মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু নয় - অর্থমন্ত্রী


সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনাকে খুব বড় দুর্নীতি বলতে নারাজ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, সরকার প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। এটা বড় ধরনের কোনো সঙ্কট নয়। সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে বেশি প্রচারণা চালিয়ে দেশের ক্ষতি করছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ভূমিকা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ইউনিটের পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ইন্টিগ্রিটি ইউনিট জেহাদী মনোভাব নিয়ে কাজ করছে বলেও দাবি করেন তিনি। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অর্থমন্ত্রী হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়ে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, হলমার্ক নিয়ে কথা বলা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। এ বিষয়ে কথা যত কম হবে ততই মঙ্গল। এদিকে সোনালী ব্যাংকের দুই উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) ওএসডি করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। গতকাল সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী এ তথ্য জানিয়েছেন। এর আগে ব্যাংকের দুই মহা-ব্যবস্থাপককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
গতকাল হোটেল রূপসী বাংলায় দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে দুর্নীতি দমন কমিশন, ইউএসএআইডি, এমআরডিআই ও প্রগতি। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি দমন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ইউনিট জেহাদী মনোভাব নিয়ে কাজ করছে। তিনি বিশ্বব্যাংকের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এরকম জেহাদী মনোভাব নিয়ে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ইউনিটের পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন অর্থমন্ত্রী।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকে যে সঙ্কটের কথা বলা হচ্ছে এটা আসলে বড় ধরনের সমস্যা না। এখানে সমস্যা হয়েছে মাত্র তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে। অথচ এ বছর মোট ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ বিতরণ করা হবে। এটা নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে গণমাধ্যম দেশের বড় ধরনের ক্ষতি করছে। দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠছে—সবকিছুই কি ধসে গেছে?’ এ বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতি হোক আর যাই হোক, গণমাধ্যমের সংস্কার প্রয়োজন। সংবাদ প্রকাশে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ ঋণের প্রতিটি পর্যায়ে গাফিলতি রয়েছে। অর্থ ছাড়ের কোনো পর্যায়েই যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। কালোটাকা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি অর্থনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এ ধরনের সমস্যা রয়েছে। বাস্তবতা হলো কালো টাকা থাকবেই।
দুর্নীতি দমন কমিশন বড় ধরনের কোনো মামলা পরিচালনা করতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি এজন্য সাক্ষীর অভাবকেই দায়ী করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, সাক্ষী না থাকায় ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঝুলে আছে। এত বছর পরও সাক্ষী না থাকায় এর বিচার করা যাচ্ছে না। ’৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির বিচার কবে নাগাদ হবে বা আদৌ হবে কিনা—তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মুহিত।
তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বক্তারা। সংসদ সদস্য কেএম খালিদ বলেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে হলমার্কের পক্ষ নেয়া অর্থমন্ত্রীর উচিত হয়নি। চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু না বলে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সংস্থা ইউএস এইডের মিশন পরিচালক রিচার্ড গ্রিন ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সাবেক মন্ত্রী ওসমান ফারুক, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, কেএম খালিদ, তথ্য কমিশনার সাদিকা হালিম প্রমুখ।
ওসমান ফারুক পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হয়তো ছোটখাট দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাবে। তবে বড় ধরনের দুর্নীতি দূর করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে। সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও বিচার বিভাগের প্রতিটি পর্যায়ে স্ব্বচ্ছতা প্রয়োজন। বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলেই তাদের পদত্যাগের মানসিকতা থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্নীতি অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। তাই প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নিয়োগ, পদোন্নতির মতো বিষয়ে অনিয়ম হলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়।
আরও দুই মহাব্যবস্থাপককে অব্যাহতি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক : অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিয়েছে—এমন দুজন মহাব্যবস্থাপককে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সাময়িক বরখাস্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদনের আগে এ অব্যাহতি দেয়া হলো। এর আগে সোনালী ব্যাংকের আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় দুই উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ওএসডি করেছে। গতকাল সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত পরিষদের পর্যালোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে আত্মসাতের অর্ধেক সম্পদ হলমার্ক গ্রুপকে ফেরত দিতে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তা তারা গ্রহণ করেছে। চিঠিতে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার অর্ধেক ১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আত্মসাতের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও শুভকর নয়। এজন্য আমরা লজ্জিত। তবে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ হলেও গ্রাহকদের দুশ্চিন্তা বা আস্থাহীনতার কোনো কারণ নেই। কেননা, সোনালী ব্যাংক অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান গত বছর ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আর আদায় করেছে ২ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২ সেপ্টেম্বর পরিষদের জরুরি বৈঠকে ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুর রহমান ও মো. মইনুল ইসলামের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় তাদের গতকাল ওএসডির (বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) নির্দেশ জারি করে সোনালী ব্যাংককে অবহিত করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দেয়া অপর দুই মহাব্যবস্থাপক মীর মহিদুর রহমান ও ননী গোপাল নাথের বিষয়ে ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে সে সময় পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads