অন্য অনেক ‘বিখ্যাত’জনের মতো সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমও মরে বেঁচে যেতে পারেননি। বিএনপি যেহেতু এখনো এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়েছে সেহেতু দলটির পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানির শেষ হচ্ছে না। এই তো মাত্র ক’দিন আগে, ৩ নভেম্বরও কঠোর ভাষায় তার নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে তিনিও নাকি জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন! অথচ ইতিহাসের সত্য হলো, সে সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানের পর সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। একজন বন্দীর পক্ষে জেলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো আদৌ সম্ভব হতে পারে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। এটাই অবশ্য জিয়াকে বিষয়বস্তু বানানোর একমাত্র কারণ নয়। প্রকৃত কারণ হলো, আজ ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনটিতে সিপাহী-ছাত্র-জনতা মিলিতভাবে সফল বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সে বিপ্লবের ফলে বন্দী জিয়াই শুধু মুক্তি পাননি, দেশের রাজনীতিতেও এসেছিল অনেক শুভ পরিবর্তন। ওই বিপ্লবের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন যেমন করা দরকার, তেমনি দরকার আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত অভিযোগের মধ্যে মোটেও কোনো সত্য রয়েছে কি না।
শুরুতেই বলা দরকার, ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে একবার বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেন, এরশাদ এই ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং শেখ মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া তাই বলে ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নভেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। বহুদিন পর এদেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্য গড়ে ওঠার বিষয়টিও ছিল এক অসাধারণ ঘটনা। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও সেটাই ঘটেছিল। নিজেদের তাগিদেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন আর সে কারণেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধবংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি। সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দী করা হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থক- এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। কয়েকদিন পর্যন্ত অফিসাররা পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবেই জানা গেছে, বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করেছিল। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ছিল। কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীরউত্তম। কর্নেল তাহের নিজেকে বঞ্চিত মনে করতেন। তার এ মানসিক বৈকল্যেরই সুযোগ নিয়েছিল জাসদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে তারা এমনভাবেই অফিসার হত্যা চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু জাসদের মাধ্যমে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু ধরে নেয়া যায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো। পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া ভারতের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ংকর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র- যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদসহ বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সে বছরের ১৫ আগস্ট বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অফিসার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ গোটা সেনা বাহিনীকেই শত্রু মনে করতো। দলটি চাইত না, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী টিকে থাকুক এবং শক্তিশালী হোক।
কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি তাদের গভীর আস্থার কারণে জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জেনারেল জিয়াও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্যে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত প্রচারিত হয়েছিল যে, অফিসার হত্যার অভিযানে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। মূলত সেজন্যই জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব হয়নি। একথা সত্য, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করার কারণে কর্নেল তাহেরকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসীতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে সম্ভাবনার অন্য দিকটি ছিল অনেক বেশি মারাত্মক। তাহেররা যদি সফল হতেন তাহলে জিয়াউর রহমানসহ শত শত অফিসারকে প্রাণ হারাতে হতো। দেশের সশস্ত্র বাহিনীও নির্মূল হয়ে যেতো।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্য বাকশালের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাকে সরানোর বা সরকার পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থাই সংবিধানে রাখা হয়নি। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধে তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লিগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার অন্য এক অবদান ছিল শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা করলেও জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রূপী, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলি। কিছু গ্রেনেডও পাওয়া গিয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার পরীক্ষা ও ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো বাজিয়ে বাজিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া (৩০ মে, ১৯৮১)। এখানে ১৭ মে এবং ৩০ মে- এই তারিখ দুটির মধ্যকার ব্যবধান লক্ষ্য করা দরকার। প্রথম তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দ্বিতীয় তারিখে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কুটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। জিয়াকে তাই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ নেই। কারণ, দেশের রাজনীতিতে তিনি মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটাননি। বড় কথা, শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রীদের সমন্বয়ে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি বরং একই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া জিয়াও যে মোশতাককে ভালো চোখে দেখতেন না, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তীকালে। জিয়ার আমলে খন্দকার মোশতাক গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন দীর্ঘদিন। সুতরাং এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, মোশতাকের সঙ্গে মিলে জিয়াউর রহমান চার নেতাকে হত্যা করেছিলেন। তাছাড়া, আগেও বলা হয়েছে, চার নেতাকে হত্যার সময় জিয়া নিজেও গৃহবন্দী ছিলেন। সত্য ও প্রমাণিত এ ইতিহাসের কারণেই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং তার মতো একজন দেশপ্রেমিক সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। না হলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিও চরম অন্যায় করা হবে।
শুরুতেই বলা দরকার, ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে একবার বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেন, এরশাদ এই ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং শেখ মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া তাই বলে ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নভেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। বহুদিন পর এদেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্য গড়ে ওঠার বিষয়টিও ছিল এক অসাধারণ ঘটনা। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও সেটাই ঘটেছিল। নিজেদের তাগিদেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন আর সে কারণেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধবংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি। সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দী করা হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থক- এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। কয়েকদিন পর্যন্ত অফিসাররা পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবেই জানা গেছে, বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করেছিল। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ছিল। কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীরউত্তম। কর্নেল তাহের নিজেকে বঞ্চিত মনে করতেন। তার এ মানসিক বৈকল্যেরই সুযোগ নিয়েছিল জাসদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে তারা এমনভাবেই অফিসার হত্যা চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু জাসদের মাধ্যমে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু ধরে নেয়া যায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো। পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া ভারতের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ংকর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র- যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদসহ বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সে বছরের ১৫ আগস্ট বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অফিসার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ গোটা সেনা বাহিনীকেই শত্রু মনে করতো। দলটি চাইত না, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী টিকে থাকুক এবং শক্তিশালী হোক।
কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি তাদের গভীর আস্থার কারণে জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জেনারেল জিয়াও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্যে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত প্রচারিত হয়েছিল যে, অফিসার হত্যার অভিযানে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। মূলত সেজন্যই জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব হয়নি। একথা সত্য, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করার কারণে কর্নেল তাহেরকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসীতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে সম্ভাবনার অন্য দিকটি ছিল অনেক বেশি মারাত্মক। তাহেররা যদি সফল হতেন তাহলে জিয়াউর রহমানসহ শত শত অফিসারকে প্রাণ হারাতে হতো। দেশের সশস্ত্র বাহিনীও নির্মূল হয়ে যেতো।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্য বাকশালের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাকে সরানোর বা সরকার পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থাই সংবিধানে রাখা হয়নি। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধে তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লিগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার অন্য এক অবদান ছিল শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা করলেও জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রূপী, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলি। কিছু গ্রেনেডও পাওয়া গিয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার পরীক্ষা ও ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো বাজিয়ে বাজিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া (৩০ মে, ১৯৮১)। এখানে ১৭ মে এবং ৩০ মে- এই তারিখ দুটির মধ্যকার ব্যবধান লক্ষ্য করা দরকার। প্রথম তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দ্বিতীয় তারিখে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কুটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। জিয়াকে তাই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ নেই। কারণ, দেশের রাজনীতিতে তিনি মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটাননি। বড় কথা, শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রীদের সমন্বয়ে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি বরং একই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া জিয়াও যে মোশতাককে ভালো চোখে দেখতেন না, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তীকালে। জিয়ার আমলে খন্দকার মোশতাক গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন দীর্ঘদিন। সুতরাং এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, মোশতাকের সঙ্গে মিলে জিয়াউর রহমান চার নেতাকে হত্যা করেছিলেন। তাছাড়া, আগেও বলা হয়েছে, চার নেতাকে হত্যার সময় জিয়া নিজেও গৃহবন্দী ছিলেন। সত্য ও প্রমাণিত এ ইতিহাসের কারণেই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং তার মতো একজন দেশপ্রেমিক সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। না হলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিও চরম অন্যায় করা হবে।
আহমদ আশিকুল হামিদ :
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন