প্রতিবছর স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলেই আমরা একটা হিসাব নিয়ে বসি, কী আমাদের অর্জন, কী আমরা হারালাম, কী আমরা আরও করতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমাদের ভুল হয়ে গেছে, কোন পথে এগোলে আমরা আরও দ্রুত পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, কীভাবে নির্মাণ করতে পারি আমাদের সন্তানদের জন্য অধিকতর বাসযোগ্য একটি আবাসভূমি। বলতে পারি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যারা যুদ্ধ করে স্বদেশ স্বাধীন করেছে। অন্যান্য দেশ স্বাধীন হয়েছে আলোচনার টেবিলে বসে, দেনদরবারের মাধ্যমে। সেসব ক্ষেত্রে আলোচনা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। সে আলোচনা কখনও ভেঙে গেছে, কখনও আবারও শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার একটা মীমাংসা হয়েছে। আমরাও ভোট ও আলোচনার টেবিলে বসেই এর একটা সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অপরিণামদর্শী বল প্রয়োগের নীতির কারণে আমরা শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে তুলে নেই। মরণপণ লড়াই করে শত্রুকে হারিয়ে দিয়ে আমরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, সদ্য স্বাধীন সেসব দেশ দ্রুত আত্মউন্নয়নের পথে এগিয়ে গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে জাতীয় ঐক্য। যারা তা পারেনি, তারা শিগগিরই গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় বড় ফুটানির কথা কোনো কাজে আসেনি। স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রেও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তখন সেখানে কেউ উন্নয়নের আশা করেনি। সেখানে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অগ্রগতির ধারা সূচিত হয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর থেকে। ফুলগেনসিও বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ৫ বছর ৫ মাস ৬ দিন যুদ্ধ করে ১৯৫৯ সালে কিউবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে। বাতিস্তারও সমর্থক ছিল। ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোগীরা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে একযোগে দেশ গড়ার ডাক দেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এই ঐক্যই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ফিদেল সরকারকে।
সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করায় ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র একযোগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে মার্কিন পক্ষে যোগ দেয় দক্ষিণ ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি পশ্চিমা দেশ। ভিয়েতনামের পক্ষ সমর্থন করে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়া। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম একটি রাষ্ট্রই ছিল। আর সেটি ছিল ফ্রান্সের দখলে। ভিয়েতনামীরা তখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। এক সময় ফ্রান্স উপলব্ধি করে যে, এ যুদ্ধে তাদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। তখন তারা কম্যুনিস্টদের সঙ্গে একটি আপোস ফর্মুলায় আসে। আর তা হলো, ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভক্ত হবে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম থাকবে সা¤্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার হিসেবে। কৌশলগত স্বার্থে হা চি মিনের নেতৃত্বাধীন উত্তর ভিয়েতনামের কম্যুনিস্টরা তা মেনে নেয়। এক ভিয়েতনাম দুটি ভিয়েতনামে পরিণত হয়। এর পরের বছর থেকেই শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দো-চীন যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলেছে টানা বিশ বছর। ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র বাহিনীকে খেয়ে না-খেয়ে লড়াই করে হারিয়ে দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ভিয়েতনাম। বিজয়ের পর দুই ভিয়েতনাম পুনরায় এক হয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষেই তারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন ভেদ-বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে জাতি গঠন ও উন্নয়নের ধারায় সকলকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। জাতি ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে কাজ করতে হবে। মুছে দিতে হবে যুদ্ধকালীন ভেদরেখা। চীনের সহযোগিতায় সে পথ ধরেই অগ্রসর হতে থাকে ভিয়েতনাম। তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থনও তাদের ছিল। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ-পরবর্তী ভিয়েতনামের উন্নয়নের গতিধারা ছিল অত্যন্ত শ্লথ। কিন্তু সেখান থেকে বের হবার পথ বড় সহজ ছিল না ভিয়েতনামের জন্য। ভিয়েতনাম ঘৃণার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে শুরু করল। তারা বিশ বছর ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছিল, তাদের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করল। স্বদেশের উন্নতির জন্য তাদের বাণিজ্য চাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে ২০ বছরে ভিয়েতনামের ১৫ লক্ষ থেকে ৩০ লোক শহীদ হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ হাজার সৈন্য তাতে নিহত হয়। অর্থাৎ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ লোক মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন ভিয়েতনামে। সে তুলনায় প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা গিয়েছিল মাত্র দুই হাজার। এই ক্রোধ ভিয়েতনামীদের তাড়া তো করবেই। তা সত্ত্বেও তারা অতীতের তিক্ততা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তা পরিপূর্ণ রূপ নিতেও বিশ বছর সময় লেগেছিল। পরে ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন। এরপর দু’ দেশ উভয় দেশে দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার আগে থেকেই অবশ্য দু’দেশের মধ্যে লিয়াজোঁ অফিস ভিত্তিক সম্পর্ক ছিল।
কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপর এই সম্পর্ক এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতি পেছনে ফেলে এখন অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দ্রুত এগিয়ে গেছে। দ’ুদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০০১ সালে দু’ দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র দেড় শ’ কোট ডলারের। আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫০ কোটি ডলারে। আবার ৩৬ লক্ষ ভিয়েতনামী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ১৮ লক্ষেরই বাস যুক্তরাষ্ট্রে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে লাওস ও কম্বোডিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি এ বছরই ভিয়েতনামে এক জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায় যে, শতকরা ৭৮ জন ভিয়েতনামী মনে করে, অতীতের তিক্ততা ভুলে ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দ্রুত সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন। আছে ২২-২৪ বছরের তরুণ-তরুণীও। তাদের অনেকে আবার মার্কিনীদের বিয়ে করতেও আগ্রহী। ভিয়েতনামে ঐ ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘরও রয়েছে। শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে তা অবহিতও করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ঘৃণা শেখানো হচ্ছে না। ইতিহাসকে যেমন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে না, তেমনি ঘৃণার বদলে জাতীয় অগ্রগতিকেই মুখ্য করে তোলা হয়েছে। শিক্ষা ও সমৃদ্ধির এই সৌকর্য আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি।
আমরা বিজয়ের সাফল্য কিংবা সমৃদ্ধির মঞ্চের বদলে ঘৃণাস্তম্ভ বানিয়েছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঔদার্য ভালবাসা সহমর্মিতার বদলে ঘৃণা করতে শিখিয়েছি। তাদের সঙ্কীর্ণতার গণ্ডীর ভেতরে আবদ্ধ করেছি। ফলে কাম্য অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারছি না। আর সে কারণে সমাজের ভেতরে তার বিষবৎ ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো এক শহরে দেখলাম ঘৃণাস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। যে ছোট্ট শিশু প্রতিদিন এই পথে ব্যাগ হাতে স্কুলে যায়, তার প্রশ্নের জবাব ঐ শিশুর অভিভাবকরা কী দেবেন? কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানীরা এদেশে ১৯৭১ সালে মানুষ হত্যা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, আর তাই এ স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, তাই এ ঘৃণাস্তম্ভ। এইভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে ঘৃণাই শিখিয়ে যাব? বাংলাদেশের এই ঘৃণাস্তম্ভের মতো কোনো স্তম্ভ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
এই ঘৃণার বিষময় ফলই হলো বর্তমান সময়ের অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা। ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতা লালন করেছি বলেই এই প্রজন্মে খুন-গুম-রাহাজানি, শিশু হত্যা-ধর্ষণ সমাজে এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। আমরা সমাজপতিরা ঘৃণা শিখিয়েছি, শিখিয়েই যাচ্ছি। এর নিকট কিংবা সুদূরপ্রসারী পরিণাম কী হতে পারে, তা ভেবে দেখতে চাইনি। গোটা সমাজ এখন তার খেসারত দিচ্ছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও এই সত্য ও বাস্তব পরিণতি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। আর তাই তিনি ১৯৭৩ সালেই দেশ থেকে সম্ভাব্য বিভেদের বীজ উপড়ে ফেলার জন্য, সকলে একযোগে কাজ করে দেশ গড়ার জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছিলেন অন্য সব রাষ্ট্রনায়কের মতো। আসুন, আজকের মহান বিজয় দিবসে অন্য সব যোদ্ধা জাতির মতো আমরাও অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে উন্নতি আর সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। সেই হোক আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, সদ্য স্বাধীন সেসব দেশ দ্রুত আত্মউন্নয়নের পথে এগিয়ে গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে জাতীয় ঐক্য। যারা তা পারেনি, তারা শিগগিরই গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় বড় ফুটানির কথা কোনো কাজে আসেনি। স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রেও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তখন সেখানে কেউ উন্নয়নের আশা করেনি। সেখানে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অগ্রগতির ধারা সূচিত হয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর থেকে। ফুলগেনসিও বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ৫ বছর ৫ মাস ৬ দিন যুদ্ধ করে ১৯৫৯ সালে কিউবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে। বাতিস্তারও সমর্থক ছিল। ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোগীরা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে একযোগে দেশ গড়ার ডাক দেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এই ঐক্যই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ফিদেল সরকারকে।
সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করায় ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র একযোগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে মার্কিন পক্ষে যোগ দেয় দক্ষিণ ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি পশ্চিমা দেশ। ভিয়েতনামের পক্ষ সমর্থন করে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়া। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম একটি রাষ্ট্রই ছিল। আর সেটি ছিল ফ্রান্সের দখলে। ভিয়েতনামীরা তখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। এক সময় ফ্রান্স উপলব্ধি করে যে, এ যুদ্ধে তাদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। তখন তারা কম্যুনিস্টদের সঙ্গে একটি আপোস ফর্মুলায় আসে। আর তা হলো, ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভক্ত হবে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম থাকবে সা¤্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার হিসেবে। কৌশলগত স্বার্থে হা চি মিনের নেতৃত্বাধীন উত্তর ভিয়েতনামের কম্যুনিস্টরা তা মেনে নেয়। এক ভিয়েতনাম দুটি ভিয়েতনামে পরিণত হয়। এর পরের বছর থেকেই শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দো-চীন যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলেছে টানা বিশ বছর। ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র বাহিনীকে খেয়ে না-খেয়ে লড়াই করে হারিয়ে দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ভিয়েতনাম। বিজয়ের পর দুই ভিয়েতনাম পুনরায় এক হয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষেই তারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন ভেদ-বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে জাতি গঠন ও উন্নয়নের ধারায় সকলকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। জাতি ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে কাজ করতে হবে। মুছে দিতে হবে যুদ্ধকালীন ভেদরেখা। চীনের সহযোগিতায় সে পথ ধরেই অগ্রসর হতে থাকে ভিয়েতনাম। তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থনও তাদের ছিল। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ-পরবর্তী ভিয়েতনামের উন্নয়নের গতিধারা ছিল অত্যন্ত শ্লথ। কিন্তু সেখান থেকে বের হবার পথ বড় সহজ ছিল না ভিয়েতনামের জন্য। ভিয়েতনাম ঘৃণার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে শুরু করল। তারা বিশ বছর ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছিল, তাদের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করল। স্বদেশের উন্নতির জন্য তাদের বাণিজ্য চাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে ২০ বছরে ভিয়েতনামের ১৫ লক্ষ থেকে ৩০ লোক শহীদ হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ হাজার সৈন্য তাতে নিহত হয়। অর্থাৎ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ লোক মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন ভিয়েতনামে। সে তুলনায় প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা গিয়েছিল মাত্র দুই হাজার। এই ক্রোধ ভিয়েতনামীদের তাড়া তো করবেই। তা সত্ত্বেও তারা অতীতের তিক্ততা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তা পরিপূর্ণ রূপ নিতেও বিশ বছর সময় লেগেছিল। পরে ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন। এরপর দু’ দেশ উভয় দেশে দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার আগে থেকেই অবশ্য দু’দেশের মধ্যে লিয়াজোঁ অফিস ভিত্তিক সম্পর্ক ছিল।
কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপর এই সম্পর্ক এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতি পেছনে ফেলে এখন অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দ্রুত এগিয়ে গেছে। দ’ুদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০০১ সালে দু’ দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র দেড় শ’ কোট ডলারের। আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫০ কোটি ডলারে। আবার ৩৬ লক্ষ ভিয়েতনামী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ১৮ লক্ষেরই বাস যুক্তরাষ্ট্রে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে লাওস ও কম্বোডিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি এ বছরই ভিয়েতনামে এক জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায় যে, শতকরা ৭৮ জন ভিয়েতনামী মনে করে, অতীতের তিক্ততা ভুলে ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দ্রুত সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন। আছে ২২-২৪ বছরের তরুণ-তরুণীও। তাদের অনেকে আবার মার্কিনীদের বিয়ে করতেও আগ্রহী। ভিয়েতনামে ঐ ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘরও রয়েছে। শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে তা অবহিতও করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ঘৃণা শেখানো হচ্ছে না। ইতিহাসকে যেমন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে না, তেমনি ঘৃণার বদলে জাতীয় অগ্রগতিকেই মুখ্য করে তোলা হয়েছে। শিক্ষা ও সমৃদ্ধির এই সৌকর্য আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি।
আমরা বিজয়ের সাফল্য কিংবা সমৃদ্ধির মঞ্চের বদলে ঘৃণাস্তম্ভ বানিয়েছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঔদার্য ভালবাসা সহমর্মিতার বদলে ঘৃণা করতে শিখিয়েছি। তাদের সঙ্কীর্ণতার গণ্ডীর ভেতরে আবদ্ধ করেছি। ফলে কাম্য অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারছি না। আর সে কারণে সমাজের ভেতরে তার বিষবৎ ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো এক শহরে দেখলাম ঘৃণাস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। যে ছোট্ট শিশু প্রতিদিন এই পথে ব্যাগ হাতে স্কুলে যায়, তার প্রশ্নের জবাব ঐ শিশুর অভিভাবকরা কী দেবেন? কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানীরা এদেশে ১৯৭১ সালে মানুষ হত্যা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, আর তাই এ স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, তাই এ ঘৃণাস্তম্ভ। এইভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে ঘৃণাই শিখিয়ে যাব? বাংলাদেশের এই ঘৃণাস্তম্ভের মতো কোনো স্তম্ভ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
এই ঘৃণার বিষময় ফলই হলো বর্তমান সময়ের অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা। ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতা লালন করেছি বলেই এই প্রজন্মে খুন-গুম-রাহাজানি, শিশু হত্যা-ধর্ষণ সমাজে এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। আমরা সমাজপতিরা ঘৃণা শিখিয়েছি, শিখিয়েই যাচ্ছি। এর নিকট কিংবা সুদূরপ্রসারী পরিণাম কী হতে পারে, তা ভেবে দেখতে চাইনি। গোটা সমাজ এখন তার খেসারত দিচ্ছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও এই সত্য ও বাস্তব পরিণতি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। আর তাই তিনি ১৯৭৩ সালেই দেশ থেকে সম্ভাব্য বিভেদের বীজ উপড়ে ফেলার জন্য, সকলে একযোগে কাজ করে দেশ গড়ার জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছিলেন অন্য সব রাষ্ট্রনায়কের মতো। আসুন, আজকের মহান বিজয় দিবসে অন্য সব যোদ্ধা জাতির মতো আমরাও অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে উন্নতি আর সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। সেই হোক আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন