প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সম্প্রতি আবারও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা মারাত্মক হতে শুরু করেছে। যথারীতি মুসলিমরাই এ পরিস্থিতির অসহায় শিকার হচ্ছেন। প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছেন তারা। গুজরাটের মতো কোনো কোনো রাজ্যে এরই মধ্যে মুসলিমদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছে। এসব আক্রমণে প্রাণহানিও ঘটেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান যতো উচ্চই হোক না কেন, টার্গেট করা হচ্ছে দেশটির মুসলিমদের। এরকম সর্বশেষ ঘটনায় সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার শিকার হয়েছেন মুম্বাই তথা বলিউডের জনপ্রিয় চিত্রতারকা আমির খান। অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলায় অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তার অমুসলিম স্ত্রী কিরণ পর্যন্ত নিজের এবং সন্তানদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেননি। তিনি এমনকি ভারত ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার জন্যও আমির খানকে অনুরোধ করেছিলেন। আমির খানের ‘অপরাধ’, তিনি তার স্ত্রীর এই উদ্বেগের কথাটা প্রকাশ্য এক অনুষ্ঠানে বলে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এসেছে হিন্দুত্ববাদীরা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি কৌশলে নীরবতা অবলম্বন করলেও তার দল ও জোটের নেতারা মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন। প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও আক্রমণ যথেষ্টই শানিয়েছেন।
ওদিকে মুম্বাইকেন্দ্রিক রাজ্য মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক মিত্র শিবসেনার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, আমিরের গালে কেউ চড় মারতে পারলে তাকে এক লাখ রুপি পুরষ্কার দেয়া হবে। ‘স্ল্যাপ আমির’ বা আমিরের গালে চড় মারো নামে শিবসেনা একটি ওয়েবসাইটও খুলেছিল, যদিও এতে তেমন সাড়া মেলেনি। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আমির খানের সমর্থকদের পক্ষ থেকে ‘কিস আমির’ বা আমির খানকে চুমু দাও ও ভালোবাসো নামে নতুন যে ওয়েবসাইটটি খোলা হয় সেখানে কিন্তু রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত ২৭ লাখের বেশি মানুষ চুমু দেয়ার মাধ্যমে আমির খানের প্রতি সমর্থন ও ভালোবাসা জানিয়েছে। একযোগে গোটা ভারত জুড়ে আমির খানকে নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়েছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী এবং পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আমির খানের পক্ষ নিয়েছেন। মুম্বাইয়ের সিনেমা জগতেও ঘটেছে স্পষ্ট বিভক্তি। উল্লেখ্য, আমির খানের পাশাপাশি সালমান খান ও শাহরুখ খানসহ বেশ কয়েকজন মুসলিম অভিনেতা বহু বছর ধরে নায়ক হিসেবে প্রবল দাপটের সঙ্গে বলিউডে রাজত্ব করছেন। হিন্দু এবং অমুসলিম অন্য নায়করা তাদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। এটাই আমির খানের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ করে আমির খানের নাম এসেছে এজন্য যে, তিনি ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ বা শুদ্ধবাদী অভিনেতা হিসেবে পরিচিত ও জনপ্রিয়। সাধারণত অভিনয়ও তিনি কম সিনেমায় করেন। কিন্তু তার অভিনীত প্রতিটি সিনেমাই বক্স অফিস হিট করে। সারা ভারতে শোরগোল পড়ে যায়। একই কারণে নানাভাবে তাকে হিংসা ও বিড়ম্বনার কবলে পড়তে হয়। পার্থক্য হলো, এতদিন বিষয়টি নিয়ে সিনেমা জগতের বাইরে তেমন আলোচনা হয়নি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে মুখ খোলা মাত্র তাকে সর্বাত্মক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। প্রধান কারণ যে তার ধর্মীয় পরিচিতি সে কথাটাও চেপে রাখা হয়নি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বলেই আমির খানকে শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়তে হয়েছে। গত সপ্তাহে চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। খবরে বলা হয়েছে, তার অমুসলিম স্ত্রী কিরণও সন্তানদের নিয়ে অচিরেই স্বামীকে অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ ভারত ছেড়ে চলে যাবেন।
ওপরে চিত্রনায়ক আমির খান সম্পর্কে বলা হলেও বাস্তবে ভারতীয় মুসলিমদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে, কংগ্রেস দলীয় এমপি এবং কেরলের বিশিষ্ট লেখক শশী থারুর মঙ্গলবার লোকসভায় দেয়া ভাষণে বলেছেন, ভারতে একজন মুসলিমের তুলনায় একটি গরুও বেশি সুরক্ষিত। অর্থাৎ ভারতে মুসলিমদের চাইতে গরুর কদর অনেক বেশি। এমপি শশী থারুর আরো বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচিত হওয়ার এবং সরকার গঠন করার পর একেবারে পাল্টে গেছেন। মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে তার রহস্যময় নীরবতার কারণেই দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ এবং সংঘাত বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে মোদির স্লোগান ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্থলে ‘হেট ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানটিই বেশি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলেও সতর্ক করেছেন মিস্টার শশী থারুর। তিনি বলেছেন, এর ফলে বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠবে ভারতের বিরুদ্ধে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এবং হিংসা-বিদ্বেষ অত্যন্ত বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর মূল কারণ আসলে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হিন্দুত্ববাদী মনোভাব ও কর্মকান্ড। দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ বানানো হলেও ১৯৪৭ সাল থেকেই মুসলিম জনগোষ্ঠী ভয়ংকর দমন-নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছেন। মুসলিম বিরোধিতার এই একটি বিষয়ে ভারতের সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেই অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে- যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে দাঙ্গার নামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সময়। মুসলিমদের বাড়িঘর পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তারা এমনকি দেশ ত্যাগ করতেও বাধ্য হন। বর্তমান পর্যায়েও তেমন পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলা যায়। আমির খানের বিষয়টিকে তাই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। আমরা ভারতীয় মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশটির সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন