রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার এখন গণদাবি : অন্যথা করলে মাশুল দিতে হবে



আওয়ামী লীগ পরিচালিত মহাজোট সরকার যেদিন তাদের নিষ্ঠুর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে জাতীয় সংসদে লোক-দেখানো একটি বিল তুলে বাতিল করে দিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, বর্তমান সঙ্কটের শুরু সেখান থেকেই। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের গৃহপালিত রাজনৈতিক দল ও কিছু ‘সুশীল’ চিত্কার-চেঁচামেচিতে পাড়া মাথায় তুলে, শ্রাবণের ধারার মতো অবিরলভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নিকুচি করে বক্তৃতা-বিবৃতির বন্যা বইয়ে দিয়ে লাভ করছেন প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি এবং আত্মপ্রসাদ। তাদের বর্শাফলকের মতো ভাষণের বহর দেখে দেশবাসী চোখ কপালে তুলে বাক্যহারা হয়েছে—তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এনেছিল কারা? আর এখনকার ভাষণের দুর্মুজইবা বর্ষিত হচ্ছে কাদের ওপর? যদিও একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সর্বস্তরের মানুষ মহাজোট সরকারের এই মহাজট বাঁধানো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখছেন ক্ষমতার মঞ্চে চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য তাদের মরণপণ কোশেশ। সেজন্যই প্রধান বিরোধী দলের ‘নিরামিষভোজী’ আন্দোলন দেখে বিরক্ত হলেও, জনগণ কিছুতেই মেনে নিচ্ছেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত। তারা এর মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গলাটিপে মেরে একটি বিশেষ দলের মনের মাধুরী মেশানো একদলীয় ‘বাকশাল’-এর প্রেতাত্মাকে কবর থেকে তুলে আবার তাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। জনমনের এই ভাবনারই প্রতিধ্বনি করেছেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। তারা গত পরশু একটি গোলটেবিল বৈঠকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে কিংবা সংসদকে জীবিত রেখে এদেশে আর যাই হোক নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং এক্ষেত্রে যদি নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীনতা দেয়া হয়, তবুও নয়।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা এখন দেশের প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীনদের ভূমিকাই সর্বোচ্চ। যখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়, যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে জাতি তাকিয়ে ছিল, সেই সময় বর্তমান সরকার দিনবদলের রাজনীতি করতে গিয়ে জাতির জন্য উপহার এনেছে সন্ত্রাস, নির্যাতন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের ভয়াবহ অন্ধকার রাত। এই রাত যাতে প্রভাতের মুখ দেখতে না পায়, সে জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা এখন পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, তিনি অন্য ১০ জন মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিতে পারেন। নির্বাচন কমিশনকে যতই শক্তিশালী করা হোক, বর্তমান সংসদ বহাল থাকলে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আবার বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে সরকারি দল ইচ্ছে করলে ফলাফল বাতিল করতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ৫টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেয়া হলেও ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অন্য মন্ত্রণালয় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারও ক’দিন আগে বিস্তৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। তার হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এখন বর্তমান সরকার, সংসদ সব বহাল রেখে কারও পক্ষে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হবে যেচে গিয়ে গিলোটিনের নিচে মাথা পেতে দেয়া। সঙ্গত কারণেই দেশজুড়ে জনমত গড়ে উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য। এক্ষেত্রে কেউ যদি মনে করে এই বিষয়টি বিএনপির দলীয় একটি দাবি, তাহলে ভুল হবে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন আর কোনো বিশেষ দলের একক দাবি নয়। সে জন্যই তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে বিএনপির বিবৃতি ও নেতাদের বক্তৃতার চেয়ে আরও অনেক বেশি শক্তভাবে কথা বলছেন অন্যান্য দল ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। এ মিছিলে দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকাকেও অবহেলা করা যায় না।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা কী প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হতে পারে, কাদের নিয়ে হতে পারে, সে ব্যাপারে কিছু প্রস্তাবনা এবং পরামর্শও তুলে ধরেছেন। সেগুলোর গুরুত্ব এবং তাত্পর্যও কম নয়। তবে আমরা মনে করি, একবার দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে বাকি বিষয়গুলো হয়তো বড় কোনো সমস্যা হবে না। তবে সবকিছুই সম্ভব হতে পারে, রাজনৈতিক সঙ্কটও দূর হতে পারে—যদি সরকার সত্যিকারের সদিচ্ছা দেখায়। আর যদি অন্ধের মতো গোঁয়ারের মতো নিজেদের ছককাটা পথেই হাঁটতে চায়, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। অবশ্য সে সংঘাতে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিতে হবে বর্তমান সরকারকেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads