন চারদিকে ছিলো সুতীব্র কৌতূহল এবং প্রবল উত্তেজনা। এই পটভূমিতে ধারণা করা হচ্ছিল যে, বেগম খালেদা জিয়া জাতির কাছে সুনির্দিষ্ট এবং নীতি নির্ধারণী বক্তব্য পেশ করবেন। তার সুদীর্ঘ ভাষণ শেষ হলে দেখা গেল যে, তিনি ঠিক সেটাই করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, অধিকাংশ মিডিয়া তার ভাষণের প্রতি সুবিচার করেনি। এতো সুদীর্ঘ ভাষণ দিলেন অথচ বড় বড় এবং নামকরা বলে পরিচিত কয়েকটি সংবাদপত্র তার ভাষণের এক-তৃতীয়াংশও ছাপেনি। আবার কিছু কিছু মিডিয়া অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেপেছে। কিন্তু যে বিষয়টি তিনি জাতির কাছে বলতে চান সেটি তারা ছাপেনি। এই জাতির দুর্ভাগ্য যে, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পাঁচ ভাগের চার ভাগই আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে অবাক করেছে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দু’টি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের আলাদা মতবাদ থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। একটি বড় এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল হিসেবে এটি স্বাভাবিক যে, বেগম জিয়া যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন এবং সেই বক্তব্যটি যদি লম্বা হয় তাহলে সেই বক্তব্যটি ভালো করে পড়ে তারপর প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। এতে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সময় ব্যয় হয়। বিএনপিও এভাবেই ধীরস্থিরভাবে সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবারে যেটা করল সেটি দেখে তো বোদ্ধা মহলের আক্কেল গুড়ুম।
৭১ টেলিভিশনে দেখা গেলো যে, বেগম জিয়া যখন ভাষণ দিচ্ছেন তখন আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে আরেকটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। টেবিলে মাইক্রো ফোন নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ রেডি হয়ে বসে আছেন। তার ডান পাশে সাবেক পরররাষ্ট্র মন্ত্রী দ্বিপু মনি। প্রস্তুতিটা অনেকটা এই রকম : যেইমাত্র বেগম জিয়ার ভাষণ শেষ হবে সেইমাত্র আওয়ামী লীগ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। টেলিভিশনের পর্দাতেও সেটিই দেখা গেলো। যে মুহূর্তে বেগম জিয়ার ভাষণ শেষ হলো সেই মুহূর্তে ৭১-এর অনুষ্ঠান উপস্থাপক ঘোষণা করলেন যে, “বেগম জিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে নেতারা রেডি হয়ে বসে আছেন, আমরা এখন ক্যামেরা সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।” ক্যামেরা যথারীতি সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সাথে সাথে জনাব হানিফ বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়ার লিখিত ভাষণ পাঠ করার সময়ই তো পেলেন না। তারপরও তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কিভাবে? এর সাদামাট অর্থ হল এই যে, বেগম জিয়া তথা ২০ দলীয় জোট যা কিছু বলুক না কেন আওয়ামী লীগকে সেটা প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। এটিই হল আওয়ামী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, অতীতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বাজেট পেশ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এ ধরনের কাণ্ডকীর্তি করতো। বাজেট পেশ হয় সাধারণত বিকাল ৩টায়। তার অন্তত ৩ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ বেলা ১২টায় তারা তাদের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের অফিসে জড়ো হতো। সেখানে আগেভাগেই পোস্টার ও ব্যানার লেখা থাকত। এসব পোস্টার এবং ব্যানারে আগেভাগেই লেখা থাকতো নি¤œ লিখিত স্লোগান “গরীব মারার বাজেট—- মানি না মানি না।” “গণবিরোধী বাজেট —— মানি না, মানি না। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ঐসব ব্যানার এবং ফেস্টুন নিয়ে বসে থাকতো। যেই মাত্র অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষ হতো সেই মুহূর্তে তারা ঐসব ব্যানার এবং ফেস্টুন নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমে পথসভা করতো এবং তারপর মিছিল করতো। পাঠক ভাইয়েরা ভেবে দেখুন, জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সেই বাজেটটিকে গরীব মারার বাজেট বানিয়ে ছাড়ত।
॥দুই॥
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি যে, বেগম জিয়ার ভাষণের যে অংশটুকু গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করার কথা সেই অংশটির পুরোপুরি প্রকাশ না করে আওয়ামী অনুগত মিডিয়া অপ্রয়োজনীয় অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশ করেছে। বেগম জিয়ার এবারের ভাষণের প্রধান ফোকাস ছিলো হাসিনা সরকার কর্তৃক গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা এবং অপহরণের দীর্ঘ ফিরিস্তি। বেগম জিয়া বলেন, শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। আন্দোলন স্থগিতের সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যে সঠিক ছিল না তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি। কারণ, আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার পর সারা দেশে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিরোধী দলমতের শত শত নেতা কর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়। তাদের আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের ওপরেও নির্যাতন চালানো হয়।
রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত পল্লী পর্যন্ত চলতে থাকে এই হত্যা উৎপীড়নের তাণ্ডব। রাজনীতি করার স্বাভাবিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়।
হত্যা ও উৎপীড়ন চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বহু মায়ের কোল খালি করে চলেছে মন্তব্য করে ২০ দলের শীর্ষ নেতা বলেন, প্রতিটি জনপদে আজ স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল। এই কান্না অত্যাচারীদের কানে পৌঁছায় না। কে কখন গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের শিকার হবে তা নিয়ে সকলে আতঙ্কিত। শত শত তরুণকে আটক করে গুলী ও নির্যাতনে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময়ে যাত্রীবাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে যাত্রাবাড়িতে ১৮ জন এবং শেরাটন হোটেলের কাছে ১১ জন যাত্রীকে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। ঐ দুটি পৈশাচিক ঘটনায় দগ্ধ আরো ১২ জন পরে হাসপাতালে প্রাণ হারায়। এছাড়া বোমা ও ককটেল মেরে এবং পিটিয়ে তারা বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপরেও আক্রমণ করেছে। তাদের সন্ত্রাসের কারণে এসএসসি পরীক্ষা তিন মাস পর্যন্ত পিছাতে হয়েছে। পবিত্র রমযান মাসেও তারা হরতাল করেছে। যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের দিনে হরতাল দিয়েছে। স্বল্পমেয়াদী ৬ষ্ঠ সংসদের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন ঠেকাতে তারা ‘গণকার্ফু’ জারি করে দেশব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছিল। এই আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল এবং রেল স্টেশন, যানবাহন, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। অফিসগামী কর্মকর্তাণ্ড কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজপথে বিবস্ত্র করেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। এসব পৈশাচিক তাণ্ডবের প্রকাশ্য নির্দেশ শেখ হাসিনা নিজে দিয়েছেন এবং এসবের বহু দালিলিক প্রমাণও রয়ে গেছে।
॥তিন॥
সাধারণ মানুষকে বোমা মেরে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং এ নিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতাসীনরাই সুবিধা পাবে। কাজেই ক্ষমতাসীনরা সুবিধা পায় এমন কোনো অপকর্মে আমাদের কেউ জড়িত থাকার প্রশ্ন ওঠে না। ইতিহাস সচেতন সকলেই জানেন যে, জার্মানীর নাৎসী নেতা হিটলার ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগিয়ে সেই দায় বিরোধীদের উপর চাপিয়ে অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এরপর নির্মম ও নিষ্ঠুর পন্থায় বিরোধী দল ও মতকে তিনি দমন করেছিলেন। বাংলাদেশে হিটলারের ক্ষুদে প্রেতাত্মারা আজ সেই পথ অনুসরণের ব্যার্থ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এসব অপতৎপরতায় হিটলারের যেমন শেষ রক্ষা হয়নি তার অনুসারী বাংলাদেশী ক্ষুদে হিটলাররাও চূড়ান্ত বিবেচনায় পরাজিত হবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আজকের সংকট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলেই আমরা সংকট মুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারবো। আমি আশা করি ক্ষমতাসীনদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তারা সমঝোতার পথে ফিরে আসবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নিবে।
খালেদা জিয়ার সমগ্র ভাষণে ছিলো শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান। গত শুক্রবার তিনি সংকটের সমাধান ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১। গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যা, যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২। সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিকত কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সকল প্রকার বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৩। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের এবং দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
বেগম জিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ চেষ্টা করেছেন। তার ফর্মূলা গ্রহণ করা বা না করা সরকারের বিষয়। যদি প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব গ্রহণ না করেন, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তিনি অশান্তি, নৈরাজ্য ও হানাহানির প্রধান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে অবাক করেছে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দু’টি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের আলাদা মতবাদ থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। একটি বড় এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল হিসেবে এটি স্বাভাবিক যে, বেগম জিয়া যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন এবং সেই বক্তব্যটি যদি লম্বা হয় তাহলে সেই বক্তব্যটি ভালো করে পড়ে তারপর প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। এতে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সময় ব্যয় হয়। বিএনপিও এভাবেই ধীরস্থিরভাবে সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবারে যেটা করল সেটি দেখে তো বোদ্ধা মহলের আক্কেল গুড়ুম।
৭১ টেলিভিশনে দেখা গেলো যে, বেগম জিয়া যখন ভাষণ দিচ্ছেন তখন আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে আরেকটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। টেবিলে মাইক্রো ফোন নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ রেডি হয়ে বসে আছেন। তার ডান পাশে সাবেক পরররাষ্ট্র মন্ত্রী দ্বিপু মনি। প্রস্তুতিটা অনেকটা এই রকম : যেইমাত্র বেগম জিয়ার ভাষণ শেষ হবে সেইমাত্র আওয়ামী লীগ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। টেলিভিশনের পর্দাতেও সেটিই দেখা গেলো। যে মুহূর্তে বেগম জিয়ার ভাষণ শেষ হলো সেই মুহূর্তে ৭১-এর অনুষ্ঠান উপস্থাপক ঘোষণা করলেন যে, “বেগম জিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে নেতারা রেডি হয়ে বসে আছেন, আমরা এখন ক্যামেরা সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।” ক্যামেরা যথারীতি সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সাথে সাথে জনাব হানিফ বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়ার লিখিত ভাষণ পাঠ করার সময়ই তো পেলেন না। তারপরও তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কিভাবে? এর সাদামাট অর্থ হল এই যে, বেগম জিয়া তথা ২০ দলীয় জোট যা কিছু বলুক না কেন আওয়ামী লীগকে সেটা প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। এটিই হল আওয়ামী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, অতীতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বাজেট পেশ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এ ধরনের কাণ্ডকীর্তি করতো। বাজেট পেশ হয় সাধারণত বিকাল ৩টায়। তার অন্তত ৩ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ বেলা ১২টায় তারা তাদের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের অফিসে জড়ো হতো। সেখানে আগেভাগেই পোস্টার ও ব্যানার লেখা থাকত। এসব পোস্টার এবং ব্যানারে আগেভাগেই লেখা থাকতো নি¤œ লিখিত স্লোগান “গরীব মারার বাজেট—- মানি না মানি না।” “গণবিরোধী বাজেট —— মানি না, মানি না। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ঐসব ব্যানার এবং ফেস্টুন নিয়ে বসে থাকতো। যেই মাত্র অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষ হতো সেই মুহূর্তে তারা ঐসব ব্যানার এবং ফেস্টুন নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমে পথসভা করতো এবং তারপর মিছিল করতো। পাঠক ভাইয়েরা ভেবে দেখুন, জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সেই বাজেটটিকে গরীব মারার বাজেট বানিয়ে ছাড়ত।
॥দুই॥
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি যে, বেগম জিয়ার ভাষণের যে অংশটুকু গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করার কথা সেই অংশটির পুরোপুরি প্রকাশ না করে আওয়ামী অনুগত মিডিয়া অপ্রয়োজনীয় অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশ করেছে। বেগম জিয়ার এবারের ভাষণের প্রধান ফোকাস ছিলো হাসিনা সরকার কর্তৃক গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা এবং অপহরণের দীর্ঘ ফিরিস্তি। বেগম জিয়া বলেন, শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। আন্দোলন স্থগিতের সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যে সঠিক ছিল না তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি। কারণ, আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার পর সারা দেশে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিরোধী দলমতের শত শত নেতা কর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়। তাদের আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের ওপরেও নির্যাতন চালানো হয়।
রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত পল্লী পর্যন্ত চলতে থাকে এই হত্যা উৎপীড়নের তাণ্ডব। রাজনীতি করার স্বাভাবিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়।
হত্যা ও উৎপীড়ন চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বহু মায়ের কোল খালি করে চলেছে মন্তব্য করে ২০ দলের শীর্ষ নেতা বলেন, প্রতিটি জনপদে আজ স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল। এই কান্না অত্যাচারীদের কানে পৌঁছায় না। কে কখন গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের শিকার হবে তা নিয়ে সকলে আতঙ্কিত। শত শত তরুণকে আটক করে গুলী ও নির্যাতনে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময়ে যাত্রীবাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে যাত্রাবাড়িতে ১৮ জন এবং শেরাটন হোটেলের কাছে ১১ জন যাত্রীকে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। ঐ দুটি পৈশাচিক ঘটনায় দগ্ধ আরো ১২ জন পরে হাসপাতালে প্রাণ হারায়। এছাড়া বোমা ও ককটেল মেরে এবং পিটিয়ে তারা বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপরেও আক্রমণ করেছে। তাদের সন্ত্রাসের কারণে এসএসসি পরীক্ষা তিন মাস পর্যন্ত পিছাতে হয়েছে। পবিত্র রমযান মাসেও তারা হরতাল করেছে। যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের দিনে হরতাল দিয়েছে। স্বল্পমেয়াদী ৬ষ্ঠ সংসদের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন ঠেকাতে তারা ‘গণকার্ফু’ জারি করে দেশব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছিল। এই আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল এবং রেল স্টেশন, যানবাহন, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। অফিসগামী কর্মকর্তাণ্ড কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজপথে বিবস্ত্র করেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। এসব পৈশাচিক তাণ্ডবের প্রকাশ্য নির্দেশ শেখ হাসিনা নিজে দিয়েছেন এবং এসবের বহু দালিলিক প্রমাণও রয়ে গেছে।
॥তিন॥
সাধারণ মানুষকে বোমা মেরে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং এ নিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতাসীনরাই সুবিধা পাবে। কাজেই ক্ষমতাসীনরা সুবিধা পায় এমন কোনো অপকর্মে আমাদের কেউ জড়িত থাকার প্রশ্ন ওঠে না। ইতিহাস সচেতন সকলেই জানেন যে, জার্মানীর নাৎসী নেতা হিটলার ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগিয়ে সেই দায় বিরোধীদের উপর চাপিয়ে অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এরপর নির্মম ও নিষ্ঠুর পন্থায় বিরোধী দল ও মতকে তিনি দমন করেছিলেন। বাংলাদেশে হিটলারের ক্ষুদে প্রেতাত্মারা আজ সেই পথ অনুসরণের ব্যার্থ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এসব অপতৎপরতায় হিটলারের যেমন শেষ রক্ষা হয়নি তার অনুসারী বাংলাদেশী ক্ষুদে হিটলাররাও চূড়ান্ত বিবেচনায় পরাজিত হবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আজকের সংকট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলেই আমরা সংকট মুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারবো। আমি আশা করি ক্ষমতাসীনদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তারা সমঝোতার পথে ফিরে আসবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নিবে।
খালেদা জিয়ার সমগ্র ভাষণে ছিলো শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান। গত শুক্রবার তিনি সংকটের সমাধান ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১। গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যা, যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২। সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিকত কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সকল প্রকার বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৩। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের এবং দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
বেগম জিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ চেষ্টা করেছেন। তার ফর্মূলা গ্রহণ করা বা না করা সরকারের বিষয়। যদি প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব গ্রহণ না করেন, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তিনি অশান্তি, নৈরাজ্য ও হানাহানির প্রধান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন