শুক্রবার, ১৫ মে, ২০১৫

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ভারতের পানি কূটনীতি


ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভা ও রাজ্যসভায় ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন পাওয়ার পর গায়ের জোরের সঙ্গে গলার জোরও অনেক বেড়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। মাঝখানে যে দু’-চার কিংবা পাঁচ-দশ বছর নয়, বরং ভারতের চাতুরিপূর্ণ কৌশলের কারণে দীর্ঘ ৪১টি বছর পার হয়ে গেছে এবং এখনো যে চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে ভারত যথারীতি বাধার পাহাড় হয়েই রয়েছে- এসব বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই ক্ষমতাসীনদের। এ ব্যাপারেও যথেষ্টই শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি একাধিক উপলক্ষে তিনি বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানির প্রাপ্য হিস্যা আদায় করতে হবে আলোচনার ভিত্তিতে, ঝগড়া-বিবাদ করে নয়। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোরও বিরোধিতা করেছেন। কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, অতীতের ‘অনেক’ সরকারই নাকি অমন চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বরং ভারতের সঙ্গে তিক্ততা বেড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের কেউ কেউ নাকি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও গোপনে গিয়ে ভারতীয়দের পা ধরে থাকে!
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,  প্রধানমন্ত্রী শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষকে শুকিয়ে মারলেও এবং দেশকে মরুভূমি বানিয়ে ফেললেও তার সরকার কখনো ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। কথাটার সত্যতা সম্পর্কে অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই জানা গেছে। সরকার কখনো কোনো প্রতিবাদ জানায়নি, পানির হিস্যার জন্য দাবিও তোলেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্নসাপেক্ষ ও রহস্যময় বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা নিয়ে ভারতীয়দের পিছিয়ে পড়ার ঘটনায়ও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে বেশি দরকার আসলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যাসত্য যাচাই করা। আসলেও কি আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন ফোরামে নালিশ জানিয়ে ন্যায়বিচার বা কোনো সুফল পাওয়া যায় না? বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করে না। কারণ, পৃথিবীর অনেক দেশই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে অধিকার ও ন্যায্য পাওনা আদায় করেছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মামলা করে স্পেন তার হিস্যাই শুধু আদায় করেনি, ফ্রান্সের একটি বাঁধকেও অকার্যকর করিয়ে ছেড়েছে। পাকিস্তানের উদাহরণও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত তার অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে বাগলিহার বাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তানকে চেনাব নদীর পানির হিস্যা থেকে কোনো এক চক্রে ৫৫ হাজার কিউসেক কম পানি দিয়েছিল। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। ভারত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করায় পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছিল। তখনই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী চেনাব নদী থেকে দুই লাখ একর ফুট পানি দেয়া হবে। এটা ২০০৮ সালের অক্টোবর-নবেম্বরের ঘটনা। এই অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, স্পেন ও পাকিস্তানের মতো কঠোর অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশও সহজেই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে সব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারে। গজলডোবা ও ফারাক্কার মতো কোনো কোনো বাঁধকে অকার্যকরও করাতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশকে পানিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা অপরাধ। অন্যদিকে ভারত বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে পানি-প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রও বানাতে চাচ্ছে।
শুধু স্পেন ও পাকিস্তানের উদাহরণই বা দেয়া কেন, বাংলাদেশ নিজেও তো উদাহরণ তৈরি করে রেখেছে। এ ব্যাপারে দুর্দান্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে তিনি ফারাক্কা বাঁধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার দাবি তুলেছিলেন। মূলত জিয়াউর রহমানের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি সর্বসম্মত বিবৃতি দিয়েছিল (২৪ নবেম্বর, ১৯৭৬)। সে বিবৃতির চাপেই ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের ধারাবাহিক বৈঠক শেষে ১৯৭৭ সালের ৫ নবেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’। বাংলাদেশের অনুকূলে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল চুক্তিটির উলে¬খযোগ্য বিষয়। ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ থাকায় ভারত কখনো যথেচ্ছভাবে পানি প্রত্যাহার করতে কিংবা বাংলাদেশকে কম হিস্যা দিতে পারেনি। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আগত আরেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকার ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পর, ১৯৯৭ সালের মার্চেই ভারত চুক্তি লংঘন করে এবং সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ড স্থাপিত হয়। ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক। সে সময় যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো কারো হাত নেই!’ অন্যদিকে অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, ভারত ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি আগেই উজানে উঠিয়ে নিয়েছে। অথচ পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯৫ সালের ২৭ মার্চও বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৬ হাজার ৮৮১ কিউসেক পানি। ১৯৭৭ সালের চুক্তির ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল এর কারণ, যার পেছনে ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাহসী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকা।
সব কৃতিত্ব তাই বলে জিয়াউর রহমানের একার ছিল না। তাকে উৎসাহ ও সাহস যুগিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও অধিকার প্রাতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইন্তিকালের মাত্র ছয় মাস আগে, ১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি ফারাক্কা মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। নেতৃত্বও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। কৃষক-শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লাখ লাখ নারী-পুরুষ ঐতিহাসিক সে মহামিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে মওলানা ভাসানীর দেয়া ১০ মিনিটের এক ভাষণের মধ্য দিয়ে মিছিলের শুরু হয়েছিল। রাজশাহী, প্রেমতলী, নবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ হয়ে কানসাটে গিয়ে ১৭ মে মিছিলের সমাপ্তি টেনেছিলেন মওলানা ভাসানী। পায়ে হেঁটে দু’দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন মিছিলকারীরা। কানসাট হাই স্কুল ময়দানে ফারাক্কা মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণার সময় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমাদের আন্দোলনের এখানেই শেষ নয়।’ ফারাক্কা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহবান জানিয়ে মওলানা ভাসানী আরো বলেছিলেন, ‘ভারত সরকারের জানা উচিত, বাংলাদেশীরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।... ’ বলা দরকার, ফারাক্কা মিছিল কোনো আকস্মিক ঘটনা বা মওলানা ভাসানীর দিক থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেয়াকে পুঁজি বানিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রাথমিক দিনগুলোতেই ভারতের আধিপত্যবাদী সরকার ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশকে অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা ও সহযোগিতার সুযোগে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও অন্যান্য সম্পদ পাচার হয়েছে ভারতে। সমগ্র দেশ ছেয়ে গেছে ভারতীয় পণ্যে, চোরাচালান হয়েছে সর্বব্যাপী। গোপন ও প্রকাশ্য বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমেও বাংলাদেশকে রাতারাতি ভারতের ইচ্ছার অধীনস্থ করা হয়েছিল। এই কার্যক্রমকে আরো এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো আদায় করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। একই সঙ্গে ভারত পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি। এই সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য মরণ বাঁধ হিসেবে চিহ্নিত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে ভারত নিয়েছিল চাতুরিপূর্ণ কৌশল। মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মওসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সেজন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। যুক্ত ইশতেহারের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কথা ছিল, ৪১ দিনের নির্ধারিত সময়ে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেল দিয়ে হুগলী নদীতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ৪১ দিনের সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মওসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি নিয়ে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানি প্রবাহ যেখানে ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক সেখানে ১৯৭৬ সালে এর পরিমাণ নেমে এসেছিল মাত্র ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। এর প্রধান কারণ ছিল ফিডার ক্যানেল দিয়ে পূর্ণ ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতের পানি প্রত্যাহার করে নেয়া। 
ভারতের এই একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সর্বনাশ সূচিত হয়েছিল। দেশ ও জাতির সেই দুঃসময়ে অভয় ও আশ্বাসের বাণী মুখে আরো একবার এগিয়ে এসেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ভারত বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি প্রথম থেকেই ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করে এসেছেন। দাবি জনিয়েছেন বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার জন্য। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধেও তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ভারতকে বেরুবাড়ি না দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরদিন, ১৯৭৪ সালের ১৭ মে এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনে ফারাক্কা বাঁধের পানি বণ্টনের মীমাংসা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য হায়াত ও মউতের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ইহার কোনো মীমাংসা করা হয়নি।’
ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দেয়া সম্মতির আড়াল নেয়ায় ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট সংকট এবং অন্যদিকে সীমান্তে সশস্ত্র আক্রমণ ও সামরিক তৎপরতার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছিল। এ কথা প্রচারিত হতে থাকে যে, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ভারত সরকার সুনজরে দেখেনি। উল্লেলখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত অভ্যুত্থানে বাকশাল সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর থেকে সীমান্তে সশস্ত্র হামলা শুরু হয়েছিল। তদন্তে দেখা গেছে, হামলা আসলে ভারতের সেনাবাহিনী এবং বিএসএফ চালাচ্ছিল। ভারতের এই যুদ্ধবাদী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ব্যাপকভাবে সীমান্ত এলাকা সফর করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে নিজের চোখে সীমান্ত পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার জন্য তার প্রতি আহবান জানান। ১৯৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক ‘খোলা চিঠি’তে ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের কন্যা হিসেবে সম্বোধন করে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম মহাপুরুষ মহাত্মা গান্ধীকে আপনার দেশের বিশ্বাসঘাতক নথুরাম গডসে হত্যা করিয়া যে মহাপাপ করিয়াছে তাহার চেয়েও জঘন্য পাপ আপনার দেশের দস্যুরা করিতেছে।’ সীমান্তের গোলযোগ ও জনগণের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে মওলানা ভাসানী তার ‘খোলা চিঠি’তে লেখেন, ‘আমার আন্তরিক আশা, আপনি স্বচক্ষে দেখিলেই ইহার আশু প্রতিকার হইবে এবং বাংলাদেশ ও হিন্দুস্থানের মধ্যে ঝগড়া-কলহের নিষ্পত্তি হইয়া পুনরায় বন্ধুত্ব কায়েম হইবে। ফারাক্কা বাঁধের দরুন উত্তরবঙ্গের উর্বর ভূমি কিভাবে শ্মশানে পরিণত হইতেছে তাহাও স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন।’
উদাত্ত আহবান জানানো সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ার পরই মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। আরো একবার ফারাক্কা কবলিত উত্তর বঙ্গ সফর শেষে ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সমাবেশে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘গঙ্গা আন্তর্জাতিক নদী। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী ভারত এককভাবে এই নদীর পানি ব্যবহার করতে পারে না।’ প্রতিবাদী কর্মসূচি হিসেবে ফারাক্কা মিছিলের জন্য ১৬ মে-কে বেছে নেয়ার পেছনেও মওলানা ভাসানীর স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। কারণ ১৯৭৪ সালের ওই দিনটিতেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ন্যায্য অধিকারের ওপর হামলা চালালে বাংলাদেশের আট কোটি মানুষ তা জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে।’
ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এই চিঠিতেও তিনি ফারাক্কা সমস্যার সমাধান এবং বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের ৪ মে। মওলানা ভাসানীর চিঠিতে তিনি ‘ব্যথিত ও বিস্মিত’ হয়েছেন জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এ কথা কল্পনাও করা যায় না যে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে দুঃখ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে শরিক হয়েছেন, সেই তিনি এখন কিভাবে এতটা মারাত্মকরূপে আমাদের ভুল বুঝেছেন, এমনকি প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে।’ ১৫৬ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পক্ষে ‘পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়’ জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী এর পর লিখেছেন, ‘আমার মনে হয়, বাংলাদেশের ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনাকে অত্যন্ত অতিরঞ্জিত এবং শুধু একটি দিকের তথ্য জানানো হয়েছে। আপনি যদি চান তাহলে আমাদের হাই কমিশনার নিজে গিয়ে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির অন্য পিঠ সম্পর্কে অবহিত করবেন।’ চিঠির শেষাংশে ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘কারো এ কথা মনে করা উচিত নয় যে, ভারত কোনো হুমকি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’
‘শ্রদ্ধাসহ আপনার একান্ত ইন্দিরা গান্ধী’ লিখে শেষ করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে মওলানা ভাসানীর অনুরোধ উপেক্ষিত হয়েছিল। তাছাড়া বিশেষ করে শেষের বাক্যে ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি। জবাবে ইন্দিরা গান্ধীকে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘আপনার ৪ মে, ১৯৭৬-এর চিঠিটি নতুন কিছু নয়, বরং ফারাক্কা প্রসঙ্গে ভারত সরকারের সরকারী ভাষ্যের পুনরাবৃত্তি মাত্র- যা আমি খ্যাতনামা পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহরুর নাতনী এবং প-িত জওয়াহেরলাল নেহরুর কন্যা হিসেবে আপনার কাছ থেকে আশা করিনি।’ ফারাক্কার কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিজের চোখে দেখে যাওয়ার জন্য আরো একবার আহ্বান জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আমি আপনার মনোভাবের প্রশংসা করি। কিন্তু সে সমাধান হতে হবে স্থায়ী এবং ব্যাপকভিত্তিক। এই সমাধান শুধু শুষ্ক মওসুমের জন্য হলে চলবে না, সারা বছর ধরে পানির প্রবাহ একই পরিমাণ হতে হবে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া না পাওয়ায় মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি পরিবর্তন করেননি। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ এবং ভারতপন্থী কয়েকটি দল ছাড়া সকল দল এবং সমগ্র জাতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ‘চলো চলো- ফারাক্কা চলো’ স্লোগান মুখে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ গিয়েছিল রাজশাহী- ফারাক্কা মিছিলের সূচনাস্থলে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ বিশাল মিছিল গিয়েছিল ফারাক্কা অভিমুখে। পরদিন ১৭ মে মিছিল শেষ হয়েছিল কানসাটে গিয়ে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। এই মিছিলের আতংকে ভারত সরকার রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে তখন তার অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।’
এ কথা সত্য যে, ভারতের সম্প্রসারণবাদী ও অবন্ধুসুলভ মনোভাবের কারণে মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল সমস্যার স্থায়ী সমাধান অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, মূলত এই মিছিলের জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ভারতকে বহুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও ফারাক্কা মিছিলের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের দাবি ও অধিকার আদায় করার পথ দেখিয়ে গেছেন। সে পথ ধরেই পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে ফারাক্কার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। এর সুফলও পেয়েছিল বাংলাদেশ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একথার সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই যে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া অন্য একটি বিষয়ও প্রধানমন্ত্রীর পরিষ্কার করা উচিত- কারা গোপনে গিয়ে ভারতীয়দের পা ধরে থাকে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads