বিশেষ করে ২০১৪ সালের অনুষ্ঠিত ‘জানুয়ারি মার্কা’ দশম সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে নির্বাচন সংস্কৃতির ইতিহাসে নয়ারূপ যুক্ত হলো গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা। জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপও।
বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ভোট জালিয়াতি ও সমর্থক কর্তৃক ভোটকেন্দ্র খলের খবর প্রকাশ পায়। এতে প্রমাণ মিলে সরকার সমর্থকরা ব্যাপক ভোট জালিয়াতির ঘটনার নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করে। নির্বাচনের খবর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্র সরেজমিন করে গণমাধ্যম কর্মীরা। ভোটগ্রহণ চলা সময়ে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, হামলা, সাংবাদিককে মারধর, কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশ না করতে দেয়াসহ নানাবিধ খবরসহ উঠে আসে ‘অভিনব ভোট ডাকাতির’ নানাবিধ চিত্র।
নির্বাচনের পরদিন ২৯ এপ্রিল সিটি থেকে চিটিং নির্বাচন কায়েমের ওইসব অপ্রত্যাশিত খবর বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো পত্রিকাই ইতিবাচক শিরোনাম করতে পারেনি; বরং শিরোনামে ‘জালিয়াতি’, ‘কারচুপি’, ‘বর্জন’, ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ কিংবা ‘কেন্দ্র দখলের কথাগুলো উঠে এসেছে। কথা হচ্ছে, পত্রিকাগুলো বিভিন্ন শিরোনামে খবর প্রকাশ করলেও সবক’টি শীর্ষ শিরোনামের প্রতিপাদ্যের বিষয় ছিল ‘ভোট জালিয়াতি’। তবে ভোট নিয়ে শীর্ষ খবর প্রকাশে শুধু ব্যতিক্রম ছিলো জনকণ্ঠ ও ইত্তেফাক পত্রিকা।
পাঠকদের উদ্দেশে শীর্ষ পত্রিকাগুলোর প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনের যৎসামন্য তুলে ধরা হলো-
সংবাদ : ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন, অভিযোগ ও বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে ভোট সম্পন্ন, অনিয়ম দখল কারচুপি জাল ভোট : বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের অভিযোগ’ শিরোনামে শীর্ষ খবর ছাপে মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সাক্ষী দেশের সবচেয়ে বয়বৃদ্ধ পত্রিকা দৈনিক সংবাদ। এতে বলা হয়, কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা, জাল ভোটসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এবং বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
প্রথম আলো : প্রথমে তারা বিএনপির প্রার্থীদের তাড়ালেন, তারপর তাড়ালেন সাংবাদিকদের, তারপর তাড়ালেন ভোটাদের তারপর আর তাড়ানোর কিছু ছিলো না। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ততক্ষণে নিজেরাই পলাতক। এভাবে ভোটের বিস্তর বয়ান উঠে এসেছে দেশের বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলোতে। ‘জিতল আ’লীগ, হারল গণতন্ত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনটির সঙ্গে বেলা দেড়টায় সাংবাদিক আবদুস সালামের তুলা একটি ছবিতে দেখা যায়, ‘মির্জা আব্বাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথে ভোটারের অপেক্ষা করছেন দুই নির্বাচনী কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতিনিধি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে যে শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই সত্যি হলো। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হলেও গণতন্ত্রের পরাজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকরা বিরোধীদের বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তারা। আর বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
মানবজমিন : ‘ডিজিটাল জামানায় এনালগ কারচুপি’ শীর্ষ শিরোনামে বহুল প্রচারিত দেশের একমাত্র ট্যাবলয়েট দৈনিক মানবজমিন লিখেছে, এক নয়া মডেলের নির্বাচন। উৎসব তো বটেই। দখলের উৎসব। একেবারেই খোলামেলা। কোনো রাখডাক নেই। সকাল সকাল প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই ‘হাওয়া’ বিএনপি সমর্থক এজেন্টরা। কেউ ঢুকতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। তবে থাকতে পারেননি কেউই। হুমকি, মারধর, হামলা আর গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন তারা। কাউকে কাউকে আটকে রাখা হয় আগেই। রক্তাক্ত এজেন্ট যেন একটি নির্বাচনেরই প্রতিচ্ছবি। আভাস পাওয়া গিয়েছিল আগের রাতেই। খবর আসছিলো, ব্যালট পেপারে সিল মারার। যদিও তার সংখ্যা ছিল কম। তবে দিনের শুরুতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।
যুগান্তর : ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব, সকালেই অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র দখল’ শিরোনামে সাত কলামে লিড খবর প্রকাশ করে বহুল প্রচারিত পাঠক নন্দিত দৈনিক যুগান্তর। এতে বলা হয়, সকালেই অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল, অংশ নেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তারাও, কেন্দ্রে কন্দ্রে সরকারদলীয় প্রতিদ্বন্দী কাউন্সিলর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ-গুলী। দল সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে দিনের প্রথম ভাগেই তিন সিটির অধিকাংশ ভোট কন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই তারা ছিনিয়ে নেয় ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স। অস্ত্রের মহড়ার পাশাপাশি জোর করে বের করে দেয় বিএনপিসহ প্রতিদ্বন্দ¦ী মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের। চলে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিলমারাসহ জাল ভোটের মহোৎসব ও নজিরবিহীন কারচুপি।
সমকাল : ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’ শিরোনামে সমকালে শীর্ষ খবর বলা হয়, শেষ পর্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই সম্পন্ন হলো তিন সিটি করপোরেশনের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন। ভোটকেন্দ্র দখল, কারচুপি, জাল ভোট, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, হামলাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোট শুরুর সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর নির্বাচনকে ‘ভোট ডাকাতি’ ও ‘প্রহসনের নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপির পাশাপাশি বিভিন্ন দলসমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাও। প্রতিবাদে ফের হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি।
নয়াদিগন্ত : ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব : বিএনপির বর্জন’ শীর্ষ শিরোনামে আট কলামজুড়ে লাল রঙে ব্যানার খবর ছাপে পাঠক নন্দিত নয়াদিগন্ত পত্রিকা। এতে তুলেধরা হয়, কেন্দ্র দখল আর নজিরবিহীন কারচুপির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো সিটি নির্বাচন। রাজধানীতে সকাল ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের দখল নেয় সরকারদলীয় লোকজন। বেশিরভাগ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের।
ইনকিলাব : ‘নজিরবিহীন ‘অভিনব’ ভোট’ শিরোনামে আট কলামে লাল রঙের ব্যানার খবর প্রকাশ করে সাহসী পত্রিকা ইনকিলাব। এতে বলা হয়, অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হলো তিন সিটি নির্বাচন। আলোচিত এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ নাটক-সিনেমার গল্প ও আলাদিনের দৈত্যকেও হার মানিয়েছে। সকাল ৯টার মধ্যেই ফল নিশ্চিত হওয়ায় ভোটের ইতিহাসে যোগ হলো নতুন অধ্যায়। অর্ধশত প্রার্থী প্রচারণায় নামতে না পারার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। আর নির্বাচনও হলো নজিরবিহীন। আগের রাত থেকেই ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায় ব্যালট পেপারে সিলমারার খবর।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ‘সবকিছু ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে’ শীর্ষ শিরোনামে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা তুলে ধরেছে, তিন সিটি নির্বাচনের মাঠ থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবকিছুতেই ছিল আ’লীগের উপস্থিতি। কেন্দ্রের আশপাশে প্রার্থীদের পক্ষে নীরব প্রচারণা, সাধারণ ভোটারদের সহায়তা ও কেন্দ্রের এজেন্ট সব ক্ষেত্রেই এটা চোখে পড়েছে। ক্ষমতাসীন আ’লীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মহানগরীর সাধারণ কর্মী সবাই ছিলেন সরব। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর এবং মেয়রÑ তিন পদেই ছিল আ’লীগ প্রার্থীদের সমর্থকদেরই প্রাধান্য।
সংগ্রাম : নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে নাতিদীর্ঘ শিরোনামে শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগ্রাম পত্রিকা। ৭৮ শব্দের ওই শিরোনামটি ছিল ‘নজিরবিহীন অনিয়ম জালিয়াতির নির্বাচন ॥ মহানগরীর অধিকাংশ কেন্দ্রে সাঈদ খোকন ও আনিসুল হকের এজেন্ট ব্যতীত আর কোনো এজেন্ট ছিল না ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ব্যালটে সিল দেয়া হয়েছে ॥ অনেক পুলিশরাই পলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দেয়ার সুযোগ দিয়েছে ॥ ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই অনেক কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে সাংবাদিকরা গুলীবিদ্ধ ও হামলার শিকার হয়েছেন ॥ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার মহিলা এজেন্টরাও গ্রেফতার থেকে রেহাই পায়নি’। প্রতিবেদনটির সঙ্গে তিনটি ছবিও লিড করা হয়। সকাল ৮টা ৩৭ মিনিটে তোলা প্রথম ছবিতে দেখা যায়, নির্বাচন চলাকালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে একই সাথে জাল ভোট দিচ্ছেন তিনজন। বেলা সোয়া ১২টায় তোলা দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায়, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেয়ার পর ব্যালট পেপার ছড়িয়ে ছিড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। ওইসব ব্যালটে ইলিশ মাছ মার্কায় ছাপ মারা ছিল। একটু দূরেই দেখা যায় ব্যালট ভর্তি বাক্স। বেলা সাড়ে ১১টায় তুলা তৃতীয় ছবিতে দেখা যায়, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল কেন্দ্রের ৮টি বুথেই ব্যালট নেই। ভোটাররা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য। একই অবস্থা রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুল কেন্দ্রে।
বণিক বার্তা : ‘বর্জন ও দখলে ম্লান সিটি নির্বাচন’ শিরোনামে দৈনিক বণিক বার্তার শীর্ষ খবরে বলা হয়, ভোটগ্রহণ শুরুর পর পরই কেন্দ্র দখলের অভিযোগ। খবর আসে জাল ভোট প্রদানেরও। তিন সিটিতেই ভোটদানে বাধা দেয়া ও ব্যাপক হারে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটে। দুপুর না গড়াতেই অনেক কেন্দ্র খল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটে।
জনতা : ‘সহিংসতা কারচুপি ও বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ভোটগ্রহণ, ৩ সিটিতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব সহযোগিতায়, কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল আগুন’ শীর্ষ শিরোনামে পাঁচ কলামে লাল-কালো কালিতে খবর ছাপে জনতা পত্রিকা। খবরে বলা হয়, কেন্দ্র দখল, ব্যালটে আগুন, হামলা, অস্ত্রের প্রদর্শন, ককটেল বিস্ফোরণ, কারচুপি, সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলীসহ বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ভোটগ্রহণ। এসময় অসহায়ের মতো নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। এদিকে ভোট কেন্দ্র প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরের চলে যাওয়া তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
ডেইলি স্টার : ÔPolls bubbles burst, BNP's early pullout makes AL win insignificant; irregularities widespread; AL rivals for councillor posts cause violence’ শিরোনামে লিড নিউজ প্রকাশ করে দেশের শীর্ষ ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার। ‘পোলস বাবল বার্স্টস অর্থাৎ ভোটের বেলুন ফাটল। এতে নির্বাচনের কারচুপির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। খবরটির সঙ্গে একটি ছবিও লিড করা হয়। ছবিতে দেখা যায়, দুজন লোক সিল মারছে। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ÔTwo men stamp the pink ballot papers for the councillor post reserved for women at Khilgaon Model College polling centre at 1:33pm yesterday.
নিউ নেশন : ইংরেজি পত্রিকা নিউ নেশন শীর্ষ শিরোনাম করেছে- ’BNP Withdraws from CC polls race. Pulls out party-backed mayoral candidates from Dhaka, Chittagong: Vote rigging, capture of centres, beating of agents by ruling party men with the help of law enforcers, EC claimed. খবরে উঠে আসে ভোট জালিযাতির অভিযোগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে বিএনপির প্রার্থী প্রত্যাহারের নানাবিধ তথ্য।
ডেইলি সান : ÔBNP pulls out of city polls, Brings charges of widespread rigging’ শীর্ষ শিরোনামে খবর ছাপে ডেইলি সান পত্রিকা।
ইনডিপেন্ডেন্ট : ’It’s mockery with democracy: BNP’ শিরোনামে ভোটের অনিয়ম-দুর্নীতির লিড নিউজ ছাপে ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা।
ফিন্যান্সশিয়াল এক্সপ্রেস : ফিন্যান্সশিয়াল এক্সপ্রেস শিরোনাম করেছে, ’Voting in city polls ends amid rigging, violence, BNP boycotts race halfway through’ অর্থাৎ সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ, কারচুপি ও সহিংসতার মধ্যে শেষ।
ভোরের ডাক : ‘তিন সিটিতেই ভোট বর্জন’ শিরোনামে শীর্ষ খবরে দৈনিক ভোরের ডাক তুলেধরে, তিন সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি বাদে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেছে। দুপুরে জালভোট, কেন্দ্র দখল, আগের রাত থেকেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন।
কালেরকণ্ঠ : ‘বিএনপির নির্বাচন বর্জন’ কালেরকণ্ঠের শীর্ষ খবরে বলা হয়, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর পরই কেন্দ্রগুলোয় ভোটার উপস্থিতি কমে যেতে থাকে। তার আগে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
মানবকণ্ঠ : ‘অনিয়ম দখল সিল আর বর্জনে শেষ হলো ভোট’ শিরোনামে লাল রঙে পাঁচ কলামে মানবকণ্ঠ পত্রিকার শীর্ষ খবরে তুলেধরা হয়, ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করার পরে এটি ছিল প্রথম নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবে এ নির্বাচন নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও জালিয়াতি, কেন্দ্র দখলসহ নানা কারণে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে নগরবাসীসহ দেশবাসীর কাছে।
সকালের খবর : ‘নির্বিঘ্নে ভোট ছিনতাই’ শিরোনামে সকালের খবর পত্রিকার শীর্ষ খবরে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর উপশহর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা ১১টা ১২ মিনিটে মারমুখী ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে ভোটকেন্দ্রের তিনটি পৃথক বুথে প্রবেশ করল তিন যুবক। তাদের পেছনে লাঠিসোটা হাতে আরও অর্ধশতাধিক যুবক। রাজিব, মানিক ও সোয়েব নামের তিন যুবক বুথে ঢুকেই পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে অব্যবহৃত তিনটি ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল মুহূর্তেই। নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন শুধু নীরব দর্শক।
ঘটনার ১৫ মিনিট পরে খবর পেয়ে ওয়ার্ড আ’লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী কাশেম মোল্লা কেন্দ্রে হাজির হন তার বাহিনী নিয়ে। তার আগমনে দ্রুত কেন্দ্র থেকে সরে পড়ে ব্যালট ছিনতাইকারীরা। কাশেম মোল্লা প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাজী টিপু সুলতানের কর্মীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করলে ভোট বন্ধ রাখা হয় কিছু সময়ের জন্য। দিনের প্রথম ভাগে সাংবাদিকদের দেখা সব ভোটকেন্দ্রেই ছিল প্রায় একই রকম ঘটনা। শুরুতেই সরকার সমর্থকরা অন্য প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোর দখল নিয়ে জাল ভোট দেয়া শুরু করে। সময়ের সঙ্গে জাল ভোট দেয়ার এ চিত্র বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। পাশাপাশি চলে হামলাও। হামলা থেকে বাদ যাননি সাংবাদিকও। ভোট জালিয়াতির এমন মহোৎসবে সাক্ষী-গোপাল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা। কখনও কখনও বাধা না দিয়ে উল্টো অনৈতিক এ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে তাদেরও। নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনরত সকালের খবরের সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিদর্শনে ভোটের এমন চিত্র ধরা পড়েছে।
যায়যায়দিন : ‘অবাধ দখল ও বর্জনে সিটি নির্বাচন’ শীর্ষ শিরোনামে কালো রঙে সাত কলামে খবর ছাপে যায়যায়দিন পত্রিকা। এতে বলা হয়, সহিংসতা, অনিয়ম, অবাধে ভোট ডাকাতি এবং নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব।
আমাদের সময় : ‘৩ সিটি নির্বাচন : আনিসুল, খোকন ও নাছির এগিয়ে, দখলে বর্জনে প্রশ্নবিদ্ধ’ কালো-লাল রঙে শিরোনামে খবর ছাপে আমাদের সময় পত্রিকা। খবরে বলা হয়, দিনভর সংঘর্ষ ও অপ্রীতিকর ঘটনার অসংখ্য অভিযোগ এলেও ইসি মাঠে নামায়নি সেনাবাহিনীকে। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালটের বান্ডেল নিয়ে আ’লীগ সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারা হচ্ছে। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শেখ আরিফুল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করেন। দুপুরে ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩১ নম্বর কেন্দ্র ঢাকা কমার্স কলেজে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থী মোবাশ্বের হোসেনের কর্মী-সমর্থকরা জালভোট দিচ্ছেন। ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ড ২৫৬ নম্বর ভোটকেন্দ্র ঊষা শিক্ষানিকেতন কেন্দ্রও স্থানীয় আ’লীগ নেতাকর্মীরা দখলে নিয়ে জালভোট দেন। এ কেন্দ্রেই প্রিসাইডিং অফিসার ওবায়দুল ইসলামকেও জালভোট দিতে দেখা যায়। ঢাকা দক্ষিণের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৪২ নম্বর কেন্দ্রের সামনে থেকে সকালে ভোটারদের ফিরিয়ে দেয় পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।
আলোকিত বাংলাদেশ : ‘জাল ভোট অনিয়ম সংঘর্ষ’ শিরোনামে খবরে আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকা তুলে ধরে, ভোট জালিয়াতি, কারচুপিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এবং বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, হামলা, গুলী ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গোলযোগে রাজধানীর কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। হামলা ও গুলীর ঘটনায় প্রার্থী, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকসহ আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের কোনো এজেন্টকে দেখা যায়নি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী, এজেন্ট ও নেতাকর্মীদের নানা কৌশলে ভোট কেন্দ্রে যেতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দিনকাল : লাল রঙে আট কলামে দৈনিক দিনকালের ব্যানার শিরোনাম ছিলো ‘তিন সিটি নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি’। এতে বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক নির্বাচন ও ভোট ডাকাতির চিত্র তুলে ধরা হয়। বলা হয়, উত্তর ছিল আ’লীগের নিয়ন্ত্রণে : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল সরকারি দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। এ সময় কেন্দ্র পর্যবেক্ষণে ও ছবি তুলতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা বাধার মুখে পড়েন।
সোনার বাংলা : ‘ভোট জালিয়াতির নির্বাচন, সব দলের বর্জন, কলঙ্কিত আ’লীগ, হুমকিতে গণতন্ত্র’ শিরোনামে ১ মে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনকারী সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার শীর্ষ খবরে বলা হয়, যা ঘটবার তাই ঘটেছে। বিএনপি তথা ২০ দল সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী ইলেকশনের দিন দ্বিপ্রহর ১২টায় নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বয়কট করছেন কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। বিএনপির এই বর্জনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশে গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিকতার রাজনীতি ও আন্দোলনের পথ সাময়িকভাবে আবার রুদ্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ‘ভোট ডাকাতি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখন ছিল বেগম জিয়ার আমল। তখন কিন্তু কোনো ভোট ডাকাতি হয়নি। শেষ হাসিনা সেদিন আরেকটি শব্দও ব্যবহার করেছিলেন। সেটি হলো ‘ভাতের অধিকার’। সেদিন কিন্তু ভাতের অধিকার থেকেও কেউ বঞ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং বিশেষ করে এইবার ২৮ এপ্রিলের সিটি নির্বাচনে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে শেখ হাসিনা মানুষকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, ভোট ডাকাতি কত প্রকার এবং কী কী। সেদিন শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেমেছিলেন, যদিও সেদিন গণতন্ত্র হারিয়ে যায়নি যে তাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কিন্তু এবার গণতন্ত্র এমনভাবে হাইজ্যাক হয়েছে, সব শ্রেণীর দল এবং মতকে রাজনীতি করতে হলে সর্বাগ্রে সেই হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। সেই পুনরুদ্ধারের কাজটি করতে হবে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে। সেই কঠিন সংগ্রামের দায়িত্ব এসেছে ২০ দলীয় জোটের ঘাড়ে। প্রতিবেদনটির সঙ্গে একটি ছবিতে দেখা যায়, রাজধানীর খিলগাঁও মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রকাশ্যে সিল মারছেন যুবলীগের দুই নেতা। এছাড়া বিশ্বব্যাপী আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সিটি নির্বাচনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সব প্রতিবেদনেই বহুদিন পর বিএনপির নির্বাচনে ফিরে আসা এবং ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে ওই দিনই তা বর্জনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা এখন অনেকটাই নিশ্চিন্তেই বলতে পারি, সংবাদপত্রগুলোর প্রকাশিত ওইসব শিরোনাম, এগুলো আমাদের শুধু হতাশই করেনি; বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বুকে একটি ‘কালো তিলক’ এঁকে দিয়ে গেল। পত্রিকাগুলোর একযোগে ‘ভোট জালিয়াতি’ শীর্ষ খবরের পরেরও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার স্তবক এবং তারই আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কর্তা বাহাদুরদের মুখের বয়ান কম করে হলেও অন্ধের দেশে বধির শাসনেরই নামান্তর।
বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ভোট জালিয়াতি ও সমর্থক কর্তৃক ভোটকেন্দ্র খলের খবর প্রকাশ পায়। এতে প্রমাণ মিলে সরকার সমর্থকরা ব্যাপক ভোট জালিয়াতির ঘটনার নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করে। নির্বাচনের খবর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্র সরেজমিন করে গণমাধ্যম কর্মীরা। ভোটগ্রহণ চলা সময়ে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, হামলা, সাংবাদিককে মারধর, কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশ না করতে দেয়াসহ নানাবিধ খবরসহ উঠে আসে ‘অভিনব ভোট ডাকাতির’ নানাবিধ চিত্র।
নির্বাচনের পরদিন ২৯ এপ্রিল সিটি থেকে চিটিং নির্বাচন কায়েমের ওইসব অপ্রত্যাশিত খবর বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো পত্রিকাই ইতিবাচক শিরোনাম করতে পারেনি; বরং শিরোনামে ‘জালিয়াতি’, ‘কারচুপি’, ‘বর্জন’, ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ কিংবা ‘কেন্দ্র দখলের কথাগুলো উঠে এসেছে। কথা হচ্ছে, পত্রিকাগুলো বিভিন্ন শিরোনামে খবর প্রকাশ করলেও সবক’টি শীর্ষ শিরোনামের প্রতিপাদ্যের বিষয় ছিল ‘ভোট জালিয়াতি’। তবে ভোট নিয়ে শীর্ষ খবর প্রকাশে শুধু ব্যতিক্রম ছিলো জনকণ্ঠ ও ইত্তেফাক পত্রিকা।
পাঠকদের উদ্দেশে শীর্ষ পত্রিকাগুলোর প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনের যৎসামন্য তুলে ধরা হলো-
সংবাদ : ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন, অভিযোগ ও বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে ভোট সম্পন্ন, অনিয়ম দখল কারচুপি জাল ভোট : বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের অভিযোগ’ শিরোনামে শীর্ষ খবর ছাপে মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সাক্ষী দেশের সবচেয়ে বয়বৃদ্ধ পত্রিকা দৈনিক সংবাদ। এতে বলা হয়, কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা, জাল ভোটসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এবং বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
প্রথম আলো : প্রথমে তারা বিএনপির প্রার্থীদের তাড়ালেন, তারপর তাড়ালেন সাংবাদিকদের, তারপর তাড়ালেন ভোটাদের তারপর আর তাড়ানোর কিছু ছিলো না। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ততক্ষণে নিজেরাই পলাতক। এভাবে ভোটের বিস্তর বয়ান উঠে এসেছে দেশের বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলোতে। ‘জিতল আ’লীগ, হারল গণতন্ত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনটির সঙ্গে বেলা দেড়টায় সাংবাদিক আবদুস সালামের তুলা একটি ছবিতে দেখা যায়, ‘মির্জা আব্বাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথে ভোটারের অপেক্ষা করছেন দুই নির্বাচনী কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতিনিধি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে যে শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই সত্যি হলো। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হলেও গণতন্ত্রের পরাজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকরা বিরোধীদের বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তারা। আর বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
মানবজমিন : ‘ডিজিটাল জামানায় এনালগ কারচুপি’ শীর্ষ শিরোনামে বহুল প্রচারিত দেশের একমাত্র ট্যাবলয়েট দৈনিক মানবজমিন লিখেছে, এক নয়া মডেলের নির্বাচন। উৎসব তো বটেই। দখলের উৎসব। একেবারেই খোলামেলা। কোনো রাখডাক নেই। সকাল সকাল প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই ‘হাওয়া’ বিএনপি সমর্থক এজেন্টরা। কেউ ঢুকতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। তবে থাকতে পারেননি কেউই। হুমকি, মারধর, হামলা আর গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন তারা। কাউকে কাউকে আটকে রাখা হয় আগেই। রক্তাক্ত এজেন্ট যেন একটি নির্বাচনেরই প্রতিচ্ছবি। আভাস পাওয়া গিয়েছিল আগের রাতেই। খবর আসছিলো, ব্যালট পেপারে সিল মারার। যদিও তার সংখ্যা ছিল কম। তবে দিনের শুরুতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।
যুগান্তর : ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব, সকালেই অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র দখল’ শিরোনামে সাত কলামে লিড খবর প্রকাশ করে বহুল প্রচারিত পাঠক নন্দিত দৈনিক যুগান্তর। এতে বলা হয়, সকালেই অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল, অংশ নেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তারাও, কেন্দ্রে কন্দ্রে সরকারদলীয় প্রতিদ্বন্দী কাউন্সিলর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ-গুলী। দল সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে দিনের প্রথম ভাগেই তিন সিটির অধিকাংশ ভোট কন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই তারা ছিনিয়ে নেয় ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স। অস্ত্রের মহড়ার পাশাপাশি জোর করে বের করে দেয় বিএনপিসহ প্রতিদ্বন্দ¦ী মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের। চলে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিলমারাসহ জাল ভোটের মহোৎসব ও নজিরবিহীন কারচুপি।
সমকাল : ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’ শিরোনামে সমকালে শীর্ষ খবর বলা হয়, শেষ পর্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই সম্পন্ন হলো তিন সিটি করপোরেশনের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন। ভোটকেন্দ্র দখল, কারচুপি, জাল ভোট, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, হামলাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোট শুরুর সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর নির্বাচনকে ‘ভোট ডাকাতি’ ও ‘প্রহসনের নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপির পাশাপাশি বিভিন্ন দলসমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাও। প্রতিবাদে ফের হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি।
নয়াদিগন্ত : ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব : বিএনপির বর্জন’ শীর্ষ শিরোনামে আট কলামজুড়ে লাল রঙে ব্যানার খবর ছাপে পাঠক নন্দিত নয়াদিগন্ত পত্রিকা। এতে তুলেধরা হয়, কেন্দ্র দখল আর নজিরবিহীন কারচুপির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো সিটি নির্বাচন। রাজধানীতে সকাল ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের দখল নেয় সরকারদলীয় লোকজন। বেশিরভাগ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের।
ইনকিলাব : ‘নজিরবিহীন ‘অভিনব’ ভোট’ শিরোনামে আট কলামে লাল রঙের ব্যানার খবর প্রকাশ করে সাহসী পত্রিকা ইনকিলাব। এতে বলা হয়, অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হলো তিন সিটি নির্বাচন। আলোচিত এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ নাটক-সিনেমার গল্প ও আলাদিনের দৈত্যকেও হার মানিয়েছে। সকাল ৯টার মধ্যেই ফল নিশ্চিত হওয়ায় ভোটের ইতিহাসে যোগ হলো নতুন অধ্যায়। অর্ধশত প্রার্থী প্রচারণায় নামতে না পারার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। আর নির্বাচনও হলো নজিরবিহীন। আগের রাত থেকেই ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায় ব্যালট পেপারে সিলমারার খবর।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ‘সবকিছু ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে’ শীর্ষ শিরোনামে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা তুলে ধরেছে, তিন সিটি নির্বাচনের মাঠ থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবকিছুতেই ছিল আ’লীগের উপস্থিতি। কেন্দ্রের আশপাশে প্রার্থীদের পক্ষে নীরব প্রচারণা, সাধারণ ভোটারদের সহায়তা ও কেন্দ্রের এজেন্ট সব ক্ষেত্রেই এটা চোখে পড়েছে। ক্ষমতাসীন আ’লীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মহানগরীর সাধারণ কর্মী সবাই ছিলেন সরব। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর এবং মেয়রÑ তিন পদেই ছিল আ’লীগ প্রার্থীদের সমর্থকদেরই প্রাধান্য।
সংগ্রাম : নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে নাতিদীর্ঘ শিরোনামে শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগ্রাম পত্রিকা। ৭৮ শব্দের ওই শিরোনামটি ছিল ‘নজিরবিহীন অনিয়ম জালিয়াতির নির্বাচন ॥ মহানগরীর অধিকাংশ কেন্দ্রে সাঈদ খোকন ও আনিসুল হকের এজেন্ট ব্যতীত আর কোনো এজেন্ট ছিল না ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ব্যালটে সিল দেয়া হয়েছে ॥ অনেক পুলিশরাই পলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দেয়ার সুযোগ দিয়েছে ॥ ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই অনেক কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে সাংবাদিকরা গুলীবিদ্ধ ও হামলার শিকার হয়েছেন ॥ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার মহিলা এজেন্টরাও গ্রেফতার থেকে রেহাই পায়নি’। প্রতিবেদনটির সঙ্গে তিনটি ছবিও লিড করা হয়। সকাল ৮টা ৩৭ মিনিটে তোলা প্রথম ছবিতে দেখা যায়, নির্বাচন চলাকালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে একই সাথে জাল ভোট দিচ্ছেন তিনজন। বেলা সোয়া ১২টায় তোলা দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায়, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেয়ার পর ব্যালট পেপার ছড়িয়ে ছিড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। ওইসব ব্যালটে ইলিশ মাছ মার্কায় ছাপ মারা ছিল। একটু দূরেই দেখা যায় ব্যালট ভর্তি বাক্স। বেলা সাড়ে ১১টায় তুলা তৃতীয় ছবিতে দেখা যায়, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল কেন্দ্রের ৮টি বুথেই ব্যালট নেই। ভোটাররা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য। একই অবস্থা রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুল কেন্দ্রে।
বণিক বার্তা : ‘বর্জন ও দখলে ম্লান সিটি নির্বাচন’ শিরোনামে দৈনিক বণিক বার্তার শীর্ষ খবরে বলা হয়, ভোটগ্রহণ শুরুর পর পরই কেন্দ্র দখলের অভিযোগ। খবর আসে জাল ভোট প্রদানেরও। তিন সিটিতেই ভোটদানে বাধা দেয়া ও ব্যাপক হারে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটে। দুপুর না গড়াতেই অনেক কেন্দ্র খল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটে।
জনতা : ‘সহিংসতা কারচুপি ও বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ভোটগ্রহণ, ৩ সিটিতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব সহযোগিতায়, কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল আগুন’ শীর্ষ শিরোনামে পাঁচ কলামে লাল-কালো কালিতে খবর ছাপে জনতা পত্রিকা। খবরে বলা হয়, কেন্দ্র দখল, ব্যালটে আগুন, হামলা, অস্ত্রের প্রদর্শন, ককটেল বিস্ফোরণ, কারচুপি, সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলীসহ বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ভোটগ্রহণ। এসময় অসহায়ের মতো নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। এদিকে ভোট কেন্দ্র প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরের চলে যাওয়া তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
ডেইলি স্টার : ÔPolls bubbles burst, BNP's early pullout makes AL win insignificant; irregularities widespread; AL rivals for councillor posts cause violence’ শিরোনামে লিড নিউজ প্রকাশ করে দেশের শীর্ষ ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার। ‘পোলস বাবল বার্স্টস অর্থাৎ ভোটের বেলুন ফাটল। এতে নির্বাচনের কারচুপির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। খবরটির সঙ্গে একটি ছবিও লিড করা হয়। ছবিতে দেখা যায়, দুজন লোক সিল মারছে। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ÔTwo men stamp the pink ballot papers for the councillor post reserved for women at Khilgaon Model College polling centre at 1:33pm yesterday.
নিউ নেশন : ইংরেজি পত্রিকা নিউ নেশন শীর্ষ শিরোনাম করেছে- ’BNP Withdraws from CC polls race. Pulls out party-backed mayoral candidates from Dhaka, Chittagong: Vote rigging, capture of centres, beating of agents by ruling party men with the help of law enforcers, EC claimed. খবরে উঠে আসে ভোট জালিযাতির অভিযোগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে বিএনপির প্রার্থী প্রত্যাহারের নানাবিধ তথ্য।
ডেইলি সান : ÔBNP pulls out of city polls, Brings charges of widespread rigging’ শীর্ষ শিরোনামে খবর ছাপে ডেইলি সান পত্রিকা।
ইনডিপেন্ডেন্ট : ’It’s mockery with democracy: BNP’ শিরোনামে ভোটের অনিয়ম-দুর্নীতির লিড নিউজ ছাপে ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা।
ফিন্যান্সশিয়াল এক্সপ্রেস : ফিন্যান্সশিয়াল এক্সপ্রেস শিরোনাম করেছে, ’Voting in city polls ends amid rigging, violence, BNP boycotts race halfway through’ অর্থাৎ সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ, কারচুপি ও সহিংসতার মধ্যে শেষ।
ভোরের ডাক : ‘তিন সিটিতেই ভোট বর্জন’ শিরোনামে শীর্ষ খবরে দৈনিক ভোরের ডাক তুলেধরে, তিন সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি বাদে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেছে। দুপুরে জালভোট, কেন্দ্র দখল, আগের রাত থেকেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন।
কালেরকণ্ঠ : ‘বিএনপির নির্বাচন বর্জন’ কালেরকণ্ঠের শীর্ষ খবরে বলা হয়, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর পরই কেন্দ্রগুলোয় ভোটার উপস্থিতি কমে যেতে থাকে। তার আগে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
মানবকণ্ঠ : ‘অনিয়ম দখল সিল আর বর্জনে শেষ হলো ভোট’ শিরোনামে লাল রঙে পাঁচ কলামে মানবকণ্ঠ পত্রিকার শীর্ষ খবরে তুলেধরা হয়, ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করার পরে এটি ছিল প্রথম নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবে এ নির্বাচন নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও জালিয়াতি, কেন্দ্র দখলসহ নানা কারণে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে নগরবাসীসহ দেশবাসীর কাছে।
সকালের খবর : ‘নির্বিঘ্নে ভোট ছিনতাই’ শিরোনামে সকালের খবর পত্রিকার শীর্ষ খবরে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর উপশহর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা ১১টা ১২ মিনিটে মারমুখী ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে ভোটকেন্দ্রের তিনটি পৃথক বুথে প্রবেশ করল তিন যুবক। তাদের পেছনে লাঠিসোটা হাতে আরও অর্ধশতাধিক যুবক। রাজিব, মানিক ও সোয়েব নামের তিন যুবক বুথে ঢুকেই পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে অব্যবহৃত তিনটি ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল মুহূর্তেই। নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন শুধু নীরব দর্শক।
ঘটনার ১৫ মিনিট পরে খবর পেয়ে ওয়ার্ড আ’লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী কাশেম মোল্লা কেন্দ্রে হাজির হন তার বাহিনী নিয়ে। তার আগমনে দ্রুত কেন্দ্র থেকে সরে পড়ে ব্যালট ছিনতাইকারীরা। কাশেম মোল্লা প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাজী টিপু সুলতানের কর্মীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করলে ভোট বন্ধ রাখা হয় কিছু সময়ের জন্য। দিনের প্রথম ভাগে সাংবাদিকদের দেখা সব ভোটকেন্দ্রেই ছিল প্রায় একই রকম ঘটনা। শুরুতেই সরকার সমর্থকরা অন্য প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোর দখল নিয়ে জাল ভোট দেয়া শুরু করে। সময়ের সঙ্গে জাল ভোট দেয়ার এ চিত্র বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। পাশাপাশি চলে হামলাও। হামলা থেকে বাদ যাননি সাংবাদিকও। ভোট জালিয়াতির এমন মহোৎসবে সাক্ষী-গোপাল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা। কখনও কখনও বাধা না দিয়ে উল্টো অনৈতিক এ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে তাদেরও। নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনরত সকালের খবরের সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিদর্শনে ভোটের এমন চিত্র ধরা পড়েছে।
যায়যায়দিন : ‘অবাধ দখল ও বর্জনে সিটি নির্বাচন’ শীর্ষ শিরোনামে কালো রঙে সাত কলামে খবর ছাপে যায়যায়দিন পত্রিকা। এতে বলা হয়, সহিংসতা, অনিয়ম, অবাধে ভোট ডাকাতি এবং নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব।
আমাদের সময় : ‘৩ সিটি নির্বাচন : আনিসুল, খোকন ও নাছির এগিয়ে, দখলে বর্জনে প্রশ্নবিদ্ধ’ কালো-লাল রঙে শিরোনামে খবর ছাপে আমাদের সময় পত্রিকা। খবরে বলা হয়, দিনভর সংঘর্ষ ও অপ্রীতিকর ঘটনার অসংখ্য অভিযোগ এলেও ইসি মাঠে নামায়নি সেনাবাহিনীকে। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালটের বান্ডেল নিয়ে আ’লীগ সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারা হচ্ছে। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শেখ আরিফুল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করেন। দুপুরে ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩১ নম্বর কেন্দ্র ঢাকা কমার্স কলেজে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থী মোবাশ্বের হোসেনের কর্মী-সমর্থকরা জালভোট দিচ্ছেন। ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ড ২৫৬ নম্বর ভোটকেন্দ্র ঊষা শিক্ষানিকেতন কেন্দ্রও স্থানীয় আ’লীগ নেতাকর্মীরা দখলে নিয়ে জালভোট দেন। এ কেন্দ্রেই প্রিসাইডিং অফিসার ওবায়দুল ইসলামকেও জালভোট দিতে দেখা যায়। ঢাকা দক্ষিণের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৪২ নম্বর কেন্দ্রের সামনে থেকে সকালে ভোটারদের ফিরিয়ে দেয় পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।
আলোকিত বাংলাদেশ : ‘জাল ভোট অনিয়ম সংঘর্ষ’ শিরোনামে খবরে আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকা তুলে ধরে, ভোট জালিয়াতি, কারচুপিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এবং বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, হামলা, গুলী ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গোলযোগে রাজধানীর কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। হামলা ও গুলীর ঘটনায় প্রার্থী, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকসহ আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের কোনো এজেন্টকে দেখা যায়নি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী, এজেন্ট ও নেতাকর্মীদের নানা কৌশলে ভোট কেন্দ্রে যেতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দিনকাল : লাল রঙে আট কলামে দৈনিক দিনকালের ব্যানার শিরোনাম ছিলো ‘তিন সিটি নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি’। এতে বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক নির্বাচন ও ভোট ডাকাতির চিত্র তুলে ধরা হয়। বলা হয়, উত্তর ছিল আ’লীগের নিয়ন্ত্রণে : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল সরকারি দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। এ সময় কেন্দ্র পর্যবেক্ষণে ও ছবি তুলতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা বাধার মুখে পড়েন।
সোনার বাংলা : ‘ভোট জালিয়াতির নির্বাচন, সব দলের বর্জন, কলঙ্কিত আ’লীগ, হুমকিতে গণতন্ত্র’ শিরোনামে ১ মে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনকারী সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার শীর্ষ খবরে বলা হয়, যা ঘটবার তাই ঘটেছে। বিএনপি তথা ২০ দল সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী ইলেকশনের দিন দ্বিপ্রহর ১২টায় নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বয়কট করছেন কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। বিএনপির এই বর্জনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশে গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিকতার রাজনীতি ও আন্দোলনের পথ সাময়িকভাবে আবার রুদ্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ‘ভোট ডাকাতি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখন ছিল বেগম জিয়ার আমল। তখন কিন্তু কোনো ভোট ডাকাতি হয়নি। শেষ হাসিনা সেদিন আরেকটি শব্দও ব্যবহার করেছিলেন। সেটি হলো ‘ভাতের অধিকার’। সেদিন কিন্তু ভাতের অধিকার থেকেও কেউ বঞ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং বিশেষ করে এইবার ২৮ এপ্রিলের সিটি নির্বাচনে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে শেখ হাসিনা মানুষকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, ভোট ডাকাতি কত প্রকার এবং কী কী। সেদিন শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেমেছিলেন, যদিও সেদিন গণতন্ত্র হারিয়ে যায়নি যে তাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কিন্তু এবার গণতন্ত্র এমনভাবে হাইজ্যাক হয়েছে, সব শ্রেণীর দল এবং মতকে রাজনীতি করতে হলে সর্বাগ্রে সেই হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। সেই পুনরুদ্ধারের কাজটি করতে হবে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে। সেই কঠিন সংগ্রামের দায়িত্ব এসেছে ২০ দলীয় জোটের ঘাড়ে। প্রতিবেদনটির সঙ্গে একটি ছবিতে দেখা যায়, রাজধানীর খিলগাঁও মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রকাশ্যে সিল মারছেন যুবলীগের দুই নেতা। এছাড়া বিশ্বব্যাপী আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সিটি নির্বাচনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সব প্রতিবেদনেই বহুদিন পর বিএনপির নির্বাচনে ফিরে আসা এবং ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে ওই দিনই তা বর্জনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা এখন অনেকটাই নিশ্চিন্তেই বলতে পারি, সংবাদপত্রগুলোর প্রকাশিত ওইসব শিরোনাম, এগুলো আমাদের শুধু হতাশই করেনি; বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বুকে একটি ‘কালো তিলক’ এঁকে দিয়ে গেল। পত্রিকাগুলোর একযোগে ‘ভোট জালিয়াতি’ শীর্ষ খবরের পরেরও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার স্তবক এবং তারই আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কর্তা বাহাদুরদের মুখের বয়ান কম করে হলেও অন্ধের দেশে বধির শাসনেরই নামান্তর।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন