সব ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া থাকে। এটা আমার কথা নয়। একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর উক্তি। এ প্রতিক্রিয়া ভালো ও মন্দ দুটোই হতে পারে। কিন্তু এই সমীকরণ ক্ষমতায় থাকলে অনুধাবন করা যায় না। ক্ষমতার বাইরে যারা আছেন তারা টের পান কত ধানে কত চাল। রাজনীতি নিয়ে লিখতে গেলে কলম থেমে যায়। কারণ এই উপত্যকায় সবাই রাজনীতি না করলেও রাজনীতি সচেতন। নিজ দলের পক্ষে কেউ কথা বললে যেমন সাদরে গ্রহণ করে, তেমনি বিপক্ষে বললে হাত পা ভেঙ্গে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। চাওয়া পাওয়ার এই পৃথিবীতে এমন নোংরা সংস্কৃতির রাজনীতি আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা ধরনের বিধিবিধান ও আইন প্রণয়ন করে থাকে। এ বিধিবিধান ও আইন প্রণয়ন কোনো সরকারের আমলেই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল না, অদূর ভবিষ্যতেও বিতর্কমুক্ত থাকবে কিনা আল্লাহ মালুম। তবে রাষ্ট্রের উচিত যে কোনো আইন প্রণয়ন করার সময় জনগণের উন্মুক্ত মতামতের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা। সম্প্রতি ১৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে স্থানীয় সরকার সংশোধন আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। প্রণীত স্থানীয় সরকার গঠনের এ বিধান নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। আর ওঠা তো স্বাভাবিক! কারণ সরকার নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার প্রয়াসে স্থানীয় সরকারের বিধান এই মুহূতে সংশোধন করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করে। সংশোধিত বিধানে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরেই দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। নতুন এ আইনে পাঁচ বছরের নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণের পর কোনো কারণে নির্বাচন না হলে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১১নং বিধিতে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, সেখানে মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিটি সরকারই তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
একটা সময় ছিল যখন নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করতো তখন মানুষের মনে আনন্দের দোলা দিত। এখন আর তেমন দেখা যায় না। কারণ সমাজ বা রাষ্ট্রে টাকা আর পেশীশক্তির মহড়া সর্বত্র চলেছে । আর যেটুকু ছিল তা স্থানীয় সরকার দলীয়ভাবে করার ঘোষণার পর ভেস্তে গেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জাতীয় দৈনিক গুলোতে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষণকারী বলেছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার জন্য যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার তা বর্তমানে অনুপস্থিত। কারণ আমাদের দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো গণতন্ত্রের ঠিকানা খুঁজে পায়নি। এই নির্বাচন নিয়ে একশ্রেণীর রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন বিশ্বের অনেক দেশে তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়,তাহলে আমাদের দেশে হতে বাধা কোথায়? যারা বিদেশীদের উদাহরণ বারবার টেনে এনেছেন, তারা কেন ভুলে যান ওই সব দেশের রাজনৈতিক সহনশীলতার সংস্কৃতি আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্র পুরোপুরি উল্টো। এখানে শাসক দল নিজের স্বার্থে পছন্দমতো পদ্ধতি প্রয়োগ করতে ভুল করে না।
অতীতের স্থানীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তাতে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন হয়েছে চার দফায়। প্রথম থেকে চতুর্থ দফা পর্যন্ত নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যত বেশি বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের আচরণ ততই জাতির সামনে উন্মোচন হয়েছে। প্রথম দফা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভোট হলেও বাকি তৃতীয় এবং চতুর্থ দফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৩৪ জন বিজয়ী হন। বিএনপি সমর্থিত ৪৫ জন বিজয়ী হন। জামায়াত সমর্থিত ১২ জন বিজয়ী হন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৬ বিএনপি ৫৩, জামায়াত ৮টিতে বিজয়ী হয়। তৃতীয় দফা নির্বাচনের পুরো চিত্র পাল্টিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অনুজেরা ভোট ছিনতাই আর জাল ভোটের মহোৎসব পালন করে। এ দফায় আওয়ামী লীগ ৪০, বিএনপি ২৭ এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত বিজয়ী হন ৮টিতে। চতুর্থ দফার নির্বাচনে কোনো রাখঢাক ছিল না। সরাসরি ক্ষমতাসীনদের ডাইরেক্ট অ্যাকশন। চারজনের মৃত্যু, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্র ছিনতাইয়ের পর ৯১ উপজেলায় নির্বাচনে ৮৮টি উপজেলার ফলাফলে আওয়ামী লীগ ৫৬, বিএপি ২৩ আর জামায়াত ৫টিতে বিজয়ী হয়।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তৃণমূলে কোন্দল সংঘাত খুনাখুনি বাড়বে। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের ওপর সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়নের মাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। এমনিতে সরকারের আজ্ঞাবহ বাহিনীর দুচোখা নীতিতে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী বিপর্যস্ত। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে যত অঘটন ঘটে তার পুরো দায় গিয়ে পড়ছে জামাত বিএনপির উপর। কোনো তদন্ত ছাড়াই আগ বাড়িয়ে কোনো একটি দল বা জোটকে দায়ী করা বাস্তবসম্মত নয়। যে দল বা গোষ্ঠীর নেতা কর্মীরা অপরাধ করুক দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করতে বাধা কোথায়! অন্যায়ভাবে কাহারও উপর অবিচার করলে প্রকৃতি তার আপন মহিমায় প্রতিশোধ নেয়। রাজনীতির এই সিঁড়ি বড় পিচ্ছিল। একবার হোঁচট খেলে দ্বিতীয়বার আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি কেউ পায় না। ইতিহাস সাক্ষী সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি,হিটলার, মুসোলিনি, হোসনি মোবারক, জামাল নাসের কেউ পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকতে পারেনি। গত সাড়ে ৬ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলে খুনোখুনির ঘটনা বেড়েই চলেছে। দলীয় সংঘাতের ফলে প্রতিদিন এক বা একাধিক নেতাকর্মীর লাশ পড়ছে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছে ২৭ জন এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১৫৪৯ জন নেতাকর্মী। আসকের পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, গত ছয় বছরে (২০০৯-২০১৪) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছে। বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার রেকর্ড বিরল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যে ধরনের নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, দুঃখজনক হলেও সত্য সে রকম নির্বাচন কমিশন এখনো তৈরি হয়নি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আর দলীয় নির্বাচন কমিশনের মধ্যে অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে না । এই নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা নেই। কারণ তারা অতীতে এ জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছে এমন নজির নেই। একশ্রেণীর বোদ্ধারা স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ভারতের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টা করছেন। ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যতটা সংস্কার হয়েছে,আমরা কি তার ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পেরেছি। নিকট অতীতে পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমুল কংগ্রেসের ভোটকেন্দ্র দখলবাজির বিরুদ্ধে সেখানকার নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপগুলোর কথা আমরা কি আমাদের দেশে ভাবতে পারি! কিছু ভোটকেদ্রে দখল ও ভোটদানে বাধা সৃষ্টির কারণে পুননির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কয়েকজন সাংসদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় তিনি পদত্যাগ করেন।( আনন্দবাজার,৭ অক্টোবর,২০১৫) আমাদের দেশের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন কি এমন নজির দেশবাসীকে দেখাতে পারবে। আর ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রর্চচার যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা কি আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আমরা আশা করতে পারি। যেখানে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে দেশে বিদেশের অধিকাংশ মানুষ অসুষ্ঠু, একতরফা ও পক্ষপাতযুক্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে; সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নামকাওয়াস্তে মহাবিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি হলে আর হাঁটা যায় না। নারকেলের জোড়াও জোড়া আর সুপারির জোড়াও জোড়া! ওই সব দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রিমান্ড এর নামে নির্যাতন চালিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে এমন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী কিংবা নির্বাচন কমিশন কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে এমন নজিরও নেই। ওই সব দেশে ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকা কি আদৌ সম্ভব হতো?
সুশীল সমাজ আর স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে এই সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না করার জন্যে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের এই চিন্তাধারা অত্যন্ত সময়োপযোগী। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের ফল হবে ভয়াবহ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যেটুকু গণতন্ত্র রয়েছে, দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সেটুকুও কবর দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যে সরকার বিশ্বরেকর্ড করেছে তার কাছে জনগণ আর প্রতারিত হতে চায় না। বদিউল আলম দলীয় প্রতীকে নির্বাচনকে অযোক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য এবং দেশের বিপর্যয় ডেকে আনা হটকারী সিদ্ধান্ত বলে আখ্যা দেন এবং শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহবান জানান। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন করার জন্য প্রার্থী এবং ভোটাররা প্রস্তুত কিনা, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ গত কয়েক বছরে মানুষ ভোটের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাজে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি আরো বলেন,দলীয় নির্বাচনের যৌক্তিকতা থাকলেও এখন সময় নয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে জনগণ এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহবান জানান। জেএডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও দখলের রাজনীতি চলবে। কেউ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে না। ফলে দখলের অপরাজনীতি রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এক বিবৃতিতে বলেছে, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা জনগণের ক্ষমতায়নের বদলে ক্ষমতাসীনদের গদি আঁকড়ে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
দেশে ইউনিয়ন পরিষদ ৪ হাজার ৫৫৩টি, উপজেলা ৪৮৮টি, পৌরসভা ৩২৩টি, জেলা পরিষদ ৬৪টি এবং সিটি করপোরেশন আছে ১১টি। দলীয় পরিচয় ও দলভিত্তিক প্রতীকে দেশের প্রথম স্থানীয় নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। বর্তমান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে ( চার্জশিট আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পর পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে। এ আইনের ধারায় ইতোমধ্যে সারা দেশে ২৩ জন মেয়র,২৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৩ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং দেড় শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে তাদের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বগুড়ায় এ পর্যন্ত ১৫ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ৪৫ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে এই প্রবণতা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একের পর এক বিএনপি জামায়াত সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের বহিষ্কারের উৎসবে মেতে ওঠেছে। এদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আন্দোলন সংগ্রাম করার ওভিযোগে রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। সরকার আইনের দোহাই দিয়ে গত দু’বছরে গাজীপুর,রাজশাহী ও সিলেটের মতো বড় সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ প্রায় ২০০ জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে। এ বরখাস্ত কেবল জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে এমন কথা নাবালক শিশুও বিশ্বাস করবে না। প্রতিহিংসার রাজনৈতিক ফসল হচ্ছে এই বরখাস্ত। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার নোংরা সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। যেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্দলীয় লেবাসে নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধী দলের কাউকে কাউকে তুচ্ছ অজুহাতে বরখাস্ত করা হচ্ছে, সেখানে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী বিরোধী দলের হলে তাকে যে বহিষ্কার করা হবে না, সেই নিশ্চয়তা কী? বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলা,দমন নিপীড়নের ভয়ে বিরোধী দলীয় প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নেতাকর্মীরা অনেক আগেই এলাকা ছাড়া। তাদের পক্ষে এলাকায় ফিরে গিয়ে মনোয়ন সংগ্রহ করা, জমা দেয়া, নির্বাচনী প্রচারণা চালানো, পোলিং এজেন্ট পাঠানো কতোটা সম্ভব তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। মোট কথা দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রথমে সরকারকে গণতান্ত্রিক চেতনায় ফিরে আসতে হবে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা না থাকলে দেশ ও জাতি যেমন বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি শাসক শ্রেণিরও শেষ রক্ষা হয় না। দেশে ও জাতির স্বার্থে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে গণতন্ত্রের চর্চাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন