সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশটাকে যেন কুরুক্ষেত্র বানানো হচ্ছে


কুরুক্ষেত্র মহাসমর! খৃস্টপূর্ব ৪ হাজার বছর আগের ঘটনা। মহাভারতে বর্ণিত প্রাণঘাতী ও আত্মঘাতী মহাযুদ্ধ! পান্ডব ও কৌরব পক্ষ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ। কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ঘটনাটা পৌরাণিক হলেও এর আবেদনটা কিন্তু সর্বব্যাপী। কারণ, সৃষ্টির আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ ধরনের প্রাণঘাতী মহাসমরের কথা আর কখনো শোনা যায়নি; কোন রূপকথায়ও নয়।
যুদ্ধ বিরল ঘটনা নয়। প্রাচীন যুগে রাম-রাবনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। বৌদ্ধদের রাজা অশোক যুদ্ধ করেছিলেন কলিঙ্গে। খৃস্টান রাজা কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট তার নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে রোম দখল করেছিলেন। কিন্তু কোন যুদ্ধের ভয়াবহতা কুরুক্ষেত্রের মত ছিল না।
কুরুক্ষেত্র সমরটা কৌবর পক্ষের দুর্যধন আর পঞ্চপান্ডবের মধ্যে হয়েছিল। ক্ষমতার উষ্ণপরশ পাওয়ার জন্য এ মহাসমর সংঘটিত হলেও এর পরিণাম কিন্তু হয়েছিল খুবই ভয়াবহ। কারণ, এই যুদ্ধটা এমনই এক প্রাণঘাতী যুদ্ধ ছিল যে, যখন এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তখন একমাত্র পঞ্চপান্ডবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জীবিত ছিলেন না। যে ক্ষমতার জন্য এই প্রাণঘাতী মহাসমর, যুদ্ধ শেষে সে ক্ষমতা চর্চার কোন জায়গা রইল না ধরাধামে। একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে হিমালয় পর্বতের গাত্র ধরে জীবিতাবস্থায় স্বর্গারোহন করলেন। স্বর্গলোকই যদি ধর্মরাজের গন্তব্য হবে, তবে মর্ত্যলোকের ক্ষমতার জন্য এই প্রাণঘাতী মহাসমরটার সার্থকতা কোথায়?
এসব পৌরানিক কাহিনী। অতি সনাতনী ঘটনা। এর মধ্যেই ভাগিরথীতে অনেক জল বয়ে গেছে। মানুষের সনাতনী চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাসের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনও এসেছে। কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে সভ্যতার সূচনা এবং তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মানুষ ন্যায়-অন্যানের সংজ্ঞায়ন ও সংবিধিবদ্ধ পন্থায় তার প্রতিকারের সুসম নিয়ম তৈরি করেছে। ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি পরিহার করে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন হয়েছে। মানুষ এসবের সুবিধাও ভোগ করছেন। সভ্যতা কিন্তু থেমে নেই বরং তা ক্রম-অগ্রসরমান, চলৎশক্তি সম্পন্ন এক স্বত্তা হিসাবে আবির্ভূত। যা স্থিতিশীল নয় বরং গতিশীল!
সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেলেও আমরা বোধ হয় খুব একটা অগ্রসর হতে পারিনি। ক্ষমতা চর্চার ধরনে বিশ্বময় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও আমরা বোধ হয় সেই পৌরানিক ও প্রস্তর যুগের নিগঢ়েই আটকা পড়ে আছি। যে বৃত্ত থেকে আমরা বেড়িয়ে আসতে পারছি না।
দেশে রাজনৈতকি সংকট চলছে। ক্ষমতার পালা বদল ও নির্বাচন ব্যবস্থা সর্বজনগ্রাহ্য করার একটা দাবিও আছে সর্ব মহলে। কিন্তু যারা এখন ক্ষমতা চর্চা করছেন তারা এ দাবিকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন। যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা মানসিকতা কাজ করছে তাদের মধ্যে। তাই চলমান এই রাজনৈতিক সংকটকে তারা দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে বলে বিশ্বাস করানোর প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু সকল পক্ষই যদি একটু আন্তরিক হয় তাহলে কথিত এ যুদ্ধাবস্থা এড়ানো খুবই সম্ভব। কিন্তু এ জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে এ বিষয়ে আপাতত কোন সুসংবাদ তাদেরকে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রও উদ্যোগী হয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে না। মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বিধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলীর আওতাভূক্ত। কিন্তু রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে উদাসীনই মনে হচ্ছে।
রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যাপক উইলোবি (Willoughby)  বলেন, (It is admitted by all that state should possess powers sufficiently extensive for the maintenance of its own continued existence against foreign interference, to provide the means whereby its national life may be preserved and developed and to maintain internal order including the protection of life, liberty and property.)
অর্থাৎ এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, রাষ্ট্রের আয়ত্তে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত যার দ্বারা রাষ্ট্র বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে, জাতীয় জীবনকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পতি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধান করতে পারে। 
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ১০ জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। যদিও দেশে ও বিদেশে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষমতাসীন ও সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েছে। জাতীয় সংসদ থেকে টিআইবির কার্যক্রম স্থগিত করার কথা বলেছেন একজন সাংসদ। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীও টিআইবিকে একহাত নিয়েছেন।
গত ৯ নভেম্বর দশম সংসদের অষ্টম অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছেন, এই সংসদ থেকে (ইফতেখারুজ্জামান) তিন দিনের সময় দিতে চাই। অবিলম্বে তিনি ক্ষমা চাইবেন। জীবনেও কোন দিন সংবিধান এবং পার্লামেন্ট নিয়ে কথা বলবেন না-এই অঙ্গীকার করলেই আমরা কেবল মেনে নেব’।
দেশের সংবিধানের অন্যমত মূলনীতি যখন গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রে যখন বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত তখন বাবু সেনগুপ্তের জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বোধ হয় থেকেই যাচ্ছে।
অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথার বলারই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ত্রুতি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলায় এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে উস্মা প্রকাশ করেছে সরকার। তাদের ভাষায়, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। গত ৬ নভেম্বর লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মকর্তা এই বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে একটি নোট হস্তান্তর করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বিদেশীদের ‘নাক’ না গলাতে বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে দেশের মানুষই চিন্তাভাবনা করবে। এ ব্যাপারে আপনারদের নাক না গলালেও চলবে’। কিন্তু দেশের মানুষকে এ বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ বা স্বাধীনতা কি পাচ্ছেন? যদি পেতেন তাহলে এ কথার যৌক্তিকতা থাকতো। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এমন অনাকাঙ্খিত মন্তব্য সর্বগ্রাসী মনোভাবেরই পরিচয় বহণ করে। এ বিষয়ে কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কালকেতু উপাখ্যান’ এর রাক্ষস রাজ কালকেতুর সাথে তুলনীয়। কবি কঙ্কন রাক্ষসরাজ কালকেতুর বর্ণনা দিয়ে গিয়ে বলেন,
মোঁচারিয়া গোঁফ দুইটা বান্ধিলেন ঘাড়ে
এক শ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজারে
আশি মন মহাবীর খায় খুদ জাউ.....
সরকার পক্ষ হয়তো রাক্ষসরাজ কালকেতুর মতই সর্বভুক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কোন কিছুতে কাউকে ভাগ দেয়ার কথা চিন্তাই করতে পারছে না। কিন্তু রাক্ষসরাজ হওয়ার স্বপ্নটা কতখানি বাস্তব সম্মত তাও তাদেরকে বারবার ভেবে দেখা উচিত।
গণতন্ত্র সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ। পরমত সহনশীলতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কতিপয় অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের দেশের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে দেশের এসব সাংবিধানিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক ৩ ধরনের অধিকার ভোগ করবে-১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো :
সামাজিক অধিকার :
জীবন ধারনের অধিকার. ২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মতপ্রকাশের অধিকার, ৪ সভা-সমিতি করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।
রাজনৈতিক অধিকার :
ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনার করার অধিকার, ৫. চাকরি লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার।
অর্থনৈতিক অধিকার :
কাজের অধিকার, ২ উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার ক্রমেই অধিকরতর কর্তৃত্ব পরায়ন হয়ে উঠছে এবং দেশকে নিজেদের তালুক-সম্পত্তি মনে করছে। তারা নিজেদের অধিকার ছাড়া অন্য কারো অধিকারই স্বীকার করছে না। সরকার ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করেছেন বেশ আগেই। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দেশ কারো তালুক-সম্পত্তি নয়। সংবিধানের ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘Bangladesh is a unitary, independent, sovereign republic to be known as the Peoples Republic of Bangladesh.’
অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে।
শাসনকাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে নাগরিকরা দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেনা। গণতন্ত্রহীনতায় দেশ যেভাবেই  চলুক না কেন, দেশের অবস্থা যাইহোক না কেন, জনসাধারণ বিশেষ প্রভাবিত হয় না। কিন্তু গণতন্ত্রে সকলেই উপলব্ধি করে যে, দেশ তার নিজের। সরকার তাদের দ্বারাই গঠিত। দেশের উন্নতি তাদের উন্নতি। তাই দেশের উন্নতির জন্য সকলেই সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে ফরাসী বিপ্লবের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে ফরাসী লেখক লাভলে (Loveleye) বলেছেন, ‘The Fence people never began to love France until after the Revolution when they were admitted to a share in its  government since which time they have adored it.) অর্থাৎ ফরাসী জাতি বিপ্লবের পর থেকেই ফ্রান্সকে ভালবাসতে শিখেছে। কারণ, তখন থেকে তারা শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে তাকে গভীরভাবে ভালবাসতে শিখেছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদারনৈতিক গণতন্ত্রায়ন ও শাসনকাজে জনগণের সম্পৃক্ততাই চলমান সংকটের একমাত্র সমাধান। সে উপলব্ধি থেকেই হয়তো ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জাতীয় সংলাপের আহবান জানান বিএনপি’র চেয়ারপর্সন বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে দেশে ক্রান্তিকাল চলছে দাবি করে খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির স্বার্থে সংকট উত্তরণে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে সরকারকে একটি জাতীয় সংলাপের দাবি জানান। বেগম জিয়ার আহবানের প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত সংলাপের জন্য দুই শর্ত সংলাপের সম্ভবনাকে জটিল হবে জটিলতর করে তুললেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বেগম জিয়া বোধ হয়তো ‘অরণ্যেই রোদন’ করে ফেলেছেন। তিনি কি এখনও আশায় বুক বেধে আছেন যে, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে! প্রেক্ষাপট তো তা মোটেই সমর্থন করে না বরং মনসুর বয়াতির ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার মদিনার মত তাকে শেষ পর্যন্ত আশাহতই হতে হবে আপাতত। 
আমরা অবশ্য নৈরাশ্যবাদী নই বরং আশাবাদী। কিন্তু হালে যা চলছে তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।  গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বললেন. উনি (খালেদা জিয়া) বলুক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন করেন। উনি বলুক-যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে। যেদিন উনি বলবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত, সেদিন উনি সংলাপে বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
এক সময় সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে সে কথাটা আনান ওনার মুখ থেকে, তাদের ( জামায়াত ) সঙ্গ ছাড়তে বলেন। তারপর ভেবে দেখা যাবে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘ খালেদা জিয়া ভাঙ্গচুর পরিহার করলে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরিবেশ না থাকলে কোন আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না। যুদ্ধের সময় কোন আলোচনা হয় না। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাধারণ নির্বাচন চাই।
আসলে দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে না রাজনৈতিক সংকট-এটি আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। যার যুদ্ধ হলে সরকার কার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ? দেশ কি বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত ?  জাতীয় সংসদ কি সরকারকে কারো সাথে যুদ্ধ করার সম্মতি দিয়েছে ?  সংবিধানের ৬৩ ধারায় সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘War shall not be declared and the Republic shall not participate in any war except with the assent of Parliament.’ অর্থাৎ সংসদের সম্মতি ব্যতিত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাইবে না কিংবা প্রজাতন্ত্র কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশে যুদ্ধাবস্থার কথা বলছেন। আসলে দেশে কোন যুদ্ধাবস্থা নয় বরং রাজনৈতিক সংকট চলছে। এই সংকট সৃষ্টিতে ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ভূমিকায় দায়ি। মূলত চলমান এই সংকটকে যুদ্ধাবস্থার সাথে তুলনা করা মোটেই সঙ্গত হবে বলে মনে হয় না। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি অর্থবহ সংলাপ এবং সকলের অংশ গ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সংলাপের প্রশ্নে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা যে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছেন তাতে সংলাপের কোন সম্ভবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাদের বক্তব্য একথা সুষ্পষ্ট যে, যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার শুধুই তাদের। তারা না চাইলে কোন কিছুই সম্ভব নয়। সরকার ও জনগণের সম্পর্ক এখন প্রভূ-ভৃত্যের। তাই প্রভূর মর্জিমতই ভৃত্যকে চলতে হবে। এটাই স্বতসিদ্ধ নিয়ম। জনগণের উপর এমন প্রভূসুলভ আচরণ আর যাইহোক দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব, গণগ্রেফতারে দেশে-বিদেশে সমালোচনায় কঠিন সময় পার করছে সরকার। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের ফাঁসির রায় কার্যকর, দন্ড কার্যকর নিয়ে জাতিসংঘসহ  বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বগ, দেশজুড়ে একের পর এক বিদেশী নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যা, ‘ তথাকথিত’ আইএস নিয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর চাপ, দেশজুড়ে গণগ্রেফতার এবং ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধে জনমনে নেতিবাচক প্রভাবসহ নানা ইস্যুতে খুব অস্থির সময় পার করছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে  ২০ দলীয় জোট নেত্রী  বেগম খালেদা জিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে দেশে ফেরা ও নিরবতা অস্বস্তিতে পড়েছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। কিন্তু সরকার চলমান সংকট মোকাবেলায় গঠনমূলক, ইতিবাচক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। গণমাধ্যমের উপর অতিমাত্রায় কড়াকড়ি আরোপ, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দন্ড কার্যকর নিয়ে জাতিসংঘ মন্তব্য করায় সরকার বিব্রত বোধ এবং এটিকে ‘ হাইলি ডিস্টার্বড’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘উৎকৃষ্ট জীবন লাভের জন্য কোন সমাজের সংগ্রামের নাম হচ্ছে রাজনীতি’। কিন্তু সরকারের সর্বগ্রাসী অপরাজনীতির কারণে দেশের প্রথিতযথা রাজনীতিকরা কল্পিত ও তুচ্ছ অভিযোগ বছরের পর বছর কারা নির্যাতন ভোগ করছে। বাদ যাচ্ছেন না শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্ম পর্যায় পর্যন্ত। বিরোধী দল বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ২১ হাজার ৬৮০টি মামলা হয়েছে। আর জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার পরিসংখ্যান দেয়া খুবই কষ্টসাধ্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচীব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমলীগের বিরুদ্ধে ৮৬ টি মামলা রয়েছে। এক যুবনেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩০টি। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, রাজনৈতিকভাবে হয়রানী করার জন্য এসব মামলা দেয়া হচ্ছে।
এখনো নির্বিচারে গণগ্রেফতারও চালানো হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে সারা দেশে ৮ হাজারেরও বেশী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এ গণগ্রেফতার এখনও অব্যাহত আছে। তা কাহা তক চলবে আল্লাহ মালুম।  কিন্তু দেশকে কুরুক্ষেত্র বানানোর মধ্যে সরকারের কোন কল্যাণ আছে বলে মনে হয় না।
সরকারের ক্ষমতা চর্চার কাঁচামাল হয়ে যদি সবকিছুই শেষ হয়ে যায় তাহলে ধর্মরাজেরা ক্ষমতার চর্চা করবেন কোথায় ? এ কথা যত তাড়াতাড়ি তারা উপলব্ধি করতে পারবেন ততই তাদের জন্যই মঙ্গল।
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা 

রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন


হঠাৎ দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন এসে হাজির হলো ধীর পায়ে আগুয়ান শীত শীতের সঙ্গে সঙ্গে। দেশের উত্তরের এলাকাগুলোয় শীত বেশ জাঁকিয়ে এসেও গেছে। শহরের যান্ত্রিক উত্তাপে ঠিকমতো টের পাওয়া না গেলেও গ্রাম-বাংলায় শীতের আগমন স্পষ্ট। কুয়াশার চাদর আর হিমেল হাওয়া ঘিরে আসছে চারদিক থেকে। এরই মাঝে নির্বাচনী উত্তাপও ছড়াচ্ছে। শীতের ছোঁয়া আর রাজনীতির উত্তাপের সমীকরণেই এখন এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ।
পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভোটের হাওয়া লেগেছে মাঠে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ঘিরে ঠিক করছে কর্মকৌশল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে এ নিয়ে বৈঠক করেছেন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। তারা কিছু সীমিত দাবি জানিয়েছে, যার মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য সামান্য সময় চাওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও সংসদীয় বোর্ড নির্বাচন প্রসঙ্গে বসে নেই। আবার রাজনীতির মাঠ-ময়দান ভোটের তরঙ্গে দোলায়িত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদিও কাউন্সিলর পদগুলোয় আগের মতোই নির্দলীয় নির্বাচন হবে। মেয়র পদে বহুদিন পর নৌকা-ধানের শীষ লড়াই দেখা যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত মাঠ পুরোটাই আওয়ামী লীগের দখলে। বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের একটি বড় অংশ রয়েছেন কারাগারে। বাকি একটি অংশ আত্মগোপনে। প্রকাশ্যে রয়েছেন কমই। জামায়াতের অবশ্য দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ হাইকোর্টের রায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। স্বতন্ত্র অথবা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করছে জামায়াত। জাতীয় পার্টিও এরই মধ্যে নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় জাতীয় পার্টির তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশন দেশের ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরিস্থিতি ক্রমেই ভোটমুখী হয়ে উঠছে। তবে নতুন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেনি নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে এলে দল ও প্রার্থীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আচরণবিধিসংক্রান্ত বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়ার দরকার হবে। কোনোভাবেই ভোটের আমেজকে উত্তেজনা ও বিদ্বেষের স্তরে যেতে দেয়া মোটেও সমীচীন হবে না।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটি ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেও নির্বাচনমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দলটির মতে, তাড়াহুড়ো করে পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় দলীয় প্রস্তুতির বিষয়েও কথা হয়। তবে সরকারি দলের কারচুপি, কেন্দ্র দখলসহ ভোট ডাকাতি হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন দলের অধিকাংশ নেতা। পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে খালেদা জিয়াও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
গ্রামভিত্তিক বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচন সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় নির্বাচনে মানুষ যেমন উৎসবমুখর থাকেন, তেমনি শঙ্কায়ও আক্রান্ত হন। অতীতে এ নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও আসলে সেটাতেও দলীয় ছোঁয়া থাকতো। এবার সেটা প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য হয়েছে। এতে লাভ না ক্ষতি হয়েছে, সেটা মূল্যায়ন করা যাবে ভোটের পর।
ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের নিরাপত্তাকে প্রথম ও প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণও সুনিশ্চিত করতে হবে- যাতে উদার ও ভয়হীনভাবে সবাই নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। বিশেষত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ ও দূরত্ব চলছে, সেটাও কমানোর চেষ্টা করতে হবে। বিরোধীরা অধিকারহীনতার যে অভিযোগ করে আসছেন, সেটা যেন বাস্তবে দেখা না যায়। সব দলের অবাধ ও মুক্ত অংশগ্রহণের প্রাণবন্ত নির্বাচনই সবার কাছে কাম্য। এতে দেশে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হওয়ার কাজটিই জোরদার হবে এবং দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মুখচ্ছবি উজ্জ্বলতর হবে।
এ কথা সত্য যে, সাম্প্রতিক অতীতে নানা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সেখান থেকেই মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেশের বাইরেও সরকারের ব্যাপারে সমালোচনার অভাব নেই। ফলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে রাজনীতির বাইরের অর্থনৈতিক অবস্থাও সমস্যার বাইরে নেই। গার্মেন্ট সেক্টরের অবস্থা খুবই খারাপ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে সর্বসাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংঘাতের বাইরে গণতন্ত্রের যত পরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলোকেই ব্যবহার করা দরকার। নির্বাচন এক্ষেত্রে একটি বড় উপায়। এই উপায়টিকে পৌর নির্বাচনের সময় গণতান্ত্রিক ও আইনানুগভাবে প্রয়োগ করে সবার জন্য সমান সুযোগ ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচন যেন অবশ্যই অবাধ, চাপমুক্ত ও সবার নিরাপদ অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।
পাশাপাশি নির্বাচসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য সংলাপের মতো একটি গণতান্ত্রিক উদ্যোগ এই নির্বাচন সামনে রেখে চলতে পারে, যাতে দলগুলোর বিভেদ ও দূরত্ব ঘুচবে, সংঘাতের রাজনীতি ফিরে পাবে শান্তির দিশা। সংঘাতহীন পরিবেশ সৃজন করে গণতান্ত্রিক সহাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন ও সংলাপসহ আরো অনেক গণতান্ত্রিক উদ্যোগ সাদরে আমন্ত্রিত হওয়াই দরকার। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন নিরাশা ও উত্তেজনার বাইরে এসে এমন গণতান্ত্রিক উদ্যোগই আশা করছে। আশা করে রক্তপাতহীন, উৎসবমুখর, অংশগ্রহণে ভরপুর নির্বাচন।
বিশেষত প্রধান দলগুলো দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলনের মাঠে থেকে যথেষ্ট গণভিত্তি তৈরি করেছে। কারণ আন্দোলনের সঙ্গে জনসমর্থন সংশ্লিষ্ট। এখন সেই জনসমর্থনকে ভোটের বাক্সে পাঠাতে দলগুলো কী কৌশল গ্রহণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশে; বিশেষত ক্ষমতার পালাবদলের সময় বা কোনো রাজনেতিক ইস্যুতে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সেই সমস্যা তীব্রতরভাবে আবির্ভূত হয়। শুরু হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচ- লড়াই। মনে হয়, সবাই যেন ওঁৎপেতে থাকে এই সময়ের জন্য। আগেভাগে সমস্যার সমাধানের কথা কানেই তোলা হয় না। এই যে নামমাত্র বিরোধী দলের উপস্থিতি, সরকার ও প্রধান প্রধান বিরোধী দলের দূরত্ব, সেটা কমানোর উদ্যোগ, সংলাপ ও আলোচনার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি অতীতে। এবার বেগম জিয়ার দল নির্বাচনে এলে তাদের সঙ্গে যথাযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দূরত্ব ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে সরকার বা বিরোধী কারোই লাভ হবে না; জনগণের দুর্ভোগ কমবে না। গণতান্ত্রিকতার পরিবেশও সম্প্রসারিত হবে না। এভাবে দূরত্ব বাড়ানোর ফলে সমাধানের পথটিও থেকে যাবে অধরা। এ পরিস্থিতি কাম্য নয়, শুভ নয়, কল্যাণকর নয়। বুদ্ধিমান-বিবেকী মানুষের কাজ হলো শান্তি ও কল্যাণের পথ সন্ধান করা; সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করা। এতেই সবার মঙ্গল। পৌর নির্বাচন সামনে রেখে যে ভোটের আমেজ ও নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়েছে, সেটাকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পথে নিয়ে যেতে সম্ভাব্য সবকিছু করার জন্য সব পক্ষকে সচেষ্ট থাকতে হবে। অতীতের ভুল ও ভ্রান্তির যেমন পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়, তেমনি অতীতের হিংসা-বিদ্বেষও নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসা উচিত হবে না। নতুন উদ্যমে গণতন্ত্রের পথে নবঅভিযাত্রাই প্রত্যাশিত দেশ-বিদেশের সবার কাছে। এই কথাটি সংশ্লিষ্টরা মনে রাখলেই একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক পৌর নির্বাচন আশা করা যায়।
আন্দোলনে আন্দোলনে অনেকগুলো বছর পাড়ি দেয়া বিরোধী নেতাকর্মীরা পৌর নির্বাচনকে সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। আবার যেহেতু বিষয়টি নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক স্তর পেরিয়ে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে পরিণত হচ্ছে, সেহেতু রাজনৈতিক শক্তি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে এই নির্বাচনে। ফলে বিষয়টি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। নির্বাচনে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে বিজয় অর্জন করলে সেটা যেমন সরকারের জনপ্রিয়তার নিম্নগামিতার প্রমাণ হবে, তেমনি নির্বাচনে বিরোধীরা সঠিক সুযোগ না পেলে বা কারচুপির ঘটনা ঘটলে নতুন আন্দোলনের সূত্র তৈরি হবে। ফলে এই নির্বাচন নিছক পৌর নির্বাচন থাকছে না, জাতীয় রাজনীতির একটি প্রতিফলনে পরিণত হচ্ছে। বরং জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব তৃণমূল ও স্থানীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ারও একটা ঝুঁকি থাকছে। তাই সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচন যেন ত্রুটিযুক্ত হয়ে সমস্যার কারণ না হয়; বরং ত্রুটিমুক্ত হয়ে সমস্যার সমাধানের পথ দেখায়- সেটাই সবার কামনা।

শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আমির খান শাহরুখ খান ও এ আর রহমানের বিরুদ্ধে শিবসেনা ও হিন্দু পরিষদের হুঙ্কার


ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির ভূমিধস বিজয়ের পর ভারতের নতুন কেন্দ্রীয় সরকার ভারতবাসী এবং সেই সাথে বিশ্ববাসীকে দেখাতে এবং বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, বর্তমান সরকার তার অতীতের সাম্প্রদায়িক রং মুছে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে যে, ঐগুলি ছিল নেহায়েত আইওয়াশ বা ধোঁকাবাজি। যদি তা না হয় তাহলে আরও ভয়ের কথা। সেক্ষেত্রে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে, বিজেপি তার প্যারেন্ট সংগঠন আরএসএসের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর ১ বছর ৫ মাস হয়ে গেছে। অথচ যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে যে, বিজেপির মিত্র সংগঠনগুলো উগ্র সাম্প্রদায়িক রূপ নিচ্ছে। ভারতে হিন্দু সমাজ যখন সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় তখন তার অবধারিত পরিণতিতে তার অভিঘাত এসে পড়ে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর। এবারও তাই হয়েছে। গরু জবাই করা বা গো-মাংস ভক্ষণ করা না করা নিয়ে ভারতের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় যে মহড়া দিচ্ছে তার পরিণতিতে ইতোমধ্যেই ৩/৪ জন মুসলমানের প্রাণ গেছে। এখন উগ্রবাদী হিন্দুরা হাত বাড়িয়েছে ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের ওপর। তাদের সেই হিন্দু উগ্রবাদের শিকার হয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র মি. পারফেক্টশনিস্ট বলে খ্যাত অভিনয় শিল্পী আমির খানের ওপর। আমির খানের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী হিন্দুদের মহড়া এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, বিষয়টি ভারতের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্লামেন্ট বা লোকসভায় উত্থাপন করেছেন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা মিসেস সোনিয়া গান্ধী। সোনিয়া গান্ধী এতদূরও বলেছেন যে, সম্প্রতি ভারতে এমন কিছু ঘটছে, যার ফলে ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতি এবং মূল্যবোধ বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, সোনিয়া গান্ধী এমন এক ব্যক্তি যার মন্তব্য হালকাভাবে নেওয়া যায় না। এই তো দেড় বছর আগেও সমগ্র ভারতে দুই দুইটি মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। আর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী না হলেও, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তথা কংগ্রেস সরকারের নেপথ্য চালিকা শক্তি ছিলেন মিসেস সোনিয়া গান্ধী। আগামীতে কংগ্রেস যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসে তাহলে বয়সের কারণে সোনিয়া প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করলেও প্রধানমন্ত্রীর গদিতে আসীন হবেন তারই ছেলে রাহুল গান্ধী।
গত বৃহস্পতিবার লোকসভায় সংবিধানের ওপর বিশেষ আলোচনাকালে সোনিয়া গান্ধী মোদি সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, “সাম্প্রতিককালে সংবিধানের নীতিমালার প্রতি হুমকি দেখা দিয়েছে। বিগত কয়েক মাসে আমরা যা দেখেছি সেটি সংবিধানের মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন।” ভারতের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ‘এনডিটিভির’ খবরে বলা হয় যে, লোকসভার চলতি শীতকালীন অধিবেশনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে সোনিয়া গান্ধী বলেন, ভারতে এখন দেখা যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। তিনি বলেন, একটি সংবিধান যতই ভাল হোক না কেন, যারা সেই সংবিধান বাস্তবায়ন করে তারা খারাপ হলে সেই ভাল সংবিধানও খারাপ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে একটি সংবিধান যতই খারাপ হোক না কেন, যারা সেই সংবিধান বাস্তবায়ন করে তারা যদি ভাল লোক হয় তাহলে একটি খারাপ সংবিধানও ভাল হয়ে যায়। পক্ষান্তরে লোকসভায় বিজেপির উপনেতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজ নাথ সিং বলেন, “দেশে আজ যে শব্দটির সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করা হচ্ছে সেটি হলো সেক্যুলারিজম। এই অপব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এই শব্দের অপব্যবহারের ফলে ভারতীয় সমাজে আজ উত্তেজনা এবং অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় সংবিধানের শুরুতে সেক্যুলারিজম এবং সোশ্যালিজম শব্দ দুটি ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর শব্দ দুটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি বলেন, হিন্দিতে সেক্যুলারিজমের অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নয়। এর হিন্দি অর্থ হলো, পন্থ বা পথ নিরপেক্ষতা। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক হওয়া। আপনি যেই হোন না কেন, এবং যে ধর্মেই আপনি বিশ্বাসী হোন না কেন, ভারতের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আপনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।”
বামপন্থী নেতা সীতা রাম ইয়াচুরি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজ নাথ সিংয়ের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে ফুটে বেরিয়েছে বিজেপির আসল মতলব। তারা চায় একটি হিন্দু রাষ্ট্র। আরএসএস কোনোদিন ধর্ম নিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেনি। তিনি বলেন, রাজ নাথ সিং সেক্যুলারিজমের যে হিন্দি অর্থই বলুন না কেন সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে, এমনকি সংসদের বিলসমূহেও সেক্যুলারিজমের অর্থ করা হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা।
পক্ষান্তরে সোনিয়া গান্ধী বলেন, আমরা বিগত কয়েক মাসে দেখছি সংবিধানের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
॥দুই॥
ঢাকার একটি বাংলা পত্রিকার দিল্লী প্রতিনিধি প্রেরিত খবরে প্রকাশ, কংগ্রেসের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে সংবিধান নিয়ে এবং সেই সুবাদে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে, নাম নেওয়া না হলেও সেই বিতর্কের কেন্দ্র ছিলেন ভারতের হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়ক আমির খান। ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম রূপকার বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন হচ্ছে। আমির খানের নাম না ধরলেও বিজেপির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি রাজ নাথ সিং বলেন, জীবনকালে আম্বেদকরকে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে, পদে পদে বাধা পেতে হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনো দিন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি। আমির খান গত সোমবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার ঘটনাগুলোয় তিনি আতঙ্কগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিরণ (আমির খানের স্ত্রী) এতটাই উদ্বিগ্ন যে আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের কি ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত?’ আমির খানের এ মন্তব্যে ভারতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক শুরু হয় বলিউডের ভেতরেও। আমিরের পাশে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত কেউ কেউ দিলেও, আক্রমণই সহ্য করতে হয় বেশি।
আমির খানের সাম্প্রতিক মন্তব্য ভারতে চলমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার একটি বহিঃপ্রকাশ। ভারতে স্বাধীন মত প্রকাশকারী একজন শিক্ষাবিদকে সম্প্রতি হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গরুর মাংস নিয়ে গুজবের জেরে সহিংস হামলায় আরও দুজন নিহত হন। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে ভারত জুড়ে সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকারসহ অন্তত ৭৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি তাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেন।
সংসদে রাজনাথ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র শব্দ দুটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রথমে ছিল না। কারণ, আম্বেদকর মনে করেছিলেন, দুটি বিষয়ই ভারতের মূল প্রকৃতির মধ্যে নিহিত। রাজনাথ বলেন, এ দেশে যে শব্দটির অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি, তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ। এই শব্দটির বদলে ‘পন্থ (পথ) নিরপেক্ষ’ ব্যবহার হওয়া উচিত।
আমির খান জানিয়েছেন, তার স্ত্রী কিরণ রাও সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ ভীত হয়ে পড়েছেন। আমির নিজের অবস্থান থেকে জানান, তিনি ভারতের এই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ইদানীং দৈনিক সংবাদপত্র পড়তেও তিনি ভয় পান। তার স্ত্রী কিরণ বলেছে যে, সে আসলেই সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আমাদের চারপাশের প্রতিদিনের  বদলে যাওয়া পরিবেশ নিয়ে সে ভীত। ইদানীং সে সকালের খবরের কাগজটা খুলতেও ভয় পাচ্ছে।’ আমির খান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানেই তিনি এ কথা বলেন। আমির খান বলেন, প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললে যা পড়ি তাতে একজন মানুষ হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে সত্যিই বলছি, আমার ভেতরে যে ভয় ও আতঙ্ক ক্রমশ দানা বাঁধছে, তা আমি অস্বীকার করতে পারবো না।
॥তিন॥
ভারতজুড়ে ক্রমবর্ধমান এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিপরীতে প্রতিবাদ জানাতে দেশটির বিভিন্ন অংশের খ্যাতিমান ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, বিজ্ঞানী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয় শিল্পীদের পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন আমির খান নিজেও। তিনি জানিয়েছেন, যত দিন এই প্রতিবাদের বিষয়টি অহিংস প্রতিবাদ থাকবে ততদিন তিনি একে সমর্থন করবেন। ভারতের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে আমিরের ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সংগীত জাদুকর এ আর রহমান।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানকে ফের হিন্দুত্বে ফিরে আসার আহ্বান জানান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দক্ষিণ ভারতের তামিল নাড়ুতে (সাবেক মাদ্রাজ) জন্ম নেওয়া এই অসাধারণ গুণী সংগীত পরিচালক ইতঃপূর্বে হিন্দু ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার মাতা এবং বোনসহ সপরিবারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯৬৭ সালে জন্ম গ্রহণকারী এই বিখ্যাত সংগীত শিল্পী মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৮৮ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার আগের নাম ছিল এ এস দীলিপ কুমার। ইসলাম গ্রহণের পর তার নতুন নাম হয় আল্লাহ রাখা রহমান বা এ আর রহমান।
এ আর রহমান বলেন, সভ্য সমাজে এই ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক নয়। রহমান বলেন, ‘কোনো কিছুই হিংস্র হওয়া উচিত নয়। আমরা সবাই তো সভ্য সমাজের বাসিন্দা। আমাদের গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া উচিত যে আমরাই সব থেকে বেশি সভ্য।’ ঐ দিকে আমির খানের এমন মন্তব্যের পর ভারতজুড়ে আলোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এরই মধ্যে আমিরকে ভারত ছাড়ার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক অভিনেতা-শিল্পীও আমির খানের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছেন। প্রবীণ অভিনেতা অনুপম খের টুইট করেছেন, ‘আমির কি নিজের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছেন ভারত ছেড়ে তিনি কোথায় যেতে চান?’ ভারতই যে তাকে আমির খান বানিয়েছে সেটাও তাকে মনে করিয়ে দেন অনুপম খের। এর কিছুক্ষণ  পরেই বিজেপির মুখপাত্র শাহ নওয়াজ হুসেন অভিযোগ করেন, আমির খানের এই মন্তব্য ভারতকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার কথায়, ‘আমিরের নামডাক-ধনদৌলত সব এই ভারতের লোকই দিয়েছে। আজ সুপার স্টার হওয়ার পর তিনি যখন এ ধরনের কথা বলেন তাতে ভারতবিরোধীরাই আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের বদনাম করার সুযোগ পেয়ে যান। এতে হয়তো আমির সস্তা প্রচার পেতে পারেন, কিন্তু ভারতের গায়ে যে কালির ছিটে লেগে যায় সেটা তিনি খেয়াল করেন না।’ আমির বিরোধী এই কোরাসে যোগ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারাও। ভারতের মানুষই যে তাকে আমির খান বানিয়েছেন, মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে সে কথাও। দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে মুখ খুলে কিছুদিন আগেই বিজেপির কট্টরপন্থী নেতাদের রোষের মুখে পড়েছিলেন বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান। তাকে পাকিস্তান চলে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন কেউ কেউ।
॥চার॥
আরেক দিকে আমিরের বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেস আমিরের মন্তব্যকে সমর্থন করায় বিষয়টি এখন রাজনৈতিকভাবে বেশ আলোচিত হচ্ছে। তবে আমির আপাতত চুপ আছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে যেভাবে সন্ত্রাসবাদ দানা বাঁধছে, তা নিয়েও কথা বলেন আমির খান। আমির খান মনে করেন, ধর্মের সঙ্গে আতঙ্কবাদকে জুড়ে দেয়া উচিত নয়। আমিরের কথায়, ‘সন্ত্রাসবাদীদের কোনো ধর্ম নেই। তা সত্ত্বেও কোনো হিংসার ঘটনা ঘটলে, তার সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা আগে খুঁজি সে ইসলামিক জঙ্গি নাকি হিন্দু জঙ্গি।
প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’ বলেছে, পাঞ্জাব শিবসেনা প্রধান রাজীব ট্যান্ডন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ভারতে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে- এই মন্তব্য করার জন্য আমির খানের গালে কেউ চড় মারতে পারলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে। আমির খান শুটিং করতে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা শহরের যে হোটেলে উঠেছেন, তার বাইরে শিবসেনা বিক্ষোভ করেছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গতকাল কলকাতায় একটি জনসভায় বলেছেন, আমির খান যে মন্তব্যই করে থাকুন না কেন তার জন্য তাকে দেশছাড়া করতে চাওয়ার অধিকার কারও নেই। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলেছে, অনলাইনে একটি জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছে; অসহিষ্ণুতা ইস্যুতে আমির খানের ব্যাপারে বিজেপির অবস্থানকে ৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ সমর্থন করে।
পাঞ্জাবে শিবসেনা নেতা রাজীব ট্যান্ডন বুধবার বলেন, ‘আমির খানের গালে যে চড় দিতে পারবে তাকে এক লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের দেশে বাস করে কেউ যাতে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস না পায়। যে কেউ, সে হোটেলের কর্মচারী কিংবা ফিল্ম ক্রু; যে-ই হোক না কেন, তাকে (আমির) চড় মারতে পারবে তাকেই লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে।’
কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্যান্ডন ব্যক্তিগতভাবে এই ‘পুরস্কার’ ঘোষণা করেছেন। এটা সংগঠনের সিদ্ধান্ত নয়।
লেখাটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন লেখাটি মেইল করব তখন অনলাইন দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ এবং অনলাইন পেপার ‘আমাদের সময় ডট কমে’ এই মর্মে খবর বেরিয়েছে যে, গত শুক্রবার আমির খান ভারত ছেড়েছেন। ভারতীয় পত্রপত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের এই দুটি পত্রিকা লিখেছে যে, আমির খান ঠিক কোথায় গেছেন, সেটা কেউ এই মুহূর্তে সঠিক বলতে পারছেন না। তবে তার সম্ভাব্য গন্তব্য আমেরিকা বলে তার ঘনিষ্ঠ মহল ধারণা করছেন।
খবরটি এখনও কনফার্মড নয়। তাই আমরা এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম।

শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিবেক যখন আদালতের কাঠগড়ায়


এক.
বিদগ্ধ অস্তিত্বের উচ্চ কণ্ঠ যখন বিস্ফোরিত...
নিজের বিবেকের অসহনীয় যন্ত্রণা আমাকে বার বার করাঘাত করে ফিরছে, অনেক সত্য ঘটনা আমি হৃদয়ের গোপন সিন্দুকে বদ্ধ করেছি, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি, নিজের বুকের ভিতরের গুমোট কান্নাকে অনেক কষ্টে সংবরণ করেছি। সুনীল দিগন্তের বিস্তর নয়ন যখন তাকিযে দেখে অসহায় অবলোকন নেত্রে অসহায় মজলুমের উপর-শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, চিরঞ্জীব সত্যকে মিথ্যার বেড়াজালে-বেড়ী পরিয়ে ধ্বজাধারী করে রেখেছে এ সমাজের সুশীল নামক একদল হায়েনার দল। তখনও আমার বিবেক জাগ্রত হয়নি। অতন্দ্রের প্রহরী বিবেককে বলি তোমার মাটির সন্তানেরা- কি পারে না তাদের অসহায় নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে? লাখো কোটি মানুষের রক্তে রঞ্জিত এদেশ আমার জন্মভূমি। আমরা জয়-পরাজয়ে হেরে যাওয়র জাতি নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের সোনালী ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে চাই, ঘুমন্ত স্তব্ধ নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে চাই আর একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। আমরা কি পারি না! প্রিয় জন্মভূমিকে বাঁচাতে আর একজন স্পেন বিজয়ী তৈরী করতে?
দুই.
একজন ভাল মানুষের গল্প...
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সরকার এর আগমনে দেশের সাধারণ মানুষ খুব খুশি। তবে একটু কষ্টে আছে দেশের প্রধান কর্তা ব্যক্তিরা। কারণ একটাই তাদের দুর্নীতি আর খলনায়কের চেহারা আজ প্রকাশ করছে কথিত ডক্টর বাহিনী। সারাদেশে চলছে ত্রাণের টিন উদ্ধারের মহোৎসব। রাজনীতিবিদ নামের মুখোশধারী কুলাঙ্গার সন্ত্রাসীদের কারণে মিডিয়ার সাংবাদিকদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধিজীবী নামে যারা খ্যাতি লাভ করেছে তারাও খুব সাবধানে কথা বলছে, আর বলবেই না কেন- একটু খানি সত্য কথা বললেই তো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কথিত গুয়ান্তানামো-বে কারাগারে। যেখানে রয়েছে দেশের বড় বড় বাঘ, হরিণ, ইঁদুর, শিয়াল ইত্যাদি আরও কত কি! ঠিক সেই মুহূর্তে আমার খুব নিকটাত্মীয়, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, শুনলাম তার নামে দুদক বাদী হয়ে মামলা করেছে। অবশ্য তার সাথে আরও কিছু সত্যের পথিকের নামও যুক্ত ছিল। আমি একটু উৎসাহী হয়ে বিস্তারিত জানার জন্য তৎকালীন প্রশাসনের ভাল মানুষদের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম- তাদের অপরাধ গরীব-দুঃখী মানুষের জন্য সরকারের দেয়া বরাদ্দ টিন তারা আর্তসাৎ করেছে। তখন সেই নিকটাত্মীয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের নামে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু। উনি আমাকে বললেন যে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ইসলামী পাঠাগার নির্মাণের জন্য সরকার কিছু ত্রাণের টিন বরাদ্দ দিয়েছিল- আমরা সে অনুযায়ী ইউএনও স্যারের মাধমে ত্রাণের টিন নিয়ে পাঠাগার নির্মাণ করি। এখন সরকার বলছে যে, “আমরা নাকি গরীব-দুঃখী মানুষের জন্য বরাদ্দ দেয়া টিন আত্মসাৎ করেছি”। আমি তখন উনাকে বললাম আপনাদের যে কাগজগুলো দিয়ে ঢেউটিন বরাদ্দ দিয়েছিল সেগুলো আমাকে দেখান। উনি আমাকে সবকিছু দেখালে আমি বললাম আদালতের রায় আপনাদের পক্ষে আসবে ইনশাআল্লাহ্। এখন আপনারা আল্লাহকে ডাকুন। এর কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে শুনলাম আমার সেই আপনজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক দৌড়াদৌড়ির পর ১২ দিনের মাথায় তাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে এলাম। উনি জেলে থাকাবস্থায় পেপার পত্রিকায় এই ব্যাপারটি নিয়ে খুব হৈ চৈ হয়েছিল। যেদিন তাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে এলাম ঠিক তার পরের দিন দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে চিঠি এল আপনাদের এই কেস একেবারেই ঝঃধু করা হল। আগামীতে এই মামলার কোন কার্যক্রম আর কখনও গ্রহণ করা হবে না। সবাই যেটা জানে আমিও সে প্রবাদটা জানতাম- সত্যের জয় চির অনস্বীকার্য। তাই হয়েছে। সত্যের জয় হয়েছে একজন ভাল মানুষের, কিন্তু তাকে যে, জেলে থাকতে হয়েছে বিনা অপরাধে, তার পরিবারকে সমাজের লোক ধিক্কার দিয়েছে, অর্থের সেলামী গুনতে হয়েছে এর বিচার করবে কে?
আমার নিকটাত্মীয় মুক্তি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল কিন্তু আমি খুশি হতে পারিনি। কারণ এক অসহনীয় যন্ত্রণার কাছে আমার নৈতিক স্পন্দন বারবার আঘাত খাচ্ছিল। আমি আামর জাগ্রত বিবেককে প্রশ্ন করেছিলাম- এই কি স্বাধীন বাংলার দুর্নীতি দমন কমিশন যেখানে নিরপরাধ ভাল মানুষটিকে সমাজের চোখে ঘৃণ্য ব্যক্তিতে পরিণত করে- কেন আবার নির্দোষ প্রমাণ করল। এই প্রশ্নের জবাব কি দিতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন !!
তিন.
কবে বন্ধ হবে গণমাধ্যমের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ?
৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪’র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ-৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব ইতিহাস-সংগ্রামে ছিল স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা। যখনই সরকার গণমাধ্যমকে কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে তখনই জনগণই তাদেরকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি কণ্টকাকীর্ণ মুহূর্তে লেখক-সাংবাদিক ও কলামিস্টরা অসামান্য অবদান  রেখেছেন।
আজ প্রত্যাশের প্রহর গুনতে থাকি কবে বন্ধ হবে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণের উপর সরকারের অবৈধ খড়গ হস্তক্ষেপ। পরিশেষে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য আমরা এগিয়ে যায়...বিদায় বেলায় ফরাসি সাহিত্যের দিকপাল লুই আরাগঁ’র সেই অমর বাণী “মহত্তম অভীষ্টের জন্য এক চিৎকার”- আসুন গণমাধ্যম নিপীড়নের প্রতিবাদে নির্ভয়ে সত্য অভীষ্টের জন্য কোটি কোটি কণ্ঠ এক সাথে প্রতিবাদ করি। 
সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম 

বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এমআরপিতে পিছিয়ে পড়লো দেশ


২৪ নবেম্বর ছিল হাতে লেখা পাসপোর্টের শেষদিন। এখন আর হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে কোনো দেশে যাতায়াত করা যাবে না। এজন্য লাগবে এমআরপি বা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বা চুক্তিটি করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। জাতিসংঘের অধীনস্থ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের ২৪ নবেম্বরের মধ্যে সব দেশ এমআরপি প্রবর্তন করবে এবং এ সময়ের পর হাতে লেখা পাসপোর্টে কোনো দেশের নাগরিকই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্য সব দেশ এমআরপি প্রবর্তন করে ফেললেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পেড়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রবাসে বসবাসরত ১৫ থেকে ২০ লাখ বাংলাদেশী এখনো এমআরপি পাননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হিসাবে এমআরপি না পাওয়াদের সংখ্যা ১১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৭। অন্যদিকে পাসপোর্ট অধিদফতর বলেছে, তাদের সংখ্যা ২ লাখের বেশি হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মন্দ শোনায়নি। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানানো হয়েছে, হাতে লেখা পাসপোর্টধারীরা কেউ চাইলে তাকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ বাংলাদেশ মিশন থেকে একটি পাসপোর্ট বা ট্রাভেল পাস দেয়া হবে এবং সেটা দেখিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসতে পারবেন। ২৪ নবেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ ব্যক্তিকে এমআরপি দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে প্রবাসী কতজন রয়েছেন, সে হিসাব অবশ্য দেয়া হয়নি।
উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ- সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী চাকরি করছেন। বহু বছর ধরে এসব দেশে বসবাসও করছেন তারা। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে এমআরপি না পাওয়ায় বিপদেও পড়েছেন তারাই; তাদের প্রকৃত সংখ্যা যত কম আর বেশিই হোক না কেন। এমন অবস্থার কারণ জানাতে গিয়ে দায়িত্বশীল সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়, এ বিপুলসংখ্যক এমআরপি বাংলাদেশে তৈরি করা এবং যথাসময়ে অর্থাৎ ২৪ নবেম্বরের আগে প্রবাসীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার সম্ভাবনা প্রথম থেকেই ছিল না। কারণ অনেক উপলক্ষেই হিসাব করে দেখা গেছে, ৫৫টি দেশের মিশনে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১০/১৫ লাখের বেশি এমআরপি তৈরি করা যেত না। তার ওপর ছিল জনবল ও নতুন পাসপোর্টের সঙ্কট। বিদেশের মিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, দেশের ভেতরে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এমআরপি তৈরির কাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি হলেও বিদেশের মিশনগুলোর কর্মকর্তারা শুরু থেকেই অযোগ্যতা দেখিয়ে এসেছেন। তাছাড়া শুধু তৈরি করলে চলবে না, ২৪ নবেম্বরের মধ্যে প্রত্যেক প্রবাসীর কাছে এমআরপি পৌঁছে দেয়ারও দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আসলে সম্ভব ছিলও না। ওদিকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ পাওয়া বিদেশী কনসোর্টিয়ামের ব্যর্থতা ও প্রতারণাপূর্ণ কর্মকা-ের কথাও জানা গেছে খবরে। তথ্য সংগ্রহ থেকে ছবি তোলা ও স্বাক্ষর নেয়া পর্যন্ত কাজগুলো তো করেইনি, বরং চাহিদা অনুযায়ী পাসপোর্ট সরবরাহেও ব্যর্থ হয়েছে ওই কনসোর্টিয়াম। বলা দরকার, সময়মতো এমআরপি না পাওয়ায় প্রবাসীরা শুধু চাকরিই হারাবেন না, দেশে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও বাধাগ্রস্ত হবেন। অনেককে এমনকি কারাগারেও যেতে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনোভাবেই আশান্বিত হওয়ার মতো নয়। এর মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে ‘তাৎক্ষণিক’ ব্যবস্থা নেয়ার গালগল্প শোনানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে এমআরপিকেন্দ্রিক পরিস্থিতি যে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমআরপি না থাকায় বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকমাত্রকেই কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে। ওদিকে বিপদে পড়বেন বিশেষ করে প্রবাসীরা। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের গাফিলতি। কারণ ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এমআরপি তৈরির প্রকল্পই শুরু হয়েছে দীর্ঘ ১৮ বছর পর, ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে। এমআরপি যে বাধ্যতামূলক, সে ঘোষণা দিতেও সরকার অনেক দেরি করেছে। ফলে সাধ্য এবং আগ্রহ থাকলেও প্রবাসীদের পাশাপাশি অন্য নাগরিকরাও অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। নানা কাজে বিদেশে যাতায়াত করেন- এমন অনেকেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এমআরপি করে উঠতে পারেননি। অথচ সরকার যদি যথেষ্ট সময় থাকতে উদ্যোগ নিত এবং জনগণকে অবহিত করত তাহলে জটিলতা ও সমস্যা এড়ানো সম্ভব হতো। তেমন অবস্থায় প্রবাসীসহ অন্য নাগরিকরাও আগে থেকে সচেষ্ট হতেন। এজন্যই সরকারের পক্ষে দায়দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না।
আমাদের মতে, বর্তমান পর্যায়ে বেশি দরকার প্রবাসীসহ সব আগ্রহী নাগরিকের জন্য এমআরপি সরবরাহের তৎপরতা জোরদার করা। দেশের ভেতরে জেলা ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পাসপোর্ট অফিসগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে হবে, জনবল বাড়াতে হবে কয়েকগুণ। নতুন পাসপোর্টের সঙ্কটও দূর করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোকে এমনভাবে সক্রিয় করতে হবে, যেন প্রবাসীরা স্বল্পসময়ের মধ্যে এমআরপি হাতে পেতে পারেন- যাতে কথিত ‘তাৎক্ষণিক’ ব্যবস্থার জন্য হাপিত্যেশ না করতে হয়। এ ব্যাপারে বিলম্ব, নিষ্ক্রিয়তা বা ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ যাতে না ওঠে, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া ঠিক কোন কোন মহলের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ এমআরপির ক্ষেত্রে এত বেশি পিছিয়ে পড়েছে, তারও তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মিথ্যার দুর্দান্ত বেসাতি


বর্তমান সরকার যেমন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তেমনি তাদের সকল কর্মকাণ্ডেও আছে মিথ্যারই প্রাধান্য। অতীত ইতিহাস নিয়ে যেমন তারা অবিরাম মিথ্যাচার করে, তেমনি সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়েও তারা ডাহা মিথ্যা বলতে কসুর করে না। আবার একটি মিথ্যা কথা প্রতিষ্ঠিত করতে শতটা মিথ্যা কথা বলতে হয়। ফলে সকালের কথার সঙ্গে বিকালের কথার কোনো সঙ্গতি থাকে না। একজনের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথার কোনো মিল পাওয়া যায় না। এভাবে এক ঘোরের মধ্যে চলছে সরকার। কিন্তু তারা উপলব্ধিই করতে পারছে না যে, জনগণ আসল সত্যটি বেছে নেয়। তারা জানে, কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা।
সরকার এমনই এক মিথ্যার নাটক করলো গত শনিবার মধ্যরাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে। দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সরকার এর আগেও জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে।
এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরই যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্ষুদ্র দল ছিল। তার  চেয়ে অনেক বড় দল ছিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি রাজনৈতিক দল। তারপরও বিশেষভাবে জামায়াতকে অভিযুক্ত করায় প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জামায়াতকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা পাকিস্তানীদের সহায়তা করেছিল, তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালেই জারি করা হয়েছিল দালাল আইন। তাতে লক্ষাধিক লোককে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির বিভক্তি এড়াতে ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। একথা মানতে হবে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে সাধারণ মানুষের কেউ পাকিস্তানের অবলুপ্তি চাননি। আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যও ছিল স্বায়ত্তশাসন আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর একগুঁয়েমির কারণে ২৫ মার্চ (১৯৭১) পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ। যদিও এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় নেতাদের অনেকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা তা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু ভুট্টো বিশেষভাবে বিরোধিতা করায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
দালাল আইন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই। তখন সবার কাছে সে স্মৃতি টাটকা ছিল। কে কী করেছে, না করেছে, প্রত্যেকে তা দেখেছেনও। যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হতো, তাহলে সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের একটি অভিযোগও কেউ দায়ের না করায় আইনটি রদ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৩৬ বছর পর নতুন করে শুরু করা হয় যুদ্ধাপরাধের মামলা, যখন সকল স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। এরপর দেয়া শুরু হয় একের পর এক মৃত্যুদণ্ড।
এর আগেও যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, তাদের কেউই প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। যদিও সংবিধানে আবেদন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলেই যে কাউকে যে কোনো দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করতে পারেন। সেভাবেই কোনো আবেদন বা আত্মসমর্পণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট এক আওয়ামী নেত্রীর ছেলের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছিলেন। যদিও এ ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট সার্বভৌম নন। এ জন্য তার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে। আর জামায়াত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর যে মনোভাব তাতে স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, এদের দণ্ড মওকুফ বা হ্রাসের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই এবং ছিলও না।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ক্ষমাপ্রার্থনার এক দুর্বল প্রহসন অনুষ্ঠান করলো। কাজটা এতই কাঁচা ছিল যে, একজন বালকও বুঝতে পারবে, এটা সত্য নয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন শনিবার সকালের দিকে কারাগারের ভেতরে ঢুকলেন দুজন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর থেকে সরকার প্রচার চালাতে থাকলো যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন, তার মুসাবিদা করতে গেছেন ঐ দুই ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর ঐ দু’জন যখন ফিরলেন, তখন সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ কোনো প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা। জবাবে একটি কথাও না বলে চলে যান তারা। প্রচার করা হলো তারা প্রাণভিক্ষার মুসাবিদা করতে গেছেন। তা হলে ফেরার সময় কেন তারা বলতে পারবেন না যে, সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কিনা।
এর আগে শুক্রবার দণ্ডিত ঐ দুজনের আইনজীবীরা তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার আবেদন করেন। কারা ফটকে অপেক্ষা করেন। আবেদনপত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও সরকারে যুক্তি ছিল বড় অদ্ভুত। প্রতিবারই কারাকর্তৃপক্ষ জানান যে, কারাগারে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাজির নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির ছিলেন না, কিন্তু তারা টেলিফোন দূরত্বের বাইরে ছিলেন না। নিম্নতর কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানাতে পারতেন, আইনজীবীদের ভেতরে যেতে দেয়া হবে কি হবে না।
আসলে সরকার যে নাটক মঞ্চস্থ করতে মনস্থ করেছিল, আইনজীবীরা দণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললে সে নাটক ভেস্তে যেত সহজেই ও বেশ আগেই। সে কারণেই ঠুনকো কথা বলে আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়নি তারা। এরপর সরকার প্রচার করতে শুরু করলো যে, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সরকারের এই রটনা কেউই বিশ্বাস করেনি। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তার আইনজীবীদের কারাগারের ভেতরে যেতে দেয়া হোক, আর সালাহ উদ্দিন-মুজাহিদের সঙ্গে কথা বলে এসে তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাক প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে প্রাণভিক্ষা ও প্রেসিডেন্টের তা নাকচের যুক্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে গেছে।
আইনজীবী ও সাংবাদিকরাও বিশ্বাস করেননি যে, তারা দু’জন প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। বিশ্বাস করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সে আবেদনের কপি দেখতে চান। বিপত্তি বাধে তখনই। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন দেখানো যাবে না। তা দেখাতে হলে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। তারা যে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।’
আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই দিন বলেন, ঐ দুজনের প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তারা দু’জনেই সংবিধানের আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। সেই আবেদনের লিখিত ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে। তবে এগুলো সিক্রেট বিষয়, দেখানো যাবে না। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র, চিঠিপত্র আমাদের কাছে আছে। এরপর তিনি এক মেঠো যুক্তি খাড়া করেন। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তার বাবার জন্য সব জায়গায় গেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তারা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এ সম্পর্কে পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। পরে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এক মন্ত্রী ফাঁসি কার্যকর করা ঐ দু’জনের ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠিটি প্রকাশের কথা তোলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, ক্ষমা সংক্রান্ত চিঠি প্রকাশের কিছু নেই। আমাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে।
ফাঁসি কার্যকর করার আগে ঐ দু’জনের পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মতো দেখা করার জন্য কারাগারে ডেকে নেয় জেল কর্তৃপক্ষ। সেখানে সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পরিবার বিশেষ করে ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমার ৬ ফুট ২ ইঞ্চি বাবা কারও কাছে মাথা নত করে না। মার্সি যদি চাই, আল্লাহর কাছে চাইবো, বান্দার কাছে নয়।’ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার পরিবারকে জানান, তিনি কোনো মার্সি পিটিশন করেননি। ‘এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য, কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্যা অপপ্রচারের নাটক করছে।’
লক্ষণীয় যে, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারও কথার সঙ্গে কারও কথার মিল নেই। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে, প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। পরিবারের জানার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে, তারা সংগোপনে আবেদন করেছেন, কিন্তু পরিবারের কাছে তা লুকিয়ে গেছেন। বড় সাংঘাতিক অভিযোগ। আর তাই তথাকথিত প্রাণভিক্ষার ঐ আবেদন দুটি অবিলম্বে প্রকাশ করা জরুরি। তা না হলে সরকারকে মানুষ মিথ্যাচারের অপবাদ দিয়েই যাবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মাথা উঁচু করে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হলেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ


বিশ্বের অগণিত মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ, কান্না ও চোখের পানিতে বুক সিক্ত করার মধ্য দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে পাড়ি জমালেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল, সাবেক মন্ত্রী বিশ্বনন্দিত নেতা জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদে আম শহীদ হাসানুল বান্নার পর এমন উঁচু পর্যায়ের নেতা পৃথিবীর আর কোথাও রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শাহাদাতবরণ করেননি। জনাব মুজাহিদ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর রক্তে রঞ্জিত হল বাংলাদেশের সবুজ জমিন। মহান আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী বান্দা হিসেবে মাথা উঁচু করে তিনি তাঁর রবের একত্ববাদের ঘোষণা দিতে দিতে এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ২২ নবেম্বরের সূচনায় ৫৫ মিনিটে জান্নাতের পথে যাত্রা শুরু করেন।
আমি যখন ছাত্র তখন থেকেই জনাব মুজাহিদের সাথে আমার পরিচয়। ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাকে আমি একজন নেতা হিসেবে পেয়েছি। ছাত্র আন্দোলনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যেভাবে আমাদেরকে গাইড করেছেন তা কখনো ভুলবো না। সদা কর্মতৎপর মুজাহিদ ভাই সব সময় ব্যস্ত থাকতেন সংগঠন নিয়ে। সংগঠনের বিস্তৃতি, অগ্রগতি সাধনে তিনি সব সময় পেরেশান ছিলেন। ছাত্রদের কোন অনুষ্ঠানের ডাক আসলে তিনি অন্য প্রোগ্রাম বাতিল করে সে প্রোগ্রামে উপস্থিত হতেন।
কর্মজীবনে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার সুবাদে তার বন্দী জীবনের কঠিন মুহূর্তে একান্ত অন্তরঙ্গ পরিবেশে কথা বলার সুযোগ হয়। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর নিয়োজিত একজন আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনার সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের মামলার পাশাপাশি ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা-মামলার শুনানিতে প্রতি সপ্তাহে তাকে দুই/তিন দিন করে আদালতে হাজির করা হতো। এ সময় সাক্ষাৎকালে মামলার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক বিষয়ে অনেক কথা হয়।
প্রায় ৫ বছর ৫ মাসের বন্দী জীবনে তিনি পরিবার, দল ও সাধারণ মানুষ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে তার সান্নিধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ এক মহা সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সেই সৌভাগ্য দান করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তাঁর আপীল খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে এবং পূর্বে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গিয়েছেন। মামলা পরিচালনার সুবাদে দেশের রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, তিনি যে দল করতেন সে দলের সাংগঠনিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সব কথা বার্তা বলেছেন তা এ দেশের মানুষের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন চিন্তা এবং অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী মুজাহিদ ভাই সবসময় নিজের মত করেই সবকিছু দেখতে অভ্যস্থ ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইতিবাচক। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী একজন মানুষ। দুশমন ক্ষতি করতে পারে এ ভাবনা কখনো তাঁর মনে ছিল না। মানবিকতা সবসময় তার অন্তরকে তাড়িত করতো। তিনি নেতিবাচক চিন্তাকে কখনো পাত্তা দিতেন না। সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কোথাও কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা শক্তভাবে ধরতেন। আর এ জন্য অনেকের কাছেই তিনি একজন কঠোর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন সরল মনের অধিকারী।
জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বদাই এক আলোচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তাঁর নাম কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবতার মুক্তি আন্দোলনে তিনি আপোষহীন ভূমিকা পালন করেছেন। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থের চাইতে দল এবং দেশের স্বার্থই ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন- তার বিরুদ্ধে সরকারি ষড়যন্ত্র ও তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার কারণে। তাঁর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই। বিনা অভিযোগে একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জনাব মুজাহিদ সরকারি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং প্রতিহিংসার নির্মম শিকার হয়ে তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি কত বড় মজলুম। বাংলাদেশের জনগণের মনের মনির কোঠায় তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। রাষ্ট্রীয় অবিচারের ঘটনা অবহিত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হবে। আর ষড়যন্ত্রকারী ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদেরকে ধিক্কার এবং নিন্দা জানাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তিনি মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেছিলেন। তাঁর আপীল খারিজ হয়ে যাবার পর তিনি রায়ের গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিসমূহ উল্লেখ করে রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জনাব মুজাহিদের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। এ আদেশের পর রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল গণমাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই। এটর্নি জেনারেলের বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্ট হয় যে, শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হওয়ার কারণেই জনাব মুজাহিদকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছে। আইনী বিবেচনায় তিনি নির্দোষ।
রিভিউ খারিজের সংবাদ দ্রুততার সাথে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামপ্রিয় জনতার মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। দেশ-বিদেশ থেকে অবিরতভাবে টেলিফোন আসতে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ বেদনাহত হয়ে পড়েন।
পবিত্র মক্কা নগরী থেকে কয়েক জন টেলিফোন করলেন। তারা জানালেন এ মুহূর্তে তারা খানায়ে কা’বায় তাওয়াফরত অবস্থায় আছেন এবং জনাব মুজাহিদের জন্য কাবা শরীফের গেলাফ ধরে বিশ্ব প্রভুর দরবারে দোয়া করছেন। আরেকজন জানালেন মাকামে সাইয়েদুল ইবরাহীমের পাশে বসে তিনি জনাব মুজাহিদের জন্য সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করছেন। কেউবা ওমরা পালন করছেন এবং তার জন্য দোয়া করছেন।
পবিত্র মদীনা নগরী থেকে একজন ফোন করে বললেন, তিনি এখন মসজিদুন নববীতে। রিয়াজুল জান্নাহ নামক স্থানে বসে তিনি আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে জনাব মুজাহিদের জন্য কান্নাকাটি করছেন। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বুক ফাটা আর্তনাদ ও হাহাকারের খবর আসছে। তাদের ফোনালাপে উপলব্ধি করলাম জনাব মুজাহিদ মানুষের নিকট কত প্রিয়। এ প্রিয় মানুষটিকে হত্যা করে সরকার মূলত প্রতিটি মানুষের কলিজায় আঘাত করেছে।
জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলাটি বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর নিকট একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ায় দিশেহারা হয়ে সরকার তাঁর মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকরের জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। ফেইসবুকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া বন্ধ করে দেয়। যাতে মানুষ সরকারের কুকর্ম জানতে না পারে। সারা দেশে চলতে থাকে ব্যাপক ধরপাকড়। পরিবারের সদস্যগণ এ পরিস্থিতিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জনাব মুজাহিদের সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে যান। কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পরিবারের সদস্যগণ তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাৎকালে ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পূর্বে পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতে জনাব মুজাহিদ যে সব কথা বলেছেন তা যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। নিম্নে তার বক্তব্যের কতিপয় দিক তুলে ধরা হলো-
প্রাণভিক্ষার প্রশ্নই আসে না : জনাব মুজাহিদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন এ জালেম সরকারের নিকট ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রাণের মালিক আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে আত্মসমর্পণ ও ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া আমি কোন দোষ করিনি। সরকার বিনা দোষে আমাকে ফাঁসি দিচ্ছে। আমি এর বিচারের ভার মহান আল্লাহর ওপর অর্পণ করলাম। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক।
আমি বেঈমান নই : জনাব মুজাহিদ তার পরিবারের সদস্যদেরকে বলেন, আমি বেঈমান নই। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী একজন অনুগত বান্দা। আমি দল এবং দেশের প্রতি কখনো বেঈমানী করিনি। আমার ওপর দল যখন যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে আমি তা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। আমার দায়িত্ব পালনে কখনো গাফিলতি ছিল না। দলের স্বার্থে যখন যা উত্তম বলে মনে করেছি নির্দ্বিধায় তাই করেছি।
রাষ্ট্র আমার ওপর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। কোন ধরনের অসৎ ও অসাধুতা আমার নিকট প্রশ্রয় পায়নি। আমি কোন ধরনের নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করিনি। আমার বিরুদ্ধে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দূরবীণ দিয়ে তালাশ করেও দুর্নীতির কোন প্রমাণ পেশ করতে পারেনি।
আমার মাথা উঁচুই থাকবে : পরিবারের সদস্যদের নিকট জনাব মুজাহিদ বলেন, আমি অন্যায়, অসত্য, মিথ্যার নিকট কখনো মাথা নত করিনি। এখনও করব না। আমি মাথা উঁচু করেই মহান রবের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হব, ইনশাআল্লাহ।
একটি বিশেষ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ : জনাব মুজাহিদ বলেন, রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে আমি মনে করি রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক। সেই হিসেবে তিনি আমারও অভিভাবক। আমার ওপর বিগত সাড়ে ৫ বছর যাবত যে সরকারি জুলুম-নির্যাতন এবং অবিচার করা হয়েছে ও বিনা অপরাধে আমাকে সরকারি পরিকল্পনায় যেভাবে ফাঁসানো হয়েছে তার প্রতিকারের জন্য আমি মহামান্য রাষ্টপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ক্ষমা চাওয়ার অপপ্রচার পরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্র : পরিবারের সদস্যগণ কারা কর্তৃপক্ষের আহ্বানে জনাব মুজাহিদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য গেলে তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে জানান আমি রেডিওর খবরের মাধ্যমে অবহিত হয়েছি যে, আমি রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমা চেয়েছি মর্মে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করতে চাই, আমি রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমা চাইনি। জালেম সরকারের নিকট ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার ওপর অবিচারের বিষয়ে রাষ্ট্রতির দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা ক্ষমা চাওয়া হিসেবে যারা প্রচার করেন তারা জঘন্য মিথ্যাচারে নিয়োজিত। এ সরকার বিগত সাড়ে ৫ বছর যাবত আমি ও আমার দলের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালিয়েছে এটা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। তারা আমাকে আমার দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীর নিকট অসম্মানিত করার জন্য ও আমার দলকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এ অপপ্রচার চালিয়েছে। এটা তাদের রাজনৈতিক দেওলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। এ অপপ্রচারে জনগণ বিভ্রান্ত হবে না। আমার শাহাদাতের পর অপপ্রচারের জন্য জনগণ সরকারকে ধিক্কার জানাবে।
আমি শহীদী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাই : শাহাদাত এক মহাসৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তায়ালা যাকে পছন্দ করেন তাকেই শহীদী মৃত্যু দেন। সবার ভাগ্যে শাহাদাতের মৃত্যু জোটে না। আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে পছন্দ করেন এবং শহীদী মৃত্যু দেন সে মৃত্যু আলিঙ্গনের জন্য আমি প্রস্তুত আছি। শহীদী মৃত্যু পরকালে আমার জন্য মহাসৌভাগ্য ও মহাপুরস্কারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
আমার রক্ত ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করবে : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণেই সরকার আমার বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র করেছে। আমি ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করার কারণে আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই আমাকে সরকার হত্যা করছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস সাক্ষী শহীদী রক্ত আল্লাহর দ্বীনকে আরো বেগবান করে। আমি বিশ্বাস করি আমার রক্ত এ জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে আরো মজবুত এবং বেগবান করবে ও ষড়যন্ত্রকারীদের সকল চক্রান্ত বানচাল হয়ে যাবে এবং চক্রান্তকারীরা নির্মূল হয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে আল্লাহর দ্বীন বিজয় লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ জমিনকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করে নিয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের রক্ত বৃথা যাবে না : জনাব মুজাহিদ আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে পরিবারের সদস্যদেরকে বলেন, জামায়াত ও ছাত্রশিবির এ জমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত। এত বড় নেয়ামত কখনো হাতছাড়া করা উচিত নয়। তোমরা সবসময়ই এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। তিনি আরো বলেন, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা বিগত ৬ বছর যাবত যে জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার বদলা আল্লাহ তায়ালা একদিন দিবেন। এই কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শত শত তরুণ এবং যুবকদেরকে জুলুমের শিকার হতে দেখে আমার মনে এই আশার সৃষ্টি হয়েছে যে, এ জমিনে একদিন এ তরুণদের নেতৃত্বে আল্লাহর দ্বীন বিজয় লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। এতটুকু আশা নিয়ে আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারছি। এ জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।
আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ : আমি জালেম সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হওয়ার পর দেশের জনগণ কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনতা আমার মুক্তি আন্দোলনে যে ভূমিকা রেখেছেন ও আমার জন্য যে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সে জন্য আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সর্বোত্তম বদলা দান করুন। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্র এবং প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকগণ আমার প্রতি যে সহানভূতি প্রদর্শন করেছেন এবং মামলা পরিচালনায় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার আইনজীবীগণ রাত-দিন পরিশ্রম করে মামলা মোকাবেলায় যে ভূমিকা পালন করেছেন তাদের সকলের প্রচেষ্টাকে আল্লাহ কবুল করুন এবং সর্বোত্তম বদলা দান করুন।
দেখা হবে জান্নাতে : জনাব মুজাহিদ বলেন, মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান ও দৃঢ় এবং অবিচল অবস্থায় আমি যেন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারি আমি দেশবাসীর কাছে সে দোয়া চাই। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে আমার আচরণে ও  কোন কথায় কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে তা ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমি আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে যেন পরিতৃপ্ত আত্মা নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারি সে জন্য দেশবাসীর দোয়া চাই। এ জালেম সরকার আমাকে আমার প্রিয় ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমি আশা করি কিয়ামতের ময়দানে সকলের সাথে সাক্ষাৎ হবে।
জনাব মুজাহিদ দেশবাসীর প্রতি ছালাম জানান ও দোয়া করতে বলেন।
মতিউর রহমান আকন্দ 

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারতীয় শিল্পীদের অশ্লীল নাচ বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে


অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে গত ২০ নবেম্বর শুক্রবার বিপিএলের তথা কথিত জমকালো উদ্বোধন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে কোনো কোনো পত্রিকায় গর্বভরে বলা হয়েছিল যে, সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি করা হবে। আরও বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশকে কাঁপাতে এই অনুষ্ঠানে নাচ ও গান পরিবেশন করবেন ভারতের হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের নাচিয়ে অভিনেতা হৃত্বিক রোশন, শ্রীলঙ্কা বংশোদ্ভূত ভারতীয় বোম্বাইয়া নৃত্য পটিয়সী নায়িকা জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ এবং ভারতীয় কণ্ঠ শিল্পী কেকে। গতকাল শনিবার এ অনুষ্ঠানের বিবরণ ফলাও করে বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের চ্যানেল নাইন এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে। স্বাভাবিক কারণেই এই অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মনে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি করে এবং অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় থেকেই কোটি কোটি মানুষ তাদের টিভি সেটের সামনে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। কিন্তু শুরুতেই এ কথা স্পষ্ট বলে রাখা দরকার যে, এই অনুষ্ঠানটি এক দিকে কোটি কোটি দর্শককে যেমন মুগ্ধ করতে পারেনি, অন্যদিকে তেমনি বিদেশীদের নর্তন কুর্দনে এবং অশ্লীল দেহ সঞ্চালনে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করতে পারেনি। বরং সাড়ে ৩ কোটি টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে বিপুলভাবে সাহায্য করেছে।
হৃত্বিক রোশন এবং জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের নর্তন কুর্দন নিয়ে একটু পরে মন্তব্য করব। কিন্তু প্রথমেই হৃত্বিকের একটি উক্তি নিয়ে মন্তব্য না করলে বাংলাদেশের শিল্পী এবং সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি অবিচার করা হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ঐ মহিলাটি হৃত্বিকের নাচ শেষে মঞ্চে তাৎক্ষণিকভাবে তার সাথে দু’চারটি কথা বলেন। এ ব্যাপারে কারো কিছু বলার নাই। তিনি যেসব প্রশ্ন করেন এবং হৃত্বিক যেসব উত্তর দেন সেসব হলো গতানুগতিক, গৎবাঁধা এবং স্টেল। কিন্তু প্রশ্নোত্তর শেষে হৃত্বিক সমবেত বিপুলসংখ্যক দর্শক শ্রোতাদেরকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, আপনারা বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দি ছবি আসতে দিচ্ছেন না কেন? তার এই প্রশ্নে দর্শক সাধারণ বিরাট হোঁচট খায়। কারণ ভারতীয় ছবি বাংলাদেশের বড় পর্দায় কেন দেখানো হয় না সেটি আমাদের দেশের সচেতন মানুষ বিলক্ষণ জানেন। তারা ভদ্র এবং বিদেশীদেরকে সম্মান করতে জানেন। তারা আরও জানেন যে বিদেশীদের সম্মান কিভাবে রক্ষা করতে হয়। তাই তারা হৃত্বিককে পাল্টা প্রশ্ন করেন নি যে আপনাদের দেশে, এমনকি পশ্চিম বাংলাতেও বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে ঢুকতে দেন না কেন? অথচ বাংলাদেশের এক শ্রেণীর কলকাতা প্রেমী শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী এবং পশ্চিমবঙ্গের এক শ্রেণীর জ্ঞান দানকারী আঁতেল উঠতে বসতে ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ বলে পাগল পারা। হৃত্বিক বলেন যে, বাংলাদেশে যদি ভারতীয় হিন্দী ছবি ঢুকতে দেওয়া হয় তাহলে তিনি ফের বাংলাদেশে এসে মঞ্চে নাচবেন না। বরং সামনে উপবিষ্ট হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বলেন যে, আপনারা যদি বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দী ছবি প্রবেশ করতে দেন তাহলে মঞ্চ থেকে নেমে আপনাদের সাথে, অর্থাৎ দর্শকদের সাথে নাচবো। হৃত্বিক রোশন বাংলাদেশী দর্শকদের আবেগ ধরে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশী দর্শকরা তার কথায় আপ্লুত বা বিভ্রান্ত হয়নি।
জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ এবং হৃত্বিক রোশনের নাচ নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। তাদের দুজনের সাথেই নেচেছেন এক দল ভারতীয় মেয়ে। এদের পরনে ছিল প্যান্টি এবং বক্ষ বন্ধনী। এসব সহচরীরা তাদের শরীরের লোভনীয় স্থানগুলি উত্তেজকভাবে সঞ্চালন করেন। আমি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করবো না। শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, ওরা নৃত্যের নামে যে লম্ফ ঝম্ফ করে গেলেন সেটি না বাঙালি সংস্কৃতি, না মুসলিম সংস্কৃতি। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা কেন ভুলে গেলেন যে এদেশের মানুষ ৯৯.৫ শতাংশ বাঙালি এবং একই সাথে ৯০ শতাংশ মুসলমান। তাদের সেন্টিমেন্ট এবং মূল্যবোধের প্রতি উদ্যোক্তাদের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত ছিল।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বাংলাদেশের অভিনেত্রী এবং নৃত্য শিল্পী সাদিয়া ইসলাম মৌ এর নেতৃত্বাধীন দলীয় নৃত্যের মাধ্যমে। সাদিয়ার এই গ্রুপ নৃত্য একদিকে যেমন দর্শকবৃন্দকে আকৃষ্ট করে অন্যদিকে তেমনি শালীনতা এবং নৃত্য কুশলতায় তা ছিল হৃদয় গ্রাহী।
॥দুই॥
গত ১৯ নবেম্বর ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, 'INTERNET, MOBILE APPS / Sudden shutdown follows verdict. ইন্টারনেট, মোবাইল এ্যাপ্স/রায়ের পর অকস্মাৎ বন্ধ’। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্ব প্রথম সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ফলে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসা ও চাকরি বাকরি সমূহ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭৫ মিনিট ধরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর সরকার ফেসবুক এবং অনলাইন ম্যাসেজিং বন্ধ করে দেয়। একই সাথে হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবারও বন্ধ করে দেয়া হয়।
ডিজিটাল জগতের বিশেষজ্ঞ এবং উদ্যোক্তারা বলেন, তাদের অনলাইন সার্ভিস বন্ধ থাকার ফলে ডিজিটাল ব্যবসা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব থাকবে দীর্ঘ দিন। কম্পিউটার সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তফা জব্বার বলেন, আধুনিক জীবন, ব্যবসা এবং অফিস আদালতের লাইফ লাইন হলো ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইট সমূহ ব্লক করা সরকারি মেকানিজমের সর্বাত্মক ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। আলোচ্য ইংরেজি পত্রিকাটির রিপোর্ট মোতাবেক সর্বোচ্চ আদালত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ পিটিশন খারিজ করার ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই ইন্টারনেট ব্লক করা হয়। ইতঃপূর্বে বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ সংস্থা ফেসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ট্যাংগো এবং ভাইবার বন্ধ করার জন্য সমস্ত মোবাইল কেরিয়ার, ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং সার্ভিস প্রভাইডারদের নির্দেশ দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, অবাধে চ্যাট করার চেয়ে জনগণের নিরাপত্তা অনেক মূল্যবান। গত ১১ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে বলেন যে, জঙ্গিদের গ্রেফতার এবং তাদের ক্রিমিনাল কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবার ব্লক করা হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এ বছরের ১৮ জানুয়ারি ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ, ট্যাংগো এবং মাই পিপল লাইন ৪ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। বিডিআর ম্যাসাকারের পর সরকার ২০০৯ সালে ২৬০ দিনের জন্য ফেসবুক এবং ইউটিউব বন্ধ করে দেয়।
ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এসব ডিজিটাল সার্ভিস বন্ধ থাকার ফলে ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যাংকিং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আউট সোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং এবং কল সেন্টারও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০ নবেম্বর ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয়, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ বন্ধ করার ফলে মোবাইল ডাটার ব্যবহার ২২ শতাংশ কমে গেছে। গত ১৯ তারিখ তিনটি মোবাইল ক্যারিয়ারের নিকট থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায় যে, গত মঙ্গলবার যেখানে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার ছিল ২৯৬ টেরাবাইট, সেখানে বুধবার নেমে এসে হয়েছে ২২৯ টেরাবাইটে। পরদিন সেটি আরও নেমে এসে হয়েছে ২০০ টেরাবাইট। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট তথ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ফেসবুক। এমনকি অনেক ব্যবসা বাণিজ্যের সংবাদ দিতে হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে বলা হয় যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া তারা এই ব্লক উইথড্র করবে না। তারানা হালিম বলেন যে, ফেসবুকিং এবং ফ্রি চ্যাটিংয়ের চেয়ে একটি জীবনের মূল্য অনেক বেশি। যদিও সোয়া ঘণ্টা পর ইন্টারনেট লাইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কিন্তু তারপর দেখা যাচ্ছে যে ইন্টারনেট স্পিড বা গতি দারুণভাবে কমে গেছে। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের এক কর্ণধার জানান যে, ভাইবার এবং হোয়াটস এ্যাপ বন্ধ করার ফলে কতগুলো ওয়েব সাইটে ঢোকা যাচ্ছে না। ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতি মন্ত্রী তারানা হালিম জানিয়েছেন, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবার ছাড়াও টুইটার, ট্যাংগো, আইএমওসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য এ্যাপেও নজরদারি চালানো হচ্ছে। দেশ ও জাতির নিরাপত্তার স্বার্থেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন।
॥তিন॥
এসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা সম্পর্কে গতকাল ২১ নবেম্বর একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এসব বন্ধ করা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ৯টি অ্যাপস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, ট্যাংগো, হ্যাঙ্গআউট, ইউস্টার্ন ডট টিভি, কমিউর, লাইন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং জঙ্গি তৎপরতা রোধ করতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে তীব্র সমালোচনার যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি প্রযুক্তিবিদরাও এ সিদ্ধান্তের প্রতি দ্বিমত পোষণ করেছেন। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের যে লক্ষ্য তা পূরণ হবে না এবং কোনো সমাধানও আসবে না। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, একদিন না একদিন তো এসব যোগাযোগ মাধ্যম খুলতে হবে। তখন কি হবে? সরকার যে আশঙ্কায় এগুলো বন্ধ করেছে, তা কি নির্মূল হয়ে যাবে? সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠী কি এসব অ্যাপস ব্যবহার বন্ধ করে দেবে? যদি তা মনে করা হয়, তবে তা অবৈজ্ঞানিক চিন্তাই শুধু নয়, এক ধরনের অজ্ঞতাও বটে। এ কারণেই বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রযুক্তিবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং তা অনেকটা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। এতে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়া ছাড়া খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ, ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব সাধারণ ব্যবহারকারী ব্যবহার করছে, তারা ইতোমধ্যে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।”
বিটিআরসি’র হিসাব মতেই দেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে শুধু ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। বাকিরা অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করছে। পত্রিকাটির মতে এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ প্রজন্ম মনে করছে, এটা তাদের অবাধ তথ্য আদান-প্রদান ও মতামত প্রকাশের মতো মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। বিশ্বজুড়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন আইএস তার বেশিরভাগ কার্যক্রম ও যোগাযোগ ইন্টারনেটের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করেই করছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর ও সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলো তো সেসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে পারছে না বা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। কারণ, তারা জানে, প্রযুক্তির এ যুগে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক পথ বন্ধ করলে অসংখ্য পথ বের হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া সরকারের ভাবমর্যাদা কোনোভাবেই উজ্জ্বল করছে না। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কোনো অ্যাপস বন্ধ করে নয়।
আসিফ আরসালান

শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নূর হোসেনের হাসি


নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয়েছিল গত ১২ নবেম্বর। আদালতে নেয়ার পথে এবং আদালত প্রাঙ্গণে তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল। আদালতে উকিলদের সঙ্গেও তিনি ঠাট্টা মশকরা করছিলেন। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই করেননি তিনি। বেড়াতে এসেছেন স্বজনদের বাড়িতে। তেমনই অভিযোগ করেছেন নিহত নজরুল ইসলামের পরিবার।
নূর হোসেনকে ফেরত আনা নিয়ে সরকার অনেক মজার নাটক করেছে। তার আগের দিন ১১ নবেম্বর দিবাগত রাত বারোটার পর সরকার আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) নেতা অনুপ চেটিয়াকে কারাগার থেকে অতি গোপনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। সরকারের এমন কেউ, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। যার এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানোরও দরকার নেই। কারণ ১২ তারিখ সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান যে, অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি তার জানা নেই। পরে অবশ্য দুপুরের দিকে তিনি বলেন যে, নিয়ম মেনে সাজার মেয়াদ শেষে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য অনুপ চেটিয়ার সাজার মেয়াদ শেষ হয় ২০০৪ সালে।
তবে অনুপ চেটিয়ার ঘটনা একটু ভিন্ন রকম। বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে অনুপ চেটিয়া আটক হন ১৯৯৭ সালে। তাতে তার সাজা হয় সাত বছরের জেল। সাজা শেষে ২০০৪ সালে, ২০০৭ সালে ও ২০১১ সালে অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা মঞ্জুর করেনি। এর মধ্যে ভারত বারবারই অনুপ চেটিয়াকে ফেরত চেয়ে আসছে। শেষ দিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল যে, অনুপ চেটিয়া এখন নিজেই স্বদেশে ফেরত যেতে চাইছে। তাই যদি হয়, তা হলে অনুপ চেটিয়াকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলো না কেন? তিনি তো আর সাজাপ্রাপ্ত আসামী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিরাপত্তা হেফাজতে। তাহলে রাতের অন্ধকারে কেন তাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হলো? সেটা জানাতে কোনো বাধা ছিল না। অনুপ চেটিয়াকে জোর করে ভারতে ফেরত পাঠানো নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছিলেন যে, এর ফলে উলফা গেরিলাদের হামলার টার্গেটে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কিছুতেই এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়কে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে গোপনে ফেরত পাঠালো। এ ক্ষেত্রে জনগণকে বোকা বানাতে সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে তারা ভারত থেকে ফেরত আনছেন নূর হোসেনকে। কিন্তু অনুপ চেটিয়া আর নূর হোসেনের কেস সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশ কিছুকাল আগেই ভারতের আদালত রায় দিয়েছিলেন যে, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক নূর হোসেনকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হোক। ফলে আজ হোক আর কাল হোক, নূর হোসেনকে ফেরত দিতে বাধ্য ছিল ভারত সরকার। তাই দুটো ঘটনাকে এক সূত্রে গাঁথা যায় না।
গত ১১ নবেম্বর সন্ধ্যা থেকেই বেনাপোল সীমান্তে নূর হোসেনকে স্বাগত জানানোর জন্য সরকারি মহল তৎপর হয়ে উঠেছিল। সেখানে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একটি দল আগেই রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন বেনাপোলের দিকে। আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাবের কর্মকর্তারাও। নিয়ম অনুযায়ী নূর হোসেনকে হস্তান্তর করার কথা ছিল পুলিশের হাতেই। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাকে হস্তান্তর করা হলো র‌্যাবের কাছে। এই সাত খুনের ঘটনায় যুক্ত ছিলেন র‌্যাবের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারাও। তাদের মধ্যে আছেন র‌্যাবের সাবেক সিও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ। তারা আছেন কারাবন্দী। কার্যত র‌্যাব কর্মকর্তারা নূর হোসেনের ভাড়াটে খুনি হিসেবেই কাজ করেছেন। নূর হোসেনকে কেন বিজিবি বা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলো না, এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে ঐ দুই কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। তারা নূরকে র‌্যাবের কাছেই হস্তান্তর করতে চেয়েছে। তখন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল হাসান এগিয়ে গিয়ে নূর হোসেনকে নিয়ে আসেন। এরপর র‌্যাবের একটি দল নূরকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে যায়। আসলে এটা তো ভারতীয়দের কোনো ব্যাপার ছিল না। তাদের আদালত তো এমন কোনো নির্দেশ দেয়নি যে, নূর হোসেনকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
তারপরও সেই র‌্যাব কর্মকর্তারাই খোশ গল্প করতে করতে বেনাপোল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন সাত খুনের প্রধান আসামী নূর হোসেনকে। দৈনিক ইত্তেফাক রিপোর্ট করেছে, আদালতে হাজির করার আগে নূর হোসেন র‌্যাব-পুলিশের হেফাজতে ছিলেন ১৩ ঘণ্টা। ‘এ সময় অনেক কথাই বলেন নূর হোসেন। তিনি স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনা তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে র‌্যাব-১১-এর সাবেক সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ জানতেন বলে তিনি জানিয়েছেন। পুরানো ঢাকায় তারেক সাঈদের জমি নিয়ে সমস্যা ছিল। সেখানে আইনজীবী দিয়ে সহায়তা করার কথা জানিয়েছেন নূর হোসেন। নূর হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নোংরা। এখানে সব সময় ‘বস’দের খুশি রাখতে হয়। এটা না করলে টিকে থাকা যায় না। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ‘বস’ই আমাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। টেলিভিশন টক-শোতে কথা বলার সুযোগ দিতে র‌্যাবের কাছে দাবি জানান নূর হোসেন। তিনি বলেন, তা হলে দেশবাসীর কাছে মনের কথা খুলে বলতে পারবেন।’
ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী নূর হোসেন আরও বলেন  যে, ‘আমি তো এখন নেই। তাহলে আমার সিদ্ধিরগঞ্জের সেই সাম্রাজ্য এখন কার দখলে? কারা এখন সুবিধাভোগী?’ এরপর নূর হোসেন যা বলেছেন, তার অনেক কিছুই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। নূর হেসেনের টার্গেট ছিল প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। তাতে হত্যা করানোর জন্যই তিনি র‌্যাবের সঙ্গে চুক্তি করেন। টাকাও কিছু পরিশোধ করেন। আর র‌্যাবের ভাড়াটে কর্মকর্তারা সাক্ষীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য অন্যদের হত্যা করে। তিনি আরও জানান, ‘প্রতিনিয়ত র‌্যাব-পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে এসেছি।’ পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত চাঁদা দিয়েছেন তিনি। কারণ, তিনি বলেন, ‘চাঁদা দেয়া ছাড়া আমার টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। পড়াশোনা জানি না। টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে রাখতাম। বালু ও ট্রাকের ব্যবসা ছিল। পরিবহনের চাঁদাবাজি থেকে অনেক টাকা আসতো।’ র‌্যাবের কর্নেল জিয়া তার সঙ্গে আলাপ কালে তিনি এসব কথা বলেন।
নূর হেসেন ১২ নবেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত র‌্যাবের হাতেই ছিলেন। এরপর তাকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় দুপুরের পর আদালতে হাজির করলে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের কোনো আবেদন করেনি। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ তো দূরের কথা, সাত খুনের এই প্রধান আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। বিক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী তাকে রিমান্ডে নেয়ার দাবিতে জুতা মিছিল করে। নানা রকম স্লোগান দেয়। মানববন্ধন করে। নিহত নজরুলের পরিবারও একই দাবি করেন। যদিও চার্জশীট হয়ে গেলে কাউকে আর রিমান্ডে নেয়ার রেওয়াজ নেই। কিন্তু অধিকতর তদন্তের জন্য রিমান্ডে নেয়া যায়। পুলিশ সে পথে অগ্রসর হয়নি। নারায়ণগঞ্জের এসপি ও সরকারি উকিল (পিপি) জোর গলায় বলেছেন, তাকে রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই।
আদালতে নেবার পথে ও এজলাশে নূর হোসেনের হাসির রহস্য এখানেই। ঐ সাত খুনের মামলায় নূর হোসেন হুকুমের আসামী মাত্র। তিনি তো আর নিজ হাতে খুন করেননি। খুন করেছেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা। নূর হোসেন জানেন, সেসব কর্মকর্তাকে কেমন জামাই আদরে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে। তা হলে নূর হোসেনকে তো আরও সমাদর করারই কথা। সমাদর তিনি পেয়েছেন। ফলে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তার হাসি। 
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান ১৬ নবেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, যে কোনো আইনজীবী ইচ্ছা করলে সাত খুন মামলার আসামীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন। তিনি বলেন, নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই। এর আগে জেলা আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সাত খুনের কোনো আসামীর পক্ষে নারায়ণগঞ্জের কোনো আইনজীবী দাঁড়াবেন না। এ সম্পর্কে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যা বলার সভাপতিই বলবেন। তবে এই মামলায় এতদিন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আসামী পক্ষে দাঁড়াননি। সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার যখন একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রাজনৈতিক ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চলছে।
এ থেকেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে নূর হোসেনের এখন হাসবারই সময়। কাঁদবার সময় খুনের শিকার সাত পরিবারের, নূর হোসেনের নয়। নূর হোসেন গং ‘চিরজীবী হোক’।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া’


বাসা হইতে এরাদা করিয়া বাহির হইলাম চাইরপাশে যাহা ঘটিতেছে সেইসব দেখিয়াও দেখিব না। চোখ থাকিতেও অন্ধ হইয়া রহিব। কোন ফালতু বাতচিত কানে ঢুকিতে দিব না। কানে তুলা গুঞ্জাইয়া রাখিব। গলার আওয়াজ নামাইয়া আনিব। বোবার নাকি দুশমন থাকে না। এখনকার সমাজে ঠোঁট যতটা চাপিয়া রাখা যায় ততটাই বেহতের। হররোজ এই উমদা ভাবনাটি দেমাগে জমা রাখিবার কোশেশ করি। কোনদিন ফল পাকে কোন দিন কাঁচা থাকিয়া যায়। এই আধাপাকা ভাবনাটি মগজে ঘুুরাইতে ঘুরাইতে রোজ অফিসের দিকে পাও বাড়াই। আইজও তাহাই করিলাম। খোশনসিবই বলিতে হইবে, বাসে একখানা কুরসিও জোগাড় হইয়া গেল শেষ কাতারে। বরাতগুণই বলিতে হইবে। আখেরে বরাত বরবাদ হইতে লাগিল। বাস এক মিনিট চলিলে তিন মিনিট খাড়া হইয়া থাকে। মিরপুর দশ নম্বরের বগলে আসিয়াতো মহা গেঞ্জামে আটকাইয়া গেলাম। বসিয়া আছি তো আছিই। আগে বাড়িবার কোশেশ করিয়াও কোন লাভ হইলো না। হররোজ এই গোলচত্বরে এমন কামড়া কামড়ি লাগিয়াই থাকে। বাস টেক্সি আর রিকশা মানুষে এক এলাহি কা-। নিশি রাইত পর্যন্ত একই আলামত। সামাল দিতে গিয়া আইনের লোকজনেরও জানকান্দানি শুরু হইয়া যায়। বাসে বসিতে বসিতে বেফানা অবস্থায় পড়িয়া গেলাম। কখন যে সীমানায় গিয়া পৌঁছাইব তাহা ভাবিতে ভাবিতে মগজে উথাল পাথাল শুরু হইয়া গিয়াছে। গাড়ি-ঘোড়ার ফাঁকফোঁকর দিয়া মানুষজনদের দৌড়াদৌড়ি যেন থামিতেই চাহিতেছে না। রাস্তাঘাটে গাড়ি আটকাইয়া থাকিবার ইহাও একটি বড় উছিলা। উড়াল পুলে উঠিতে নারাজ। ঠ্যাং কমজুর হইয়া পড়িবে এমন একখানা ভাব। কেহ কেহ আবার ট্রাফিক পুলিশের বেক্কলি বা বেরহমির কথাও তুলিয়া থাকেন। যত কিসিমের অজুহাতই উঠুক না কেন গাড়ি চাক্কায় খিল ধরিবার বেমারটি যেন দিন দিন ডাঙর হইতেছে। দিকদারি বাড়িতেছে। মুশকিলের বাত  হইল এই বেরামের এলাজ করিবার মতো হাকিম জোগাড় হইলো না। জোগাড় করিবার কোশেশের আলামতও নজরে আসিতেছে না। চারদিকে কেবলই আইন্ধারই নামিতেছে। পথেঘাটে দিকদারি, অফিস কাচারিতে দিকদারি, বাজার সদায় করিতে গিয়াও দিকদারির অন্ত থাকিতেছে না। এক ঘণ্টার পথ পারি দিতে আজকাইল তিন চাইর ঘণ্টা লাগিয়া যাইতেছে। দিনের অর্ধেকটা সময়ই কাবার হইয়া যায় বাসে, পথে পথে। কপালের লেখন কে করে খ-ন এমনি একটা সময়ের  মাইঝ বরাবর দিয়া যেন আমরা হাঁটিতেছি। বাসে বসিয়া বসিয়া সময় কাবার করিতে গেলে এমনি সব আজগবি চিন্তা মাথায় আসিয়া জমা হয়। মালুম হইল মগজ পুর হইয়া যাইতেছে, আউলাঝাউলা চিন্তার ভারে। খালাস পাইবার পথ তালাশ করিবার ফুরসতও যেন আটকাইয়া যাইতেছে। এক কাতারে অনেকগুলি বাঁশি বাজিয়া উঠিতে ধরফরাইয়া উঠিলাম। ইহারি মধ্যে সব বেরহম চিন্তা আসমানে উড়িয়া গেল।
বাস মিরপুর দশ পার হইল কাউসালি করিতে করিতে। বাসের সাথে সাথে সওয়ারীগণও কাউসালির মধ্যে আটকাইয়া যায়। আমিও আটকাইয়া গেলাম। সওয়ারীদের গেঞ্জামে পসিনা ঝরিতে লাগিল। গেঞ্জাম হইবার কথা না থাকিলেও হইল। সিটিং সার্ভিস নাম লেখিয়া বাসওয়ালা সওয়ারীদের সাথে চিটিং করিল। বাস বোঝাই করিয়া সওয়ারী উঠাইল। কুরসির আয়োজন মত সওয়ারী তুলিবার আইন থাকিলেও তাহা তারা মানিল না। এই অন্যায় তাহারা রোজই করিয়া থাকে। ইহা লইয়া কাজিয়া-ফ্যাসাদতো রোজকার আলামত। এইসব দেখভাল করিবারও যেন কেহ নাই। এই দিকে সিটিংয়ের ভাঁওতাবাজিতে আটকাইয়া বেশতি পয়সা আদায় করিতে ইহাদের কোন শরম নাই। বাসওয়ালাদের বেশরম কায়কারবার এবং চিল্লাচিল্লিতে দেমাগে খিল ধরিয়া যাইতেছিল। বাড়ি হইতে এরাদা করিয়া আসিয়াছি দেখিয়াও দেখিব না, শুনিয়াও শুনিব না। তাই ঝিম মারিয়া বসিয়া থাকিলাম। তাহা ছাড়া নতুন ভাড়া লইয়াতো হাতাহাতির জোগাড় হয় সব বাসেই। এই বাসেও হুমকি ধমকি কম হইল না। আলামত দেখিয়া মালুম হইল ‘আমরা সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে’। কবি রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকার সিটিং বাসে আসিয়া চড়িতেন তাহা হইলে হয়তো আরো উমদা কিছু লেখিয়া ফেলিতে পারিতেন। তিনি আর জিন্দা নাই। মরিয়া বাঁচিয়া গিয়াছেন। জিন্দা থাকিলে হয়তো মহা কেলেংকারিতে পড়িতে হইতো। সিটিংওয়ালাদের চিটিংবাজি দেখিতে দেখিতে একদিন মনের দুঃখ মনে সামলাইয়া বিষ খাইতেন না হয় দড়িতে ঝুলিতেন। দিকদারি আর কাহাতক সহ্য করা যায়। দুঃখ শুনিবারও কেহ নাই। যার যার ধান্দায় ব্যস্ত। কামাই রুজিতে বেচইন। তামাম দেশই তো আজকাইল চিটিংবাজির কারখানা বনিয়া যাইতেছে। এই কারখানার কারিগরদের ফান্দে পড়িয়া আমার মতো বেক্কলদের জানকান্দানির একশেষ। আব্বাসউদ্দিনের একখানা গান শুনিয়াছিলাম ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। চাইরপাশ দেখিয়া শুনিয়া মালুম হইতেছে আমার মতো বেক্কলের গোষ্ঠী ‘বগা’ হইয়া গিয়াছে। ফান্দে আটকাইয়া এখন কান্দনই সার। ফান্দুয়া ভাইদেরই কপাল রোশনাই হইতেছে দিন দিন।
ইহারই মধ্যে দুই ঘণ্টা সোয়া দুই ঘণ্টা কাবার হইয়া গিয়াছে। কাউসালি করিতে করিতে আমাদের বাসখানা প্রেস ক্লাবের সামনে আসিয়া খাড়া হইল। কন্ডাকটরের প্রেস ক্লাব ডাক শুনিয়া ধরফরাইয়া উঠিলাম। এতসময় দেমাগে নানান চিন্তা আসিয়া দৌড়াদৌড়ি করিতেছিল। তাই এক অচিন রাজ্যে গিয়া হাজির হইয়া ছিলাম। আইজকাল হামেশাই এমন হইতেছে। ঝিমমারিয়া বসিয়া থাকিলেই হইল। সামনে কেবল চিটিংবাজির সায়র ফুলিয়া ফাঁপিয়া আগাইতে থাকে। কুচিন্তা ঘিরিয়া ধরে। ডর ভয় গলির মোড়ে মোড়ে খাড়া হইয়া থাকে। তাই হররোজ ডরভয়কে সাথে লইয়াই বাড়ি হইতে পথে নামি। না জানি কোন গরদিশ কোন জাগায় গিয়া আছড়াইয়া, পড়ে। বলাতো যায় না। এই জামানায় তো আবার চিটিংবাজদেরই জয়।
ডাইনে বামে নজর ঘুরাইয়া বাস হইতে নামিলাম। এতসময় বসিয়া থাকিতে থাকিতে কোমর আর মাথা ঝিমঝিম করিতেছে। ঝিমমারা গতর লইয়াই উড়াল পুল দিয়া তোপখানা সড়ক পাড়ি দিলাম। প্রেস ক্লাবে পৌঁছাইতে হইলে এই পথেই আহসানির সাথে পার হওয়া যায়। আমিও তাহাই করিলাম। আচানক ব্যাপার হইল এই পুলে কেহ চড়িতে চাহে না। মানুষজন সড়ক দিয়াই দৌড়াদৌড়ি করে। তোপখানা সড়কের কিনার ঘেঁষিয়া কোর্ট কাচারির আড্ডাখানা। লোকজনে গিজগিজ করে। ইহার পরও খুব কম মানুষই উড়াল পুল পছন্দ করে। কেন যে এমন করে বুঝে আসে না। আবার এই কিসিমের মানুষেরাই উড়াল পুলের দাবিতে মিছিল করে। মজমা জমায়। বাঙ্গালদের মনের দিশা পাওয়া মুশকিল। পুলে উঠিয়া দেখি আমি একজনই সওয়ারী। পুলটি সাফসুতরের কোন বালাই নাই। এইখানে সেইখানে আবর্জনা পড়িয়া আছে। কাহারা যে এইসব পুলের দেখভাল করে আল্লাহ মালুম। কোন কোন পুলে দেখিয়াছি লোহা জং ধরিয়া ঝরিতেছে। পলেস্তার খসিয়া পড়িতেছে। গলিজ ছড়াইয়া ছিটাইয়া আছে সিঁড়িতে। কোন কোনটিতে বিছানাপত্রও বিছাইয়া রাখিয়াছে। হকারের যন্ত্রণাতো লাগিয়াই থাকে হরহামেশা। এইসব দেখিবার বুঝি কেহ নাই। মা-বাপ হারা এতিম এই পুলটি পার হইতে হইতে নজর ছানি করিতে ছিলাম পুবে পশ্চিমে। দেখিলাম প্রেস ক্লাবের গেইট কাছাকাছি আটদশ লোকের কাতার। তাহাদের হাতে একখানা বড় কাপড়। সেই কাপড়ে কী জানি লেখা রহিয়াছে। পাঠ করিবার ইচ্ছা হইল না। এই রকম মজমা এই এলাকায় লাগিয়াই থাকে। তাই কে শোনে কার কথা। চিটিংয়ের জামানায় মিটিং করিয়া কি ফায়দা। প্রেস ক্লাবে ঢুকিতে যাইব। এমন সময় একটি চেন পরিচয় আওয়াজ আসিয়া কানে বাড়ি খাইল। আমি খাড়া হইয়া গেলাম। ডাইনে নজর ঘুরাইতেই ভুত দেখিবার মতো আঁতকাইয়া উঠিলাম। একটু দূরে কিতাবালী মুচকি হাসিতেছে। গালভর্তি পান, ঠোঁটের দুই কিনার দিয়া পানের লাল রস নামিতেছে। তিন চাইর বছর পার হইয়া গেল কিতাবালী লাপাত্তা। তাহার কোন হদিস পাইতে ছিলাম না। জানি দোস্ত কিতাবালীকে পাইয়া দিল ধরফরাইয়া উঠিল। আগের মতই আছে কিতাবালী। মাথায় একখানা খয়ারি রংয়ের তুর্কি টুপি উঠিয়াছে। হাতের লাঠি কান্দের ঝোলা কালা সেরওয়ানী সব আগের মতই রহিয়া গিয়াছে। বাবরির চেহারাও বদলায় নাই। ত্বর সহিতে ছিল না। তাই একরকম দৌড়াইয়া কিতাবালীর বগলে আসিয়া হাজির হইলাম। সিনাতে সিনা মিলাইলাম, মোসাফাহ হইল বহু সময় ধরিয়া। হাত যেন ছাড়িতেই চাহে না কিতাবালী। বহুত কোশেশ করিয়া কিতাবালীর আঞ্জা হইতে আলগা হইলাম।
কুশল অদল বদলের পর কিতাবালী জানাইল আমি নারিকেল জিঞ্জিরায় দিন গোজরান করিয়াছি গত কয়টা বছর। তোমরা যাহার নাম দিয়াছ সেন্টমার্টিন। তোমাদের এই ঢাকা শহরে থাকিতে থাকিতে জান কান্দানি শুরু হইয়া গিয়াছিল। তাই দ্বীপে পালাইয়া গিয়াছিলাম। সায়রের কাছে থাকিলে মনটা সায়রের মতো ডাঙ্গর হইয়া যায়। ছহবতে তাছির বদল হয়। বেতমিজী বেলেহাজী আর ফাসেকি সব সায়রের ঢেউয়ের বাড়িতে দিশাহীন হইয়া পড়ে। তোমাদের এই ঢাকা শহরে তো বাস-রিকশার কেচকেচানি আর চিটিংবাজদের গলাবাজী মাথা মগজ সব খিল ধরিয়া থাকে। বেরহম আদমদের আলামত দেখিতে দেখিতে নজর খোলা হইয়া যাইতেছিল। তাই দ্বীপবাসে গিয়াছিলাম। এখন বল তোমার দিনকাল কিরকম কাটিতেছে। জবাবে জানাইলাম কাটিতেছে একরকম। কিতাবালী আমার নজরে নজর রাখিল। সেইখানে কি জানি তালাশ করিতেছে মালুম হইল। একটু বাদে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বুঝিলাম এই হাসিতে কিতাবালী তাহার মনের অনেক জ্বালাকে খোলাসা করিয়া দিয়াছে। যে জ্বালা জুড়াইতে সে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পাড়ি জমাইয়াছে। দূরে গেলে কি আর জ্বালা জুড়ায়! কিতাবালীকে ইহা কে বুঝাইবে। একদিকে কিতাবালীর টান অন্যদিকে কামের তাকিদ, কোন দিক সামাল দিব ভাবিয়া পাইতেছিলাম না। তাই কিতাবালীকে আমার সাথে প্রেস ক্লাবে ঢুকিতে বলিলাম। আমার আবদার শুনিয়া কিতাবালীর চেহারায় যেন অমাবস্যা নামিয়া আসিল। তাহার চেহারার দিকে নজর দিয়া আমিও থতমত খাইয়া গেলাম। প্রেস ক্লাবের নাম শুনিয়া কিতাবালী এমন বেজার হইবে তাহা আন্দাজ করিতে পারি নাই। আতকা কিতাবালী হাত বাড়াইয়া বলিল দোস্ত এখন তবে বিদায়। আমিও হাতখানি শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখিয়া জানিতে চাহিলাম বিষয় কী। প্রেস ক্লাবের নাম শুনিয়া তুমি এতটা বেজার হইলে কেন? গোস্যারই বা কি থাকিতে পারে?
কিতাবালী কিছু সময় চুপ মারিয়া থাকিল। চুপ থাকিয়া কিতাবালী তাহার গোস্যাকে বশে আনে। আবার তাহার ঠোঁট নড়িয়া উঠিল। কিতাবালী জানাইল দিলে খুব চোট পাইয়াছি। এই দেখ আমার ঝোলা খালি। সত্যি সত্যি দেখিলাম তাহার ঝোলায় দু’একটি চটি বই ছাড়া তেমন কিছু নাই। যেই বেগে দু’চারখানা খবরের কাগজ থাকিত সেইখানে কিছুই নাই। কারণ জানিতে চাহিলে কিতাবালী বলিল সে এখন আর আখবর পাঠ করে না। বেহুদা সময় বরবাদ। জোড়া তালি দিয়া কিসসা কাহিনী আর কত মগজে রাখা যায়। এই পচাগান্ধ পড়িতে পড়িতে তোমাদের মতো পাঠকদের মগজেও পচন ধরিতে শুরু করিয়াছে। তাই আমি আমার মগজকে তোমাদের মগজের কচকচানি হইতে তফাতে রাখিয়াছি। 
ডরাইতেছিলাম কিতাবালী কোন সময় কোন বেফাঁস কথা বলিয়া বসে। কিতাবালীর এই রকমই খাসিলত। ইশারা দিয়া থামাইতে চাহিলাম। কিন্তু থামিল না। কথার রেলগাড়ি ছুটাইত লাগিল। একটু ঢুক গিলিয়া বলিল তোমরা না বড় গলায় চিল্লাচিল্লি কর, তোমরা জাতির বিবেক। হায়রে বিবেক। নিজেরা নিজেরা খামচা খামচি করিয়া কলিজা গুর্দা আড়ফাড় করিতেছ। আবার এলান চলিতেছে আমরা বিবেক। যেইখানে নিজেদেরই বিবেক নাই, অন্যের বিবেক তাহারা কি করিয়া বনিতে চাহে। কিতাবালীর কথাবার্তার জবাব দিতে গিয়া চুপ মারিয়া গেলাম। বলাতো যায় না কিতাবালী কোন বেফাঁস কথা বলিয়া বসে।
আমি প্রেস ক্লাবের দিকে নজর ঘুরাইতে ছিলাম। আমার বেচইন ভাব দেখিয়া কিতাবালী আবার হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম হাসিবার কি দেখিলা। হাসিতে হাসিতেই কিতাবালী জবাবে বলিল তোমরা ফান্দে আটকাইয়া গিয়াছ। কাউসালি করিয়া কোন ফায়দা হইবে না। আব্বাস উদ্দিনের গানটি শোন নাই। ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে/ফান্দ বসাইছে ফান্দুয়া ভাই, পুঁটি মাছ দিয়া/মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া।’ তোমরা তো দেখিতেছি চাইর পাওয়ে ফালাফালি করিতেছ। তন্তুরার সূতা যে কোন দিন লোহার গুনা হইয়া দেখা দিব তাহা ভাবিয়া দেখিলা না। কিতাবালীর বয়ান শুনিয়া আমি থ বনিয়া গেলাম। এমনিতে বাস অনেক সময় গিলিয়া ফেলিয়াছে। এখন আবার কিতাবালীর সাথে বহুত সময় কাবার হইয়া গেল। মন উসখুস করিতে লাগিল। কিতাবালী জানাইয়া ছিল রোজানা আখবরের সাথে আর কোন মোয়ামেশা নাই। তাহার ঝোলাও খালি দেখিলাম। কিন্তু বয়ান শুনিয়া তো মালুম হইল তাহার বুঝ এখনো সাড়ে ষোল আনা।  আখবরওয়ালাদের উপর হইতে তাহার জিদ এখনো নামিয়া আসে নাই। এই খবর আমি আগ হইতেই জানিতাম। কিতাবালী কথায় কথায় আমাকে ‘দলদাস’ বলিয়া খোটা দিত। আমি বরাবরই তাহার এই খোটাখুটি হজম করিয়া যাইতাম। আইজ কেন জানি তাহার খোটায় দিলে চোট পাইলাম। এই চোট কিতাবালীর তরফে না আমার তরফে তাহা বুঝে আসিল না।
সিনাতে সিনা মিলাইল, মোসাফা করিয়া কিতাবালী এক সময় বিদায় নিল। আমিও মাথা নেচা করিয়া প্রেস ক্লাবের উঠানে পাও রাখিলাম।

বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আসল কারিগরদের মুখোশ উন্মোচন প্রয়োজন


প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে সিরিয়ার রাক্কা শহরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিভিন্ন্ অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে ফ্রান্স। রোববার রাতে ফরাসী জঙ্গি বিমান বড় ধরনের হামলা চালায়। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্দানের ফরাসী বিমান ঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়ে দশটি জেট ফাইটার এ হামলায় অংশ নেয়। লক্ষ্যবস্তুতে ফেলা হয় ২০টি বোমা। যেসব লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে, তার মধ্যে আই এস-এর একটি কমান্ডপোস্ট, অস্ত্রগুদাম ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এ অভিযানে আই এস-এর কতটা ক্ষতি হয়েছে বা কেউ হতাহত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আইএস বিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রেখেই ফরাসী বিমান বাহিনী এ হামলা চালায় বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য যে, প্যারিসে গত শুক্রবার (১৩ নবেম্বর) সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে ‘যুদ্ধের শামিল’ বিবেচনা করে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ ‘নির্দয়’ জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
আমরা জানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে যেন হতাহত করা না হয় এবং কোনো দেশ যেন বিপর্যস্ত না হয়। রোববার রাতে ফ্রান্সের দশটি জেট ফাইটার সিরিয়ার রাক্কা শহরে ২০টি বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু এই হামলায় কি কি ধ্বংস হয়েছে এবং কারা নিহত হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিগত দিনগুলোতে লক্ষ্য করা গেছে বিবদমান পক্ষগুলোর সংঘর্ষে সাধারণ জনগণ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, স্বজনরা নিহত হয়েছে। এই কারণে লাখ লাখ সিরীয় নাগরিক দেশ ছেড়ে অভিবাসীর মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। এখন আই এস দমনের নামে ফ্রান্স যেভাবে প্রতিশোধের মনোভাব নিয়ে সিরিয়ায় বোমা হামলা চালাচ্ছে তাতে প্রাণ বাঁচাতে আরো কত সিরীয় নাগরিক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের ধরতে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের পুুলিশ ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক অভিযান চালিয়েছে। তারা কমপক্ষে নয়জনকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে প্যারিসে হামলার জন্য আমেরিকা ও তার মিত্রদের অভিযুক্ত করেছে উইকিলিকস। হামলার ঘটনার পর এক টুইট বার্তায় উইকিলিকস বলেছে, বছরের পর বছর ধরে সিরিয়া ও লিবিয়ায় চরমপন্থীদের অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার ফল প্যারিসের এই হামলা। আরেক টুইট বার্তায় ওই ওয়েবসাইটটি বলেছে, প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায়ও ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এসব মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য যেসব উগ্রপন্থীদের প্রতিপালন করেছে তাদের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। এদিকে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন সহকারী অর্থমন্ত্রী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক পল ক্রেইগ রবার্টস বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ হাসিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো পরিকল্পিতভাবে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। পল ক্রেইগ আরো বলেন, সিরিয়া যুদ্ধে প্রবেশের কৌশল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোজোট একাজ করেছে। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ফরাসি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আইএস-এর এমন হামলা চালানো সম্ভব নয়। এছাড়া এই হামলা আইএস এর স্বার্থ নয় বরং পশ্চিমাদের স্বার্থরক্ষা করবে। আমি মনে করি যে, এ ধরনের হামলা চালানো অত্যন্ত দুরূহ কাজ, যা করা আইএস-এর ক্ষমতার বাইরে। ক্রেইগ আরো বলেন, আমি মনে করি এ হামলার পেছনে মিথ্যা লুকিয়ে আছে। ইউরোপের দেশগুলোতে অভিবাসীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও বোমা চোরাচালান করতে পারে না, তারা কি করে হামলা চালাবে? তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো দেশের ক্ষমতাসীন সরকার এ হামলাকে অযুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের দেশের সীমানা বন্ধের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। মার্কিন এ বিশ্লেষক আরো বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের জন্য মার্কিন নীতিকে সমর্থন করেছে ইউরোপের দেশগুলো। এর ফল হিসেবে লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এ কারণে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকারগুলো। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন মিথ্যা ঘটনা সাজানো হচ্ছে। এদিকে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণে আইএস এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে মুসলিম সমাজে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান ছিল না। মাহাথির আরো বলেন, জনগণের ওপর বোমা ফেললে আপনাকেও মনে রাখতে হবে যে সন্ত্রাস হবেই। এদিকে ভারতের সমাজবাদী পার্টির নেতা এবং উত্তর প্রদেশের নগর উন্নয়ন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ আজম খান প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলাকে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেন, সুপার পাওয়ার দেশগুলোর চিন্তা করা উচিত যে, ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের পদক্ষেপেরই প্রতিক্রিয়া প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলা। সন্ত্রাসী হামলাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে নিন্দা জানিয়ে আজম খান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মজুদ তেল থেকে অন্যায়ভাবে সংগৃহীত অর্থে ইউরোপের শহরগুলো আলোকিত হতে পারে না। সাম্প্রতিক বিশ্ব সংকটের মূল কারণ পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বলে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন- আপনারা কি চান ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়ার তেল ভাণ্ডার অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে মদ ও নাচ-গানের সংস্কৃতির জন্য পরিচিত প্যারিসের মতো শহরগুলো আলোকিত হোক? তিনি বলেন, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস-এর সন্দেহজনক স্থানে বোমা বর্ষণের ফলে বেসামরিক নিরাপদ লোকজনের মৃত্যু ছাড়াও হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এ কাজের পেছনে তাদের কী যুক্তি আছে? গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে সংকট সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে দায়ী করে আজম খান আরো বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলো ইতোমধ্যে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশ ধ্বংস করেছে। তারা নির্মম শক্তির মাধ্যমে এসব দেশের তেল ভাণ্ডার দখল করতে এবং নিজেদের শহরগুলোকে সাজাতে চায় যা একেবারে অন্যায়। সিরিয়ায় হোক আর প্যারিসে হোক, নিরপরাধ মানুষ হত্যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
প্যারিসে সন্ত্রাসী আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে আইএস এবং আইএস সৃষ্টির কারিগর কারা তা সাবেক মার্কিন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক পল ক্রেইগসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, সন্ত্রাসী হামলা সিরিয়ায় হোক কিংবা প্যারিসে- তার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মুসলমানদেরই। ইউরোপজুড়ে মুসলমানরা এখন আতঙ্কের মধ্যে জীবন যাপন করছে। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই কানাডার একটি মসজিদে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এই আগুন তো শান্তি ও মানবিক সমাজের উপাদান হতে পারে না। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার প্রকৃত কারিগরদের ব্যাপারে কেউ কেউ কিছু কিছু কথা বলছেন। কিন্তু সন্ত্রাসের গডফাদারদের ব্যাপারে পৃথিবীর মানব সমাজ একসাথে স্পষ্টভাবে কথা না বললে প্রহসনের রাজনীতি চলতেই থাকবে। সাজানো সন্ত্রাসবাদের দুর্ভোগ থেকেও মুক্তি পাবে না মানুষ। এখন সময়ের দাবি পূরণে মানবজাতি এগিয়ে আসে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রই জঙ্গিবাদের প্রতিষেধক


এটা আর মোটেও নতুন খবর নয় যে, রাজনৈতিক সংকট এবং গণগ্রেফতারসহ দমন-নির্যাতনের কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকায় দেশের সকল মহলে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণও প্রবল আতংকের মধ্যে রয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীনরা ছাড়া অন্য সকলের পক্ষ থেকে গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করে সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি উঠেছে একযোগে। এ প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। গত সোমবার অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে চলমান গণগ্রেফতারকে ‘বিভীষিকাময়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বার সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিশেষ যৌথ অভিযানের নামে কোনো মামলা ও ওয়ারেন্ট ছাড়াই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় আইনশৃংখলা বাহিনীর ভয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে বনে-জঙ্গলেও আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটলে ঘরছাড়া মানুষ এক সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠবে, যার পরিণতি কারো জন্য শুভ হবে না। একই দিন কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত এক সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, সরকার যদি অব্যাহতভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয় এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার সুযোগ না দেয় তাহলে এদেশ অচিরেই সত্যি সত্যি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কারণ, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। অমন অশুভ ও ভয়ংকর পরিণতি এড়ানোর উদ্দেশ্যে বিএনপির এই নেতা অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ওদিকে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডন থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, মানুষের ভোটের অধিকার হরণকারী বর্তমান সরকারের আমলে শুধু গণতন্ত্র ও জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোই বিপন্ন হয়নি, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ধূলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রামী মওলানা ভাসানীর ভূমিকার উল্লেখ করে বেগম খালেদা জিয়া নতুন পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
আমরা মনে করি, ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলেও প্রত্যেকের বক্তব্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তারা একদিকে বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুলে ধরেছেন অন্যদিকে সরকারের উদ্দেশে বলেছেন তার দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ধরনের নিন্দা-প্রতিবাদ এবং দাবি ও আহ্বান জানানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত কল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও ক্ষমতাসীনরা এখনো জাতিকে বিভক্ত করার এবং সংঘাত ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ংকর কর্মকা-েই ব্যস্ত রয়েছেন। তারা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে এমনভাবে অভিযান চালাচ্ছেন দেশ যাতে দল ও রাজনীতিহীন হয়ে পড়ে। কথায় কথায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ানোর ফলেও পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটছে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমন অবস্থায় সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অপরাজনীতির অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, নিছক সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াত বিরোধী অভিযান চালানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত দেশ ও জনগণের স্বার্থে গণগ্রেফতারের অভিযান এবং দমন-নির্যাতন বন্ধ করে গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা। উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া। এমন উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই বেগম খালেদা জিয়া শুধু আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেননি, তারও আগে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। একই আহ্বান উচ্চারিত হয়েছে অন্য সকল মহলের পক্ষ থেকেও। এই আহ্বানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি করার অভিযোগও অকারণে ওঠেনি। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য জঙ্গিবাদের উল্লেখ করলে দেখা যাবে, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রেখে চলেছেন। কেউ বলছেন দেশে জঙ্গিবাদী সংগঠন আছে আবার কেউ বলছেন নেই। এ ধরনের বক্তব্য সত্ত্বেও বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে কথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে বিরামহীনভাবে। অন্যদিকে অনস্বীকার্য সত্য হলো, সরকারের অপরাজনীতি, উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান অভিযানের কারণেই দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। ঘটছে হত্যাকাণ্ড এবং ভয়ংকর সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। 
আমাদের মতে, এখানেই রয়েছে একটি কঠিন সত্য অনুধাবন করার বিষয়। বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমদ যথার্থই বলেছেন, জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার সুযোগ না দেয়া হলে বাংলাদেশ অচিরেই সত্যিকারের জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কারণ, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলেই জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীনদের উচিত কথাটা যথোচিত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া এবং তার ভিত্তিতে নতুন পর্যায়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। বছরের পর বছর ধরে প্রমাণিত এ সত্যও মনে রাখা দরকার যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন নয় বরং দল দুটি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দীর্ঘ সংগ্রামে অংশ নিয়েছে ও নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রকামী অমন দুটি দলকেই সরকার জঙ্গিবাদী বানিয়ে ফেলার উন্মত্ত চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে স্বল্পকালের মধ্যে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা সারা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এজন্যই সরকারের উচিত গণগ্রেফতার ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করা এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ গণতন্ত্রমুখী সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া। সরকারকে একই সাথে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও পদক্ষেপ নিতে হবে। 
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার এবং নতুন জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার আশংকাও থাকবে না।

Ads