তিন সিটি নির্বাচনকে নিয়ে দেশ-বিদেশের বিশ্লেষণ এবং গণতান্ত্রিক দুনিয়ার ধিক্কার এখনো অব্যাহত রয়েছে। নজিরবিহীন অনিয়ম ও জালিয়াতির এই নির্বাচন সারা দুনিয়াকে স্তম্ভিত করেছে। গণতান্ত্রিক দুনিয়া নির্বাচনের এই জালিয়াতির মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ঝড়ুঝঞ্ঝার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন।
বলাবাহুল্য, গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে সরকার বিরোধী ২০ দলীয় জোট অংশগ্রহণ করেছিল এবং সরকারি দলের নজিরবিহীন জালিয়াতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের দিন বেলা ১২টার দিকে তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সরকারি দল আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ভোট জালিয়াতি তীব্র গতি ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মেয়র নির্বাচিত হন। কাউন্সিলার নির্বাচনেও তারা রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সদ্য সমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট সমর্থিত তিনজন মেয়র প্রার্থী সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ৯ লাখ ২৪ হাজার, যা শতকরা হিসেবে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ দাঁড়ায়। এই ভোট পেয়েছেন তারা নির্বাচন বয়কট করার পরও। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৪ লাখ ৭০ হাজার ভোট। যা মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৫৫ শতাংশ।
আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে একটা বিস্ময়কর অবস্থা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাঠকরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ইতঃপূর্বে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই কর্পোরেশনগুলোতে শাসক দলের কোন প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। তারা যে এসব নির্বাচনে সন্ত্রাস কারচুপির আশ্রয় নেয়নি তা নয়। কিন্তু তাদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সাধারণ ভোটাররা বিরোধী দলের পক্ষে তাদের রায় প্রদান করেছিলেন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ২০ দলের প্রার্থী পেয়েছিলেন মোট প্রদত্ত ভোটের ৬০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৮ শতাংশ। খুলনা সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৯ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ৩৯ শতাংশ। একইভাবে বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪ শতাংশ ও ৪৩ শতাংশ, ৫০ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ এবং ৫৫ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ। সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল গাজীপুরে ২০১৩ সালে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ২০ দলীয় প্রার্থীর কাছে ১ লাখ ৬ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। গাজীপুরে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ২৬ হাজার এবং সেখানে ৬৩ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৪৪ হাজার এবং এদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। যদিও এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেকে মনে করেন আওয়ামী লীগ তাদের প্রাপ্ত ভোটের যে সংখ্যা প্রদর্শন করছে তার শতকরা ৮০ ভাগই ভুয়া ও জাল ভোট। আমি এখন ওদিকে যেতে চাচ্ছি না।
নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত এক তথ্যানুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশনের ভোটার টার্ন আউট ছিল ৪৪ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ২০ দলীয় প্রার্থীদের তুলনায় ভোট বেশি পেয়েছেন ২০ শতাংশ। (আওয়ামী লীগ ৫৫.৪৩%, বিএনপি ৩৪.৮৩%)। এই ফলাফল অতীতের নির্বাচনের ঠিক উল্টো, বাস্তবতা বিবর্জিত বলে অনেকের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন, উল্লেখিত নির্বাচনগুলোর পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশে দুঃশাসন নির্যাতন ছাড়া এমন কোনও জনবান্ধব অথবা গণতন্ত্রবান্ধব কাজ করেনি যে মানুষ তাদের ৭ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন, স্বৈরাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও দুর্নীতির কথা ভুলে গিয়ে দ্বিগুণ ভোট দিয়ে তাদের বাক্স ভর্তি করে ফেলবেন। এটি অবিশ্বাস্য। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে তারা এত বেশি ভোট পেলেন? এর উত্তর সহজ ও সুস্পষ্ট। ক্ষমতাসীনদের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ভোট জালিয়াতি, ভুয়া ভোট এবং নির্বাচন কমিশনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সিংহভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাসক দলের অবৈধ কাজে অংশগ্রহণ এবং ভোট জালিয়াতিতে সহায়তা প্রদান এর জন্য প্রধানত দায়ী।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি কর্পোরেশনে সম্প্রতি যে সীমাহীন জালিয়াতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা ও দেশসমূহ বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার বিবৃতিতে বলেছেন, সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্তে তিনি উৎফুল্ল হয়েছিলেন কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে তাদের নির্বাচন বয়কট তাকে হতাশ করেছে। তিনি বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এই জালিয়াতি এবং অনিয়মে হতাশা ব্যক্ত করে অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। বিদেশীরা শুধু নয় আমরাও যা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা আমরা পাচ্ছি না। আর যাদের লজ্জা নেই তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, আসলে কিছু হয়নি। এতো সুন্দর, খুন-খারাবিমুক্ত নির্বাচন এ দেশে এটাই হচ্ছে প্রথম। কি চমৎকার ! বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমার জন্ম। ঐ অঞ্চলে একটি কথা আছে, “বেহায়াকে মারে পিছা, বেহায়া কয়, হুদা মিছা।” ঝাড়ুকে নোয়াখালী অঞ্চলে পিছা বলে। আর কাউকে ঝাড়ু মারা বা ঝাড়ু দিয়ে পিটানো অত্যন্ত অপমানকর ব্যাপার। মনে হচ্ছে আমরা আমাদের মান অপমানের অনুভূতিও হারিয়ে ফেলেছি।
আমি উতোপূর্বে বিরোধী ২০ দলের সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের উপর মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে তারা সম্ভবত নরুন পাবার আশায় তাদের নাক বিসর্জন দিচ্ছেন। মন্তব্যটি বাস্তবের সাথে এত হুবহু মিলে যাবে তা আমি চিন্তা করিনি। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেখেছি। সরকার পরিচালনায় তাদের স্টাইল দেখেছি। তাদের অধীনে নির্বাচন দেখেছি। যেনতেন প্রকারে নির্বাচনের ফলাফল আমি তাদের ছিনিয়ে নিতেও দেখেছি। দেশবাসী বিশেষ করে ২০ দল তা দেখেননি তা আমি বিশ্বাস করি না। তাদের ক্ষমতালিপ্সা ও দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্যই কেয়ারটেকার সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। ২০ দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিল মুখ্যত দু’টি কারণে। এক, দলীয় অসহিষ্ণু ও স্বৈরাচারী সরকার তখন ক্ষমতায় ছিল। দুই, নির্বাচন কমিশন ছিল তাদের বশংবদ, গৃহপালিত প্রাণীর ন্যায়। এই একই অবস্থা বহাল থাকা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় আমি বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছিলাম। সম্ভবত তারা দুনিয়াকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, সাধারণ নির্বাচন বর্জন তাদের জন্য যৌক্তিক ছিল। হাঁ, এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা জিতেছেন। কিন্তু তাতে লাভ কি হয়েছে?
আমি নরুন প্রাপ্তির কথা বলছিলাম। সহযোগী একটি ইংরেজি দৈনিক আমরা সিটি নির্বাচনে কি হারিয়েছি তার একটা তালিকা দিয়েছে। তালিকাটি তাৎপর্যপূর্ণ।
তারা বলেছেন, সিটি কর্পোরেশনের যে নির্বাচন হয়েছে এবং যে নির্বাচন হতে পারতো তার মধ্যে তারা সাগর মহাসাগরের দূরত্ব দেখতে পেয়েছেন। তারা মনে করেছিলেন দেশে এমন একটি নির্বাচন হবে যেখানে মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে যাবে এবং তাদের ইচ্ছামতো মেয়র নির্বাচন করবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে সরকার গঠন করেছেন, দুনিয়াব্যাপী দুর্ণাম কুড়িয়েছেন এবং যার বিরুদ্ধে প্রায় তিন মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধ চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিল সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু সম্ভবত অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা সরকারের কাছে তাদের এই প্রত্যাশা সঠিক ছিল না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রে ফেরৎ আসতে পারিনি। বিজয়ী এবং বিজিতের কোলাকুলি দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরিবর্তে আমরা এমন একটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি যা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ও নিন্দিত নির্বাচন।
আমরা জনগণের আস্থা এবং নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ভরসা দু’টিই হারিয়েছি। আমাদের হারানোর তালিকায় দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার একটি সুবর্ণ সুযোগ। সরকারকে দেশ বিদেশের বহু সংস্থা ও এজেন্সি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এই সমঝোতার জন্য সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। নির্বাচনের প্রহসন করে এবং সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ভোট জালিয়াতি করে সরকার প্রমাণ করলেন যে, তারা ২০ দলীয় জোট তথা বিএনপি ও বিরোধী দলকে থোড়াই কেয়ার করেন। আমাদের তৃতীয় প্রাপ্তি হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব এবং তার সহকর্মীরা প্রমাণ করেছেন যে, তারা সরকারের Most obedient Servant, অত্যন্ত অনুগত ভৃত্য, গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী নন।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে নির্বাচন কমিশনের ন্যায় দলীয় বাহিনীর ভূমিকা পালন করে একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারা বিরোধীদলীয় ভোটার ও নির্বাচন এবং পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে, কারচুপিতে সরকারি দলকে সাহায্য করে, ব্যালট পেপার সীল মেরে প্রমাণ করেছেন যে, মানুষের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার অথবা মানবাধিকারের ব্যাপারে তাদের কিছুই করার নেই; শাসক দলকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য দু’টিই নিশ্চিত। এটি আমাদের চতুর্থ প্রাপ্তি।
আমাদের পঞ্চম প্রাপ্তি হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের গলাধাক্কা ও মার খাওয়া। এই নির্বাচনে সাংবাদিকরা চরমভাবে অপমানিত হয়েছেন এবং শাসক দল তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তারা যা চান তা করতে সক্ষম। আমাদের সর্বশেষ প্রাপ্তি হচ্ছে গণতন্ত্রের পরাজয় এবং আওয়ামী লীগের বিজয়। অনেকে আওয়ামী লীগের এই বিজয়কে গণতন্ত্রের হত্যা বলে চিহ্নিত করেন। তাদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রকে হত্যা না করে এই দলটির পক্ষে কখনো নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভবপর নয়। কাজেই আসুন, আমরা গণতন্ত্রের জানাযায় অংশ নেই। তা করতে না পারলে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করাই আমাদের দায়িত্ব।
বলাবাহুল্য, গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে সরকার বিরোধী ২০ দলীয় জোট অংশগ্রহণ করেছিল এবং সরকারি দলের নজিরবিহীন জালিয়াতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের দিন বেলা ১২টার দিকে তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সরকারি দল আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ভোট জালিয়াতি তীব্র গতি ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মেয়র নির্বাচিত হন। কাউন্সিলার নির্বাচনেও তারা রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সদ্য সমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট সমর্থিত তিনজন মেয়র প্রার্থী সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ৯ লাখ ২৪ হাজার, যা শতকরা হিসেবে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ দাঁড়ায়। এই ভোট পেয়েছেন তারা নির্বাচন বয়কট করার পরও। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৪ লাখ ৭০ হাজার ভোট। যা মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৫৫ শতাংশ।
আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে একটা বিস্ময়কর অবস্থা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাঠকরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ইতঃপূর্বে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই কর্পোরেশনগুলোতে শাসক দলের কোন প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। তারা যে এসব নির্বাচনে সন্ত্রাস কারচুপির আশ্রয় নেয়নি তা নয়। কিন্তু তাদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সাধারণ ভোটাররা বিরোধী দলের পক্ষে তাদের রায় প্রদান করেছিলেন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ২০ দলের প্রার্থী পেয়েছিলেন মোট প্রদত্ত ভোটের ৬০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৮ শতাংশ। খুলনা সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৯ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ৩৯ শতাংশ। একইভাবে বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪ শতাংশ ও ৪৩ শতাংশ, ৫০ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ এবং ৫৫ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ। সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল গাজীপুরে ২০১৩ সালে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ২০ দলীয় প্রার্থীর কাছে ১ লাখ ৬ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। গাজীপুরে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ২৬ হাজার এবং সেখানে ৬৩ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৪৪ হাজার এবং এদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। যদিও এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেকে মনে করেন আওয়ামী লীগ তাদের প্রাপ্ত ভোটের যে সংখ্যা প্রদর্শন করছে তার শতকরা ৮০ ভাগই ভুয়া ও জাল ভোট। আমি এখন ওদিকে যেতে চাচ্ছি না।
নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত এক তথ্যানুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশনের ভোটার টার্ন আউট ছিল ৪৪ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ২০ দলীয় প্রার্থীদের তুলনায় ভোট বেশি পেয়েছেন ২০ শতাংশ। (আওয়ামী লীগ ৫৫.৪৩%, বিএনপি ৩৪.৮৩%)। এই ফলাফল অতীতের নির্বাচনের ঠিক উল্টো, বাস্তবতা বিবর্জিত বলে অনেকের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন, উল্লেখিত নির্বাচনগুলোর পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশে দুঃশাসন নির্যাতন ছাড়া এমন কোনও জনবান্ধব অথবা গণতন্ত্রবান্ধব কাজ করেনি যে মানুষ তাদের ৭ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন, স্বৈরাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও দুর্নীতির কথা ভুলে গিয়ে দ্বিগুণ ভোট দিয়ে তাদের বাক্স ভর্তি করে ফেলবেন। এটি অবিশ্বাস্য। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে তারা এত বেশি ভোট পেলেন? এর উত্তর সহজ ও সুস্পষ্ট। ক্ষমতাসীনদের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ভোট জালিয়াতি, ভুয়া ভোট এবং নির্বাচন কমিশনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সিংহভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাসক দলের অবৈধ কাজে অংশগ্রহণ এবং ভোট জালিয়াতিতে সহায়তা প্রদান এর জন্য প্রধানত দায়ী।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি কর্পোরেশনে সম্প্রতি যে সীমাহীন জালিয়াতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা ও দেশসমূহ বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার বিবৃতিতে বলেছেন, সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্তে তিনি উৎফুল্ল হয়েছিলেন কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে তাদের নির্বাচন বয়কট তাকে হতাশ করেছে। তিনি বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এই জালিয়াতি এবং অনিয়মে হতাশা ব্যক্ত করে অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। বিদেশীরা শুধু নয় আমরাও যা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা আমরা পাচ্ছি না। আর যাদের লজ্জা নেই তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, আসলে কিছু হয়নি। এতো সুন্দর, খুন-খারাবিমুক্ত নির্বাচন এ দেশে এটাই হচ্ছে প্রথম। কি চমৎকার ! বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমার জন্ম। ঐ অঞ্চলে একটি কথা আছে, “বেহায়াকে মারে পিছা, বেহায়া কয়, হুদা মিছা।” ঝাড়ুকে নোয়াখালী অঞ্চলে পিছা বলে। আর কাউকে ঝাড়ু মারা বা ঝাড়ু দিয়ে পিটানো অত্যন্ত অপমানকর ব্যাপার। মনে হচ্ছে আমরা আমাদের মান অপমানের অনুভূতিও হারিয়ে ফেলেছি।
আমি উতোপূর্বে বিরোধী ২০ দলের সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের উপর মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে তারা সম্ভবত নরুন পাবার আশায় তাদের নাক বিসর্জন দিচ্ছেন। মন্তব্যটি বাস্তবের সাথে এত হুবহু মিলে যাবে তা আমি চিন্তা করিনি। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেখেছি। সরকার পরিচালনায় তাদের স্টাইল দেখেছি। তাদের অধীনে নির্বাচন দেখেছি। যেনতেন প্রকারে নির্বাচনের ফলাফল আমি তাদের ছিনিয়ে নিতেও দেখেছি। দেশবাসী বিশেষ করে ২০ দল তা দেখেননি তা আমি বিশ্বাস করি না। তাদের ক্ষমতালিপ্সা ও দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্যই কেয়ারটেকার সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। ২০ দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিল মুখ্যত দু’টি কারণে। এক, দলীয় অসহিষ্ণু ও স্বৈরাচারী সরকার তখন ক্ষমতায় ছিল। দুই, নির্বাচন কমিশন ছিল তাদের বশংবদ, গৃহপালিত প্রাণীর ন্যায়। এই একই অবস্থা বহাল থাকা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় আমি বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছিলাম। সম্ভবত তারা দুনিয়াকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, সাধারণ নির্বাচন বর্জন তাদের জন্য যৌক্তিক ছিল। হাঁ, এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা জিতেছেন। কিন্তু তাতে লাভ কি হয়েছে?
আমি নরুন প্রাপ্তির কথা বলছিলাম। সহযোগী একটি ইংরেজি দৈনিক আমরা সিটি নির্বাচনে কি হারিয়েছি তার একটা তালিকা দিয়েছে। তালিকাটি তাৎপর্যপূর্ণ।
তারা বলেছেন, সিটি কর্পোরেশনের যে নির্বাচন হয়েছে এবং যে নির্বাচন হতে পারতো তার মধ্যে তারা সাগর মহাসাগরের দূরত্ব দেখতে পেয়েছেন। তারা মনে করেছিলেন দেশে এমন একটি নির্বাচন হবে যেখানে মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে যাবে এবং তাদের ইচ্ছামতো মেয়র নির্বাচন করবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে সরকার গঠন করেছেন, দুনিয়াব্যাপী দুর্ণাম কুড়িয়েছেন এবং যার বিরুদ্ধে প্রায় তিন মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধ চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিল সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু সম্ভবত অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা সরকারের কাছে তাদের এই প্রত্যাশা সঠিক ছিল না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রে ফেরৎ আসতে পারিনি। বিজয়ী এবং বিজিতের কোলাকুলি দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরিবর্তে আমরা এমন একটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি যা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ও নিন্দিত নির্বাচন।
আমরা জনগণের আস্থা এবং নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ভরসা দু’টিই হারিয়েছি। আমাদের হারানোর তালিকায় দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার একটি সুবর্ণ সুযোগ। সরকারকে দেশ বিদেশের বহু সংস্থা ও এজেন্সি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এই সমঝোতার জন্য সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। নির্বাচনের প্রহসন করে এবং সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ভোট জালিয়াতি করে সরকার প্রমাণ করলেন যে, তারা ২০ দলীয় জোট তথা বিএনপি ও বিরোধী দলকে থোড়াই কেয়ার করেন। আমাদের তৃতীয় প্রাপ্তি হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব এবং তার সহকর্মীরা প্রমাণ করেছেন যে, তারা সরকারের Most obedient Servant, অত্যন্ত অনুগত ভৃত্য, গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী নন।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে নির্বাচন কমিশনের ন্যায় দলীয় বাহিনীর ভূমিকা পালন করে একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারা বিরোধীদলীয় ভোটার ও নির্বাচন এবং পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে, কারচুপিতে সরকারি দলকে সাহায্য করে, ব্যালট পেপার সীল মেরে প্রমাণ করেছেন যে, মানুষের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার অথবা মানবাধিকারের ব্যাপারে তাদের কিছুই করার নেই; শাসক দলকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য দু’টিই নিশ্চিত। এটি আমাদের চতুর্থ প্রাপ্তি।
আমাদের পঞ্চম প্রাপ্তি হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের গলাধাক্কা ও মার খাওয়া। এই নির্বাচনে সাংবাদিকরা চরমভাবে অপমানিত হয়েছেন এবং শাসক দল তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তারা যা চান তা করতে সক্ষম। আমাদের সর্বশেষ প্রাপ্তি হচ্ছে গণতন্ত্রের পরাজয় এবং আওয়ামী লীগের বিজয়। অনেকে আওয়ামী লীগের এই বিজয়কে গণতন্ত্রের হত্যা বলে চিহ্নিত করেন। তাদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রকে হত্যা না করে এই দলটির পক্ষে কখনো নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভবপর নয়। কাজেই আসুন, আমরা গণতন্ত্রের জানাযায় অংশ নেই। তা করতে না পারলে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করাই আমাদের দায়িত্ব।
ড. মোঃ নূরুল আমিন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন