সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা : জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে



তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের সংক্ষিপ্তসার অনেকভাবেই পাল্টে গেছে রোববার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে। গত ১৬ মাসে এই রায়কে ঘিরে ঘটে যাওয়া অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা থেকেও জনমনে নানান প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যেই সংক্ষিপ্ত রায়ের অভিমত অগ্রাহ্য করে জাতীয় সংসদে নেয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই বাতিল হয়ে গেছে। এখন প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সরকারি পদক্ষেপের সমর্থন থেকে যে কারও মনে প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষরদানকারী দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের সাত বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলে একমত হতে পারেননি। এদের মধ্যে তত্কালীন প্রধান বিচারপতিসহ চারজন বাতিলের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। ভিন্নমত প্রকাশকারী তিনজনের মধ্যে দু’জন বিচারপতি দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন। অপর বিচারপতি বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। ভিন্নতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই রায় নৈতিকভাবে কতখানি জোরালো, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সাবেক প্রধান বিচারপতি ইচ্ছা করলেই এ পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন। কারণ এর মধ্যেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের ফলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংঘর্ষিক অবস্থা গভীর হয়েছে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা জোরালো করে তুলেছে। পক্ষে রায় প্রকাশের চেয়ে এর কার্যকারিতা নিয়েই মানুষের আগ্রহ বেশি। কারণ আদালতের রায়ের কার্যকারিতা নির্ভর করে নির্বাহী বিভাগ সেটা কতখানি প্রয়োগ করতে পারে, তার ওপর। যদি রায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা নীতিগত প্রশ্ন থাকে, তবে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে জনগণ মেনে নিল কি-না তার ওপর। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকাশিত রায় চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে গভীর থেকে গভীরতার দিকে ঠেলে দিল—এটা না বলে পারা যায় না।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্যের সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে বৈধ ও সংবিধানসম্মত বলে রায় দেয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলেও সেটি ধামাচাপা পড়েই ছিল। হঠাত্ করে ২০১১ সালে বিষয়টি সামনে আনা হয় এবং আপিল বিভাগে এর শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার মাত্র ক’দিন আগে দেয়া রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। তবে সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের না জড়িয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ওই সংশোধনীর অধীনে হতে পারে বলা হয়। এই সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর রায়টি পূর্ণাঙ্গভাবে লিখে সুপ্রিমকোর্টে জমা দেয়ার কথা জানান সাবেক প্রধান বিচারপতি। তারপর আবার সেটি ফিরিয়ে নেয়ার কথাও জানা যায়। এভাবে দীর্ঘ ১৬ মাসে রায়টি নিয়ে অনেকভাবেই পানি ঘোলা করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত রায়ে এখন দেখা যাচ্ছে, আগের অনেক কিছুই বদলে গেছে। জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের মতোই রায় থেকেও বিষয়টি আড়াল করা হয়েছে। যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল এই রায়ের সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। এটি তার দাবি হলেও পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ দাবির সমর্থন মেলে না। উচ্চ আদালতের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করাই ভালো।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে যেসব যুক্তি তোলা হয়েছে, বাস্তবে তেমন ঘটনার দেখা মেলেনি। গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো কিছুই ধ্বংস হয়নি। বরং এটি বাতিলের ফলে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে তা দেশের অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা গভীর করে তুলেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত জনগণ মেনে নেয়ার ফলে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার গঠনের যে গণতান্ত্রিক ধারা সৃষ্টি হয়েছে, আলোচ্য রায়ে তার ধারাবাহিকতাই ক্ষুণ্ন হওয়ার হুমকি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল যদি বলে বসে রাজনৈতিক বিষয় রাজনৈতিকভাবেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, তবে সেটা বলার ক্ষেত্রেও যুক্তি অস্বীকার করা কঠিন। বিবেকের সামনে অন্য কিছু বড় হতে পারে না। এই রায়ের ফলে জনগণের দৃষ্টিতে দেশের ক্ষতির পাশাপাশি কার্যত উচ্চ আদালতের অবস্থান দুর্বল হলো। দেশের চেয়ে বড় কিছু কি আছে? এখন অস্বাভাবিকভাবে দেয়া এই রায় মানা না মানার সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। জনগণ না মানলে সেটা কার্যকর হবে না। জনগণের এই ক্ষমতা কে অস্বীকার করবে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads