বাস্তবের জীবনে ক্ষমতার আবর্তন এক চিরচেনা বিষয়, যা কখনো কখনো নাটকের আবহে মঞ্চায়িত হয়। যেমন, কালজয়ী নাট্যকার শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন ‘টুয়েলফ্থ নাইট’। ভারতের ব্রাত্য বসুর পুনর্লিখন করলেন ‘মুম্বাই নাইট্স’। রঙ্গমঞ্চ কীভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় অন্তর্ঘাত করতে পারে, চার শতাব্দীর ব্যবধানেও সেটা খেয়াল না করে উপায় নেই। রাজনৈতিক নাটকের এমন রূপান্তর বিশ্বের নানা দেশে ও নানা সময়েই সম্ভব। কারণ, নাটক যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে বলতেই হবে যে, সে জীবনের অনেকটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে রাজনীতি। কারণ, সহস্রবর্ষ পূর্বে পণ্ডিত এরিস্টোটোল স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে গেছেন, “মানুষ আসলে রাজনৈতিক জীব।” আর রাজনীতির ভেতরে গোত্র, গোষ্ঠী, পরিবার বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় ক্ষমতার বৃত্ত। অতীতেও যেটি ছিল সত্য, বর্তমানে সেটা হয়েছে চরম সত্য। যে কারণেই ইতিহাসে বার বার স্বৈরতান্ত্রিক হিটলার, স্ট্যালিনের মুখ নানা ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আশ্রয় করে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে।
শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকটি সম্ভবত ১৬০১ সালে লেখা। ওই বছর বড়দিনের পর দ্বাদশ রজনীতে, অর্থাৎ এপিফ্যানি-র রাতে, যে তারিখে তিন প্রাজ্ঞ পুরুষ সদ্যোজাত ত্রাতাকে দেখতে বেথল্হোমে তীর্থ করতে আসেন, রাণি এলিজাবেথ হোয়াইটহল প্রাসাদে অর্সিনো নামের এক ইতালীয় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। রাজসভার আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ ছিল শেক্সপিয়ারের দল ‘লর্ড চেম্বারলেন্স’ প্রযোজিত এক নাটক। অভ্যাগতদের নামের সঙ্গে ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকের এক প্রধান চরিত্রের নামের মিল রয়েছে, সে আবার ডিউক, তার সামাজিক কদর গল্পে সব চাইতে বেশি। তা ছাড়া নাটকের নামের ব্যাখ্যা গল্পে নেই, হয়তো মঞ্চায়নের উপলক্ষের মধ্যে রয়েছে। ৬ জানুয়ারির ধার্মিক তাৎপর্য গুরুগম্ভীর, কিন্তু তার উদযাপনের ধরনটি উৎসবের, অন্তত বেশ কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর সঙ্গে রাজনীতির কিছু বিষয়ও অস্পষ্ট নয়।
সাহিত্যের ইতিহাস অনুযায়ী, আইনের পড়ুয়া জন ম্যানিংহ্যাম-এর রোজনামচা থেকে জানতে পাই যে, তাঁর আইনের বিদ্যাপীঠ মিডল টেম্পল-এ নাটকটি তিনি দেখেন ১৬০২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, নাটকটি রচনার পরের বছরই। ও-দিনও আবার গির্জার পঞ্জিকায় অনুষ্ঠান বা পরবের দিন। সে-দিন ক্যান্ডলমাস উপলক্ষে মোমবাতি জ্বালানো হয়, কারণ ওই তারিখে যিশুর জন্মের চল্লিশ দিনের মাথায় জেরুজালেমের মন্দিরে পুরোহিতদের কাছে তাঁকে হাজির করেন তাঁর মা। এই উৎসবের বাতাবরণেই নাটকের বিস্তার।
নাটকটির সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক তাই সব দিক থেকেই নিবিড়। রাজসভায় অভিনীত নাটকে রাজনীতির প্রসঙ্গও সংলাপে দুর্লভ নয়। শেক্সপিয়ার এই দু’টি মাত্রাকে আলাদা করে রাখেননি, কমেডি ও ট্র্যাজিক সম্ভাবনাও মূল নাটকে প্রায়শই একাকার। সামাজিক বিভাজন একটি ছিল গল্পে। উপরতলার প্রেম-প্রতিহিংসার বৃত্ত আভিজাত্য ও কাব্যিক সংলাপে প্রকাশ, আর নিচুতলার দুনিয়ায় সেই একই প্রসঙ্গগুলি হুল্লোড় এবং অভব্য গদ্যের আবহে ঘেরা। এতে সমাজের বিভক্ত অংশের মানুষের উৎসব, অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ এবং রাজনৈতিক চিন্তা ও ভঙ্গির প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে। হাস্যরস, করুণরস ইত্যাদির সঙ্গে হালকাভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। এতেই নাটকটি সাধারণ বা গতানুগতিক মাত্রার চেয়েও বেশি গভীরতা এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।
অন্যদিকে, শেক্সপিয়ারের চারশত বছর পরে রচিত ‘মুম্বাই নাইট্স’ নামের পুনর্লিখনে নাট্যকার ব্রাত্য বসু বিন্যাসটি ধরেছেন নিপুণ ভাবে। মিনার্ভা রেপর্টরি থিয়েটার প্রযোজিত নাটকটিতে রাজনীতি, প্রেম ও হিংসার বিকল্প পটভূমি হল মুম্বই চলচ্চিত্রের জগৎ এবং তার সঙ্গে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাজশ। কমিক হুল্লোড় জমিয়ে তোলার খাতিরেও শেক্সপিয়ার ইতালীয় কোম্মেদিয়া দেল্লার্তে-র খড়ের কাঠামোর উপরে লাগিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য ধারালো সংলাপ ও চরিত্রায়ণের প্রলেপ। ব্রাত্যর নাটকে জমাট মজার আশ্রয় মুম্বই ফিল্মে মনোরঞ্জনের রকমারি মশলার ঝাঁঝালো মিশেল। সামাজিক বিভাজনটি বাংলা নাটকটিতেও ঠিক দৃঢ় নয়। এই দুই মহলের মধ্যে সেতুর কাজ করেছে পারিবারিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার রফা, এবং সূত্রধর-সদৃশ একটি গাইড চরিত্র।
‘মুম্বাই নাইট্স’ বাংলা থিয়েটারে শেক্সপিয়ার-চর্চায় এক নতুন খবর। শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে যে লৌকিক-লোকোত্তরের সন্ধি, গদ্য ও কাব্যের যে রৌদ্ররাত্রির খেলা, তার সঙ্গে টক্কর দূরস্থান, অনুকৃতির চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হননি ব্রাত্য। তিনি কাজে লাগিয়েছেন ব্রেখ্ট-এর ‘মজা’। প্রমোদ-ব্যবসার সঙ্গে যখন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের যোগ প্রায় ওতপ্রোত, তখন সেই ‘মজা’ আর স্রেফ হিন্দি ছবির গান, সম্মেলক নাচ, মঞ্চসজ্জা, কোরিয়োগ্রাফি ও কোরাস-সদৃশ ব্যান্ডের ব্যবহারের অজুহাতে সীমিত থাকে না। তামাশার ছলে সাম্প্রদায়িকতা বা যুদ্ধবাজ রাজনীতির প্রসঙ্গ তাই কোনো সময়েই আরোপিত বলে মনে হয় না।
ইংরেজি নাটকটির কথা উঠলেই ভাষ্যকাররা একটি শব্দ ব্যবহার করেন: মেলানকলি বা বিষাদ। জুডি ডেন্চ এক দশকের বেশি ফারাকে ভায়োলা-র ভূমিকায় অভিনয় করেন বিলেতে, ১৯৫৭ সালে ওল্ড ভিক প্রযোজনায়, আবার ১৯৬৯ সালে জন বার্টন-এর নির্দেশনায় রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানির হয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রথমবার মঞ্চসজ্জা ও পোশাকের প্রধান রং ছিল হেমন্তের, বাদামি ও হালকা লাল, দ্বিতীয়বার বসন্তের সবুজ ছিল বেশি। নাটকের সময়কাল শীত হলেও প্রেমের বিচিত্র প্রমাদ হেমন্তের কুয়াশাজনিত বলে ভ্রম মনে হতে পারে, আবার বসন্তের স্বপ্ন বলেও হাজির করা যায়। প্রতীচ্যের শিল্পে প্রেমের এই মায়ার খেলা, যার মধ্যে সমকামিতার ইঙ্গিত মিশে আছে, প্রায়শ কৌতুক ও উল্লাসের ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে, যেমন মোৎসার্টের ‘ফিগারোর বিবাহ’ অপেরায়।
সমাজের নানা প্রসঙ্গের এই মিশেলের তাৎপর্য মোক্ষম ধরেছেন ব্রাত্য বসু। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে শেক্সপিয়ারের প্রতিভায় বিষাদ ও কৌতুক, সূক্ষ্মতম কাব্য ও স্থূলতম হুল্লোড়, প্রেম ও হিংস্রতা, ক্ষমতা ও দ্বন্দ্ব সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদান, এদের পৃথক করলে জীবন, সমাজ ও রাজনীতি বিমূর্ত বিষয় হয়ে পড়ে। মুম্বইয়ের রাস্তায় জনস্রোত, গণেশ চতুর্থীর শোভাযাত্রা, ক্রিকেট, অপরাধ জগৎ, বিনোদন ব্যবসা এবং হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতি তেমনই এক সূত্রে গাঁথা বাংলা ভাষ্যটিতে। পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের রাজনীতির কারসাজি কী ভাবে ফাঁস করে দিতে পারে কমেডি, সেই পাঠটি ব্রাত্য বসু নিয়েছেন ইংরেজ নাট্যকারের থেকেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে দেশজ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুতে আত্মস্থ করার মাধ্যমে চিরায়ত নাটকের বিস্তার সমকালেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন রূপান্তর বিশ্বের নানা দেশেই সম্ভব। কারণ, গণতন্ত্রের দামামা বাজানো হলেও স্বৈরতন্ত্রের প্রচ্ছায়া একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায় নি বিশ্বের নানা দেশ ও সমাজ থেকে। এখনো ক্ষমতার নানা রঙ-তামাশা গবেষকদের মনোযোগের বিষয়।
উল্লেখ্য, শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর পরেই ১৬২৩ সালে ‘টুয়েলফ্থ নাইট অর হোয়াট ইউ উইল’ নাটক নামের হেঁয়ালি ছেড়ে ‘মালভোলিয়ো’ নামে মঞ্চস্থ হয়। মালভোলিয়ো ধনী অলিভিয়ার ঘরদোরের নিয়মরক্ষী, বেনিয়মের কড়া শত্রু। এর এক দশকের মধ্যেই ইংল্যান্ডের দোরগোড়ায় গৃহযুদ্ধ। ক্রমশ রাজতন্ত্রবিরোধীদের নেতৃত্ব চলে যায় মালভোলিয়োদের হাতে, ১৬৪২ সালে হুল্লোড়ের দুশমনরা দেশের সব থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দেয়। পৃথিবীর নানা দেশেও কি তুলনীয় পরিস্থিতি আসন্ন কিনা, সে প্রশ্ন নাটকের পর্বে পর্বে ছড়ানো, যার প্রতিচ্ছবি রয়েছে বাস্তবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রঙ্গমঞ্চের অন্তর্ঘাতী সম্ভাবনাটি অন্তত ভুলতে দেন না নাট্যকার-নির্দেশক। কমেডির প্রাণকেন্দ্রে হাসি ও নিষ্ঠুরতার যে সমবায়, তা অসামান্য অভিনয়ে টানটান ধরে রাখেন মালভোলিয়ো চরিত্র, যিনি ব্রিটিশ ইতিহাস ও রাজনীতিরও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
কিছুটা মদত ও মেধাবী নির্দেশনা পেলে মঞ্চে কিন্তু বাস্তবের প্রতিফলন চমৎকারভাবে করা সম্ভব। শেক্সপিয়ার সে পথ দেখিয়ে গেছেন। ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশ সে পথ ধরে সমসাময়িক বহু ঘটনার নাটকীয় রূপান্তর সাধন করেছেন। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ এবং ‘মুম্বাই নাইট্স’ তার উজ্জ্বল নমুনা অনুসরণ করে অনেক দেশের বহুবর্ণা, চিত্র-বিচিত্র রাজনীতির রূপায়ণ খুবই সম্ভব। বিশেষত, হিটলার-পরবর্তী যুগে ঘাপটি-মারা বহু হিটলার যেমন রক্তপানের উন্মাতাল নেশায় বিশ্বের স্থানে স্থানে নখর বিস্তার করছে, তখন রাজনৈতিক নির্মম-বাস্তবতার অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। ভয়ে যখন মানুষ সরাসরি সেসব কথা বলতে পারে না, তখন নাটকের আশ্রয় নেয়। এভাবেই বাস্তবে আর নাটকে জীবনের সত্য উদ্ভাসিত হয়। ক্ষমতার গোপন আবর্ত প্রকাশ্যে দেখা যায়। শেক্সপিয়ারের দেখিয়ে দেওয়া পথে সে কাজ এখনো করছেন বিশ্বের নানা দেশের নাট্যকারগণ। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও তা চলতে থাকবে। শুধু স্থান, কাল, পাত্র বদলে যাচ্ছে মাত্র!
শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকটি সম্ভবত ১৬০১ সালে লেখা। ওই বছর বড়দিনের পর দ্বাদশ রজনীতে, অর্থাৎ এপিফ্যানি-র রাতে, যে তারিখে তিন প্রাজ্ঞ পুরুষ সদ্যোজাত ত্রাতাকে দেখতে বেথল্হোমে তীর্থ করতে আসেন, রাণি এলিজাবেথ হোয়াইটহল প্রাসাদে অর্সিনো নামের এক ইতালীয় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। রাজসভার আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ ছিল শেক্সপিয়ারের দল ‘লর্ড চেম্বারলেন্স’ প্রযোজিত এক নাটক। অভ্যাগতদের নামের সঙ্গে ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকের এক প্রধান চরিত্রের নামের মিল রয়েছে, সে আবার ডিউক, তার সামাজিক কদর গল্পে সব চাইতে বেশি। তা ছাড়া নাটকের নামের ব্যাখ্যা গল্পে নেই, হয়তো মঞ্চায়নের উপলক্ষের মধ্যে রয়েছে। ৬ জানুয়ারির ধার্মিক তাৎপর্য গুরুগম্ভীর, কিন্তু তার উদযাপনের ধরনটি উৎসবের, অন্তত বেশ কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর সঙ্গে রাজনীতির কিছু বিষয়ও অস্পষ্ট নয়।
সাহিত্যের ইতিহাস অনুযায়ী, আইনের পড়ুয়া জন ম্যানিংহ্যাম-এর রোজনামচা থেকে জানতে পাই যে, তাঁর আইনের বিদ্যাপীঠ মিডল টেম্পল-এ নাটকটি তিনি দেখেন ১৬০২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, নাটকটি রচনার পরের বছরই। ও-দিনও আবার গির্জার পঞ্জিকায় অনুষ্ঠান বা পরবের দিন। সে-দিন ক্যান্ডলমাস উপলক্ষে মোমবাতি জ্বালানো হয়, কারণ ওই তারিখে যিশুর জন্মের চল্লিশ দিনের মাথায় জেরুজালেমের মন্দিরে পুরোহিতদের কাছে তাঁকে হাজির করেন তাঁর মা। এই উৎসবের বাতাবরণেই নাটকের বিস্তার।
নাটকটির সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক তাই সব দিক থেকেই নিবিড়। রাজসভায় অভিনীত নাটকে রাজনীতির প্রসঙ্গও সংলাপে দুর্লভ নয়। শেক্সপিয়ার এই দু’টি মাত্রাকে আলাদা করে রাখেননি, কমেডি ও ট্র্যাজিক সম্ভাবনাও মূল নাটকে প্রায়শই একাকার। সামাজিক বিভাজন একটি ছিল গল্পে। উপরতলার প্রেম-প্রতিহিংসার বৃত্ত আভিজাত্য ও কাব্যিক সংলাপে প্রকাশ, আর নিচুতলার দুনিয়ায় সেই একই প্রসঙ্গগুলি হুল্লোড় এবং অভব্য গদ্যের আবহে ঘেরা। এতে সমাজের বিভক্ত অংশের মানুষের উৎসব, অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ এবং রাজনৈতিক চিন্তা ও ভঙ্গির প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে। হাস্যরস, করুণরস ইত্যাদির সঙ্গে হালকাভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। এতেই নাটকটি সাধারণ বা গতানুগতিক মাত্রার চেয়েও বেশি গভীরতা এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।
অন্যদিকে, শেক্সপিয়ারের চারশত বছর পরে রচিত ‘মুম্বাই নাইট্স’ নামের পুনর্লিখনে নাট্যকার ব্রাত্য বসু বিন্যাসটি ধরেছেন নিপুণ ভাবে। মিনার্ভা রেপর্টরি থিয়েটার প্রযোজিত নাটকটিতে রাজনীতি, প্রেম ও হিংসার বিকল্প পটভূমি হল মুম্বই চলচ্চিত্রের জগৎ এবং তার সঙ্গে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাজশ। কমিক হুল্লোড় জমিয়ে তোলার খাতিরেও শেক্সপিয়ার ইতালীয় কোম্মেদিয়া দেল্লার্তে-র খড়ের কাঠামোর উপরে লাগিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য ধারালো সংলাপ ও চরিত্রায়ণের প্রলেপ। ব্রাত্যর নাটকে জমাট মজার আশ্রয় মুম্বই ফিল্মে মনোরঞ্জনের রকমারি মশলার ঝাঁঝালো মিশেল। সামাজিক বিভাজনটি বাংলা নাটকটিতেও ঠিক দৃঢ় নয়। এই দুই মহলের মধ্যে সেতুর কাজ করেছে পারিবারিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার রফা, এবং সূত্রধর-সদৃশ একটি গাইড চরিত্র।
‘মুম্বাই নাইট্স’ বাংলা থিয়েটারে শেক্সপিয়ার-চর্চায় এক নতুন খবর। শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে যে লৌকিক-লোকোত্তরের সন্ধি, গদ্য ও কাব্যের যে রৌদ্ররাত্রির খেলা, তার সঙ্গে টক্কর দূরস্থান, অনুকৃতির চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হননি ব্রাত্য। তিনি কাজে লাগিয়েছেন ব্রেখ্ট-এর ‘মজা’। প্রমোদ-ব্যবসার সঙ্গে যখন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের যোগ প্রায় ওতপ্রোত, তখন সেই ‘মজা’ আর স্রেফ হিন্দি ছবির গান, সম্মেলক নাচ, মঞ্চসজ্জা, কোরিয়োগ্রাফি ও কোরাস-সদৃশ ব্যান্ডের ব্যবহারের অজুহাতে সীমিত থাকে না। তামাশার ছলে সাম্প্রদায়িকতা বা যুদ্ধবাজ রাজনীতির প্রসঙ্গ তাই কোনো সময়েই আরোপিত বলে মনে হয় না।
ইংরেজি নাটকটির কথা উঠলেই ভাষ্যকাররা একটি শব্দ ব্যবহার করেন: মেলানকলি বা বিষাদ। জুডি ডেন্চ এক দশকের বেশি ফারাকে ভায়োলা-র ভূমিকায় অভিনয় করেন বিলেতে, ১৯৫৭ সালে ওল্ড ভিক প্রযোজনায়, আবার ১৯৬৯ সালে জন বার্টন-এর নির্দেশনায় রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানির হয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রথমবার মঞ্চসজ্জা ও পোশাকের প্রধান রং ছিল হেমন্তের, বাদামি ও হালকা লাল, দ্বিতীয়বার বসন্তের সবুজ ছিল বেশি। নাটকের সময়কাল শীত হলেও প্রেমের বিচিত্র প্রমাদ হেমন্তের কুয়াশাজনিত বলে ভ্রম মনে হতে পারে, আবার বসন্তের স্বপ্ন বলেও হাজির করা যায়। প্রতীচ্যের শিল্পে প্রেমের এই মায়ার খেলা, যার মধ্যে সমকামিতার ইঙ্গিত মিশে আছে, প্রায়শ কৌতুক ও উল্লাসের ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে, যেমন মোৎসার্টের ‘ফিগারোর বিবাহ’ অপেরায়।
সমাজের নানা প্রসঙ্গের এই মিশেলের তাৎপর্য মোক্ষম ধরেছেন ব্রাত্য বসু। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে শেক্সপিয়ারের প্রতিভায় বিষাদ ও কৌতুক, সূক্ষ্মতম কাব্য ও স্থূলতম হুল্লোড়, প্রেম ও হিংস্রতা, ক্ষমতা ও দ্বন্দ্ব সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদান, এদের পৃথক করলে জীবন, সমাজ ও রাজনীতি বিমূর্ত বিষয় হয়ে পড়ে। মুম্বইয়ের রাস্তায় জনস্রোত, গণেশ চতুর্থীর শোভাযাত্রা, ক্রিকেট, অপরাধ জগৎ, বিনোদন ব্যবসা এবং হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতি তেমনই এক সূত্রে গাঁথা বাংলা ভাষ্যটিতে। পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের রাজনীতির কারসাজি কী ভাবে ফাঁস করে দিতে পারে কমেডি, সেই পাঠটি ব্রাত্য বসু নিয়েছেন ইংরেজ নাট্যকারের থেকেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে দেশজ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুতে আত্মস্থ করার মাধ্যমে চিরায়ত নাটকের বিস্তার সমকালেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন রূপান্তর বিশ্বের নানা দেশেই সম্ভব। কারণ, গণতন্ত্রের দামামা বাজানো হলেও স্বৈরতন্ত্রের প্রচ্ছায়া একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায় নি বিশ্বের নানা দেশ ও সমাজ থেকে। এখনো ক্ষমতার নানা রঙ-তামাশা গবেষকদের মনোযোগের বিষয়।
উল্লেখ্য, শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর পরেই ১৬২৩ সালে ‘টুয়েলফ্থ নাইট অর হোয়াট ইউ উইল’ নাটক নামের হেঁয়ালি ছেড়ে ‘মালভোলিয়ো’ নামে মঞ্চস্থ হয়। মালভোলিয়ো ধনী অলিভিয়ার ঘরদোরের নিয়মরক্ষী, বেনিয়মের কড়া শত্রু। এর এক দশকের মধ্যেই ইংল্যান্ডের দোরগোড়ায় গৃহযুদ্ধ। ক্রমশ রাজতন্ত্রবিরোধীদের নেতৃত্ব চলে যায় মালভোলিয়োদের হাতে, ১৬৪২ সালে হুল্লোড়ের দুশমনরা দেশের সব থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দেয়। পৃথিবীর নানা দেশেও কি তুলনীয় পরিস্থিতি আসন্ন কিনা, সে প্রশ্ন নাটকের পর্বে পর্বে ছড়ানো, যার প্রতিচ্ছবি রয়েছে বাস্তবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রঙ্গমঞ্চের অন্তর্ঘাতী সম্ভাবনাটি অন্তত ভুলতে দেন না নাট্যকার-নির্দেশক। কমেডির প্রাণকেন্দ্রে হাসি ও নিষ্ঠুরতার যে সমবায়, তা অসামান্য অভিনয়ে টানটান ধরে রাখেন মালভোলিয়ো চরিত্র, যিনি ব্রিটিশ ইতিহাস ও রাজনীতিরও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
কিছুটা মদত ও মেধাবী নির্দেশনা পেলে মঞ্চে কিন্তু বাস্তবের প্রতিফলন চমৎকারভাবে করা সম্ভব। শেক্সপিয়ার সে পথ দেখিয়ে গেছেন। ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশ সে পথ ধরে সমসাময়িক বহু ঘটনার নাটকীয় রূপান্তর সাধন করেছেন। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ এবং ‘মুম্বাই নাইট্স’ তার উজ্জ্বল নমুনা অনুসরণ করে অনেক দেশের বহুবর্ণা, চিত্র-বিচিত্র রাজনীতির রূপায়ণ খুবই সম্ভব। বিশেষত, হিটলার-পরবর্তী যুগে ঘাপটি-মারা বহু হিটলার যেমন রক্তপানের উন্মাতাল নেশায় বিশ্বের স্থানে স্থানে নখর বিস্তার করছে, তখন রাজনৈতিক নির্মম-বাস্তবতার অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। ভয়ে যখন মানুষ সরাসরি সেসব কথা বলতে পারে না, তখন নাটকের আশ্রয় নেয়। এভাবেই বাস্তবে আর নাটকে জীবনের সত্য উদ্ভাসিত হয়। ক্ষমতার গোপন আবর্ত প্রকাশ্যে দেখা যায়। শেক্সপিয়ারের দেখিয়ে দেওয়া পথে সে কাজ এখনো করছেন বিশ্বের নানা দেশের নাট্যকারগণ। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও তা চলতে থাকবে। শুধু স্থান, কাল, পাত্র বদলে যাচ্ছে মাত্র!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন