শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নতুন আরও দুই মন্ত্রী বিতর্কিত : জনতার মঞ্চের মখা আলমগীর সুপ্রিমকোর্টের রায়ে এমপি হিসেবে অযোগ্য ” আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ



নতুন শপথ নেয়া সাত মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর আরও দু’জন নানা কারণে বিতর্কিত। এর মধ্যে ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর জনতার মঞ্চের বিতর্কিত নেতা। তার সংসদ সদস্যপদ আপিল বিভাগে খারিজ হলেও নানা কৌশলে তিনি এখনও পদটি ধরে রেখেছেন। আপিল বিভাগের রায়ের পরও হাইকোর্ট থেকে আরেকটি রায় পেয়ে এমপি হিসেবে বহাল আছেন। নতুন দেয়া ব্যাংকের একটি পেয়েছেন তিনি।
এদিকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া ঝিনাইদহ-২ আসনের এমপি আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। বৃহস্পতিবার শপথ নেয়া আরেক মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কাহিনী আমার দেশসহ বিভিন্ন পত্রিকায় দু’দিন ধরে ছাপা হয়েছে। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠান ‘সাকো’-এর এমডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ফারুক। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পাসপোর্ট জব্দের পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তার সংসদ সদস্য পদটি সুপ্রিমকোর্টের রায়ে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারই অযোগ্য। তার প্রার্থিতাকেই অবৈধ ঘোষণা করেছে পর্যায়ক্রমে হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আলোকে কমিশন তার সদস্যপদ বাতিল করে গেজেট জারি করেছিল। ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন গেজেট জারির মাধ্যমে চাঁদপুর-১ আসনটি শূন্য ঘোষণা করে।
কিন্তু গেজেটে যুগ্ম সচিবের স্বাক্ষর করার এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদন করেন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ওই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনের গেজেটের কার্যকারিতা ৬ মাস
স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে এখনও বহাল রয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ব্যক্তির সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকল হাইকোর্ট বিভাগের এক নির্দেশনায়।
গত বৃহস্পতিবার বিতর্কিত এই সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। মন্ত্রী হওয়ার পর তার এসব বিষয় আবার বিতর্কের জন্ম দেয়। নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে—সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নির্বাচনের অযোগ্য হিসেবে সদস্যপদ খারিজ হয়েছে, সেই ব্যক্তি আবার মন্ত্রী হলেন কেমন করে?
দৈনিক আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত জরুরি আইনের সরকারের আমলে গুরুতর অপরাধ সংক্রান্ত জাতীয় সমম্বয় কমিটির (এনসিসি) শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকায় নাম ছিল মহীউদ্দীন খান আলমগীরের। তখন দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছিল। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ওই বছরের ২৬ জুলাই এ মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। এ অবস্থায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি মনোনয়ন পান চাঁদপুর-১ আসনে নির্বাচনের জন্য। মনোনয়নপত্র বাছাইকালে ৩ ডিসেম্বর রিটার্নিং অফিসার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৫১ ধারা অনুযায়ী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন তিনি। শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনও রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। অর্থাত্ দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে আরপিও অনুযায়ী তিনি নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দেয় নির্বাচন কমিশন। এ সিদ্ধান্তের পর মহীউদ্দীন খান আলমগীর হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টও তখন নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত সঠিক বলে রায় দেয়। এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীর আপিল বিভাগে আবেদন জানান। নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের তত্কালীন চেম্বার জজ বিচারপতি জয়নুল আবেদীন হাইকোর্টের রায়কে সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পরে তার লিভ টু আপিল আবেদনটি আপিল বিভাগের ফুল কোর্টে শুনানির জন্য আসে। তত্কালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ ২০১০ সালের ১৫ জুলাই বিস্তারিত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে আপিল বিভাগের ফুল কোর্ট মহীউদ্দীন খান আলমগীরের লিভ টু আপিল আবেদন খারিজ করে রায় দেয়। এই রায়ের ফলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তটি বহাল হয়। অর্থাত্ তিনি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য বলেই বিবেচিত ছিলেন না। রায়ের কপি পাওয়ার পর ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেমবর নির্বাচন কমিশন তার সংসদ সদস্য পদটি বাতিল করে গেজেট জারি করে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদকেও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের গেজেট জারির পর চাঁদপুর-১ আসনে উপ-নির্বাচনের নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছিল তখন।
এদিকে মহীউদ্দীন খান আলমগীর যেহেতু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ছিলেন, সেই কারণ দেখিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিএনপির প্রার্থী আ ন ম এহসানুল হক মিলন তাকে বিজয়ী ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনে একটি আবেদন জানান। এছাড়া তিনি হাইকোর্ট বিভাগেও পৃথক একটি রিট আবেদন করে বিজয়ী ঘোষণার জন্য নিবেদন করেন। তার রিট আবেদনটি গ্রহণ করে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনের প্রতি কারণ দর্শানোর রুল জারি করে। রুলে জানতে চাওয়া হয়—মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর আ ন ম এহছানুল হক মিলনকে কেন বিজয়ী ঘোষণা করা হবে না। রুলটি এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহীউদ্দীন খান আলমগীর গেজেটে যুগ্ম সচিবের স্বাক্ষর করার এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের দুই বছর পর আপিল বিভাগেও একটি পৃথক রিভিও পিটিশন দায়ের করেছে। গত ১০ জুন রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে আপিল বিভাগ আগের ঘোষিত রায় স্থগিত রাখারও নির্দেশ দিয়েছে। সিনিয়র আইনজীবীদের মতে, সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে এটি নতুন নজির। রায় ঘোষণার ২ বছর পর রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করে আগের রায় স্থগিত করার নজির নেই। ১০ জুন রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করে ২ বছর আগের রায় স্থগিত করলেও লিখিত আদেশ এখনও বের হয়নি। কোন গ্রাউন্ডে দুই বছর পর রিভিউ পিটিশন সুপ্রিমকোর্ট গ্রহণ করেছে এবং নিজেদের রায় দুই বছর পর স্থগিত করেছে, লিখিত আদেশ বের হলে জানা যাবে।
এদিকে সব মিলিয়ে চাঁদপুর-১ আসনটি নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে এখনও ৩টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আ ন ম এহসানুল হক মিলনের এবং অপর ২টি হচ্ছে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের। তার একটি মামলা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে জারি করা গেজেটে যুগ্ম সচিবের স্বাক্ষরের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে এবং একই ঘটনায় আপিল বিভাগে ২ বছর পর আরেকটি রিভিউ পিটিশন। অর্থাত্ মামলার বেড়াজালের কৌশলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সংসদ সদস্য পদটি টিকে রয়েছে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের ফলাফল ও প্রার্থিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায়ে এরই মধ্যে ২টি আসনে পরিবর্তন ঘটেছে। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায়ে বিজয়ী প্রার্থীর মনোনয়ন অযোগ্য ঘোষণার পর ভোলা-১ আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। টাঙ্গাইল-৫ আসনের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। তিনি এরই মধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও নিয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত আবদুল হাই এখন প্রতিমন্ত্রী : সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত লাল পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত আবদুল হাই এখন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রণালয় পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা এ প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসে মদতদান, সন্ত্রাসী লালন, দুর্নীতি, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের অভিযোগও রয়েছে। অবশ্য প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই। কিছুদিন পর তার নির্বাচনী এলাকার এনসার আলী প্রিন্স কানাডা যান। পাসপোর্টে তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের ছেলে তখন বালকমাত্র। জালিয়াতির এ বিষয়টি ধরে ফেলে কানাডা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় এনসার আলী প্রিন্সকে। কানাডা সরকার এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় ঢাকায় কানাডিয়ান দূতাবাসকে। এ ব্যাপারে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি মামলা হয়। তদন্তে প্রাথমিকভাবে জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ডিবির একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ওয়াচ) তত্কালীন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল হাই ও এনসার আলী প্রিন্সকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
সংসদ সদস্যদের জন্য বরাদ্দ লাল পাসপোর্টের গুরুত্ব দেয় বিদেশি দূতাবাসগুলো। অভিযোগ রয়েছে, সংসদ সদস্য আবদুল হাই এই সুযোগটি কাজে লাগান মোটা টাকার বিনিময়ে। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের রাতে (গত বৃহস্পতিবার) সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাইয়ের এ কেলেঙ্কারির বিষয়টি উত্থাপন করেন। গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয়তাবাদী যুবদল সভাপতি ও তত্কালীন সংসদ সদস্য (বরিশাল-২) মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঘটনাটি তিনি অবহিত বলে আমার দেশ-কে জানান। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের লাল পাসপোর্ট সে সময় পুলিশ জব্দ করেছিল।
লাল পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির বিষয়টি ঝিনাইদহের লোকেরও মুখে মুখে। ঝিনাইদহে কর্মরত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক জানান, এ ব্যাপারে সে সময় তারা নিজ নিজ পত্রিকায় রিপোর্টও করেছিলেন। ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান এবং ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওহাবের সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করা হলে তারাও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, বিষয়টি ঝিনাইদহের সব লোক জানে। টাকার লোভে সংসদ সদস্য অন্যের ছেলেকে নিজের ছেলে হিসেবে দেখিয়েছিলেন বলে তাদের ধারণা।
অভিযুক্ত সংসদ সদস্য ও সদ্যনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই অবশ্য ব্যাপারটিকে ‘অ্যাকসিডেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। আমার লাল পাসপোর্টটি চুরি হয়ে যায়। পরে জানতে পারি, সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে একজন কানাডা গিয়েছিল।’ মামলার পরিণতি সম্বন্ধে আবদুল হাই জানান, গত জরুরি সরকারের সময় মামলা থেকে তিনি বেকসুর খালাস পান।
অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ : সদ্যনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছে নানা অভিযোগ। নিতান্ত মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান আবদুল হাই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বলে জানান শৈলকূপা এলাকার লোকজন। ঝিনাইদহ ও শৈলকূপায় বাড়িসহ বহু সম্পত্তি ও গাড়ির মালিক তিনি। অথচ সংসদ সদস্য আবদুল হাই কোন পেশায় নিযুক্ত, ঝিনাইদহ এলাকার মানুষ তা জানেন না।
বর্তমান সরকারের সময়কালে আবদুল হাইয়ের নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। ঠিকাদাররা সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ লোকদের চাঁদা না দিয়ে কাজ করতে পারেন না বলে অভিযোগ। পৌনে চার বছরে টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রভৃতি কয়েকশ’ প্রকল্প ছাড় হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে শুধুই খাতা-কলমে; বাস্তবে নয়। ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি করে প্রকল্পের টাকা লুটে নিয়েছে সংসদ সদস্যের লোকেরা। সংসদ সদস্য আবদুল হাই এ বিষয়ে বলেন, প্রতিটি প্রকল্প সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। যদি কোনো দুর্নীতি হয়ও তা সংসদ সদস্যের অগোচরে বলে তিনি দাবি করেন। সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান অবশ্য দাবি করেন, শৈলকূপাসহ গোটা ঝিনাইদহ জেলাতেই বর্তমান সরকারের আমলে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়নি। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে বরাদ্দ আসা টাকার পুরোটাই লুটপাট হয়েছে।
শৈলকূপায় লুটপাট চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও এমপিওভুক্তির নামেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, জনপ্রতিনিধিকে ‘খুশি’ করতে না পারলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয় না। এই প্রক্রিয়ায় শুধু লাঙলবাঁধ আফিলউদ্দিন কলেজ থেকেই ৫২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে এলাকায় প্রচার আছে। সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওহাবও একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫২ লাখ টাকা লুটে নেয়ার কাহিনী শুনেছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য আবদুল হাই বলেন, তিনি নিয়োগ বাণিজ্য করেন না। এলাকার উন্নয়নে তিনি নিঃস্বার্থভাবে সাধ্যমতো কাজ করছেন বলে দাবি করেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিরোধী দল দলন : সদ্যনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাইয়ের নির্বাচনী এলাকা শৈলকূপায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। এ উপজেলায় গত পৌনে তিন বছরে খুন হয়েছে ১৭ জন। জবর দখল, চাঁদাবাজি, ভাংচুর, মারপিটের ঘটনা ঘটেছে অগণিত। খুন হওয়া ১৭ জনের মধ্যে ছাত্রদল নেতা আশরাফুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রশিদ ও টুটুল, যুবদল নেতা রেজাউল ইসলাম, বিএনপি কর্মী আবদুল কুদ্দুসের নাম উল্লেখযোগ্য। খুনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িতরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোনা শিকদারের ক্যাডার বলে এলাকায় পরিচিত। এককালের চরমপন্থী নেতা (জাসদ গণবাহিনী) সোনা শিকদারের রাজনৈতিক প্রশ্রয়দাতা সংসদ সদস্য আবদুল হাই। চরমপন্থী দল ও গ্রুপগুলোর সঙ্গে এখনও সোনা শিকদারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
শৈলকূপা পৌরসভার বিগত নির্বাচনে সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী তৈয়বুর রহমান খান শোচনীয় পরাজয়বরণ করেন। তৈয়বুরকে হিন্দুরা ভোট দেয়নি—এমন অভিযোগে নির্বাচনের পর শৈলকূপা শহরে হিন্দু মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয় সংসদ সদস্য সমর্থিত সন্ত্রাসীরা। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সে সময় ঝিনাইদহের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের হাইকোর্টে তলবও করা হয়। নির্যাতিত হয়েও ভয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ীরা।
শুধু খুন-খারাবি, দখলবাজি, চাঁদাবাজিই নয়, শৈলকূপায় গত পৌনে চার বছরে বিরোধী দল কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিই পালন করতে পারেনি। বিরোধী দলের বহু রাজনৈতিক কর্মসূচি পণ্ড হয়ে গেছে ১৪৪ ধারা জারির কারণে। সংসদ সদস্য আবদুল হাই নেপথ্যে থেকে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে এসব করিয়েছেন বলে অভিযোগ ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওহাবের। তিনি বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে বিএনপির কত কর্মী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। আর সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান বলেন, ১৪৪ ধারা জারি করে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পণ্ড করার ক্ষেত্রে শৈলকূপা সম্ভবত বাংলাদেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
সংসদ সদস্য আবদুল হাই বিরোধী দল দলনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক নির্দেশে সন্ত্রাস হচ্ছে না। তিনি বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের সময় আওয়ামী লীগের অন্তত ৬০ জন নেতাকর্মীকে বিকলাঙ্গ করে দেয়া হয়। সে সময় নেতাকর্মীরা কেউ শৈলকূপায় অবস্থান করতে পারেনি। নির্যাতিত কর্মীরা হয়তো রাগে দু’-একটি ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি দাবি করেন, এখন বিরোধী দলের সব নেতাকর্মী নিজ নিজ এলাকায় থাকতে পারছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল হাই বলেন, সোনা শিকদারের ওপর অতীতে অনেক নির্যাতন হয়েছে। তাই সোনা শিকদারের নেতৃত্বে এখন কিছু ঘটনা তো ঘটতেই পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads