রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫

দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন


হঠাৎ দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন এসে হাজির হলো ধীর পায়ে আগুয়ান শীত শীতের সঙ্গে সঙ্গে। দেশের উত্তরের এলাকাগুলোয় শীত বেশ জাঁকিয়ে এসেও গেছে। শহরের যান্ত্রিক উত্তাপে ঠিকমতো টের পাওয়া না গেলেও গ্রাম-বাংলায় শীতের আগমন স্পষ্ট। কুয়াশার চাদর আর হিমেল হাওয়া ঘিরে আসছে চারদিক থেকে। এরই মাঝে নির্বাচনী উত্তাপও ছড়াচ্ছে। শীতের ছোঁয়া আর রাজনীতির উত্তাপের সমীকরণেই এখন এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ।
পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভোটের হাওয়া লেগেছে মাঠে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ঘিরে ঠিক করছে কর্মকৌশল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে এ নিয়ে বৈঠক করেছেন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। তারা কিছু সীমিত দাবি জানিয়েছে, যার মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য সামান্য সময় চাওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও সংসদীয় বোর্ড নির্বাচন প্রসঙ্গে বসে নেই। আবার রাজনীতির মাঠ-ময়দান ভোটের তরঙ্গে দোলায়িত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদিও কাউন্সিলর পদগুলোয় আগের মতোই নির্দলীয় নির্বাচন হবে। মেয়র পদে বহুদিন পর নৌকা-ধানের শীষ লড়াই দেখা যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত মাঠ পুরোটাই আওয়ামী লীগের দখলে। বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের একটি বড় অংশ রয়েছেন কারাগারে। বাকি একটি অংশ আত্মগোপনে। প্রকাশ্যে রয়েছেন কমই। জামায়াতের অবশ্য দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ হাইকোর্টের রায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। স্বতন্ত্র অথবা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করছে জামায়াত। জাতীয় পার্টিও এরই মধ্যে নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় জাতীয় পার্টির তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশন দেশের ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরিস্থিতি ক্রমেই ভোটমুখী হয়ে উঠছে। তবে নতুন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেনি নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে এলে দল ও প্রার্থীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আচরণবিধিসংক্রান্ত বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়ার দরকার হবে। কোনোভাবেই ভোটের আমেজকে উত্তেজনা ও বিদ্বেষের স্তরে যেতে দেয়া মোটেও সমীচীন হবে না।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটি ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেও নির্বাচনমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দলটির মতে, তাড়াহুড়ো করে পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় দলীয় প্রস্তুতির বিষয়েও কথা হয়। তবে সরকারি দলের কারচুপি, কেন্দ্র দখলসহ ভোট ডাকাতি হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন দলের অধিকাংশ নেতা। পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে খালেদা জিয়াও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
গ্রামভিত্তিক বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচন সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় নির্বাচনে মানুষ যেমন উৎসবমুখর থাকেন, তেমনি শঙ্কায়ও আক্রান্ত হন। অতীতে এ নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও আসলে সেটাতেও দলীয় ছোঁয়া থাকতো। এবার সেটা প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য হয়েছে। এতে লাভ না ক্ষতি হয়েছে, সেটা মূল্যায়ন করা যাবে ভোটের পর।
ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের নিরাপত্তাকে প্রথম ও প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণও সুনিশ্চিত করতে হবে- যাতে উদার ও ভয়হীনভাবে সবাই নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। বিশেষত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ ও দূরত্ব চলছে, সেটাও কমানোর চেষ্টা করতে হবে। বিরোধীরা অধিকারহীনতার যে অভিযোগ করে আসছেন, সেটা যেন বাস্তবে দেখা না যায়। সব দলের অবাধ ও মুক্ত অংশগ্রহণের প্রাণবন্ত নির্বাচনই সবার কাছে কাম্য। এতে দেশে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হওয়ার কাজটিই জোরদার হবে এবং দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মুখচ্ছবি উজ্জ্বলতর হবে।
এ কথা সত্য যে, সাম্প্রতিক অতীতে নানা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সেখান থেকেই মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেশের বাইরেও সরকারের ব্যাপারে সমালোচনার অভাব নেই। ফলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে রাজনীতির বাইরের অর্থনৈতিক অবস্থাও সমস্যার বাইরে নেই। গার্মেন্ট সেক্টরের অবস্থা খুবই খারাপ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে সর্বসাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংঘাতের বাইরে গণতন্ত্রের যত পরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলোকেই ব্যবহার করা দরকার। নির্বাচন এক্ষেত্রে একটি বড় উপায়। এই উপায়টিকে পৌর নির্বাচনের সময় গণতান্ত্রিক ও আইনানুগভাবে প্রয়োগ করে সবার জন্য সমান সুযোগ ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচন যেন অবশ্যই অবাধ, চাপমুক্ত ও সবার নিরাপদ অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।
পাশাপাশি নির্বাচসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য সংলাপের মতো একটি গণতান্ত্রিক উদ্যোগ এই নির্বাচন সামনে রেখে চলতে পারে, যাতে দলগুলোর বিভেদ ও দূরত্ব ঘুচবে, সংঘাতের রাজনীতি ফিরে পাবে শান্তির দিশা। সংঘাতহীন পরিবেশ সৃজন করে গণতান্ত্রিক সহাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন ও সংলাপসহ আরো অনেক গণতান্ত্রিক উদ্যোগ সাদরে আমন্ত্রিত হওয়াই দরকার। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন নিরাশা ও উত্তেজনার বাইরে এসে এমন গণতান্ত্রিক উদ্যোগই আশা করছে। আশা করে রক্তপাতহীন, উৎসবমুখর, অংশগ্রহণে ভরপুর নির্বাচন।
বিশেষত প্রধান দলগুলো দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলনের মাঠে থেকে যথেষ্ট গণভিত্তি তৈরি করেছে। কারণ আন্দোলনের সঙ্গে জনসমর্থন সংশ্লিষ্ট। এখন সেই জনসমর্থনকে ভোটের বাক্সে পাঠাতে দলগুলো কী কৌশল গ্রহণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশে; বিশেষত ক্ষমতার পালাবদলের সময় বা কোনো রাজনেতিক ইস্যুতে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সেই সমস্যা তীব্রতরভাবে আবির্ভূত হয়। শুরু হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচ- লড়াই। মনে হয়, সবাই যেন ওঁৎপেতে থাকে এই সময়ের জন্য। আগেভাগে সমস্যার সমাধানের কথা কানেই তোলা হয় না। এই যে নামমাত্র বিরোধী দলের উপস্থিতি, সরকার ও প্রধান প্রধান বিরোধী দলের দূরত্ব, সেটা কমানোর উদ্যোগ, সংলাপ ও আলোচনার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি অতীতে। এবার বেগম জিয়ার দল নির্বাচনে এলে তাদের সঙ্গে যথাযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দূরত্ব ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে সরকার বা বিরোধী কারোই লাভ হবে না; জনগণের দুর্ভোগ কমবে না। গণতান্ত্রিকতার পরিবেশও সম্প্রসারিত হবে না। এভাবে দূরত্ব বাড়ানোর ফলে সমাধানের পথটিও থেকে যাবে অধরা। এ পরিস্থিতি কাম্য নয়, শুভ নয়, কল্যাণকর নয়। বুদ্ধিমান-বিবেকী মানুষের কাজ হলো শান্তি ও কল্যাণের পথ সন্ধান করা; সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করা। এতেই সবার মঙ্গল। পৌর নির্বাচন সামনে রেখে যে ভোটের আমেজ ও নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়েছে, সেটাকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পথে নিয়ে যেতে সম্ভাব্য সবকিছু করার জন্য সব পক্ষকে সচেষ্ট থাকতে হবে। অতীতের ভুল ও ভ্রান্তির যেমন পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়, তেমনি অতীতের হিংসা-বিদ্বেষও নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসা উচিত হবে না। নতুন উদ্যমে গণতন্ত্রের পথে নবঅভিযাত্রাই প্রত্যাশিত দেশ-বিদেশের সবার কাছে। এই কথাটি সংশ্লিষ্টরা মনে রাখলেই একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক পৌর নির্বাচন আশা করা যায়।
আন্দোলনে আন্দোলনে অনেকগুলো বছর পাড়ি দেয়া বিরোধী নেতাকর্মীরা পৌর নির্বাচনকে সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। আবার যেহেতু বিষয়টি নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক স্তর পেরিয়ে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে পরিণত হচ্ছে, সেহেতু রাজনৈতিক শক্তি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে এই নির্বাচনে। ফলে বিষয়টি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। নির্বাচনে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে বিজয় অর্জন করলে সেটা যেমন সরকারের জনপ্রিয়তার নিম্নগামিতার প্রমাণ হবে, তেমনি নির্বাচনে বিরোধীরা সঠিক সুযোগ না পেলে বা কারচুপির ঘটনা ঘটলে নতুন আন্দোলনের সূত্র তৈরি হবে। ফলে এই নির্বাচন নিছক পৌর নির্বাচন থাকছে না, জাতীয় রাজনীতির একটি প্রতিফলনে পরিণত হচ্ছে। বরং জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব তৃণমূল ও স্থানীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ারও একটা ঝুঁকি থাকছে। তাই সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচন যেন ত্রুটিযুক্ত হয়ে সমস্যার কারণ না হয়; বরং ত্রুটিমুক্ত হয়ে সমস্যার সমাধানের পথ দেখায়- সেটাই সবার কামনা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads