বর্তমান সরকার যেমন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তেমনি তাদের সকল কর্মকাণ্ডেও আছে মিথ্যারই প্রাধান্য। অতীত ইতিহাস নিয়ে যেমন তারা অবিরাম মিথ্যাচার করে, তেমনি সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়েও তারা ডাহা মিথ্যা বলতে কসুর করে না। আবার একটি মিথ্যা কথা প্রতিষ্ঠিত করতে শতটা মিথ্যা কথা বলতে হয়। ফলে সকালের কথার সঙ্গে বিকালের কথার কোনো সঙ্গতি থাকে না। একজনের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথার কোনো মিল পাওয়া যায় না। এভাবে এক ঘোরের মধ্যে চলছে সরকার। কিন্তু তারা উপলব্ধিই করতে পারছে না যে, জনগণ আসল সত্যটি বেছে নেয়। তারা জানে, কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা।
সরকার এমনই এক মিথ্যার নাটক করলো গত শনিবার মধ্যরাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে। দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সরকার এর আগেও জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে।
এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরই যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্ষুদ্র দল ছিল। তার চেয়ে অনেক বড় দল ছিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি রাজনৈতিক দল। তারপরও বিশেষভাবে জামায়াতকে অভিযুক্ত করায় প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জামায়াতকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা পাকিস্তানীদের সহায়তা করেছিল, তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালেই জারি করা হয়েছিল দালাল আইন। তাতে লক্ষাধিক লোককে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির বিভক্তি এড়াতে ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। একথা মানতে হবে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে সাধারণ মানুষের কেউ পাকিস্তানের অবলুপ্তি চাননি। আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যও ছিল স্বায়ত্তশাসন আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর একগুঁয়েমির কারণে ২৫ মার্চ (১৯৭১) পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ। যদিও এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় নেতাদের অনেকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা তা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু ভুট্টো বিশেষভাবে বিরোধিতা করায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
দালাল আইন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই। তখন সবার কাছে সে স্মৃতি টাটকা ছিল। কে কী করেছে, না করেছে, প্রত্যেকে তা দেখেছেনও। যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হতো, তাহলে সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের একটি অভিযোগও কেউ দায়ের না করায় আইনটি রদ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৩৬ বছর পর নতুন করে শুরু করা হয় যুদ্ধাপরাধের মামলা, যখন সকল স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। এরপর দেয়া শুরু হয় একের পর এক মৃত্যুদণ্ড।
এর আগেও যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, তাদের কেউই প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। যদিও সংবিধানে আবেদন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলেই যে কাউকে যে কোনো দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করতে পারেন। সেভাবেই কোনো আবেদন বা আত্মসমর্পণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট এক আওয়ামী নেত্রীর ছেলের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছিলেন। যদিও এ ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট সার্বভৌম নন। এ জন্য তার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে। আর জামায়াত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর যে মনোভাব তাতে স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, এদের দণ্ড মওকুফ বা হ্রাসের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই এবং ছিলও না।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ক্ষমাপ্রার্থনার এক দুর্বল প্রহসন অনুষ্ঠান করলো। কাজটা এতই কাঁচা ছিল যে, একজন বালকও বুঝতে পারবে, এটা সত্য নয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন শনিবার সকালের দিকে কারাগারের ভেতরে ঢুকলেন দুজন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর থেকে সরকার প্রচার চালাতে থাকলো যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন, তার মুসাবিদা করতে গেছেন ঐ দুই ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর ঐ দু’জন যখন ফিরলেন, তখন সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ কোনো প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা। জবাবে একটি কথাও না বলে চলে যান তারা। প্রচার করা হলো তারা প্রাণভিক্ষার মুসাবিদা করতে গেছেন। তা হলে ফেরার সময় কেন তারা বলতে পারবেন না যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা।
এর আগে শুক্রবার দণ্ডিত ঐ দুজনের আইনজীবীরা তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার আবেদন করেন। কারা ফটকে অপেক্ষা করেন। আবেদনপত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও সরকারে যুক্তি ছিল বড় অদ্ভুত। প্রতিবারই কারাকর্তৃপক্ষ জানান যে, কারাগারে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাজির নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির ছিলেন না, কিন্তু তারা টেলিফোন দূরত্বের বাইরে ছিলেন না। নিম্নতর কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানাতে পারতেন, আইনজীবীদের ভেতরে যেতে দেয়া হবে কি হবে না।
আসলে সরকার যে নাটক মঞ্চস্থ করতে মনস্থ করেছিল, আইনজীবীরা দণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললে সে নাটক ভেস্তে যেত সহজেই ও বেশ আগেই। সে কারণেই ঠুনকো কথা বলে আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়নি তারা। এরপর সরকার প্রচার করতে শুরু করলো যে, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সরকারের এই রটনা কেউই বিশ্বাস করেনি। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তার আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়া হোক, আর সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদের সঙ্গে কথা বলে এসে তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাক প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে প্রাণভিক্ষা ও প্রেসিডেন্টের তা নাকচের যুক্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে গেছে।
আইনজীবী ও সাংবাদিকরাও বিশ্বাস করেননি যে, তারা দু’জন প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। বিশ্বাস করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সে আবেদনের কপি দেখতে চান। বিপত্তি বাধে তখনই। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন দেখানো যাবে না। তা দেখাতে হলে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। তারা যে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।’
আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই দিন বলেন, ঐ দুজনের প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তারা দু’জনেই সংবিধানের আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সেই আবেদনের লিখিত ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে। তবে এগুলো সিক্রেট বিষয়, দেখানো যাবে না। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র, চিঠিপত্র আমাদের কাছে আছে। এরপর তিনি এক মেঠো যুক্তি খাড়া করেন। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তার বাবার জন্য সব জায়গায় গেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তারা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এ সম্পর্কে পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। পরে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এক মন্ত্রী ফাঁসি কার্যকর করা ঐ দু’জনের ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠিটি প্রকাশের কথা তোলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠি প্রকাশের কিছু নেই। আমাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে।
ফাঁসি কার্যকর করার আগে ঐ দু’জনের পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মতো দেখা করার জন্য কারাগারে ডেকে নেয় জেল কর্তৃপক্ষ। সেখানে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পরিবার বিশেষ করে ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমার ৬ ফুট ২ ইঞ্চি বাবা কারও কাছে মাথা নত করে না। মার্সি যদি চাই, আল্লাহর কাছে চাইবো, বান্দার কাছে নয়।’ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার পরিবারকে জানান, তিনি কোনো মার্সি পিটিশন করেননি। ‘এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য, কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্যা অপপ্রচারের নাটক করছে।’
লক্ষণীয় যে, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারও কথার সঙ্গে কারও কথার মিল নেই। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে, প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে, তারা সংগোপনে আবেদন করেছেন, কিন্তু পরিবারের কাছে তা লুকিয়ে গেছেন। বড় সাংঘাতিক অভিযোগ। আর তাই তথাকথিত প্রাণভিক্ষার ঐ আবেদন দুটি অবিলম্বে প্রকাশ করা জরুরি। তা না হলে সরকারকে মানুষ মিথ্যাচারের অপবাদ দিয়েই যাবে।
সরকার এমনই এক মিথ্যার নাটক করলো গত শনিবার মধ্যরাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে। দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সরকার এর আগেও জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে।
এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরই যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্ষুদ্র দল ছিল। তার চেয়ে অনেক বড় দল ছিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি রাজনৈতিক দল। তারপরও বিশেষভাবে জামায়াতকে অভিযুক্ত করায় প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জামায়াতকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা পাকিস্তানীদের সহায়তা করেছিল, তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালেই জারি করা হয়েছিল দালাল আইন। তাতে লক্ষাধিক লোককে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির বিভক্তি এড়াতে ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। একথা মানতে হবে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে সাধারণ মানুষের কেউ পাকিস্তানের অবলুপ্তি চাননি। আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যও ছিল স্বায়ত্তশাসন আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর একগুঁয়েমির কারণে ২৫ মার্চ (১৯৭১) পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ। যদিও এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় নেতাদের অনেকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা তা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু ভুট্টো বিশেষভাবে বিরোধিতা করায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
দালাল আইন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই। তখন সবার কাছে সে স্মৃতি টাটকা ছিল। কে কী করেছে, না করেছে, প্রত্যেকে তা দেখেছেনও। যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হতো, তাহলে সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের একটি অভিযোগও কেউ দায়ের না করায় আইনটি রদ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৩৬ বছর পর নতুন করে শুরু করা হয় যুদ্ধাপরাধের মামলা, যখন সকল স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। এরপর দেয়া শুরু হয় একের পর এক মৃত্যুদণ্ড।
এর আগেও যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, তাদের কেউই প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। যদিও সংবিধানে আবেদন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলেই যে কাউকে যে কোনো দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করতে পারেন। সেভাবেই কোনো আবেদন বা আত্মসমর্পণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট এক আওয়ামী নেত্রীর ছেলের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছিলেন। যদিও এ ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট সার্বভৌম নন। এ জন্য তার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে। আর জামায়াত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর যে মনোভাব তাতে স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, এদের দণ্ড মওকুফ বা হ্রাসের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই এবং ছিলও না।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ক্ষমাপ্রার্থনার এক দুর্বল প্রহসন অনুষ্ঠান করলো। কাজটা এতই কাঁচা ছিল যে, একজন বালকও বুঝতে পারবে, এটা সত্য নয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন শনিবার সকালের দিকে কারাগারের ভেতরে ঢুকলেন দুজন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর থেকে সরকার প্রচার চালাতে থাকলো যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন, তার মুসাবিদা করতে গেছেন ঐ দুই ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর ঐ দু’জন যখন ফিরলেন, তখন সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ কোনো প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা। জবাবে একটি কথাও না বলে চলে যান তারা। প্রচার করা হলো তারা প্রাণভিক্ষার মুসাবিদা করতে গেছেন। তা হলে ফেরার সময় কেন তারা বলতে পারবেন না যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা।
এর আগে শুক্রবার দণ্ডিত ঐ দুজনের আইনজীবীরা তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার আবেদন করেন। কারা ফটকে অপেক্ষা করেন। আবেদনপত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও সরকারে যুক্তি ছিল বড় অদ্ভুত। প্রতিবারই কারাকর্তৃপক্ষ জানান যে, কারাগারে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাজির নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির ছিলেন না, কিন্তু তারা টেলিফোন দূরত্বের বাইরে ছিলেন না। নিম্নতর কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানাতে পারতেন, আইনজীবীদের ভেতরে যেতে দেয়া হবে কি হবে না।
আসলে সরকার যে নাটক মঞ্চস্থ করতে মনস্থ করেছিল, আইনজীবীরা দণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললে সে নাটক ভেস্তে যেত সহজেই ও বেশ আগেই। সে কারণেই ঠুনকো কথা বলে আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়নি তারা। এরপর সরকার প্রচার করতে শুরু করলো যে, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সরকারের এই রটনা কেউই বিশ্বাস করেনি। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তার আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়া হোক, আর সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদের সঙ্গে কথা বলে এসে তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাক প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে প্রাণভিক্ষা ও প্রেসিডেন্টের তা নাকচের যুক্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে গেছে।
আইনজীবী ও সাংবাদিকরাও বিশ্বাস করেননি যে, তারা দু’জন প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। বিশ্বাস করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সে আবেদনের কপি দেখতে চান। বিপত্তি বাধে তখনই। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন দেখানো যাবে না। তা দেখাতে হলে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। তারা যে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।’
আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই দিন বলেন, ঐ দুজনের প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তারা দু’জনেই সংবিধানের আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সেই আবেদনের লিখিত ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে। তবে এগুলো সিক্রেট বিষয়, দেখানো যাবে না। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র, চিঠিপত্র আমাদের কাছে আছে। এরপর তিনি এক মেঠো যুক্তি খাড়া করেন। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তার বাবার জন্য সব জায়গায় গেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তারা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এ সম্পর্কে পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। পরে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এক মন্ত্রী ফাঁসি কার্যকর করা ঐ দু’জনের ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠিটি প্রকাশের কথা তোলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠি প্রকাশের কিছু নেই। আমাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে।
ফাঁসি কার্যকর করার আগে ঐ দু’জনের পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মতো দেখা করার জন্য কারাগারে ডেকে নেয় জেল কর্তৃপক্ষ। সেখানে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পরিবার বিশেষ করে ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমার ৬ ফুট ২ ইঞ্চি বাবা কারও কাছে মাথা নত করে না। মার্সি যদি চাই, আল্লাহর কাছে চাইবো, বান্দার কাছে নয়।’ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার পরিবারকে জানান, তিনি কোনো মার্সি পিটিশন করেননি। ‘এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য, কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্যা অপপ্রচারের নাটক করছে।’
লক্ষণীয় যে, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারও কথার সঙ্গে কারও কথার মিল নেই। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে, প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে, তারা সংগোপনে আবেদন করেছেন, কিন্তু পরিবারের কাছে তা লুকিয়ে গেছেন। বড় সাংঘাতিক অভিযোগ। আর তাই তথাকথিত প্রাণভিক্ষার ঐ আবেদন দুটি অবিলম্বে প্রকাশ করা জরুরি। তা না হলে সরকারকে মানুষ মিথ্যাচারের অপবাদ দিয়েই যাবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন