ভূ-কম্পন এবং রাজনীতির কম্পনে মানুষের হৃদকম্পনের মাত্রা বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাঁচার আকুতি নিয়ে সাগরে ভাসছে অভিবাসীরা। বহু অভিবাসী ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। এখন ৮ হাজার অভিবাসী অথৈ সাগরে ভাসছে। তাদের নৌকার জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। নেই খাবার ও পানি। বর্তমানে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলতে থাকায় ভাসমান এই মানুষগুলোকে তীরে নিয়ে যাচ্ছে না পাচারকারীরা। ১৬ বছরের কিশোর মোহাম্মদ শরীফ, সে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরে নিপীড়িত-অসুস্থ রোহিঙ্গাদের সেবা করবে। এমন স্বপ্ন নিয়ে নৌকায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে সাগর পাড়ি দেয়ার অভিযাত্রায় নেমেছিল। উত্তাল সাগরের ভয়ঙ্কর এই যাত্রায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা এবং পাচারকারীদের মারধর-নির্যাতনে কোনরকমে প্রাণটা বাঁচাতে পেরেছে, কিন্তু স্বপ্নটা ঝরে পড়েছে। দেখেছে সঙ্গীদের লাশ উচ্ছিষ্টের মত কিভাবে সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। গত রোব ও সোমবার মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের উদ্ধার করা হয়েছে, কিশোর মোহাম্মদ শরীফ তাদেরই একজন। নিষ্ঠুর মানব পাচারকারীদের নির্যাতন ও নৃশংসতা এখন বড় খবর হয়ে উঠেছে। কিন্তু মানব পাচারের এ কর্মকা- তো নতুন কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তা ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় চলে আসছে। দেশী-বিদেশী গডফাদাররা মিলেমিশেই এমন অমানববিক কর্মকা- চালিয়ে আসছে। সমুদ্র উপকূলে ৬০ পয়েন্টের মানব পাচারে জড়িত রয়েছে চার দেশের সিন্ডিকেট। কিন্তু অপকর্ম থেকে তাদেরকে হঠাতে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। এখন অবশ্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। গত ৫ দিনে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ মারা গেছে কথিত ৫ মানব পাচারকারী। তবে পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেটের, হোতাদের বাঁচাতে চুনোপুঁটিরা বন্দুক যুদ্ধের শিকার?’ এমন শিরোনাম থেকে সংশয় জাগে, মানব পাচারকারীদের আসলেই দমন করা যাবে তো?
লেখার শুরুতে ভূ-কম্পন ও রাজনৈতিক কম্পনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। দীর্ঘ ৬৫ বছরের জীবন যাপনে এমন ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা আগে লক্ষ্য করিনি। এক ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতচিহ্ন না মোছার আগেই আবারও শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে নেপালে। তার অভিঘাত এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। এত ভূমিকম্প কেন? ধরিত্রী কি আমাদের ভার বহন করতে পারছে না, নাকি বহন করতে চাইছে না? ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষে যে বিপর্যয় তা মানুষেরই অর্জন। বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের কারণগুলো বিশ্লেষণ করছেন। ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই, ভূমির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কথাও আমরা জানি। এসব বিষয় স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, আসমানি ও জমিনি বালা-মুসিবাত যখন আবির্ভূত হয়, তখন স্রষ্টার অনুমোদনেরও প্রয়োজন হয়। এ কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব ধর্মের মানুষই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। মানব জাতির দীর্ঘ ইতিহাসে আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংসের কথা আমরা জানি। তাদের পাপ ও বাড়াবাড়ি এতটাই সীমা লঙ্ঘন করেছিল যে, পুরো জাতিকেই সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। নূহ নবীর আমলে মহা প্লাবনের কথাও আমরা জানি। সে তুলনায় নেপাল, ভারত বা বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প ঘটে গেল তা ক্ষুদ্র বলেই বিবেচনা করতে হয়। স্রষ্টা কিংবা প্রকৃতি হয়তো মৃদুভাবে নিজের অসন্তুষ্টির কথা কিছুটা জানান দিয়ে গেল। প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন? জুলুম-নির্যাতন, প্রতারণা-প্রহসন, অশ্লীলতা-ব্যভিচার, অনাচার ও অমানবিকতার মাত্রা সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন? মহাবিশ্বের ছোট্ট গ্রহ এই পৃথিবীতে কিংবা আমাদের সমাজে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ এবং অশ্লীলতা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না কিংবা প্রকৃতি ও মহাপ্রভু নিশ্চুপ থাকবেন- এমনটা তো ভাবা যায় না। আমরা যদি প্রকৃতির প্রতি সদাচারী হই এবং অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন এবং অশ্লীলতার বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে আশা করা যায় প্রকৃতির মতো আমাদের সমাজও হয়ে উঠবে মানুষের বসবাস উপযোগী। সহজ ভাষায় বলা যায়, নৈতিক মেরুদ- সোজা করে আমরা যদি মানবিক আচরণে উদ্বুদ্ধ হই তাহলে প্রকৃতিও হয়ে উঠবে মানববান্ধব। এই সহজ সত্যটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নইলে শুধু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও তথ্য উপাত্তের বোঝা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়তো সম্ভব হবে না।
শুধু ভূ-কম্পন নয়, রাজনৈতিক কম্পনেও মানুষের জীবন যাপনে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ছে। মানুষ তো সরকার গঠন করে শান্তি-শৃঙ্খলা তথা সুশাসনের জন্য। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংবিধানকে মান্য করার সাথে সাথে ন্যায়-নীতিকে সমুন্নত রাখতে হয়। অনুরাগ-বিরাগের বদলে নিরপেক্ষ থাকতে হয়। ভোগবিলাস ও অর্থলিপ্সার বদলে ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হতে হয়। এসব গুণ ধারণ না করে শুধু কথামালা দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বর্তমান সময়ে আমরা তো আদর্শ ও নীতির রাজনীতির বদলে চাতুর্য ও প্রহসনের রাজনীতি লক্ষ্য করছি। জনসেবা ও দেশসেবার কথা বলে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করাই এখন রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় রাজনীতিকদের আশেপাশে নীতিবান ও জ্ঞানীগুণী মানুষের অবস্থান তেমন লক্ষ্য করা যায় না। বরং ক্ষমতার ফলভোগী ব্যবসায়ী, মাস্তান ও দুর্বৃত্তদের সমাবেশই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নীতির রাজনীতিতে তো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বেছে নিতে হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে তেমন রুচি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দমন-পীড়ন, চাতুর্য এবং হরতাল-অবরোধের রাজনীতিতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমরা জানি যে, মানুষের মধ্যে অনুরাগ ও বিরাগের প্রবণতা আছে। কিন্তু সরকার কিংবা প্রশাসনের মধ্যে অনুরাগ কিংবা বিরাগের প্রবণতা থাকলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আর সুশাসন ছাড়া দেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে না। বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে উপলব্ধি করা যায়, দেশ সুশাসনের পথে চলছে না। ২৬ দিন গত হওয়ার পরও নারী লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো যারা নিপীড়কদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করছেন, পুলিশ তাদের ওপরই বর্বর হামলা চালানোর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ১০ মে রোববার নারী লাঞ্ছনার বিচার চাইতে এসে লাঞ্ছিত হয়েছেন ছাত্রীরা। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুরুষ পুলিশের লাথি-ঘুষি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েকজন ছাত্রীকে। ধাওয়া খেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছাত্রীটিকেও চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করেছে পুরুষ পুলিশ। অথচ সেখানে নারী পুলিশের অভাব ছিল না।
নিপীড়কদের গ্রেফতার ও শাস্তিসহ ৬ দফা দাবিতে ১০ মে দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। তাদের ডিএমপি কার্যালয়ের সীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি পুলিশ। মেরে-ধরে রাস্তা থেকেই তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে ৩৪ জন আহত হয়েছেন বলে ছাত্র ইউনিয়ন জানিয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ৪ জন ভর্তি আছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছে তাদের দমনে পুলিশ এমন মারমুখী হলো কেন-জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ডিসি রমনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের দমনে পুলিশ এমন মারমুখী হলো কেন-এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া আসলেই কঠিন। দেশে সুশাসন থাকলে এমন দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো না, নারী-লাঞ্ছনাকারীরাও হয়তো বহু আগেই গ্রেফতার হয়ে যেত। সুশাসনের অভাবে দেখা যায় পুলিশ কারো ওপর বেশ মারমুখী, কারো ব্যাপারে আবার প্রশ্রয়দাতা। অনুরাগ ও বিরাগের উদাহরণ দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তো পুলিশ ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ের কারণে নানা রকম অন্যায় কর্মকাণ্ডে এখন বেশ বেপরোয়া। এমনকি ছাত্রলীগে থেকেও তারা সরকারি চাকরি করার সুবিধা পাচ্ছেন। ১১ মে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ছাত্রলীগের কমিটিতে পুরোনোরা পদ আঁকড়ে আছেন। জড়িয়ে পড়ছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে, ঢুকছেন সরকারি চাকরিতেও। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরকারি চাকরি করলেও কেউ ছাত্রলীগ করতে পারেন না। কিন্তু ৬ বছর প্রবাস কল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এক যুগের বেশি সময় ধরে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ মুখার্জী। অবশ্য গত ১৬ এপ্রিল তাকে ওই পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। চাঁদাবাজির একাধিক মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু কি এপিএস! সংগঠনটির ওয়েবসাইট, দফতর ও একাধিক নেতার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ২ জন সহ-সভাপতি, ১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ৫ জন সম্পাদক, ১০ জন উপ-সম্পাদক এবং ২ জন সহ-সম্পাদক প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। এছাড়া বিভিন্ন পদের অন্তত ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২ জন পুলিশে উপ-পরিদর্শকও আছে এই তালিকায়। তালিকায় অন্তত ৫০ জন আছেন যারা পেশায় ব্যবসায়ী এমন তালিকায় অনুরাগের চিত্রটা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করা যায়। আর নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দয়ভাবে পেটানোর দৃশ্যে বিরাগের চিত্রটাও বেশ স্পষ্টভাবেই অঙ্কিত হয়েছে। এমন দৃশ্যে সরকার লজ্জা পায় কি না জানি না, তবে জনগণ লজ্জা পায়। কারণ ভেদাভেদের এমন সমাজের জন্য জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এমন শাসনকে সুশাসন হিসেবেও বিবেচনা করা যায় না। বর্তমান সরকার এবং প্রশাসন আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, এটা জাতির জন্য এক অশনি সংকেত। পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলও যোগ্য জবাব দিতে পারছে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে সময়ের দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য যে সৃজনশীল চেতনা ও কর্মসূচি প্রয়োজন তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এসব শূন্যতা পূরণ হলে জনমনে আবার আশার সঞ্চার হতে পারে।
লেখার শুরুতে ভূ-কম্পন ও রাজনৈতিক কম্পনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। দীর্ঘ ৬৫ বছরের জীবন যাপনে এমন ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা আগে লক্ষ্য করিনি। এক ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতচিহ্ন না মোছার আগেই আবারও শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে নেপালে। তার অভিঘাত এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। এত ভূমিকম্প কেন? ধরিত্রী কি আমাদের ভার বহন করতে পারছে না, নাকি বহন করতে চাইছে না? ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষে যে বিপর্যয় তা মানুষেরই অর্জন। বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের কারণগুলো বিশ্লেষণ করছেন। ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই, ভূমির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কথাও আমরা জানি। এসব বিষয় স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, আসমানি ও জমিনি বালা-মুসিবাত যখন আবির্ভূত হয়, তখন স্রষ্টার অনুমোদনেরও প্রয়োজন হয়। এ কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব ধর্মের মানুষই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। মানব জাতির দীর্ঘ ইতিহাসে আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংসের কথা আমরা জানি। তাদের পাপ ও বাড়াবাড়ি এতটাই সীমা লঙ্ঘন করেছিল যে, পুরো জাতিকেই সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। নূহ নবীর আমলে মহা প্লাবনের কথাও আমরা জানি। সে তুলনায় নেপাল, ভারত বা বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প ঘটে গেল তা ক্ষুদ্র বলেই বিবেচনা করতে হয়। স্রষ্টা কিংবা প্রকৃতি হয়তো মৃদুভাবে নিজের অসন্তুষ্টির কথা কিছুটা জানান দিয়ে গেল। প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন? জুলুম-নির্যাতন, প্রতারণা-প্রহসন, অশ্লীলতা-ব্যভিচার, অনাচার ও অমানবিকতার মাত্রা সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন? মহাবিশ্বের ছোট্ট গ্রহ এই পৃথিবীতে কিংবা আমাদের সমাজে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ এবং অশ্লীলতা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না কিংবা প্রকৃতি ও মহাপ্রভু নিশ্চুপ থাকবেন- এমনটা তো ভাবা যায় না। আমরা যদি প্রকৃতির প্রতি সদাচারী হই এবং অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন এবং অশ্লীলতার বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে আশা করা যায় প্রকৃতির মতো আমাদের সমাজও হয়ে উঠবে মানুষের বসবাস উপযোগী। সহজ ভাষায় বলা যায়, নৈতিক মেরুদ- সোজা করে আমরা যদি মানবিক আচরণে উদ্বুদ্ধ হই তাহলে প্রকৃতিও হয়ে উঠবে মানববান্ধব। এই সহজ সত্যটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নইলে শুধু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও তথ্য উপাত্তের বোঝা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়তো সম্ভব হবে না।
শুধু ভূ-কম্পন নয়, রাজনৈতিক কম্পনেও মানুষের জীবন যাপনে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ছে। মানুষ তো সরকার গঠন করে শান্তি-শৃঙ্খলা তথা সুশাসনের জন্য। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংবিধানকে মান্য করার সাথে সাথে ন্যায়-নীতিকে সমুন্নত রাখতে হয়। অনুরাগ-বিরাগের বদলে নিরপেক্ষ থাকতে হয়। ভোগবিলাস ও অর্থলিপ্সার বদলে ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হতে হয়। এসব গুণ ধারণ না করে শুধু কথামালা দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বর্তমান সময়ে আমরা তো আদর্শ ও নীতির রাজনীতির বদলে চাতুর্য ও প্রহসনের রাজনীতি লক্ষ্য করছি। জনসেবা ও দেশসেবার কথা বলে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করাই এখন রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় রাজনীতিকদের আশেপাশে নীতিবান ও জ্ঞানীগুণী মানুষের অবস্থান তেমন লক্ষ্য করা যায় না। বরং ক্ষমতার ফলভোগী ব্যবসায়ী, মাস্তান ও দুর্বৃত্তদের সমাবেশই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নীতির রাজনীতিতে তো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বেছে নিতে হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে তেমন রুচি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দমন-পীড়ন, চাতুর্য এবং হরতাল-অবরোধের রাজনীতিতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমরা জানি যে, মানুষের মধ্যে অনুরাগ ও বিরাগের প্রবণতা আছে। কিন্তু সরকার কিংবা প্রশাসনের মধ্যে অনুরাগ কিংবা বিরাগের প্রবণতা থাকলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আর সুশাসন ছাড়া দেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে না। বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে উপলব্ধি করা যায়, দেশ সুশাসনের পথে চলছে না। ২৬ দিন গত হওয়ার পরও নারী লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো যারা নিপীড়কদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করছেন, পুলিশ তাদের ওপরই বর্বর হামলা চালানোর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ১০ মে রোববার নারী লাঞ্ছনার বিচার চাইতে এসে লাঞ্ছিত হয়েছেন ছাত্রীরা। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুরুষ পুলিশের লাথি-ঘুষি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েকজন ছাত্রীকে। ধাওয়া খেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছাত্রীটিকেও চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করেছে পুরুষ পুলিশ। অথচ সেখানে নারী পুলিশের অভাব ছিল না।
নিপীড়কদের গ্রেফতার ও শাস্তিসহ ৬ দফা দাবিতে ১০ মে দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। তাদের ডিএমপি কার্যালয়ের সীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি পুলিশ। মেরে-ধরে রাস্তা থেকেই তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে ৩৪ জন আহত হয়েছেন বলে ছাত্র ইউনিয়ন জানিয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ৪ জন ভর্তি আছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছে তাদের দমনে পুলিশ এমন মারমুখী হলো কেন-জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ডিসি রমনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের দমনে পুলিশ এমন মারমুখী হলো কেন-এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া আসলেই কঠিন। দেশে সুশাসন থাকলে এমন দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো না, নারী-লাঞ্ছনাকারীরাও হয়তো বহু আগেই গ্রেফতার হয়ে যেত। সুশাসনের অভাবে দেখা যায় পুলিশ কারো ওপর বেশ মারমুখী, কারো ব্যাপারে আবার প্রশ্রয়দাতা। অনুরাগ ও বিরাগের উদাহরণ দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তো পুলিশ ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ের কারণে নানা রকম অন্যায় কর্মকাণ্ডে এখন বেশ বেপরোয়া। এমনকি ছাত্রলীগে থেকেও তারা সরকারি চাকরি করার সুবিধা পাচ্ছেন। ১১ মে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ছাত্রলীগের কমিটিতে পুরোনোরা পদ আঁকড়ে আছেন। জড়িয়ে পড়ছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে, ঢুকছেন সরকারি চাকরিতেও। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরকারি চাকরি করলেও কেউ ছাত্রলীগ করতে পারেন না। কিন্তু ৬ বছর প্রবাস কল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এক যুগের বেশি সময় ধরে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ মুখার্জী। অবশ্য গত ১৬ এপ্রিল তাকে ওই পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। চাঁদাবাজির একাধিক মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু কি এপিএস! সংগঠনটির ওয়েবসাইট, দফতর ও একাধিক নেতার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ২ জন সহ-সভাপতি, ১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ৫ জন সম্পাদক, ১০ জন উপ-সম্পাদক এবং ২ জন সহ-সম্পাদক প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। এছাড়া বিভিন্ন পদের অন্তত ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২ জন পুলিশে উপ-পরিদর্শকও আছে এই তালিকায়। তালিকায় অন্তত ৫০ জন আছেন যারা পেশায় ব্যবসায়ী এমন তালিকায় অনুরাগের চিত্রটা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করা যায়। আর নারী-লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দয়ভাবে পেটানোর দৃশ্যে বিরাগের চিত্রটাও বেশ স্পষ্টভাবেই অঙ্কিত হয়েছে। এমন দৃশ্যে সরকার লজ্জা পায় কি না জানি না, তবে জনগণ লজ্জা পায়। কারণ ভেদাভেদের এমন সমাজের জন্য জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এমন শাসনকে সুশাসন হিসেবেও বিবেচনা করা যায় না। বর্তমান সরকার এবং প্রশাসন আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, এটা জাতির জন্য এক অশনি সংকেত। পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলও যোগ্য জবাব দিতে পারছে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে সময়ের দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য যে সৃজনশীল চেতনা ও কর্মসূচি প্রয়োজন তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এসব শূন্যতা পূরণ হলে জনমনে আবার আশার সঞ্চার হতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন