সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫

দেশটাকে যেন কুরুক্ষেত্র বানানো হচ্ছে


কুরুক্ষেত্র মহাসমর! খৃস্টপূর্ব ৪ হাজার বছর আগের ঘটনা। মহাভারতে বর্ণিত প্রাণঘাতী ও আত্মঘাতী মহাযুদ্ধ! পান্ডব ও কৌরব পক্ষ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ। কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ঘটনাটা পৌরাণিক হলেও এর আবেদনটা কিন্তু সর্বব্যাপী। কারণ, সৃষ্টির আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ ধরনের প্রাণঘাতী মহাসমরের কথা আর কখনো শোনা যায়নি; কোন রূপকথায়ও নয়।
যুদ্ধ বিরল ঘটনা নয়। প্রাচীন যুগে রাম-রাবনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। বৌদ্ধদের রাজা অশোক যুদ্ধ করেছিলেন কলিঙ্গে। খৃস্টান রাজা কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট তার নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে রোম দখল করেছিলেন। কিন্তু কোন যুদ্ধের ভয়াবহতা কুরুক্ষেত্রের মত ছিল না।
কুরুক্ষেত্র সমরটা কৌবর পক্ষের দুর্যধন আর পঞ্চপান্ডবের মধ্যে হয়েছিল। ক্ষমতার উষ্ণপরশ পাওয়ার জন্য এ মহাসমর সংঘটিত হলেও এর পরিণাম কিন্তু হয়েছিল খুবই ভয়াবহ। কারণ, এই যুদ্ধটা এমনই এক প্রাণঘাতী যুদ্ধ ছিল যে, যখন এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তখন একমাত্র পঞ্চপান্ডবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জীবিত ছিলেন না। যে ক্ষমতার জন্য এই প্রাণঘাতী মহাসমর, যুদ্ধ শেষে সে ক্ষমতা চর্চার কোন জায়গা রইল না ধরাধামে। একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে হিমালয় পর্বতের গাত্র ধরে জীবিতাবস্থায় স্বর্গারোহন করলেন। স্বর্গলোকই যদি ধর্মরাজের গন্তব্য হবে, তবে মর্ত্যলোকের ক্ষমতার জন্য এই প্রাণঘাতী মহাসমরটার সার্থকতা কোথায়?
এসব পৌরানিক কাহিনী। অতি সনাতনী ঘটনা। এর মধ্যেই ভাগিরথীতে অনেক জল বয়ে গেছে। মানুষের সনাতনী চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাসের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনও এসেছে। কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে সভ্যতার সূচনা এবং তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মানুষ ন্যায়-অন্যানের সংজ্ঞায়ন ও সংবিধিবদ্ধ পন্থায় তার প্রতিকারের সুসম নিয়ম তৈরি করেছে। ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি পরিহার করে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন হয়েছে। মানুষ এসবের সুবিধাও ভোগ করছেন। সভ্যতা কিন্তু থেমে নেই বরং তা ক্রম-অগ্রসরমান, চলৎশক্তি সম্পন্ন এক স্বত্তা হিসাবে আবির্ভূত। যা স্থিতিশীল নয় বরং গতিশীল!
সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেলেও আমরা বোধ হয় খুব একটা অগ্রসর হতে পারিনি। ক্ষমতা চর্চার ধরনে বিশ্বময় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও আমরা বোধ হয় সেই পৌরানিক ও প্রস্তর যুগের নিগঢ়েই আটকা পড়ে আছি। যে বৃত্ত থেকে আমরা বেড়িয়ে আসতে পারছি না।
দেশে রাজনৈতকি সংকট চলছে। ক্ষমতার পালা বদল ও নির্বাচন ব্যবস্থা সর্বজনগ্রাহ্য করার একটা দাবিও আছে সর্ব মহলে। কিন্তু যারা এখন ক্ষমতা চর্চা করছেন তারা এ দাবিকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন। যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা মানসিকতা কাজ করছে তাদের মধ্যে। তাই চলমান এই রাজনৈতিক সংকটকে তারা দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে বলে বিশ্বাস করানোর প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু সকল পক্ষই যদি একটু আন্তরিক হয় তাহলে কথিত এ যুদ্ধাবস্থা এড়ানো খুবই সম্ভব। কিন্তু এ জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে এ বিষয়ে আপাতত কোন সুসংবাদ তাদেরকে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রও উদ্যোগী হয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে না। মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বিধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলীর আওতাভূক্ত। কিন্তু রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে উদাসীনই মনে হচ্ছে।
রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যাপক উইলোবি (Willoughby)  বলেন, (It is admitted by all that state should possess powers sufficiently extensive for the maintenance of its own continued existence against foreign interference, to provide the means whereby its national life may be preserved and developed and to maintain internal order including the protection of life, liberty and property.)
অর্থাৎ এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, রাষ্ট্রের আয়ত্তে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত যার দ্বারা রাষ্ট্র বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে, জাতীয় জীবনকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পতি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধান করতে পারে। 
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ১০ জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। যদিও দেশে ও বিদেশে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষমতাসীন ও সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েছে। জাতীয় সংসদ থেকে টিআইবির কার্যক্রম স্থগিত করার কথা বলেছেন একজন সাংসদ। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীও টিআইবিকে একহাত নিয়েছেন।
গত ৯ নভেম্বর দশম সংসদের অষ্টম অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছেন, এই সংসদ থেকে (ইফতেখারুজ্জামান) তিন দিনের সময় দিতে চাই। অবিলম্বে তিনি ক্ষমা চাইবেন। জীবনেও কোন দিন সংবিধান এবং পার্লামেন্ট নিয়ে কথা বলবেন না-এই অঙ্গীকার করলেই আমরা কেবল মেনে নেব’।
দেশের সংবিধানের অন্যমত মূলনীতি যখন গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রে যখন বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত তখন বাবু সেনগুপ্তের জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বোধ হয় থেকেই যাচ্ছে।
অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথার বলারই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ত্রুতি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলায় এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে উস্মা প্রকাশ করেছে সরকার। তাদের ভাষায়, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। গত ৬ নভেম্বর লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মকর্তা এই বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে একটি নোট হস্তান্তর করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বিদেশীদের ‘নাক’ না গলাতে বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে দেশের মানুষই চিন্তাভাবনা করবে। এ ব্যাপারে আপনারদের নাক না গলালেও চলবে’। কিন্তু দেশের মানুষকে এ বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ বা স্বাধীনতা কি পাচ্ছেন? যদি পেতেন তাহলে এ কথার যৌক্তিকতা থাকতো। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এমন অনাকাঙ্খিত মন্তব্য সর্বগ্রাসী মনোভাবেরই পরিচয় বহণ করে। এ বিষয়ে কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কালকেতু উপাখ্যান’ এর রাক্ষস রাজ কালকেতুর সাথে তুলনীয়। কবি কঙ্কন রাক্ষসরাজ কালকেতুর বর্ণনা দিয়ে গিয়ে বলেন,
মোঁচারিয়া গোঁফ দুইটা বান্ধিলেন ঘাড়ে
এক শ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজারে
আশি মন মহাবীর খায় খুদ জাউ.....
সরকার পক্ষ হয়তো রাক্ষসরাজ কালকেতুর মতই সর্বভুক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কোন কিছুতে কাউকে ভাগ দেয়ার কথা চিন্তাই করতে পারছে না। কিন্তু রাক্ষসরাজ হওয়ার স্বপ্নটা কতখানি বাস্তব সম্মত তাও তাদেরকে বারবার ভেবে দেখা উচিত।
গণতন্ত্র সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ। পরমত সহনশীলতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কতিপয় অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের দেশের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে দেশের এসব সাংবিধানিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক ৩ ধরনের অধিকার ভোগ করবে-১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো :
সামাজিক অধিকার :
জীবন ধারনের অধিকার. ২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মতপ্রকাশের অধিকার, ৪ সভা-সমিতি করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।
রাজনৈতিক অধিকার :
ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনার করার অধিকার, ৫. চাকরি লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার।
অর্থনৈতিক অধিকার :
কাজের অধিকার, ২ উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার ক্রমেই অধিকরতর কর্তৃত্ব পরায়ন হয়ে উঠছে এবং দেশকে নিজেদের তালুক-সম্পত্তি মনে করছে। তারা নিজেদের অধিকার ছাড়া অন্য কারো অধিকারই স্বীকার করছে না। সরকার ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করেছেন বেশ আগেই। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দেশ কারো তালুক-সম্পত্তি নয়। সংবিধানের ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘Bangladesh is a unitary, independent, sovereign republic to be known as the Peoples Republic of Bangladesh.’
অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে।
শাসনকাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে নাগরিকরা দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেনা। গণতন্ত্রহীনতায় দেশ যেভাবেই  চলুক না কেন, দেশের অবস্থা যাইহোক না কেন, জনসাধারণ বিশেষ প্রভাবিত হয় না। কিন্তু গণতন্ত্রে সকলেই উপলব্ধি করে যে, দেশ তার নিজের। সরকার তাদের দ্বারাই গঠিত। দেশের উন্নতি তাদের উন্নতি। তাই দেশের উন্নতির জন্য সকলেই সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে ফরাসী বিপ্লবের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে ফরাসী লেখক লাভলে (Loveleye) বলেছেন, ‘The Fence people never began to love France until after the Revolution when they were admitted to a share in its  government since which time they have adored it.) অর্থাৎ ফরাসী জাতি বিপ্লবের পর থেকেই ফ্রান্সকে ভালবাসতে শিখেছে। কারণ, তখন থেকে তারা শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে তাকে গভীরভাবে ভালবাসতে শিখেছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদারনৈতিক গণতন্ত্রায়ন ও শাসনকাজে জনগণের সম্পৃক্ততাই চলমান সংকটের একমাত্র সমাধান। সে উপলব্ধি থেকেই হয়তো ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জাতীয় সংলাপের আহবান জানান বিএনপি’র চেয়ারপর্সন বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে দেশে ক্রান্তিকাল চলছে দাবি করে খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির স্বার্থে সংকট উত্তরণে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে সরকারকে একটি জাতীয় সংলাপের দাবি জানান। বেগম জিয়ার আহবানের প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত সংলাপের জন্য দুই শর্ত সংলাপের সম্ভবনাকে জটিল হবে জটিলতর করে তুললেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বেগম জিয়া বোধ হয়তো ‘অরণ্যেই রোদন’ করে ফেলেছেন। তিনি কি এখনও আশায় বুক বেধে আছেন যে, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে! প্রেক্ষাপট তো তা মোটেই সমর্থন করে না বরং মনসুর বয়াতির ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার মদিনার মত তাকে শেষ পর্যন্ত আশাহতই হতে হবে আপাতত। 
আমরা অবশ্য নৈরাশ্যবাদী নই বরং আশাবাদী। কিন্তু হালে যা চলছে তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।  গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বললেন. উনি (খালেদা জিয়া) বলুক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন করেন। উনি বলুক-যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে। যেদিন উনি বলবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত, সেদিন উনি সংলাপে বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
এক সময় সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে সে কথাটা আনান ওনার মুখ থেকে, তাদের ( জামায়াত ) সঙ্গ ছাড়তে বলেন। তারপর ভেবে দেখা যাবে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘ খালেদা জিয়া ভাঙ্গচুর পরিহার করলে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরিবেশ না থাকলে কোন আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না। যুদ্ধের সময় কোন আলোচনা হয় না। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাধারণ নির্বাচন চাই।
আসলে দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে না রাজনৈতিক সংকট-এটি আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। যার যুদ্ধ হলে সরকার কার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ? দেশ কি বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত ?  জাতীয় সংসদ কি সরকারকে কারো সাথে যুদ্ধ করার সম্মতি দিয়েছে ?  সংবিধানের ৬৩ ধারায় সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘War shall not be declared and the Republic shall not participate in any war except with the assent of Parliament.’ অর্থাৎ সংসদের সম্মতি ব্যতিত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাইবে না কিংবা প্রজাতন্ত্র কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশে যুদ্ধাবস্থার কথা বলছেন। আসলে দেশে কোন যুদ্ধাবস্থা নয় বরং রাজনৈতিক সংকট চলছে। এই সংকট সৃষ্টিতে ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ভূমিকায় দায়ি। মূলত চলমান এই সংকটকে যুদ্ধাবস্থার সাথে তুলনা করা মোটেই সঙ্গত হবে বলে মনে হয় না। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি অর্থবহ সংলাপ এবং সকলের অংশ গ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সংলাপের প্রশ্নে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা যে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছেন তাতে সংলাপের কোন সম্ভবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাদের বক্তব্য একথা সুষ্পষ্ট যে, যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার শুধুই তাদের। তারা না চাইলে কোন কিছুই সম্ভব নয়। সরকার ও জনগণের সম্পর্ক এখন প্রভূ-ভৃত্যের। তাই প্রভূর মর্জিমতই ভৃত্যকে চলতে হবে। এটাই স্বতসিদ্ধ নিয়ম। জনগণের উপর এমন প্রভূসুলভ আচরণ আর যাইহোক দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব, গণগ্রেফতারে দেশে-বিদেশে সমালোচনায় কঠিন সময় পার করছে সরকার। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের ফাঁসির রায় কার্যকর, দন্ড কার্যকর নিয়ে জাতিসংঘসহ  বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বগ, দেশজুড়ে একের পর এক বিদেশী নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যা, ‘ তথাকথিত’ আইএস নিয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর চাপ, দেশজুড়ে গণগ্রেফতার এবং ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধে জনমনে নেতিবাচক প্রভাবসহ নানা ইস্যুতে খুব অস্থির সময় পার করছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে  ২০ দলীয় জোট নেত্রী  বেগম খালেদা জিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে দেশে ফেরা ও নিরবতা অস্বস্তিতে পড়েছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। কিন্তু সরকার চলমান সংকট মোকাবেলায় গঠনমূলক, ইতিবাচক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। গণমাধ্যমের উপর অতিমাত্রায় কড়াকড়ি আরোপ, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দন্ড কার্যকর নিয়ে জাতিসংঘ মন্তব্য করায় সরকার বিব্রত বোধ এবং এটিকে ‘ হাইলি ডিস্টার্বড’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘উৎকৃষ্ট জীবন লাভের জন্য কোন সমাজের সংগ্রামের নাম হচ্ছে রাজনীতি’। কিন্তু সরকারের সর্বগ্রাসী অপরাজনীতির কারণে দেশের প্রথিতযথা রাজনীতিকরা কল্পিত ও তুচ্ছ অভিযোগ বছরের পর বছর কারা নির্যাতন ভোগ করছে। বাদ যাচ্ছেন না শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্ম পর্যায় পর্যন্ত। বিরোধী দল বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ২১ হাজার ৬৮০টি মামলা হয়েছে। আর জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার পরিসংখ্যান দেয়া খুবই কষ্টসাধ্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচীব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমলীগের বিরুদ্ধে ৮৬ টি মামলা রয়েছে। এক যুবনেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩০টি। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, রাজনৈতিকভাবে হয়রানী করার জন্য এসব মামলা দেয়া হচ্ছে।
এখনো নির্বিচারে গণগ্রেফতারও চালানো হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে সারা দেশে ৮ হাজারেরও বেশী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এ গণগ্রেফতার এখনও অব্যাহত আছে। তা কাহা তক চলবে আল্লাহ মালুম।  কিন্তু দেশকে কুরুক্ষেত্র বানানোর মধ্যে সরকারের কোন কল্যাণ আছে বলে মনে হয় না।
সরকারের ক্ষমতা চর্চার কাঁচামাল হয়ে যদি সবকিছুই শেষ হয়ে যায় তাহলে ধর্মরাজেরা ক্ষমতার চর্চা করবেন কোথায় ? এ কথা যত তাড়াতাড়ি তারা উপলব্ধি করতে পারবেন ততই তাদের জন্যই মঙ্গল।
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads