বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেবাদাসসুলভ বাহাদুরি



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
বাংলাদেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি বন্ধের কোনো সম্ভাবনা না থাকার মূল কারণ সরকার কর্তৃক এ দুই কাজ নিজেরাই করা এবং অন্যদের এই কাজে উত্সাহিত করা। এর ফলে দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ কোনো ধরনের অপরাধেরই কোনো শাস্তির ব্যবস্থা এ দেশে নেই। যে দেশে অপরাধের শাস্তি নেই সে দেশ হলো অপরাধীদের অভয়ারণ্য। স্বাধীন বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পর আজ প্রকৃতপক্ষে ও সর্বতোভাবে পরিণত হয়েছে অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে।
পুরনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন অদক্ষ ও অযোগ্য প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে শুধু অক্ষম নন, প্রচণ্ড জনবিরোধী হিসেবে স্বাক্ষর রাখলেও দুর্নীতির ক্ষেত্রে যে পিছিয়ে ছিলেন না এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার অপসারণের পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত নানা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে তার পেয়ারের লোকেরা এবং তার ভাইসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনরা প্রশাসনে হস্তক্ষেপ থেকে নিয়ে আর্থিক দুর্নীতি কী পরিমাণে করেছেন তার বিবরণ এখন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। এরই মধ্যে যা প্রকাশিত হয়েছে তার থেকেই এটা স্পষ্ট যে, তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনে যতই অক্ষম এবং অপারদর্শী হোন, চুরি-দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার স্থান বেশ উঁচুতে। ‘দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন’-এর সরকারি নীতি বেশ ভালোভাবেই তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কার্যকর করেছিলেন।
এহেন এক মন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে এখন অন্য একজনকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। ইনি ইতিপূর্বেই একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে দেশের জনগণ ও সংবাদমাধ্যমে চিহ্নিত। দুর্নীতির কারণে তার শাস্তিও হয়েছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে উচ্চ আদালত তাকে সংসদ সদস্য পদের অযোগ্য ঘোষণার পরও সরকার ফন্দিফিকির করে মামলা দায়ের করে এই শাস্তি স্থগিত রাখায় তিনি এখনও সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন! বোঝার অসুবিধা নেই যে, এই অপকীর্তি করতে গিয়ে সরকার প্রকারান্তরে নিজেদের সংবিধানই পদদলিত করছে। অবশ্য সংবিধান পদদলিত করার এটাই প্রথম ও একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। এ ধরনের কাজ সরকারের পক্ষ থেকে ভূরি ভূরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সব থেকে আতঙ্কজনক ব্যাপার হচ্ছে, নিজেদের চুরি-দুর্নীতি-সন্ত্রাসের প্রয়োজনেই সরকারি লোকজন এ কাজ নিয়মিতভাবে করছে। এর দ্বারা তারা এরই মধ্যে ভালোভাবে প্রমাণ করেছে যে, সংবিধান নয়, চুরি-দুর্নীতিই বাংলাদেশে সার্বভৌম! বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক ও দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়স্থল হিসেবে এখন এমন একজনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন যাঁকে তিনি নিজের মন্ত্রিসভাতেও আগে ঠাঁই দিতে পারেননি। তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক পরিবর্তনের পর সুযোগ বুঝে এখন তিনি তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত করেছেন!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েই এই নতুন মন্ত্রী তাদের নেত্রীর পথ অনুসরণ করে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের পতাকা তার মন্ত্রণালয়ে উত্তোলন করে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিগত ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি র্যাব সদর দফতর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী নিজেই গুম, নাকি কেউ তাকে গুম করেছে তা আমার জানা নেই।’ (আমার দেশ ২৫.৯.২০১২) একথা যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেদের একটি বাহিনীর সদর দফতরে বসে সাংবাদিকদের সামনে বলতে পারেন সে দেশে কোনো গুমের তদন্ত করার বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকতে পারে এটা ভাবার কারণ নেই। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তার নিজস্ব নয়। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঠিক পরই তাদের প্রধানমন্ত্রী এক প্রকাশ্য সভায় একথাই বলেছিলেন। একথা বলার জন্য তিনি সারাদেশে, সর্বত্র, ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। এখন তার দ্বারা নিযুক্ত নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার সেই ধিকৃত পূর্বকথার পুনরাবৃত্তি করে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিষয়ে তাদের সরকারি নীতির ঘোষণা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন করে দিলেন। এছাড়া তিনি এ প্রসঙ্গে আর এক মিথ্যার অবতারণা করেন। তিনি বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ ধরনের হত্যা অনেক ঘটেছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর তা অনেকটা কমে এসেছে।’ (ঐ) বাস্তব ব্যাপার একেবারে অন্য রকম। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের ক্রসফায়ার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, গুম খুন ইত্যাদি হত্যাকাণ্ড যে আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে এটা এদেশে বসবাসকারী আমরা ভালোভাবেই জানি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা বৃদ্ধির কথা বলেছে।
আসলে বাংলাদেশে এখন এক পুরোদস্তুর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। এদের ফ্যাসিবাদের প্রতিফলন প্রতিটি ক্ষেত্রে হচ্ছে। সভা-সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদির ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, জনগণের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, ক্রসফায়ার, গুম-খুনই নয়—বেডরুম মার্ডারও এখন আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেছে। লক্ষ করার বিষয় যে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বেডরুম হত্যা হঠাত্ করেই বেড়ে গেছে। এই সাংবাদিক হত্যার পর তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাফ দিয়ে ঘোষণা করেন যে তিন দিনের মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু এই ঘোষণার পর রহস্যজনকভাবে তার বুলি পরিবর্তিত হয়। মনে হয় এই ঘোষণা দেয়ার সময় তিনি হত্যাকাণ্ডের ‘রহস্যের’ সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। পরে এ পরিচয়ের কারণেই তিনি তার ঘোষণা প্রত্যাহার করে বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড জটিল ব্যাপার এবং এর তদন্ত কাজ অনেক সময়সাপেক্ষ। আজ পর্যন্ত এ তদন্ত শেষ হয়নি। তবে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, সাগর-রুনি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে এবং আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যেই প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করা হবে! (আমার দেশ ২৬.৯.২০১২) তদন্তের কী ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে তিনি একথা বলেছেন জানা নেই। তবে ভুয়া ও মিথ্যা কথা ও মিথ্যা ঘোষণা এ সরকারের লোকজনের পক্ষে এতই স্বাভাবিক যে এসব কথাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। কাজেই ১০ অক্টোবর এলে তখনই এ বিষয়ে মতামত দেয়া যেতে পারবে।
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের কাজ দেখানোর জন্য যথেষ্ট তত্পর মনে হচ্ছে। কিন্তু নিজের গলায় দুর্নীতির মালা ঝুলিয়ে ও ফ্যাসিস্টসুলভ কথাবার্তা বলে তিনি যে পথে হাঁটতে শুরু করেছেন সে পথ খুব পরিচিত। এ পথ তাদের শ্রেণী ও তাদের সরকারের দ্বারাই নির্মিত। প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা-নেত্রী সবাই এই পথের পথিক। এরা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়ার পর থেকে নিজেদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি শিকেয় তুলে যে পথ ধরে এতদিন হেঁটেছেন সে পথ যে তারা তাদের মেয়াদের পরবর্তী সময়ে পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবেন তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়োগও সেটাই প্রমাণ করছে।
২৬.৯.২০১২

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads