ফাজলামিরও বোধকরি একটা সীমা থাকে। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দিনের নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন এখন বাংলাদেশে বহাল আছে, তাদের ফাজলামির কোনো সীমা আছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের প্রায় ৯ কোটি ভোটার ও ১৬ কোটি লোকের সঙ্গে তারা ধারাবাহিকভাবে এক ধরনের ইয়ার্কি করে যাচ্ছে। গত বছর ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে এই কমিশন যতগুলো নির্বচন বা উপনির্বাচন করেছে, তার সবই ছিল ইয়ার্কিতে ভরা। সরকার ও সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো বাদে ভোটার কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের যে তাচ্ছিল্য, তা ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। এরা নির্বাচন কমিশনকে যেমন একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তেমনি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছে।
এই লেখা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছবে, যখন তারা এ লেখা পড়ার সুযোগ পাবেন, ততক্ষণে রকিব কমিশনের নির্বাচনী কৌতুক শুরু হয়ে গেছে। কিংবা সরকারের প্রধান অংশীদার ও তাদের সাবেক প্রভু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নির্বাচনে ভোট দেয়া শেষ হয়ে গেছে। এই কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেভাবেই সকাল ১১টার মধ্যে এর আগের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখনও এই হাস্যকর ব্যক্তিরা জনগণের ভোটাধিকারে সংরক্ষণ করতে কোনো রকম চেষ্টাই করেননি। তাদের তত্ত্বাবধানে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়। অন্যান্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এই কমিশনের পোলিং অফিসাররা দুই হাতে সরকারি প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরেছেন। সেখানে পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিকদের ঢুকতে দেননি নির্বাচনের দায়িত্ব পালনরত সরকার-সমর্থক পুলিশ কর্মকর্তারা। অনেক জায়গায় তাদের নাজেহাল করেছেন। আর এই অথর্ব নির্বাচন কমিশন তাতেই বাহবা বাহবা বেশ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।
তখনও নির্বাচনের আগে এদের প্রভু ছাড়া সব প্রতিদ্বন্দী দল ও প্রার্থী দাবি করছিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হোক। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সে দাবি আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি সাধারণত করা হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, সেনাবাহিনী পাহারায় থাকলে জালিয়াত, কেন্দ্র দখলকারী, হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসীরা দূরে থাকবে এবং জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারুক- এটাই চায় না সরকার। আর সে কারণে চায় না নির্বাচন কমিশন। এদের দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন করা। সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে যদি মানুষ নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, তাতে নির্বাচন কমিশনের অসুবিধা কোথায়, বোঝা মুশকিল। সরকারের অসুবিধা বোঝা যায়। মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে এই জনধিকৃত সরকার যে অনন্তকালের জন্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, সে কথা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার করে না। তাছাড়া গত সাত বছরে এ সরকার জনগণের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে তারা এর দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে দেবেন। তবে একথাও সত্য যে, এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা যেমন জনগণের রুদ্ররোষে পড়বে, তেমনি সে রোষ থেকে বাদ পড়বেন না নির্বাচন কমিশনের এই নিম্ন শ্রেণীর সেবাদাসরাও। পবিত্র দায়িত্ব পালনে চরম পক্ষপাতিত্বের কারণে এদেরও পিঠ বাঁচানো দায় হয়ে পড়বে। তবে সবার ওপরে এই আত্মমর্যাদাহীন কর্মচারীদের চাই তাদের চাকরির নিশ্চয়তা। সে নিশ্চয়তা তো সংবিধানই তাদের দিয়েছে। সরকারের এমন সেবাদাস হওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে সরকারের নির্দেশ মানতে মানতে এদের মধ্যে যে দাস মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে তারা বের হতে পারছেন না।
এই কমিশন গঠনের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে তারা এমন ইয়ার্কি-ফাজলামি শুরু করেছে, মনে হতে শুরু করে এরা নির্দিষ্ট মিশন নিয়ে এই ‘চাকরি’ গ্রহণ করেছে। আর তা হলো নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি করা, যাতে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ না করেন। রকিব কমিশন তার সে মিশন প্রায় সফল করে এনেছে। এদেশে যখনই কোনো নির্বাচন আসে, তখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কৌতূহলের সৃষ্টি হতে থাকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, তা নিয়ে ততই জমজমাট হয়ে ওঠে আলোচনা। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের অধিকাংশেরই শিকড় প্রোথিত আছে গ্রামে-মফস্বলে। ফলে অলিতে-গলিতে, চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনস্টেশনে চলতে থাকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা; চলে নানা বিশ্লেষণ। কিন্তু এবার রাজধানীতে সেই নির্বাচনী উত্তাপ তেমন একটা লক্ষণীয় নয়।
গত সোমবার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা দেদার আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং এসব বিষয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে কমিশনাররা হাসিরপাত্রে পরিণত হয়েছেন। তারা বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দলের ২৩ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠল। নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নানা বক্তব্য দিয়ে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এ সংশয় নিরসনে কমিশন কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনিয়মকারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে জেলে ঢোকান। অভিযোগ উঠেছে এমন দু-একজনের প্রার্থিতা বাতিল করুন। অনিয়ম ও অভিযোগ উঠলে নির্বাচন বন্ধ করুন। সুজনের সভাপতি হাফিজউদ্দিন আহমদ খানও এই ইসির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আগেও ইসির বিতর্কিত ভূমিকা দেখা গেছে।
সুজনের এই বক্তব্য ইতিমধ্যেই অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে ইসি কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। আর একে হাস্যকর করতে তারা যা করেছে, তা ছিল একেবারে অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কমিশন টাঙ্গাইলের সখিপুর পৌরসভা নির্বাচনে ৯টি ভোটকেন্দ্রের পাঁচটিতে একজন করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের চারজন নৈশপ্রহরী ও একজন পিয়ন। উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭০০-এর বেশি ও ৫০টি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০০-এর বেশি শিক্ষক থাকলেও তাদের নিয়োগ না দিয়ে ঐ পিয়ন ও নৈশপ্রহরীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত পোলিং কর্মকর্তা ও শিক্ষক নাম না প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে পিয়নদের সমান গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অপমান করা হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচজন নয়, এর চেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তা করা হয়নি।’ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংসদ নির্বাচনের পরিপত্রে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া যাবে না বলে উল্লেখ থাকলেও পৌর নির্বাচনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে যেহেতু সরকারি শিক্ষকের কোনো অভাব নেই, তাই পিয়নদের নিয়োগ না দেয়াই সমীচীন।
এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। সেদিনও সিইসিকে দেখলাম নানা ধরনের ফটর ফটর করতে। কিন্তু এই অনিয়ম নিয়ে তিনি একটি কথাও বললেন না। ধারণা করা যায়, এভাবে শত শত পিয়ন-দারোয়ান-সুইপারকে নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে এই ইসি নিয়োগ দিয়েছে। শুধু কী তাই? গণধিকৃত রকিব কমিশন সীতাকু- পৌরসভা নির্বাচনে বারবকু-ের এক যুবলীগ সভাপতিকেও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এভাবে সরকারি দলকে জেতাতে কত-শত অনিয়মের আশ্রয় এই কমিশন নিয়েছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। শুধু একটা কথাই নিশ্চিত করে বলা যায়, নির্বাচন নিরপেক্ষ বা সুষ্ঠু হওয়ার কোনো আশা নেই। তাছাড়া প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বাড়িঘরে আগুন, মধ্যরাতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে চড়াও, কাফনের কাপড় পাঠিয়ে ভোট থেকে বিরত থাকার আহ্বান একবারে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সং-এর মতো বসে বসে তামাশা দেখছে কমিশন।
আর মিডিয়া, সাবধান! মিডিয়া কর্মীদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে দূরে রাখার নানা পরিকল্পনা করেছে ইসি। সিইসি রকিব সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তারা যেন ক্যামেরা বুথের দিকে না ধরেন। তাদের কেন্দ্রে ঢুকতে হবে কেন্দ্র কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে। পুলিশ তাতেও নারাজ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয়েছে নানা ধরনের বাধানিষেধ। এর বোধকরি দরকার ছিল না। কারণ এখন যেসব টিভি চালু আছে, তার সবই সরকার ও সরকার দলের নিয়ন্ত্রণে। ফলে শুধু বলে দিলেই যথেষ্ট, তারা কোনো কেন্দ্রের ধারে-কাছেও ভিড়বে না। যেমন গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করেন। সাধারণত টিভি চ্যানেলগুলো তার বক্তব্য সরাসরি প্রচার করে। চ্যানেলগুলো সেভাবে তৈরিও ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য কলকাঠির নির্দেশে তারা বেগম জিয়ার ভাষণ সরাসরি প্রচার করতে পারেনি। ফলে আমরা শুধু এটুকুই বোধকরি, প্রার্থনা করতে পারি, ইসিসহ সব পিয়ন-দারোয়ান দ্বারা পরিচালিত এই নির্বাচন ধারা চিরজীবী হোক।
এই লেখা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছবে, যখন তারা এ লেখা পড়ার সুযোগ পাবেন, ততক্ষণে রকিব কমিশনের নির্বাচনী কৌতুক শুরু হয়ে গেছে। কিংবা সরকারের প্রধান অংশীদার ও তাদের সাবেক প্রভু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নির্বাচনে ভোট দেয়া শেষ হয়ে গেছে। এই কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেভাবেই সকাল ১১টার মধ্যে এর আগের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখনও এই হাস্যকর ব্যক্তিরা জনগণের ভোটাধিকারে সংরক্ষণ করতে কোনো রকম চেষ্টাই করেননি। তাদের তত্ত্বাবধানে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়। অন্যান্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এই কমিশনের পোলিং অফিসাররা দুই হাতে সরকারি প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরেছেন। সেখানে পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিকদের ঢুকতে দেননি নির্বাচনের দায়িত্ব পালনরত সরকার-সমর্থক পুলিশ কর্মকর্তারা। অনেক জায়গায় তাদের নাজেহাল করেছেন। আর এই অথর্ব নির্বাচন কমিশন তাতেই বাহবা বাহবা বেশ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।
তখনও নির্বাচনের আগে এদের প্রভু ছাড়া সব প্রতিদ্বন্দী দল ও প্রার্থী দাবি করছিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হোক। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সে দাবি আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি সাধারণত করা হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, সেনাবাহিনী পাহারায় থাকলে জালিয়াত, কেন্দ্র দখলকারী, হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসীরা দূরে থাকবে এবং জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারুক- এটাই চায় না সরকার। আর সে কারণে চায় না নির্বাচন কমিশন। এদের দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন করা। সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে যদি মানুষ নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, তাতে নির্বাচন কমিশনের অসুবিধা কোথায়, বোঝা মুশকিল। সরকারের অসুবিধা বোঝা যায়। মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে এই জনধিকৃত সরকার যে অনন্তকালের জন্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, সে কথা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার করে না। তাছাড়া গত সাত বছরে এ সরকার জনগণের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে তারা এর দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে দেবেন। তবে একথাও সত্য যে, এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা যেমন জনগণের রুদ্ররোষে পড়বে, তেমনি সে রোষ থেকে বাদ পড়বেন না নির্বাচন কমিশনের এই নিম্ন শ্রেণীর সেবাদাসরাও। পবিত্র দায়িত্ব পালনে চরম পক্ষপাতিত্বের কারণে এদেরও পিঠ বাঁচানো দায় হয়ে পড়বে। তবে সবার ওপরে এই আত্মমর্যাদাহীন কর্মচারীদের চাই তাদের চাকরির নিশ্চয়তা। সে নিশ্চয়তা তো সংবিধানই তাদের দিয়েছে। সরকারের এমন সেবাদাস হওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে সরকারের নির্দেশ মানতে মানতে এদের মধ্যে যে দাস মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে তারা বের হতে পারছেন না।
এই কমিশন গঠনের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে তারা এমন ইয়ার্কি-ফাজলামি শুরু করেছে, মনে হতে শুরু করে এরা নির্দিষ্ট মিশন নিয়ে এই ‘চাকরি’ গ্রহণ করেছে। আর তা হলো নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি করা, যাতে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ না করেন। রকিব কমিশন তার সে মিশন প্রায় সফল করে এনেছে। এদেশে যখনই কোনো নির্বাচন আসে, তখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কৌতূহলের সৃষ্টি হতে থাকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, তা নিয়ে ততই জমজমাট হয়ে ওঠে আলোচনা। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের অধিকাংশেরই শিকড় প্রোথিত আছে গ্রামে-মফস্বলে। ফলে অলিতে-গলিতে, চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনস্টেশনে চলতে থাকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা; চলে নানা বিশ্লেষণ। কিন্তু এবার রাজধানীতে সেই নির্বাচনী উত্তাপ তেমন একটা লক্ষণীয় নয়।
গত সোমবার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা দেদার আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং এসব বিষয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে কমিশনাররা হাসিরপাত্রে পরিণত হয়েছেন। তারা বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দলের ২৩ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠল। নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নানা বক্তব্য দিয়ে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এ সংশয় নিরসনে কমিশন কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনিয়মকারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে জেলে ঢোকান। অভিযোগ উঠেছে এমন দু-একজনের প্রার্থিতা বাতিল করুন। অনিয়ম ও অভিযোগ উঠলে নির্বাচন বন্ধ করুন। সুজনের সভাপতি হাফিজউদ্দিন আহমদ খানও এই ইসির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আগেও ইসির বিতর্কিত ভূমিকা দেখা গেছে।
সুজনের এই বক্তব্য ইতিমধ্যেই অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে ইসি কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। আর একে হাস্যকর করতে তারা যা করেছে, তা ছিল একেবারে অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কমিশন টাঙ্গাইলের সখিপুর পৌরসভা নির্বাচনে ৯টি ভোটকেন্দ্রের পাঁচটিতে একজন করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের চারজন নৈশপ্রহরী ও একজন পিয়ন। উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭০০-এর বেশি ও ৫০টি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০০-এর বেশি শিক্ষক থাকলেও তাদের নিয়োগ না দিয়ে ঐ পিয়ন ও নৈশপ্রহরীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত পোলিং কর্মকর্তা ও শিক্ষক নাম না প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে পিয়নদের সমান গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অপমান করা হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচজন নয়, এর চেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তা করা হয়নি।’ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংসদ নির্বাচনের পরিপত্রে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া যাবে না বলে উল্লেখ থাকলেও পৌর নির্বাচনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে যেহেতু সরকারি শিক্ষকের কোনো অভাব নেই, তাই পিয়নদের নিয়োগ না দেয়াই সমীচীন।
এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। সেদিনও সিইসিকে দেখলাম নানা ধরনের ফটর ফটর করতে। কিন্তু এই অনিয়ম নিয়ে তিনি একটি কথাও বললেন না। ধারণা করা যায়, এভাবে শত শত পিয়ন-দারোয়ান-সুইপারকে নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে এই ইসি নিয়োগ দিয়েছে। শুধু কী তাই? গণধিকৃত রকিব কমিশন সীতাকু- পৌরসভা নির্বাচনে বারবকু-ের এক যুবলীগ সভাপতিকেও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এভাবে সরকারি দলকে জেতাতে কত-শত অনিয়মের আশ্রয় এই কমিশন নিয়েছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। শুধু একটা কথাই নিশ্চিত করে বলা যায়, নির্বাচন নিরপেক্ষ বা সুষ্ঠু হওয়ার কোনো আশা নেই। তাছাড়া প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বাড়িঘরে আগুন, মধ্যরাতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে চড়াও, কাফনের কাপড় পাঠিয়ে ভোট থেকে বিরত থাকার আহ্বান একবারে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সং-এর মতো বসে বসে তামাশা দেখছে কমিশন।
আর মিডিয়া, সাবধান! মিডিয়া কর্মীদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে দূরে রাখার নানা পরিকল্পনা করেছে ইসি। সিইসি রকিব সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তারা যেন ক্যামেরা বুথের দিকে না ধরেন। তাদের কেন্দ্রে ঢুকতে হবে কেন্দ্র কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে। পুলিশ তাতেও নারাজ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয়েছে নানা ধরনের বাধানিষেধ। এর বোধকরি দরকার ছিল না। কারণ এখন যেসব টিভি চালু আছে, তার সবই সরকার ও সরকার দলের নিয়ন্ত্রণে। ফলে শুধু বলে দিলেই যথেষ্ট, তারা কোনো কেন্দ্রের ধারে-কাছেও ভিড়বে না। যেমন গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করেন। সাধারণত টিভি চ্যানেলগুলো তার বক্তব্য সরাসরি প্রচার করে। চ্যানেলগুলো সেভাবে তৈরিও ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য কলকাঠির নির্দেশে তারা বেগম জিয়ার ভাষণ সরাসরি প্রচার করতে পারেনি। ফলে আমরা শুধু এটুকুই বোধকরি, প্রার্থনা করতে পারি, ইসিসহ সব পিয়ন-দারোয়ান দ্বারা পরিচালিত এই নির্বাচন ধারা চিরজীবী হোক।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন