সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবন



আর দশজনের মতো নিস্তরঙ্গ জীবন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে হয়ত ছিল না। একটানা বেশিদিন ফুলের বিছানাও জোটেনি এই জনপ্রিয় নেত্রীর সুদীর্ঘ ৬৭ বছরের ঘটনাবহুল জীবনে। জন্মলগ্নে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল ১৯৪৫ সালে। জন্মের দুই বছরের মধ্যেই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হল। মহাযুদ্ধ আর দেশবিভাগের মতো সংসার ও জীবন ওলটপালট করে দেয়া দুটি বড় ঘটনা যেমন করেই হোক সামাল দিয়েছিলেন তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। তিনি তখনও অবোধ এক শিশুমাত্র। পরবর্তী জীবনে পরিণত বয়সে আরো অনেক ঝড়-ঝাপটা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সামাল দিয়েছেন অসীম ধৈর্য সহকারে। ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরা একটুখানি মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে তার চরিত্রে একধরনের হার-না-মানা সংগ্রামী বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
১৯৬০ সালে ক্যাপ্টেন জিয়ার সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমেই মূলত বেগম খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত্ সংগ্রামী জীবনের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। স্বামী ছিলেন বীর সিপাহসালার। নানা সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে সবসময় ঝুঁকি (কখনো কখনো মৃত্যুর ঝুঁকিও) জড়িয়ে থাকে। স্বামী যেসব বিশাল মাপের ঝুঁকি নিতেন, তার প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়ত স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপরও। বীরবধূ হওয়ার বিড়ম্বনা সারাটি জীবনই সইতে হয়েছে তাকে, বলতে গেলে বিয়ের পর থেকেই। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে গেল। কোলে তখন তার ছয় মাস বয়সী প্রথম পুত্র সন্তান। যুদ্ধযাত্রা করলেন সিপাহসালার স্বামী। লাহোরের কাছে খেমকারান সেক্টরে স্বামী যখন বীর বিক্রমে লড়ছেন, বেগম খালেদা জিয়া তখন উদ্বেগে আকুল হয়ে বিনিদ্র সব রজনী পার করছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন স্বামীর মঙ্গলের জন্য। যুদ্ধ শেষে স্বামী তার ফিরে এলেন নন্দিত বীরের বেশে। তার নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব অর্জন করল। বীরত্বের তকমা নিয়ে ফিরে আসা স্বামীকে কাছে পেয়ে স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তার সব দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের অবসান হল। স্বামীর বীরত্বের বন্দনা চারপাশে শুনে শুনে গর্বে বুক ভরে গেল তার।
বছর পাঁচেক সংসার না করতেই আবার হাজির হল ১৯৭১ সাল। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে তখন। উত্তাল মার্চ মাসে স্বামী মেজর জিয়ার কর্মস্থল হল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নির্বিচার গণহত্যা চালাল, তখন মেজর জিয়া নিজ রেজিমেন্টসহ সেই রাতেই বিদ্রোহ করলেন। বললেন— ‘উই রিভোল্ট...।’ অর্থাত্ ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম...।’ পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারকে বন্দী করে নিজ রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তে যুদ্ধযাত্রা করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্বামী তার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেন না। বেগম খালেদা জিয়া তখন অবুঝ দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় নিরাপদ আশ্রয় পাবেন, সেই চিন্তায় দিশেহারা। প্রথমে ষোলশহরের বাসা ছেড়ে আত্মগোপন করলেন চট্টগ্রামেই চাচা দেলোয়ার হোসেনের বাসায়। পরদিন ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হল—‘আমি মেজর জিয়া বলছি...। ...আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি...।’ সংশোধিত আকারে এই স্বাধীনতার ঘোষণা মেজর জিয়ার কণ্ঠে পুনরায় উচ্চারিত হল ২৭ মার্চ তারিখেও। ইথারে স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দুই রকম। প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুবই ইতিবাচক। সারাদেশের পলায়নপর ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘুরে দাঁড়াল এই ঘোষণা শুনে। পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই কর্মরত একজন বাঙালি মেজর রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। তা শুনে নিরস্ত্র দিশেহারা বাঙালি জাতির মনে সাহসের সঞ্চার হল। আন্তর্জাতিকভাবেও মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হল। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি ছিল খুবই নেতিবাচক, বিশেষ করে অরক্ষিত বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই শিশুপুত্রের জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হন্যে হয়ে তাদের আটক করার জন্য খুঁজতে লাগল। চট্টগ্রামে তার অবস্থান আর নিরাপদ নয় আঁচ করতে পেরে অসহায় বেগম খালেদা জিয়া বোরকায় মুখ ঢেকে দুই শিশুপুত্রসহ নদীপথে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছালেন এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে। সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় এসে শান্তিনগরে বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নিলেন। অল্প কিছুদিন বাদে সিদ্ধেশ্বরীতে আরেক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করলেন এবং সেখান থেকেই মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেন। এরপর থেকে দুই শিশুপুত্রসহ ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী ছিলেন প্রায় সাড়ে সাত মাস এবং ১৬ ডিসেম্বর তারিখে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার দিন তিনি মুক্তিলাভ করলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বামী জিয়াউর রহমান বীর উত্তম খেতাব লাভ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছিলেন। এর বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়ার দুই শিশুপুত্রসহ ৯ মাসব্যাপী বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামকেও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গেই স্মরণে রাখা উচিত।
হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আবার সংসার সাজালেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বামী জিয়াউর রহমান কুমিল্লার একটি ব্রিগেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। কিছুদিন পর সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে পদোন্নতিও পেলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে কিছু মধ্যমসারির সেনা কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। দেশে সামরিক আইন জারি করে তারা। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বা নির্দেশসূত্র ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু নানামুখী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যে ১৯৭৫ সালেরই ৩ নভেম্বর তারিখে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেন এবং শেখ মুজিব হত্যাকারী সেনাকর্মকর্তাদের নিরাপদে দেশত্যাগের ব্যবস্থা করে দেন। চেইন অব কমান্ড ভেঙে এ সময় খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সপরিবারে গৃহবন্দী করেন এবং নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এটি ছিল দ্বিতীয় বন্দীজীবনের অভিজ্ঞতা এবং এবার স্বামীসহ। পুনরায় স্বামী-সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়লেন তিনি। কিন্তু নানা কারণে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান সৈনিকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি এবং জনসাধারণও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ঘটনাপরম্পরায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে অভূতপূর্ব এক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে সিপাহী-জনতার বিপ্লব নামে অভিহিত হয়ে থাকে। সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদিন রাজপথে নেমে আসে এবং তাদের আস্থাভাজন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত করে তার হাতেই দেশে বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিরসনের দায়িত্ব অর্পণ করে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান এবং নিজের ও স্বামী-সন্তানের জীবন-মৃত্যু নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার দোলাচলে এই কয়েকদিনে নতুন ধরনের এক প্রতিকূল পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেন বেগম খালেদা জিয়া।
৭ নভেম্বরের পর আবার সংসার গোছানোয় মন দিলেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বামী জেনারেল জিয়া এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশের দুর্দশা দূর করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়তে কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলেন। ১৯৭৮ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন জিয়াউর রহমান। বাকশালের জঞ্জাল সরিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করলেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেন। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই অতিপ্রয়োজনীয় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। গণশিক্ষা কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, খালখনন কর্মসূচি, গভীর সমুদ্রে মত্স্য আহরণ, বিদেশে জনশক্তি রফতানি, গার্মেন্ট শিল্প পরীক্ষামূলকভাবে চালু, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসূচির পাইলট কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যুগান্তকারী কিছু উদ্ভাবনী পদক্ষেপ হিসেবে আজো সর্বমহলে প্রশংসিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং তলাবিহীন ঝুড়ির হাস্যস্পদ অপবাদ ঘুচিয়ে সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি সূচিত হতে থাকে। তখনই শুরু হয় আবার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনাকর্মকর্তার গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। দীর্ঘ একুশ বছরের বর্ণিল দাম্পত্য জীবন হুট করে বিবর্ণ বৈধব্যে পরিণত হয়। সারা জীবনের সব প্রতিকূল অভিজ্ঞতা সইলেও এমনতর নিষ্ঠুরতম অভিজ্ঞতার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। স্বামীর জানাজায় শোকাতুর মানুষের ঢল নামল। লাশের ওপর তিনি আছড়ে পড়ে কাঁদলেন। শিশুপুত্ররাও অঝোর ধারায় কাঁদল পিতার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে। এই নিষ্ঠুরতম ও করুণ অভিজ্ঞতা বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে বিরাট এক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, যা পরবর্তী জীবনে তাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে এনেছিল।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তারিখে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং বিচারপতি সাত্তারকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করেন ক্ষমতাসীন সেনাপ্রধান এরশাদ। সদ্য স্বামী হারানোর শোকে বিহ্বল বেগম খালেদা জিয়া তখন দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রকে আগলে ধরে নিভৃতে দিনযাপন করছিলেন। আর বিএনপি নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত এবং ধ্বংসপ্রায়। এমতাবস্থায় দলপ্রেমী কিছু কনিষ্ঠ নেতার উপর্যুুপরি আহ্বানে বিএনপিকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে এমনকি নিজের জীবন দিয়ে হলেও প্রিয়তম স্বামীর গড়া দল বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার সংকল্প গ্রহণ করেন। তার এই অটুট মনোবল এবং কঠোর পরিশ্রমে বিএনপি যেন নতুন জীবন পায়। মূলত বেগম খালেদা জিয়ার মোহময়ী ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণে সেই সময়ের অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সীরা দলে দলে বিএনপির পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। ফলে ছাত্রদল এবং যুবদলের ব্যাপক প্রসার ঘটে দেশব্যাপী। অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হতে থাকে। যুবদল ছড়িয়ে পড়ে পাড়ায়-মহল্লায় সর্বত্র। এ সময় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বিএনপি কিছুটা শক্তি হারালেও বিপুল সংখ্যায় তরুণ প্রজন্মের যোগদানের মাধ্যমে প্রকারান্তরে দল আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নতুন অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে দলের ভেতরে, নানা স্তরে। অকাল শাহাদাত বরণের কারণে দল বিকাশে যে কাজগুলো স্বামী করে যাওয়ার সময় পাননি, সেই কাজগুলো পরম যত্নে সুসম্পন্ন করেন বেগম খালেদা জিয়া। পাশাপাশি রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের দুঃশাসন অবসান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে। কূটচালে সিদ্ধহস্ত এরশাদ ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা যৌথভাবে নানা ধরনের বাঁকা পথ ও কৌশল অবলম্বন করলেও বেগম খালেদা জিয়া সোজাপথে জনগণের ওপর আস্থা রাখার নীতি গ্রহণ করেন। স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে কোন ধরনের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অঙ্গীকারে তিনি অটল থাকেন। এ সময়ে রাজপথে তার সংগ্রামী ভূমিকা ছিল উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী এবং সারাদেশে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয় মূলত তার বিচক্ষণ ও আপসহীন নেতৃত্বে। পুরস্কার হিসেবে স্বৈরাচার-পরবর্তী ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নীরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ তাকে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দলকে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসীন করে শহীদ স্বামীর আদর্শ ও কর্মের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেন তিনি।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে যখন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেপে বসেছিল দেশি-বিদেশি অপশক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, সেই সময়েও বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। গৃহবন্দী অবস্থায় থেকেও বিধিনিষেধের বেড়াজাল সুকৌশলে ডিঙিয়ে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে কথা বলে ও বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীদের এদেশীয় ক্রীড়নকদের দ্বারা প্রণীত ‘মাইনাস টু’ তত্ত্বকে তিনি নস্যাত্ করে দিয়েছিলেন বিশেষ রাজনৈতিক মুন্সীয়ানায়। তিনি সহ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন কোন অবস্থাতেই দেশত্যাগ না করার ব্যাপারে তার দৃঢ়চেতা অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা ১১ জানুয়ারির অবৈধ সরকারের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও বেগম খালেদা জিয়া শত চাপের মুখেও দেশ ছাড়েননি। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, ‘এদেশ ছাড়া আমার কোন ঠিকানা নেই। বাঁচতে হলে এদেশেই বাঁচব এবং মরতে হলেও এদেশেই মরব। দেশের জনগণকে ফেলে আমি অন্য কোথাও যাব না।’ তার এই ঘোষণায় পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল এবং শুধু নিজের ব্যাপারেই নয়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ারও তিনি নিন্দা জানিয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সেই কঠিন অবস্থার মধ্যে স্বার্থপরের মত দেশত্যাগ করলে তিনি ও তার পরিবার হয়ত নিরাপদ জীবনযাপন করবেন কোন এক বিদেশভূমিতে; কিন্তু পরিণামে দেশ ও জনগণ অরক্ষিত হয়ে যাবে। নিজের ও পরিবারের ওপর চেপে বসা সমূহ বিপদকে তুচ্ছ করে দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের সুরক্ষাকে এমনভাবে প্রাধান্য দিতে পারা খুব সহজসাধ্য নয়। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও পরিণত কোন রাজনীতিবিদের কাছ থেকেই কেবল ঘোরতর সঙ্কটকালে এমনতর ভূমিকা আশা করা যায়।
আজ বেগম খালেদা জিয়ার চতুর্থ কারামুক্তি দিবস পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। ২০০৮ সালের এই দিনে তিনি জাতীয় সংসদ ভবনে স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে বছরাধিককাল কারাভোগ শেষে মুক্তিলাভ করেছিলেন। প্রাণপ্রিয় পুত্রদ্বয়, পুত্রবধূগণ এবং নাতনীরা আজ তার পাশে নেই। চিকিত্সার প্রয়োজনে তারা দীর্ঘকাল যাবত্ বিদেশভূমিতে বসবাস করছেন। প্রিয়তম স্বামীর চল্লিশ বছরের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ীটিও অতিসম্প্রতি জোরপূর্বক তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন একটি ভাড়া বাড়িতে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। দেশ ও জনগণের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা ও অঙ্গীকারের কারণে আজো দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এবং সতত লড়ছেন হাল-না-ছাড়া নাবিকের মত। সবকিছু দেখে-শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, আর কত ত্যাগ স্বীকার করবেন এই মহীয়সী নেত্রী তার প্রিয় দেশ ও দেশের জনগণের জন্য? স্বামীর মত তার সংগ্রামও কি চলতেই থাকবে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত?
লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি; সহ-সভাপতি, জাতীয়তাবাদী তাঁতী দল এবং মহাসচিব, এমবিএ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads