বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫

এমআরপিতে পিছিয়ে পড়লো দেশ


২৪ নবেম্বর ছিল হাতে লেখা পাসপোর্টের শেষদিন। এখন আর হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে কোনো দেশে যাতায়াত করা যাবে না। এজন্য লাগবে এমআরপি বা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বা চুক্তিটি করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। জাতিসংঘের অধীনস্থ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের ২৪ নবেম্বরের মধ্যে সব দেশ এমআরপি প্রবর্তন করবে এবং এ সময়ের পর হাতে লেখা পাসপোর্টে কোনো দেশের নাগরিকই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্য সব দেশ এমআরপি প্রবর্তন করে ফেললেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পেড়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রবাসে বসবাসরত ১৫ থেকে ২০ লাখ বাংলাদেশী এখনো এমআরপি পাননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হিসাবে এমআরপি না পাওয়াদের সংখ্যা ১১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৭। অন্যদিকে পাসপোর্ট অধিদফতর বলেছে, তাদের সংখ্যা ২ লাখের বেশি হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মন্দ শোনায়নি। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানানো হয়েছে, হাতে লেখা পাসপোর্টধারীরা কেউ চাইলে তাকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ বাংলাদেশ মিশন থেকে একটি পাসপোর্ট বা ট্রাভেল পাস দেয়া হবে এবং সেটা দেখিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসতে পারবেন। ২৪ নবেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ ব্যক্তিকে এমআরপি দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে প্রবাসী কতজন রয়েছেন, সে হিসাব অবশ্য দেয়া হয়নি।
উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ- সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী চাকরি করছেন। বহু বছর ধরে এসব দেশে বসবাসও করছেন তারা। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে এমআরপি না পাওয়ায় বিপদেও পড়েছেন তারাই; তাদের প্রকৃত সংখ্যা যত কম আর বেশিই হোক না কেন। এমন অবস্থার কারণ জানাতে গিয়ে দায়িত্বশীল সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়, এ বিপুলসংখ্যক এমআরপি বাংলাদেশে তৈরি করা এবং যথাসময়ে অর্থাৎ ২৪ নবেম্বরের আগে প্রবাসীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার সম্ভাবনা প্রথম থেকেই ছিল না। কারণ অনেক উপলক্ষেই হিসাব করে দেখা গেছে, ৫৫টি দেশের মিশনে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১০/১৫ লাখের বেশি এমআরপি তৈরি করা যেত না। তার ওপর ছিল জনবল ও নতুন পাসপোর্টের সঙ্কট। বিদেশের মিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, দেশের ভেতরে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এমআরপি তৈরির কাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি হলেও বিদেশের মিশনগুলোর কর্মকর্তারা শুরু থেকেই অযোগ্যতা দেখিয়ে এসেছেন। তাছাড়া শুধু তৈরি করলে চলবে না, ২৪ নবেম্বরের মধ্যে প্রত্যেক প্রবাসীর কাছে এমআরপি পৌঁছে দেয়ারও দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আসলে সম্ভব ছিলও না। ওদিকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ পাওয়া বিদেশী কনসোর্টিয়ামের ব্যর্থতা ও প্রতারণাপূর্ণ কর্মকা-ের কথাও জানা গেছে খবরে। তথ্য সংগ্রহ থেকে ছবি তোলা ও স্বাক্ষর নেয়া পর্যন্ত কাজগুলো তো করেইনি, বরং চাহিদা অনুযায়ী পাসপোর্ট সরবরাহেও ব্যর্থ হয়েছে ওই কনসোর্টিয়াম। বলা দরকার, সময়মতো এমআরপি না পাওয়ায় প্রবাসীরা শুধু চাকরিই হারাবেন না, দেশে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও বাধাগ্রস্ত হবেন। অনেককে এমনকি কারাগারেও যেতে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনোভাবেই আশান্বিত হওয়ার মতো নয়। এর মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে ‘তাৎক্ষণিক’ ব্যবস্থা নেয়ার গালগল্প শোনানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে এমআরপিকেন্দ্রিক পরিস্থিতি যে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমআরপি না থাকায় বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকমাত্রকেই কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে। ওদিকে বিপদে পড়বেন বিশেষ করে প্রবাসীরা। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের গাফিলতি। কারণ ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এমআরপি তৈরির প্রকল্পই শুরু হয়েছে দীর্ঘ ১৮ বছর পর, ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে। এমআরপি যে বাধ্যতামূলক, সে ঘোষণা দিতেও সরকার অনেক দেরি করেছে। ফলে সাধ্য এবং আগ্রহ থাকলেও প্রবাসীদের পাশাপাশি অন্য নাগরিকরাও অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। নানা কাজে বিদেশে যাতায়াত করেন- এমন অনেকেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এমআরপি করে উঠতে পারেননি। অথচ সরকার যদি যথেষ্ট সময় থাকতে উদ্যোগ নিত এবং জনগণকে অবহিত করত তাহলে জটিলতা ও সমস্যা এড়ানো সম্ভব হতো। তেমন অবস্থায় প্রবাসীসহ অন্য নাগরিকরাও আগে থেকে সচেষ্ট হতেন। এজন্যই সরকারের পক্ষে দায়দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না।
আমাদের মতে, বর্তমান পর্যায়ে বেশি দরকার প্রবাসীসহ সব আগ্রহী নাগরিকের জন্য এমআরপি সরবরাহের তৎপরতা জোরদার করা। দেশের ভেতরে জেলা ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পাসপোর্ট অফিসগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে হবে, জনবল বাড়াতে হবে কয়েকগুণ। নতুন পাসপোর্টের সঙ্কটও দূর করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোকে এমনভাবে সক্রিয় করতে হবে, যেন প্রবাসীরা স্বল্পসময়ের মধ্যে এমআরপি হাতে পেতে পারেন- যাতে কথিত ‘তাৎক্ষণিক’ ব্যবস্থার জন্য হাপিত্যেশ না করতে হয়। এ ব্যাপারে বিলম্ব, নিষ্ক্রিয়তা বা ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ যাতে না ওঠে, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া ঠিক কোন কোন মহলের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ এমআরপির ক্ষেত্রে এত বেশি পিছিয়ে পড়েছে, তারও তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads