বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

চলে গেলেন এক দুর্দান্ত সাহসী দেশপ্রেমিক সাংবাদিক : আতাউস সামাদের দেখিয়ে যাওয়া পথ




আমরা অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম প্রধান দিশারী এবং দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুতে এ দেশের সাংবাদিকতার জগতে তো বটেই, রাজনৈতিক অঙ্গনেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও সাংবাদিকতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন এই পরিশ্রমী সাংবাদিক। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগেও দৈনিক আমার দেশ-এর অফিসে এসে কাজ করে গেছেন তিনি। টেলিফোনে যোগাযোগ তো রেখেছেনই।
১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করার পর আতাউস সামাদ তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন সামরিক ও স্বৈরশাসনের অধীনে। শ্বাসরুদ্ধকর সেই বছরগুলোতে দুর্দান্ত সাহসী ছিল তার ভূমিকা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দারা বিরামহীনভাবে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছে, প্রলোভনও তাকে কম দেখানো হয়নি। কিন্তু ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে এবং প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন চালিয়েও তাকে সত্য প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এমনকি গ্রেফতারও বরণ করেছেন। ওই দিনগুলোতে মানুষ আতাউস সামাদের পাঠানো খবর শোনার জন্য সাগ্রহে বিবিসি রেডিও খুলে বসে থাকত। তার কণ্ঠেও অনেক খবর শোনা যেত। সে সময় মোবাইল দূরে থাক, সাধারণ বা ল্যান্ড টেলিফোনও কমই ছিল। ফলে স্বৈরশাসকের প্রচণ্ড দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কেও তারা জানার সুযোগ পেতেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আতাউস সামাদ প্রধান ভরসা হয়ে উঠতেন। বিবিসিতে প্রচারিত তার খবরই নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উজ্জীবিত করে তুলত। সেদিক থেকে স্ব্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি তার এই অবস্থান বজায় রেখেছেন। প্রয়োজনের সময়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকাও পালন করেছেন।
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ছিল আতাউস সামাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি ঘটনা ও তথ্যকে। কোনো বিষয়ের সঙ্গে তীব্র দ্বিমত থাকলেও সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য বা খবর প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সত্ থাকতেন। কোনো তথ্যেরই বিকৃতি ঘটাতেন না। তার সঙ্গে বা অধীনে যারা সাংবাদিকতা করেছেন, তাদেরও তিনি সঠিক তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সততা বজায় রাখার তাগিদ দিতেন। অনুসন্ধান বা খবর খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষষ্ট। এমন অনেক বিষয়েই তিনি রিপোর্ট করেছেন ও অন্যদের দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছেন, যেগুলো সহজে কারও চোখেই পড়ত না। এরকম অনেক খবর পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের যে কোনো সঙ্কট ও দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। ১/১১-এর অবৈধ অভ্যুত্থান এবং মইন-ফখরুদ্দীনদের অসাংবিধানিক স্বৈরশাসনের দিনগুলোতে দৈনিক আমার দেশকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন, চরম বিপদের মুখেও সাংবাদিকদের আগলে রেখেছেন পরম আদরে। হুমকির তিনি পরোয়া করেননি কখনও। মইন-ফখরুদ্দীনদের সময় দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও অর্থনৈতিক অবরোধসহ বিভিন্ন কারণে আমার দেশ-এর অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল তখনও আতাউস সামাদই এগিয়ে এসেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমানকে তিনি শুধু আমার দেশ-এর সঙ্গে যুক্তই করেননি, তাকে সাংবাদিকতায়ও এনেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফলে আমার দেশ যখন দফায় দফায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মিথ্যা মামলার আড়ালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সরকার যখন কারাগারে ঢুকিয়েছে, তখনও অভয়ের বাণী মুখে দুর্দান্ত সাহসে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। বস্তুত তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বই আমার দেশকে প্রায় নিশ্চিত ধ্বংসের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভিও আতাউস সামাদের নেতৃত্ব পেয়েছিল বলেই টিকে থাকতে পেরেছে। অতুলনীয় ছিল তার দেশপ্রেম। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং সীমান্তে হত্যাকাণ্ড থেকে ফারাক্কা বাঁধের কুফল ও পানি আগ্রাসন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় স্বার্থেই ভারতকে করিডোর দেয়ার কঠোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন আতাউস সমাদ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এজন্যই দল নির্বিশেষে সবাই তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়েছেন।
আতাউস সামাদের ইন্তেকালে যারা দৈনিক আমার দেশ-এর অফিসে এসে শোক জানিয়ে গেছেন এবং যারা শোকবাণী পাঠিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা সেই সঙ্গে আশ্বস্ত করতে চাই, দৈনিক আমার দেশ সব সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। কোনো কারণেই কখনও বিচ্যুত হবে না। এভাবেই আমরা মরহুম আতাউস সামাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে এগিয়ে যাব। তিনিও বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads