বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫

মিয়ানমারের নির্বাচন


গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সে দেশের নির্যাতিত নেত্রী অং সান সু চী’র দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিরাট বিজয় অর্জন করেছে। মঙ্গলবার থেকে প্রশ্নসাপেক্ষ কারণে ফলাফল ঘোষণা হঠাৎ ধীর হয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, এনএলডি সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার চাইতেও অনেক বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, কয়েক যুগ ধরে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এই ফলাফল এবং পরাজয় মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।  প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বলেছেন, তারা জনমতের প্রতি সম্মান দেখাবেন। সামরিক জান্তার সমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)-ও পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। ফলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং ফলাফল বাতিল করার মতো অন্য কোনো ঘটনা না ঘটলে সু চী’র দলই মিয়ানমারে সরকার গঠন করবে। এজন্য অবশ্য আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, সরকার গঠনের আগে নতুন পার্লামেন্ট প্রথমে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। সে পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ক্ষমতায় থাকবেন। সরকারও থাকবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপির। প্রসঙ্গক্রমে প্রাধান্যে এসেছে মিয়ানমারের সংবিধান। সামরিক জান্তার উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত ও পরিবর্তিত সংবিধানে পার্লামেন্টের উচ্চ ও নি¤œকক্ষের উভয়টিতে সেনাবাহিনীর মনোনীতজনদের জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। সে কারণে এবারের নির্বাচনে ৪৪০ আসনবিশিষ্ট নি¤œকক্ষের ৩৩০টিতে এবং ২২৪ আসনবিশিষ্ট উচ্চকক্ষের ১৬৮টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে মনোনয়ন দেবেন সেনাবাহিনী প্রধান। 
দেশটির সংবিধানের অন্য একটি নির্দেশনাও অং সান সু চী’র জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশী নাগরিকের স্ত্রী বা স্বামী এবং তাদের কোনো সন্তান মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, অং সান সু চী একজন ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করেছিলেন এবং তার দু’জন সন্তানও রয়েছে। সে কারণে যতো জনপ্রিয়তা ও সমর্থনই থাকুক না কেন, সু চীর পক্ষে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। সু চী অবশ্য এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টেরও ওপরে থাকবেন এবং কর্তৃত্ব করবেন। অর্থাৎ নিজে প্রেসিডেন্ট না হতে পারলেও রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা তার হাতেই থাকবে। বিষয়টি নিয়ে সঙ্গত কারণেই জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে। কারণ, সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কোনো পদ নেই। সু চী যদি কোনোভাবে সংবিধানের বাইরে চলে যান কিংবা তার বিরুদ্ধে যদি সংবিধান লংঘনের অভিযোগ ওঠে তাহলে অতীতের মতো সেনাবাহিনী আবারও হস্তক্ষেপ করবে এবং এনএলডি সরকারকে বিদায় নিতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও গৃহবন্দী সু চী’র দল এনএলডি জয়ী হয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা ওই ফালাফলকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে এনএলডি সরকার গঠন করতে পারেনি। পরবর্তীকালে ২০১২ সালের উপনির্বাচনের মাধ্যমে সু চীকে পার্লামেন্টে আসতে হয়েছে। গৃহবন্দীদশা থেকেও মুক্তি পেয়েছেন তিনি। 
দেশটির সাংবিধানিক বিধি-নিষেধসহ আরো কিছু জটিল বিষয় নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চললেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন। বলা হচ্ছে এবং আপাতদৃষ্টিতেও এটাই সত্য যে, নির্বাচন অবাধ হয়েছে। বড় কথা, এর মধ্য দিয়ে বহু বছর পর মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নতুন দরোজা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য সংশয় এখনো কাটেনি। কারণ, নির্বাচনের পরদিন সোমবার ফলাফল ঘোষণা শুরু করা হলেও মঙ্গলবার থেকে হঠাৎ গতি অনেক ধীর হয়ে গেছে। বুধবার পর্যন্ত মাত্র ২০ শতাংশ আসনের ফলাফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ধারণা করা হচ্ছে, এনএলডির নিরংকুশ বিজয়কে সহজে মেনে নিতে পারছে না বলেই সামরিক জান্তার নির্দেশে ধীর গতিতে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এর ফাঁকে কারচুপির আশংকাও ব্যক্ত করেছে এনএলডি। অমন আশংকা অমূলক না হলেও গণমাধ্যমের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, যতো কারচুপিই করা হোক না কেন অং সান সু চী বিজয়কে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হবে না। সরকারও তার দলই গঠন করবে। 
আমরা মনে করি, মিয়ানমারের এই নির্বাচন থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সতর্ক হওয়ারও কিছু কারণ। দেশটিতে ক্ষমতাসীন দল ইউএসডিপি শুধু পরাজয়ই স্বীকার করে নেয়নি, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনও অং সান সু চীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সামরিক জান্তার পক্ষ থেকেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য কোনো চেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, এনএলডির সরকার গঠন আসলে সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকেও তাই এখন থেকে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে এনএলডি সরকার যাতে নমনীয় ও মানবিক নীতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষ্যে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেও অন্য সব উগ্র বৌদ্ধবাদী দলের মতো অং সান সু চী নিজেও রোহিঙ্গা তথা মুসলমানদের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানেই রয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি এমনকি রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারণার বিরোধিতা পর্যন্ত করেছেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জন্যও তিনি সোচ্চার হননি। সে কারণে মোটেও আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই যে, সু কী’র নেতৃত্বে নতুন সরকার রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। এই সরকারের ওপরও বরং উগ্র বৌদ্ধবাদী দলগুলোর প্রভাব থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বরফ নাও গলতে পারে। সুতরাং সরকারের উচিত এখন থেকেই কৌশলী হওয়া এবং নতুন পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার ব্যাপারেও সরকারকে এখনই সক্রিয় হতে হবে বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads