বিবর্ণ সময়ের হাতে চলছে বোধের ক্ষরণ। অন্যায় আর অনাচার ওঁতপেতে আছে চতুর শেয়াল শকুনির মত। এক অসহায় সমাজ আর সমাজ ব্যবস্থার ন্যুব্জ হাতে দিন দিন আমরা মানুষ থেকে অমানুষের আওতায় চলে যাচ্ছি। কা-জ্ঞানহীন, মুণ্ডুজ্ঞানহীন, মানুষে পরিণত হচ্ছি। আমাদের প্রতিদিনকার অন্যায়, সামাজিক অবক্ষয়, হত্যা, খুন, ধর্ষণ নামক বিভিন্ন অপরাধগুলোই তা বলে দিচ্ছে।
কালের ভোঁতা ক্ষরণে তারুণ্যের উদ্ভাসিত উল্লাসের দৃষ্টি আজ বেশ বেসামাল আর এলেমেলো। শুনেছি মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা যদি সত্যিকারের অনুভূতি হয় তাহলে তা বেশ কষ্টদায়ক। আর মরে মরে প্রতিদিন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া নাকি অনেক ভালো। ক্ষরণ আর অনুতাপের না বলা কথাগুলো বেশ লজ্জার তা সুস্থ বিবেক ও মস্তিষ্ককে বড্ড পীড়া দেয়, কাঁদায়। সামাজিক জীবনে প্রতিটি মানুষ কতো বড় অভিনেতা হয়ে বেঁচে থাকে এ নির্মম সত্য সেই শুধু জানে। চলছে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকটের মত বর্তমান প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট, চিন্তা চেতনায় চলছে অবিরত নানাবিধ ক্ষরণ, অসুস্থ জীবনাচার আর মূল্যবোধের টানাপোড়ন। বোধের টানাপোড়নে আমাদের হাসি কান্না আজ ডেকোরেটিভ, ঘরে সাজানো মুখোশের মত। যার কারণে আমাদের জীবন চলে আসছে হতাশা, অনিশ্চয়তা। আমরা যেন আজ বোধকে জ্ঞান অনুভব করে মেতে উঠছি বিধ্বংসী খেলার মাঠে। সদা রূপান্তর আর অপসৃয়মানতার এই খেলা চলে মনের গভীরে বাইরে তা আবার স্থান কাল পাত্র ভেদে নির্ণীত হলে উদ্ভূত দৃশ্য আর বিরোধ সংঘাতে দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
অন্তঃসারশূন্য সমাজ কাঠামো আর দুর্বল বোধের উপর বসতি স্থাপন করে আমরা দিনের পর দিন একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। প্রেম, ভালোবাসা, নর নারীর জটিল মানসিক ও দৈহিক সম্পর্ক, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবক্ষায়িত জীবনাচার, অবাধ যৌনাচার, অতি দারিদ্র, ক্ষুধা, হত্যা, আত্মহত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচার, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা, আত্মদহন, বিকৃত ভোগ লালসার অস্থির বিশৃঙ্খলা বিবর্ণ জননিরপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মনোজগতের অতল গহ্বরে অন্ধকারের পুঞ্জীভূত হয়ে দিনে দিনে ক্ষেভে পরিণত হচ্ছে। আর এই ক্ষোভই একদিন প্রকাণ্ড অপরাধের বৃক্ষে, ফলে ফুলে রূপান্তরিত হয়ে আঘাত হানছে এ সমাজ ব্যবস্থার উপর।
অনেক দিন আগের কথা, আহমেদ সফার একটা লেখা পড়েছিলাম সেখানে জানতে পেরেছি শুকুরের বাচ্চার যখন নতুন দাঁত গজায় তখন নাকি সে প্রথম বাবা মায়ের পাছায় কামড় দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে। হ্যাঁ আমি দেশের বর্তমান অবক্ষয়ের খপ্পরে পড়া বাবা-মাকে খুন করা ঐশী রহমানের কথা বলছি। ঐশী রহমান ইতঃপূর্বে পুলিশকে দেয়া তার এক বক্তব্যে বলেছিল, তার বাবা ছিল সেকেলে মানে ব্যাকডেটেড আর মায়ের সাথে তার ম্যাচ করতো না। মানে মা তাকে অসৎ বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে বলতো।
মাদকাসক্ত ঐশী রহমান নিজের ফ্রিডম না থাকার কারণে বিরক্ত হয়ে পূর্বপরিচিত বন্ধু জনি ও জনির এক পরিচিত বন্ধুর সহযোগিতায় কফির মধ্যে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে বাবা মাকে নির্মমভাবে খুন করেছিল। আর লাশ দুটি বাথরুমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে সহয়তা করেছিল গৃহকর্মী খাদিজা খাতুন ওরফে সুমি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই মামলার আসামীপক্ষ মানে ঐশী রহমান, জনি ও সুমি সবাই আইনের চোখে অপরাধী হলেও তারা বয়সে শিশু। কেননা বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু অধিকার আইনুনাযায়ী ১৬ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু।
বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ডের রায় আজকে হয়ে গেল। শুধু তাই নয় এ রায়ের মাধ্যম্যে ঐশীর বয়স ১৬ কিংবা তার কম এমনকি ঐশীকে ‘নাবালগ’ দাবি করলেও আজ আদালত তার পর্যবেক্ষণে ঐশীকে সাবালক বলে মন্তব্য করেছেন। ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ রায় ঘোষণার সময় বলেছেন, ”আমি বয়সের চিন্তা করেছি এবং ঐশীর প্রকৃত বয়স পেয়ে গেছি। ২০০৩ সালের শিশু আইন অনুসারেই তার বয়স ধরা হয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে ঘটনার সময় তিনি সাবালক হিসাবে এসেছেন।” তবে ঐশীর বয়স কত ছিল সে বিষয়ে আদালত স্পষ্ট কিছু বলেননি।
জানা গেছে, রায় ঘোষণা শেষে ঐশীর প্রধান আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা জানান, বয়স নির্ণয়ের জন্য যে ছয়টি এক্সরে করতে হয় আদালত তার মধ্যে দুইটি এক্সরে সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া আদালত আমাদের বয়স প্রমাণের বিভিন্ন সার্টিফিকেট আমলে নেননি। ঐশী রহমানের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যার ঘটনার সময় তাদের মেয়ে ঐশীর বয়স কত ছিল এ নিয়ে তখন থেকেই বিভ্রান্তি ও বিতর্ক চলে আসছিল। তবে সে সময় তার বয়স নির্ণয়ের বিভিন্ন মেডিকেল পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, মেডিকেল পরীক্ষায় ঐশীর বয়স ১৮ বছরের বেশি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি রির্পোট ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের শিশু অধিকার আইনে যদি ঐশী রহমানের মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, নতুন শিশু অধিকার আইন বাস্তবায়ন হয় সে বছরের ২১ আগস্ট। আর ঘটনা ঘটেছে ১৬ আগস্ট। যেহেতু নতুন শিশু আইন বাস্তবায়নের আগে যত ঘটনা ঘটেছে তা আগের আইনের আওতায় পড়বে সেহেতু ঐশীর বয়স ১৬ বছরের বেশি হলেই তাকে আর শিশু বলার সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট শিশুর বয়সসীমা ১৬ থেকে ১৮ বছরে উন্নীতকরণ করা হয়েছে। আর এই নতুন শিশু আইনে আইনগত সুরক্ষা, শিশুবান্ধব পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিচারকাজ সম্পাদনের বিধান রাখা হয়েছে।
যেখানে শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে শিশুর বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশের কথা। এ আইনে শিশুর প্রতি সব অন্যায় আচরণের জন্য দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি কোন শিশু বা কিশোর অপরাধী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্যান্য সাধারণ অপরাধী থেকে আলাদা করে কিশোর সংশোধন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ শাস্তি না দিয়ে তার আচরণকে সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিশু আইনের সুফল পাবে। এ আইনে প্রতি জেলায় শিশু আদালত গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং শিশু ভিকটিম ও সাক্ষী উভয়কে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপরাধের শিকার শিশুকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
ঐশী রহমান যদি উপযুক্ত শিশু আইনের আওতায় বিচার পেয়ে থাকেন তাহলে আমাদের বলার কিছু থাকবে না। কারণ সব অপরাধীই বিচার পাক একজন সভ্য সমাজের মানুষ হিসাবে এতটুকু আমাদের কাম্য কিন্তু যদি আইনের কোন ফাঁক ফোকর আর মারপ্যাচে পড়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়ে কিশোর অপরাধী হিসাবে সংশোধনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক।
আসলে বর্তমান সময়ে যে বিষয়টা বেশি লক্ষণীয় তা হলো কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তার। এটা দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। কিছুদিন আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এক ব্যাংকার নারীর ওড়না ধরে টান দেয় মোটরসাইকের আরোহী চার যুবক। ফলে কিছুদূর মোটরসাইকেলে ওড়না পেঁচিয়ে টেনে হেঁচড়ে যাওয়া পর ঘটনাস্থলে ঐ নারীর মৃত্যু হয়। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রকাশক হত্যার সাথে জড়িতদের সম্পর্কে জানা গেছে তাদের বেশিরভাগের বয়সই ১৬ থেকে ১৮ এর মধ্যে। ঐশী রহমানের বয়স ও একই কোঠায়।
ইদানীং কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মাদক পাচার ও আরোহণের দায়িত্বে রয়েছে কিশোর অপরাধীরাই। দেশ ছেয়ে গেছে কিশোর, যুবকের নীল নেশার বিষে। হত্যা, ধর্ষণ, নেশার সাথে ইদানীং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছে দেশের কিশোর ও তরুণ সমাজ। কতটা নিচে নামলে, কতটা অবক্ষয়ের সাথে জড়িয়ে গেলে একজন সন্তান রীতিমত প্লান প্রোগাম করে তার প্রিয় বাবা-মাকে খুন করতে পারে আমরা কি ভেবে দেখেছি ?
আসলে এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এই নৈতিক অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে আমাদের সমাজের নৈতিক শিক্ষার অভাব, পিতামাতা কর্তৃক প্রদত্ত সঠিক শিক্ষার অভাব, আকাশ সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল, মোবাইল কোম্পানিগুলোর লোভনীয় অফার, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, ব্যবসায়িক খুঁটিকে শক্ত করার অপপ্রয়াস সর্বোপরি উগ্র সংস্কৃতি ও সাহিত্য। আমাদের শিক্ষা মাধ্যমগুলোতে এখনো নৈতিক শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ও এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকরা এখন এক ধান্ধা নিয়ে বসে আছেন কেমন করে ভালো রেজাল্ট করা যায়। সন্তান কোথায় গেল, কার সাথে মিশলো, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করলো কিনা, পাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁ দিচ্ছে কিনা, কারো সাথে গিয়ে নেশা করছে কিনা পিতামাতার সেই আগ্রহ নেই বললেই চলে। বরং সন্তানকে আরো বেশি শিক্ষামুখী করার জন্য কত আপডেট ল্যাপটপ আর মোবাইল কিনে দেয়া যায় বাবা মায়ের নজর এখন সন্তানের সাথে সুর মিলিয়ে সেদিকেই। কষ্ট লাগে যখন দেখা যায় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট পাওয়ার পরও একজন ভালো ছাত্র কিংবা ছাত্রী সঙ্গদোষে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা এখনো পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি। আমরা এখনো মেরুদণ্ডের উপর ভর করে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে যাওয়াতে অধিক আনন্দ বোধ করি। লাল নীল স্বপ্নের বিলাসিতার ফানুস উড়িয়ে মুখ থুবড়ে হোঁচট খাই পিচঢালা রাস্তায়। সস্তা বক্তব্য আর চায়ের কাপে ধোঁয়াটে ঝাঁঝের ঝড় তুলে পথ দেখাই ভোগবাদী সমাজের। এই যদি আমাদের অবস্থা হয় তাহলে কোন দিনও আমরা উত্তরণের পথ খুঁজে পাবো না। সবার আগে আমাদের বদলে যেতে হবে। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, ভালো মানুষ। পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতার। গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে বিশেষ করে বখে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য। সেখানে মা বাবা, পরিবারের সবার উপস্থিতি রাখতে হবে। শুধু তাই নয় একটি সমাজকে সুষ্ট সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদ্রষ্টা আর সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না।
কালের ভোঁতা ক্ষরণে তারুণ্যের উদ্ভাসিত উল্লাসের দৃষ্টি আজ বেশ বেসামাল আর এলেমেলো। শুনেছি মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা যদি সত্যিকারের অনুভূতি হয় তাহলে তা বেশ কষ্টদায়ক। আর মরে মরে প্রতিদিন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া নাকি অনেক ভালো। ক্ষরণ আর অনুতাপের না বলা কথাগুলো বেশ লজ্জার তা সুস্থ বিবেক ও মস্তিষ্ককে বড্ড পীড়া দেয়, কাঁদায়। সামাজিক জীবনে প্রতিটি মানুষ কতো বড় অভিনেতা হয়ে বেঁচে থাকে এ নির্মম সত্য সেই শুধু জানে। চলছে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকটের মত বর্তমান প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট, চিন্তা চেতনায় চলছে অবিরত নানাবিধ ক্ষরণ, অসুস্থ জীবনাচার আর মূল্যবোধের টানাপোড়ন। বোধের টানাপোড়নে আমাদের হাসি কান্না আজ ডেকোরেটিভ, ঘরে সাজানো মুখোশের মত। যার কারণে আমাদের জীবন চলে আসছে হতাশা, অনিশ্চয়তা। আমরা যেন আজ বোধকে জ্ঞান অনুভব করে মেতে উঠছি বিধ্বংসী খেলার মাঠে। সদা রূপান্তর আর অপসৃয়মানতার এই খেলা চলে মনের গভীরে বাইরে তা আবার স্থান কাল পাত্র ভেদে নির্ণীত হলে উদ্ভূত দৃশ্য আর বিরোধ সংঘাতে দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
অন্তঃসারশূন্য সমাজ কাঠামো আর দুর্বল বোধের উপর বসতি স্থাপন করে আমরা দিনের পর দিন একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। প্রেম, ভালোবাসা, নর নারীর জটিল মানসিক ও দৈহিক সম্পর্ক, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবক্ষায়িত জীবনাচার, অবাধ যৌনাচার, অতি দারিদ্র, ক্ষুধা, হত্যা, আত্মহত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচার, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা, আত্মদহন, বিকৃত ভোগ লালসার অস্থির বিশৃঙ্খলা বিবর্ণ জননিরপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মনোজগতের অতল গহ্বরে অন্ধকারের পুঞ্জীভূত হয়ে দিনে দিনে ক্ষেভে পরিণত হচ্ছে। আর এই ক্ষোভই একদিন প্রকাণ্ড অপরাধের বৃক্ষে, ফলে ফুলে রূপান্তরিত হয়ে আঘাত হানছে এ সমাজ ব্যবস্থার উপর।
অনেক দিন আগের কথা, আহমেদ সফার একটা লেখা পড়েছিলাম সেখানে জানতে পেরেছি শুকুরের বাচ্চার যখন নতুন দাঁত গজায় তখন নাকি সে প্রথম বাবা মায়ের পাছায় কামড় দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে। হ্যাঁ আমি দেশের বর্তমান অবক্ষয়ের খপ্পরে পড়া বাবা-মাকে খুন করা ঐশী রহমানের কথা বলছি। ঐশী রহমান ইতঃপূর্বে পুলিশকে দেয়া তার এক বক্তব্যে বলেছিল, তার বাবা ছিল সেকেলে মানে ব্যাকডেটেড আর মায়ের সাথে তার ম্যাচ করতো না। মানে মা তাকে অসৎ বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে বলতো।
মাদকাসক্ত ঐশী রহমান নিজের ফ্রিডম না থাকার কারণে বিরক্ত হয়ে পূর্বপরিচিত বন্ধু জনি ও জনির এক পরিচিত বন্ধুর সহযোগিতায় কফির মধ্যে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে বাবা মাকে নির্মমভাবে খুন করেছিল। আর লাশ দুটি বাথরুমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে সহয়তা করেছিল গৃহকর্মী খাদিজা খাতুন ওরফে সুমি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই মামলার আসামীপক্ষ মানে ঐশী রহমান, জনি ও সুমি সবাই আইনের চোখে অপরাধী হলেও তারা বয়সে শিশু। কেননা বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু অধিকার আইনুনাযায়ী ১৬ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু।
বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ডের রায় আজকে হয়ে গেল। শুধু তাই নয় এ রায়ের মাধ্যম্যে ঐশীর বয়স ১৬ কিংবা তার কম এমনকি ঐশীকে ‘নাবালগ’ দাবি করলেও আজ আদালত তার পর্যবেক্ষণে ঐশীকে সাবালক বলে মন্তব্য করেছেন। ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ রায় ঘোষণার সময় বলেছেন, ”আমি বয়সের চিন্তা করেছি এবং ঐশীর প্রকৃত বয়স পেয়ে গেছি। ২০০৩ সালের শিশু আইন অনুসারেই তার বয়স ধরা হয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে ঘটনার সময় তিনি সাবালক হিসাবে এসেছেন।” তবে ঐশীর বয়স কত ছিল সে বিষয়ে আদালত স্পষ্ট কিছু বলেননি।
জানা গেছে, রায় ঘোষণা শেষে ঐশীর প্রধান আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা জানান, বয়স নির্ণয়ের জন্য যে ছয়টি এক্সরে করতে হয় আদালত তার মধ্যে দুইটি এক্সরে সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া আদালত আমাদের বয়স প্রমাণের বিভিন্ন সার্টিফিকেট আমলে নেননি। ঐশী রহমানের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যার ঘটনার সময় তাদের মেয়ে ঐশীর বয়স কত ছিল এ নিয়ে তখন থেকেই বিভ্রান্তি ও বিতর্ক চলে আসছিল। তবে সে সময় তার বয়স নির্ণয়ের বিভিন্ন মেডিকেল পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, মেডিকেল পরীক্ষায় ঐশীর বয়স ১৮ বছরের বেশি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি রির্পোট ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের শিশু অধিকার আইনে যদি ঐশী রহমানের মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, নতুন শিশু অধিকার আইন বাস্তবায়ন হয় সে বছরের ২১ আগস্ট। আর ঘটনা ঘটেছে ১৬ আগস্ট। যেহেতু নতুন শিশু আইন বাস্তবায়নের আগে যত ঘটনা ঘটেছে তা আগের আইনের আওতায় পড়বে সেহেতু ঐশীর বয়স ১৬ বছরের বেশি হলেই তাকে আর শিশু বলার সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট শিশুর বয়সসীমা ১৬ থেকে ১৮ বছরে উন্নীতকরণ করা হয়েছে। আর এই নতুন শিশু আইনে আইনগত সুরক্ষা, শিশুবান্ধব পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিচারকাজ সম্পাদনের বিধান রাখা হয়েছে।
যেখানে শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে শিশুর বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশের কথা। এ আইনে শিশুর প্রতি সব অন্যায় আচরণের জন্য দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি কোন শিশু বা কিশোর অপরাধী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্যান্য সাধারণ অপরাধী থেকে আলাদা করে কিশোর সংশোধন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ শাস্তি না দিয়ে তার আচরণকে সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিশু আইনের সুফল পাবে। এ আইনে প্রতি জেলায় শিশু আদালত গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং শিশু ভিকটিম ও সাক্ষী উভয়কে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপরাধের শিকার শিশুকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
ঐশী রহমান যদি উপযুক্ত শিশু আইনের আওতায় বিচার পেয়ে থাকেন তাহলে আমাদের বলার কিছু থাকবে না। কারণ সব অপরাধীই বিচার পাক একজন সভ্য সমাজের মানুষ হিসাবে এতটুকু আমাদের কাম্য কিন্তু যদি আইনের কোন ফাঁক ফোকর আর মারপ্যাচে পড়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়ে কিশোর অপরাধী হিসাবে সংশোধনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক।
আসলে বর্তমান সময়ে যে বিষয়টা বেশি লক্ষণীয় তা হলো কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তার। এটা দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। কিছুদিন আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এক ব্যাংকার নারীর ওড়না ধরে টান দেয় মোটরসাইকের আরোহী চার যুবক। ফলে কিছুদূর মোটরসাইকেলে ওড়না পেঁচিয়ে টেনে হেঁচড়ে যাওয়া পর ঘটনাস্থলে ঐ নারীর মৃত্যু হয়। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রকাশক হত্যার সাথে জড়িতদের সম্পর্কে জানা গেছে তাদের বেশিরভাগের বয়সই ১৬ থেকে ১৮ এর মধ্যে। ঐশী রহমানের বয়স ও একই কোঠায়।
ইদানীং কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মাদক পাচার ও আরোহণের দায়িত্বে রয়েছে কিশোর অপরাধীরাই। দেশ ছেয়ে গেছে কিশোর, যুবকের নীল নেশার বিষে। হত্যা, ধর্ষণ, নেশার সাথে ইদানীং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছে দেশের কিশোর ও তরুণ সমাজ। কতটা নিচে নামলে, কতটা অবক্ষয়ের সাথে জড়িয়ে গেলে একজন সন্তান রীতিমত প্লান প্রোগাম করে তার প্রিয় বাবা-মাকে খুন করতে পারে আমরা কি ভেবে দেখেছি ?
আসলে এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এই নৈতিক অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে আমাদের সমাজের নৈতিক শিক্ষার অভাব, পিতামাতা কর্তৃক প্রদত্ত সঠিক শিক্ষার অভাব, আকাশ সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল, মোবাইল কোম্পানিগুলোর লোভনীয় অফার, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, ব্যবসায়িক খুঁটিকে শক্ত করার অপপ্রয়াস সর্বোপরি উগ্র সংস্কৃতি ও সাহিত্য। আমাদের শিক্ষা মাধ্যমগুলোতে এখনো নৈতিক শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ও এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকরা এখন এক ধান্ধা নিয়ে বসে আছেন কেমন করে ভালো রেজাল্ট করা যায়। সন্তান কোথায় গেল, কার সাথে মিশলো, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করলো কিনা, পাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁ দিচ্ছে কিনা, কারো সাথে গিয়ে নেশা করছে কিনা পিতামাতার সেই আগ্রহ নেই বললেই চলে। বরং সন্তানকে আরো বেশি শিক্ষামুখী করার জন্য কত আপডেট ল্যাপটপ আর মোবাইল কিনে দেয়া যায় বাবা মায়ের নজর এখন সন্তানের সাথে সুর মিলিয়ে সেদিকেই। কষ্ট লাগে যখন দেখা যায় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট পাওয়ার পরও একজন ভালো ছাত্র কিংবা ছাত্রী সঙ্গদোষে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা এখনো পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি। আমরা এখনো মেরুদণ্ডের উপর ভর করে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে যাওয়াতে অধিক আনন্দ বোধ করি। লাল নীল স্বপ্নের বিলাসিতার ফানুস উড়িয়ে মুখ থুবড়ে হোঁচট খাই পিচঢালা রাস্তায়। সস্তা বক্তব্য আর চায়ের কাপে ধোঁয়াটে ঝাঁঝের ঝড় তুলে পথ দেখাই ভোগবাদী সমাজের। এই যদি আমাদের অবস্থা হয় তাহলে কোন দিনও আমরা উত্তরণের পথ খুঁজে পাবো না। সবার আগে আমাদের বদলে যেতে হবে। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, ভালো মানুষ। পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতার। গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে বিশেষ করে বখে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য। সেখানে মা বাবা, পরিবারের সবার উপস্থিতি রাখতে হবে। শুধু তাই নয় একটি সমাজকে সুষ্ট সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদ্রষ্টা আর সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না।
হাসি ইকবাল
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন