বিখ্যাত মানুষদের বিপদের শেষ নেই। মরে গেলেও বেঁচে যেতে পারেন না তারা। মৃত্যুর পর বরং তাদের নিয়ে গবেষণা ও মূল্যায়নের নামে ঘাঁটাঘাঁটি অনেক বেশি হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমও তেমন একজন বিখ্যাত মানুষ। বিএনপি যেহেতু এখনো এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়েছে সেহেতু জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানি চলছে বিরামহীনভাবে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার নিন্দা-সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন এমন অনেকেও, যারা সরাসরি রাজনীতি করেন না। এদেরই কেউ কেউ বলেছেন, জিয়া নাকি একজন ‘খলনায়ক’! কোন উপলক্ষে এবং কারা বলেছেন- সে প্রসঙ্গে অবশ্য যাওয়ার পরিবর্তে এবারের নিবন্ধে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা হবে। বলা দরকার, আজ ৩০ মে তার মৃত্যুবার্ষিকী বলেই তাকে বিষয়বস্তু বানানো হচ্ছে। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছিলেন। এ উপলক্ষে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার মূল্যায়ন করা যেতেই পারে।
ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা রয়েছে। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেন এবং এরশাদ সে ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সে বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া তাই বলে ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নভেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও নিজেদের তাগিদেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন বলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি।
সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার বিশেষ দেশপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থকÑ এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে, বাংলাদেশকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। এর ফলে কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে এমনভাবেই অফিসার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, যার পরিণতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো এবং এই বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া দেশ বিশেষের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ংকর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রÑ যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদ এবং আরো দু-একটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা থাকায় জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জিয়া নিজেও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। কেন অফিসারদের হত্যা করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছেÑ সেকথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়নি। মূলত এসব কারণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাকশালের গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের তো প্রশ্নই ওঠে না, বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধেও তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে ৩৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি আসলে বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। (স্মরণ করা দরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা কম করেননি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই ১৯৮১ সালের ১৭ মে নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।) জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়ার উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখনো প্রথম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমানের ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কুটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন সকল ব্যাখ্যাতেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। দূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। জিয়াকে ‘খলনায়ক’ বানাতে গিয়ে বিশেষজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে যে কারো মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে স্মরণ করা দরকার, সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ঘোষিত একটি রায়ে (যা পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর) দু’জন মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারপতিদের মন্তব্য ছিল, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও অভিমত নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু খুবই নৈরাশ্যজনক। কারণ, এরশাদের বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সময়ে তো বটেই, মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেও এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগই প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে শেখ সেলিমের মালিকানাধীন দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াসহ নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদ এমনকি নিশ্চিত পতনের মুখে এসেও টিকে গেছেন কয়েকবার। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ একযোগে কাজ করে এসেছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এরশাদের দলের একাধিকজন এখনো শেখ হাসিনার মন্ত্রী। এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের অন্তত তুলনা চলে না। জিয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং অমন একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতিকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে বরং সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। নাহলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিও চরম অন্যায় করা হবে।
ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা রয়েছে। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেন এবং এরশাদ সে ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সে বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া তাই বলে ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নভেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও নিজেদের তাগিদেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন বলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি।
সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার বিশেষ দেশপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থকÑ এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে, বাংলাদেশকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। এর ফলে কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে এমনভাবেই অফিসার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, যার পরিণতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো এবং এই বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া দেশ বিশেষের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ংকর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রÑ যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদ এবং আরো দু-একটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা থাকায় জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জিয়া নিজেও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। কেন অফিসারদের হত্যা করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছেÑ সেকথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়নি। মূলত এসব কারণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাকশালের গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের তো প্রশ্নই ওঠে না, বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধেও তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে ৩৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি আসলে বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। (স্মরণ করা দরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা কম করেননি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই ১৯৮১ সালের ১৭ মে নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।) জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়ার উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখনো প্রথম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমানের ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কুটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন সকল ব্যাখ্যাতেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। দূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। জিয়াকে ‘খলনায়ক’ বানাতে গিয়ে বিশেষজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে যে কারো মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে স্মরণ করা দরকার, সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ঘোষিত একটি রায়ে (যা পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর) দু’জন মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারপতিদের মন্তব্য ছিল, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও অভিমত নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু খুবই নৈরাশ্যজনক। কারণ, এরশাদের বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সময়ে তো বটেই, মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেও এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগই প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে শেখ সেলিমের মালিকানাধীন দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াসহ নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদ এমনকি নিশ্চিত পতনের মুখে এসেও টিকে গেছেন কয়েকবার। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ একযোগে কাজ করে এসেছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এরশাদের দলের একাধিকজন এখনো শেখ হাসিনার মন্ত্রী। এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের অন্তত তুলনা চলে না। জিয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং অমন একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতিকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে বরং সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। নাহলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিও চরম অন্যায় করা হবে।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন