রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গুমাতঙ্ক : ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই



বিরোধী রাজনীতিকসহ মানুষ গুম হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই অভিযোগ যে কতটা নৈরাজ্যের পরিচায়ক তা বিশ্লেষণ করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সরকারের চার বছরের শাসনামলে গুম-খুনের পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে, দেশ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। আইনের শাসন চলে গেছে নির্বাসনে। খুন-খারাবির বিচার দীর্ঘায়িত হচ্ছে, আসামি খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। এমনকি প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও। মাসের পর মাস গুম হয়ে আছেন একাধিক রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশার মানুষ, সরকার হদিস করতে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এই অক্ষমতা-অপারগতার দুর্নাম এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে বিদেশে। ফলে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে, গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ছে। অথচ সরকারের মধ্যে কোনো বিচলন দেখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে কেউ গুম-খুনের শিকার হতে পারেন যে কোনো সময়। গভীর শঙ্কায় দেশের মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্র দায় স্বীকার করছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ‘গুম থেকে সবার সুরক্ষা’ নিয়ে এক প্রচারাভিযান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকায়। দুই দিনব্যাপী প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শ্রমবিষয়ক জাতিসংঘ কমিটির ড. রেইনার হুলেসহ দেশি-বিদেশি বরেণ্য ব্যক্তিত্ব গুম এবং রাষ্ট্রের হয়রানি থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। মূল প্রবন্ধে ‘অধিকার’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাম্প্রতিক সময়ে দেশে গুমের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানান, র্যাব, পুলিশ ও ডিবির দ্বারা ২০১২ সালের প্রথম আট মাসে ২১ জন, ২০১১ সালে ৩০ জন, ২০১০ সালে ১৮ জনকে গুম করা হয়। এ সংখ্যা আরও বেশি বলে সেমিনারে উল্লেখ করেছেন একাধিক বক্তা। বস্তুত. গুমের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে বর্তমান সরকারের আমলে তার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি গুম করার কৌশলেও যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। এর মধ্যে বিরোধীদলীয় যে ক’জন নেতা গুম হয়েছেন তাদের বাড়ি বা রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছে র্যাব পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকধারী লোকজন। ক্ষেত্রবিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু পরে তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাসা বা কর্মস্থল থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা কাউকে ধরে নিয়ে গায়েব করে দিচ্ছে। কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কেউ নিখোঁজ।
এভাবে মানুষ অপহৃত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। জনগণ এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করলেও তারা কোনো দায় স্বীকার করছেন না। ঘুম হওয়া লোকদের খুঁজে বের করার জন্য পুলিশের ওপর যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে অবলীলায়। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমানে ডাক ও তারমন্ত্রী) প্রতিটি ঘটনার পর তার প্রতিক্রিয়ায় গুম হওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার আশ্বাস দিয়েছেন এবং শেষাবধি তা পরিণত হয়েছে মিথ্যা কুহকে। পুলিশ বা র্যাব কাউকে খুঁজে পায়নি। তারপরও তিনি দাবি করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে। প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্য শুনেও মনে হয়েছে, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। দেশ-বিদেশের একাধিক মানবাধিকার সংস্থা প্রামাণ্য পরিসংখ্যান দিয়ে গুম-খুন প্রতিরোধের সুপারিশ করা সত্ত্বেও সরকার পক্ষ তাদের নিজস্ব মতামতকেই বলবত্ রেখেছেন। এর ফাঁকে গুমাতঙ্ক আরও ভয়াল আশঙ্কার সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও জনস্বার্থ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় গণফোরাম সভাপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তিনি গুম হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন। দেশে যারা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে, তারা যা খুশি করতে পারেন। কারণ পচন ধরেছে মাথা থেকে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই তিনি এ ধরনের সংশয় প্রকাশ করেছেন। এই একই কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও অন্যরাও গুমাতঙ্কে রয়েছেন একথা বলা যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন, দলীয়করণ, রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক লুটপাট এবং বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি অভিযোগ একযোগে আইনের শাসনকে ক্রমে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। যেন ক্ষমতার জোর এবং ষড়যন্ত্রের কালোহাত একযোগে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের গলা চেপে ধরেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাষ্ট্রযন্ত্র বা যে কারও হয়রানি থেকে জনগণকে রক্ষা করার অনিবার্য দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রযন্ত্র বিশেষত আদালতের ওপর। আদালত কোনো মানুষ গুম হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে। আর সরকার যদি আদালতের এই হুকুম তামিল করে তাহলে গুম তো বটেই, যে কোনো অপরাধ কমে আসতে বাধ্য। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের কোনো আশাব্যঞ্জক অবস্থার নজির দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। মানবাধিকার রক্ষার বেলায় বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে স্ব স্ব ভূমিকায় স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে শূন্যের কোঠায় আনতে প্রথমে আন্তরিক হতে হবে সরকারকে। সেক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিলে গুমাতঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। হোঁচট খাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এজন্য যা কিছু অগণতান্ত্রিক তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে দেশবাসীকে। বজ্রকঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে খুন হওয়া লাশের সংখ্যা বাড়বে, বেড়ে যাবে আরও মানুষ হারিয়ে যাওয়া। ভয়—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads