নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি গভীর বেদনার সাথে বলেছেন যে, ভারত তাদের অর্থাৎ নেপালের সমস্ত স্বপ্ন চূরমার করে দিয়েছে। তিনি নেপালের ওপর আরোপিত ভারতের অঘোষিত অবরোধের কথা বলছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রায় ৩ মাসেরও বেশি সময় হলো, নেপালের ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধ চলছে। এতদিন ধরে নেপালে জ্বালানি সরবরাহের একমাত্র উৎস ছিল ভারত। এ ছাড়া বিদেশ থেকে যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নেপালে আসে সেগুলো ভারতের ওপর দিয়েই আসে। এখন ভারত এই জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি নেপালে সরবরাহের প্রবেশ মুখগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নেপালে দেখা দিয়েছে হাহাকার। তারপরেও এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত নেপাল ভারতের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি। বিগত প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের পর নেপাল রাষ্ট্রটি এমনিতেই বিধ্বস্ত। তার ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধ নেপালের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপরেও নেপালের সরকার ও জনগণের স্বাধীন চেতনার প্রতি অভিনন্দন। নতি স্বীকার করার পরিবর্তে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভারতের সব ধরনের সিনেমার প্রদর্শন নেপাল বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমগ্র নেপালে ভারতের সব ভাষার ছবি বিশেষ করে হিন্দি ছবির রয়েছে একচেটিয়া বাজার। নেপাল প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। ভারতও হিন্দু প্রধান দেশ। তৎসত্ত্বেও ভারতের সংবিধানে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। কিন্তু নেপালে বিগত ৬০/৬৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ধর্ম ছিল হিন্দু। পৃথিবীর আর কোন দেশে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্ম চালু নাই। এই তো সেদিন নেপালের নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়েছে। সেই সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদস্থলে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। নেপালে ভারতীয় মুদ্রা শুধু মাত্র সহজেই বিনিময় যোগ্য নয়, বরং সমগ্র নেপালে দ্রব্য সামগ্রী কেনা বেচার জন্য নেপালী মুদ্রার পাশাপাশি ভারতীয় মুদ্রাও চালু রয়েছে। যেখানে দুই দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বন্ধন অবিচ্ছেদ্য, সেখানে নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নেপাল ভারতীয় সিনেমা বন্ধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
ভারতের অবরোধ আরোপের কঠোর সমালোচনা করে প্রতিবেশী দেশ নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি বলেছেন, ‘হিমালয়ের দেশকে উন্নতির ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যে বাসনা ছিল সেই বাসনা (স্বপ্ন) ভেঙে খান খান করে দিয়েছে ভারতের অবরোধ।’ দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা থেকে উত্তরণে নেপালের শিক্ষাবিদদের একটি স্মারকপত্র রোববার হাতে পাওয়ার পর তিনি বলেন, নেপালকে উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার যে পরিকল্পনা ছিল সেটি মেঘে ঢেকে গেছে। সোমবার এ খবর প্রকাশ করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। ২৫ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ওই ভূ-কম্পনে প্রায় ১০ হাজার লোক নিহত হন। নির্বাচনে জয়লাভের পর অলি বলেছিলেন, তিনি বহু জাতির একটি দেশ গড়ে তুলবেন। দৈনন্দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূর, কাঠমান্ডুতে আধুনিক বৈদ্যুতিক যান চালু এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির ওপর দেশকে দাঁড় করাবেন তিনি। রোববার হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘প্রধান মন্ত্রী হওয়ার আগে আমি বেশকিছু স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি কঠিন দুরবস্থার মধ্যে প্রধান মন্ত্রী হলাম। যখন ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ক্ষত দূর করার চেষ্টা করছি, তখন সীমান্তে মারাত্মক একটি ঝড় ফের আমাদের আঘাত হানল। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে সেই ক্ষত ও ভোগান্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’ নেপালের নতুন সংবিধানে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এমন অভিযোগে দেশটির সংখ্যালঘু মধেশী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের কারণে ভারত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। দেশটি থেকে নেপালে আসা তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ট্রাক আটকা পড়ে। এরপর ভারত নেপালে তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়।
ভারত নেপাল সাম্প্রতিক বিরোধের উৎপত্তি কোথায়, সেটি জানা দরকার। নেপালবাসীদের দুর্ভাগ্য যে, দেশটির ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এই দেশটি তিনবার ঝড় ঝাপটার শিকার হয়েছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে দেশটির ওপর দিয়ে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এই ভূমিকম্পে ১০ হাজার লোক নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে শুরু হয় প্রচ- রাজনৈতিক গোলযোগ। এই গোলযোগে ৪০ ব্যক্তি নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগে তার দক্ষিণের বিশাল প্রতিবেশী তার ওপর আরোপ করেছে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবরোধ।
এতসব ঝড় ঝাপটার পরও বিগত ৭ বছর ধরে সারা দেশে তীব্র বাদানুবাদের পর অবশেষে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নেপালে চালু হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান। দেশটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল’ বা ‘ যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক নেপালী প্রজাতন্ত্র’। বলাবাহুল্য, বোধগম্য কারণেই এই সংবিধান চালুর ফলে নেপালের বর্তমান সরকারের ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়েছে তার বিশাল প্রতিবেশী ভারত। আর এই ক্ষিপ্ততার কারণেই সংবিধান চালুর মাত্র ৩ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর চতুর্দিকে স্থল পরিবেষ্টিত দেশটির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করেছে ভারত।
॥দুই॥
কেন ভারত নেপালের ওপর চটে গেছে? কারণটি হলো এই যে, নতুন সংবিধান যেহেতু ফেডারেল চরিত্রের তাই ফেডারেশনের মূলনীতি হিসেবে দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। দেশটির মধেশী, থারু এবং জনজাতি - এই তিনটি নৃতাত্বিক সম্প্রদায় এই শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা মনে করে যে, এই শাসনতন্ত্র তাদের সাম্প্রদায়িক আকৃতিকে আরও খর্ব করবে। এদের মধ্যে মধেশীদের জন্য ভারদের রয়েছে প্রবল টান। কারণ এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হলো ভারতে। ভারতের বিহার রাজ্যের টেরাই অঞ্চলে তাদের বাস। নেপালের অধিকাংশ মানুষ পার্বত্য উপজাতীয় হলেও মধেশীরা সমতল ভূমির। তাদের সংস্কৃতিও আলাদা। নেপালে ২ কোটি ৭০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মধেশীরা ৫০ শতাংশ বলে ভারতীয় পত্র পত্রিকার দাবি। বাইরে থেকে দেখলে বিষয়টিকে মনে হবে, এই বিবাদ সমতল ভূমির মানুষ এবং পাহাড়ীদের মধ্যে বিবাদ। যারা পাহাড়ী তাদের মধ্যে রয়েছে উচ্চবিত্ত হিন্দু, যারা নেপালের সমগ্র জনগোষ্ঠির ১৫ শতাংশ। এরাই রাজধানী কাঠমান্ডুতে বসে সমগ্র নেপালকে এ পর্যন্ত শাসন করে এসেছে।
নেপালের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এই যে, তার প্রায় সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আসে ভারত সংলগ্ন নেপালগঞ্জ, বীরগঞ্জ, জানকপুর এবং বিরাট নগর সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে মধেশীরা সেই রাস্তাটি অবরোধ করে রাখে যে রাস্তা দিয়ে ভারত থেকে দ্রব্যসামগ্রী নেপালে প্রবেশ করে। যদিও ভারত অস্বীকার করেছে তবুও বাস্তব ঘটনা হলো এই যে, ভারত খুব চাতুর্যের সাথে এই অবরোধ চালু রেখেছে। তারা প্রকাশ্যে বলছে না যে, তারা নেপালের ওপর অবরোধ জারি করেছে। কিন্তু তলে তলে তারা সীমান্তে কর্মরত ভারতীয় কর্মকর্তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নেপালে পণ্যসামগ্রী পরিবহনকারী যান বাহনকে ঢুকতে না দেয়।
যখন নেপালে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া চলছিল তখন মধেশীদের দাবি দাওয়া পূরণের জন্য ভারত বারবার নেপাল সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল। সংবিধান জারি করার আগে ভারত নেপাল সরকারকে বার বার বলেছে যে ধীরে চলো। কারণ, সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই শাসনতন্ত্রের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা শাসনতন্ত্রের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপালোচনা শুরু করেন এবং শাসনতন্ত্র চালু করেন। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তারা ভারতীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি এবং ভারত যে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে বলেছিল সেটিও তারা শোনেননি। আর এ কারণেই ভারত ক্ষুব্ধ হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষেকগণ মনে করেন।
॥তিন॥
এখানে কয়েকটি তারিখ লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো, সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব জয় শংকর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে কাঠমান্ডু গমন করেন। তিনি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান প্রশ্নে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য নেপালের সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দকে বলেন। তিনি তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেন যে, নেপালে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে সেটি ভারতেরও কোনো কোনো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ পুলিশী জুলুম থেকে বাঁচার জন্য অনেক মধেশী ভারতের বিহার রাজ্যে স্মরণার্থী হিসাবে আসছে। আর একই সময়ে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর বিহারের বিধানসভা গঠনের জন্য পর্যায়ক্রমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে নেপালের নেতৃবৃন্দ তাদের অবস্থানে অটল থাকেন। এ পর্যায়ে দিল্লী নেপালকে প্রস্তাবিত সংবিধানের ৭টি অনুচ্ছেদ বাতিল করার দাবি জানায়। এসব দাবির মধ্যে একটি হলো, যেসব ভারতীয় নারী নেপালীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তাদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাকে নেপালী নাগরিকত্ব প্রদান করা। দ্বিতীয় দাবি হলো, জনসংখ্যার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি দেয়া হোক। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মধেশীরা নেপালী জন গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী। এই দাবি মানা হলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীরা নেপালের রাজনীতি এবং প্রশাসনে প্রাধান্য পায়। অপর একটি দাবি ছিল, জন সংখ্যার হার মোতাবেক নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হোক। এটি করলে মধেশীরা বেশি সংখ্যক নির্বাচনী এলাকা পাবে। পরবর্তী দাবি ছিল, পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হোক জনসংখ্যার ভিত্তিতে। এই দাবি যদি নেপালীরা মেনে নেয় তাহলে মধেশীরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে। তার পরের দাবিতে বলা হয় যে, জন্মগত ভাবে যারা নেপালী নাগরিক শুধুমাত্র তারাই প্রেসিডেন্ট বা প্রধান মন্ত্রী হতে পারবেন সেই ব্যবস্থা বাতিল করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নেপালে বাস করছে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেপালের নাগরিকত্ব লাভ করেছে তাদেরকেও প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু দাবি দাওয়া ভারত নেপালকে মানতে বলেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের সবগুলো দাবিই নেপালের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের শামিল। এসব দাবি যদি নেপাল মেনে নিত তাহলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীদের মাধ্যমে ভারত নেপাল শাসন করতো। কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সব দাবি মেনে নিতে পারে না। তাই নেপালও মেনে নেয়নি। এজন্যই শুরু হয়েছে ভারতের সাথে নেপালের তীব্র বিরোধ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নেপালের জনসংখ্যার চেয়ে সাড়ে ৫ গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ নেপালের মতো পারেনি। কিন্তু আয়তন এবং জনসংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট এবং দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় অন্যায় আবদার মেনে নেয়নি। এখানেই এই দুটি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে মৌলিক তফাত।
তারপরেও নেপালের সরকার ও জনগণের স্বাধীন চেতনার প্রতি অভিনন্দন। নতি স্বীকার করার পরিবর্তে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভারতের সব ধরনের সিনেমার প্রদর্শন নেপাল বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমগ্র নেপালে ভারতের সব ভাষার ছবি বিশেষ করে হিন্দি ছবির রয়েছে একচেটিয়া বাজার। নেপাল প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। ভারতও হিন্দু প্রধান দেশ। তৎসত্ত্বেও ভারতের সংবিধানে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। কিন্তু নেপালে বিগত ৬০/৬৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ধর্ম ছিল হিন্দু। পৃথিবীর আর কোন দেশে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্ম চালু নাই। এই তো সেদিন নেপালের নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়েছে। সেই সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদস্থলে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। নেপালে ভারতীয় মুদ্রা শুধু মাত্র সহজেই বিনিময় যোগ্য নয়, বরং সমগ্র নেপালে দ্রব্য সামগ্রী কেনা বেচার জন্য নেপালী মুদ্রার পাশাপাশি ভারতীয় মুদ্রাও চালু রয়েছে। যেখানে দুই দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বন্ধন অবিচ্ছেদ্য, সেখানে নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নেপাল ভারতীয় সিনেমা বন্ধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
ভারতের অবরোধ আরোপের কঠোর সমালোচনা করে প্রতিবেশী দেশ নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি বলেছেন, ‘হিমালয়ের দেশকে উন্নতির ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যে বাসনা ছিল সেই বাসনা (স্বপ্ন) ভেঙে খান খান করে দিয়েছে ভারতের অবরোধ।’ দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা থেকে উত্তরণে নেপালের শিক্ষাবিদদের একটি স্মারকপত্র রোববার হাতে পাওয়ার পর তিনি বলেন, নেপালকে উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার যে পরিকল্পনা ছিল সেটি মেঘে ঢেকে গেছে। সোমবার এ খবর প্রকাশ করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। ২৫ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ওই ভূ-কম্পনে প্রায় ১০ হাজার লোক নিহত হন। নির্বাচনে জয়লাভের পর অলি বলেছিলেন, তিনি বহু জাতির একটি দেশ গড়ে তুলবেন। দৈনন্দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূর, কাঠমান্ডুতে আধুনিক বৈদ্যুতিক যান চালু এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির ওপর দেশকে দাঁড় করাবেন তিনি। রোববার হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘প্রধান মন্ত্রী হওয়ার আগে আমি বেশকিছু স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি কঠিন দুরবস্থার মধ্যে প্রধান মন্ত্রী হলাম। যখন ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ক্ষত দূর করার চেষ্টা করছি, তখন সীমান্তে মারাত্মক একটি ঝড় ফের আমাদের আঘাত হানল। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে সেই ক্ষত ও ভোগান্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’ নেপালের নতুন সংবিধানে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এমন অভিযোগে দেশটির সংখ্যালঘু মধেশী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের কারণে ভারত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। দেশটি থেকে নেপালে আসা তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ট্রাক আটকা পড়ে। এরপর ভারত নেপালে তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়।
ভারত নেপাল সাম্প্রতিক বিরোধের উৎপত্তি কোথায়, সেটি জানা দরকার। নেপালবাসীদের দুর্ভাগ্য যে, দেশটির ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এই দেশটি তিনবার ঝড় ঝাপটার শিকার হয়েছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে দেশটির ওপর দিয়ে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এই ভূমিকম্পে ১০ হাজার লোক নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে শুরু হয় প্রচ- রাজনৈতিক গোলযোগ। এই গোলযোগে ৪০ ব্যক্তি নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগে তার দক্ষিণের বিশাল প্রতিবেশী তার ওপর আরোপ করেছে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবরোধ।
এতসব ঝড় ঝাপটার পরও বিগত ৭ বছর ধরে সারা দেশে তীব্র বাদানুবাদের পর অবশেষে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নেপালে চালু হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান। দেশটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল’ বা ‘ যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক নেপালী প্রজাতন্ত্র’। বলাবাহুল্য, বোধগম্য কারণেই এই সংবিধান চালুর ফলে নেপালের বর্তমান সরকারের ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়েছে তার বিশাল প্রতিবেশী ভারত। আর এই ক্ষিপ্ততার কারণেই সংবিধান চালুর মাত্র ৩ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর চতুর্দিকে স্থল পরিবেষ্টিত দেশটির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করেছে ভারত।
॥দুই॥
কেন ভারত নেপালের ওপর চটে গেছে? কারণটি হলো এই যে, নতুন সংবিধান যেহেতু ফেডারেল চরিত্রের তাই ফেডারেশনের মূলনীতি হিসেবে দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। দেশটির মধেশী, থারু এবং জনজাতি - এই তিনটি নৃতাত্বিক সম্প্রদায় এই শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা মনে করে যে, এই শাসনতন্ত্র তাদের সাম্প্রদায়িক আকৃতিকে আরও খর্ব করবে। এদের মধ্যে মধেশীদের জন্য ভারদের রয়েছে প্রবল টান। কারণ এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হলো ভারতে। ভারতের বিহার রাজ্যের টেরাই অঞ্চলে তাদের বাস। নেপালের অধিকাংশ মানুষ পার্বত্য উপজাতীয় হলেও মধেশীরা সমতল ভূমির। তাদের সংস্কৃতিও আলাদা। নেপালে ২ কোটি ৭০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মধেশীরা ৫০ শতাংশ বলে ভারতীয় পত্র পত্রিকার দাবি। বাইরে থেকে দেখলে বিষয়টিকে মনে হবে, এই বিবাদ সমতল ভূমির মানুষ এবং পাহাড়ীদের মধ্যে বিবাদ। যারা পাহাড়ী তাদের মধ্যে রয়েছে উচ্চবিত্ত হিন্দু, যারা নেপালের সমগ্র জনগোষ্ঠির ১৫ শতাংশ। এরাই রাজধানী কাঠমান্ডুতে বসে সমগ্র নেপালকে এ পর্যন্ত শাসন করে এসেছে।
নেপালের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এই যে, তার প্রায় সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আসে ভারত সংলগ্ন নেপালগঞ্জ, বীরগঞ্জ, জানকপুর এবং বিরাট নগর সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে মধেশীরা সেই রাস্তাটি অবরোধ করে রাখে যে রাস্তা দিয়ে ভারত থেকে দ্রব্যসামগ্রী নেপালে প্রবেশ করে। যদিও ভারত অস্বীকার করেছে তবুও বাস্তব ঘটনা হলো এই যে, ভারত খুব চাতুর্যের সাথে এই অবরোধ চালু রেখেছে। তারা প্রকাশ্যে বলছে না যে, তারা নেপালের ওপর অবরোধ জারি করেছে। কিন্তু তলে তলে তারা সীমান্তে কর্মরত ভারতীয় কর্মকর্তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নেপালে পণ্যসামগ্রী পরিবহনকারী যান বাহনকে ঢুকতে না দেয়।
যখন নেপালে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া চলছিল তখন মধেশীদের দাবি দাওয়া পূরণের জন্য ভারত বারবার নেপাল সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল। সংবিধান জারি করার আগে ভারত নেপাল সরকারকে বার বার বলেছে যে ধীরে চলো। কারণ, সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই শাসনতন্ত্রের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা শাসনতন্ত্রের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপালোচনা শুরু করেন এবং শাসনতন্ত্র চালু করেন। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তারা ভারতীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি এবং ভারত যে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে বলেছিল সেটিও তারা শোনেননি। আর এ কারণেই ভারত ক্ষুব্ধ হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষেকগণ মনে করেন।
॥তিন॥
এখানে কয়েকটি তারিখ লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো, সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব জয় শংকর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে কাঠমান্ডু গমন করেন। তিনি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান প্রশ্নে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য নেপালের সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দকে বলেন। তিনি তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেন যে, নেপালে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে সেটি ভারতেরও কোনো কোনো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ পুলিশী জুলুম থেকে বাঁচার জন্য অনেক মধেশী ভারতের বিহার রাজ্যে স্মরণার্থী হিসাবে আসছে। আর একই সময়ে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর বিহারের বিধানসভা গঠনের জন্য পর্যায়ক্রমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে নেপালের নেতৃবৃন্দ তাদের অবস্থানে অটল থাকেন। এ পর্যায়ে দিল্লী নেপালকে প্রস্তাবিত সংবিধানের ৭টি অনুচ্ছেদ বাতিল করার দাবি জানায়। এসব দাবির মধ্যে একটি হলো, যেসব ভারতীয় নারী নেপালীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তাদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাকে নেপালী নাগরিকত্ব প্রদান করা। দ্বিতীয় দাবি হলো, জনসংখ্যার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি দেয়া হোক। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মধেশীরা নেপালী জন গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী। এই দাবি মানা হলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীরা নেপালের রাজনীতি এবং প্রশাসনে প্রাধান্য পায়। অপর একটি দাবি ছিল, জন সংখ্যার হার মোতাবেক নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হোক। এটি করলে মধেশীরা বেশি সংখ্যক নির্বাচনী এলাকা পাবে। পরবর্তী দাবি ছিল, পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হোক জনসংখ্যার ভিত্তিতে। এই দাবি যদি নেপালীরা মেনে নেয় তাহলে মধেশীরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে। তার পরের দাবিতে বলা হয় যে, জন্মগত ভাবে যারা নেপালী নাগরিক শুধুমাত্র তারাই প্রেসিডেন্ট বা প্রধান মন্ত্রী হতে পারবেন সেই ব্যবস্থা বাতিল করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নেপালে বাস করছে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেপালের নাগরিকত্ব লাভ করেছে তাদেরকেও প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু দাবি দাওয়া ভারত নেপালকে মানতে বলেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের সবগুলো দাবিই নেপালের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের শামিল। এসব দাবি যদি নেপাল মেনে নিত তাহলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীদের মাধ্যমে ভারত নেপাল শাসন করতো। কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সব দাবি মেনে নিতে পারে না। তাই নেপালও মেনে নেয়নি। এজন্যই শুরু হয়েছে ভারতের সাথে নেপালের তীব্র বিরোধ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নেপালের জনসংখ্যার চেয়ে সাড়ে ৫ গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ নেপালের মতো পারেনি। কিন্তু আয়তন এবং জনসংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট এবং দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় অন্যায় আবদার মেনে নেয়নি। এখানেই এই দুটি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে মৌলিক তফাত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন